ভ্রমণ কাহিনী-২
ঘুরে আসুন ভারতের হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং
কাজী রিপন :
জীবন একটাই। কখন চলে যাবে কেউ জানে না। এই ছোট্ট জীবনে একটু সময় করে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী এই সুন্দর জগতটা একটু ঘুরে দেখুন। জীবনটাকে উপভোগ করুন। আর তাই আমার সকল বন্ধুদের জন্য কম খরচে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করার বিষয়ে তথ্য জানার জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াশ : এ পর্যায়ে ভারতের হিমালয় কণ্যা দাজিলিং এর কথা। যেখানে সড়ক পথে মেঘের উপর দিয়ে আপনি যাবেন। মেঘ এসে আপনাকে ঘিরে ধরবে। কখনও হিমালয়ের ঠান্ডা হাওয়া, আবার কখনও ছায়া, কখনও রাতের মতো অন্ধকার, আবার কখনও ভয়, তারপরেই পাকা কমলালেবুর গ্রাণ, প্রতিটি মুহুতেই আপনি রোমান্স অনুভব করবেন। আর দার্জিলিং ঘুরে আসতে, আপনার কক্সবাজার ঘুরতে যে রকম খরচ হয়, সেইরকম খরচই হবে।
২৯ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং গিয়েছিলাম। আমাদের পথ ছিল লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানার বুড়িমারি স্থল বন্দর হয়ে ভারতের কুচবিহার জেলার চেংরাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে শিলিগুড়ি। তারপর শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং। কারণ এই রোডে দার্জিলিং যেতে সবচেয়ে কম সময় লাগে এবং সবচেয়ে কম খরচ লাগে। আমরা শ্যামলী পরিবহনের সরাসরি ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাসের টিকিট নিয়েছিলাম। যেহেতু, আমরা টাঙ্গাইল জেলার লোক। তাই আমাদের জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল যে, শ্যামলী পরিবহনের গাড়িটি রাত ৮ টায় ঢাকার আরামবাগ থেকে ছাড়ে। আর এই গাড়ি টাঙ্গাইল হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে উত্তরবঙ্গ হয়ে চলে যায় বুড়িমারি। এরপর সীমান্তের ওপারে চেংরাবান্ধায় তাদের আরেকটি গাড়ি থাকে।
সেটাতে শিলিগুড়ি নিয়ে যায়। যাহোক, আমরা আর কষ্ট করে ঢাকা যাইনি। রাতে নিজের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে পরে বিশ্রাম নিয়ে টাঙ্গাইল শহর বাইপাসের রাবনা থেকে রাত ১১ টার দিকে আমাদের গাড়িতে উঠি। আর যারা ঢাকা থেকে যেতে চান, তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসটার্মিনাল থেকে বিভিন্ন পরিবহনের গাড়িতেও বুড়িমারি আসতে পারেন। তবে যারা প্রথমবার ঐ রোডে দার্জিলিং যাবেন। তাদের জন্য সরাসরি ঢাকা টু শিলিগুড়ির বাসে যাওয়াই ভালো। কারণ সরাসরি বাসে একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, বাস কর্তৃপক্ষ বুড়িমারি ও চেংরাবান্ধা সীমান্তের দুই স্থানেই আপনার ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসে আনুষ্ঠানিকতার সকল কাজে সহায়তা করবে। এছাড়া চেংরাবান্ধা থেকে বাসের সংখ্যা কম। তবে গ্রুপে বেশি লোক থাকলে সমস্যা হয় না। তখন সেখানে জিপসহ নানারকম গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু একা বা দুইজন হলে একটু সমস্যা হয়। তবে যদি টাকা থাকে আপনার বেশি, তবে কোথাও কোন সমস্যা নেই। একাই আপনি ট্যাক্সি ভাড়া করে যেতে পারবেন শিলিগুড়ি। যাহোক, আমরা ভোরে বুড়িমারি পৌছালাম। বুড়িমারি পৌছে আমরা টের পেলাম যে, আমরা হিমালয়ের দিকে যাচ্ছি আর শীতে ঠান্ডার মাত্রা কত বেশি তাহা বুঝতে পারলাম। পরে সেখানে ফ্রেস হয়ে ঐতিহ্যবাহী সেই বুড়ির হোটেলে সকালে নাস্তা খেয়ে ইমিগ্রেশনসহ যাবতীয় কাজ সেরে ভারতের চেংরাবান্ধা পৌছালাম। পরে সেখানকার মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙ্গিয়ে রুপি নিলাম। এরপর শ্যামলী পরিবহনের তাদের আরেকটি বাসে শিলিগুড়ি রওনা হলাম। চারিদিকে সবুজ-শ্যামল আর নতুনত্ব দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। চেংরাবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি যেতে ২ থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগে। পরে আমরা শিলিগুড়ি শহরের মালাগুড়ি মোড়ে শ্যামলীর কাউন্টারে নামলাম। সেখানে নেমে ফ্রেস হয়ে আমাদের চোখে পড়লো একটি খাবার হোটেল। তার নাম “ঢাকাইয়া হোটেল”। পেটে ক্ষুধাও অনেক। তাই দেরি না করে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলে ঢুকতেই এক মহিলা এসে বলল, আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন। আমরা বললাম বাংলাদেশ থেকে। শুনেই ঐ মহিলা বলল, আমিই একমাত্র যে, এই শিলিগুড়ি শহরে বাংলার মতো অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো ভাত-মাছ রান্না করি। আমার এখানে খেলে শান্তি পাবেন। অন্য হোটেলে খেলে আপনাদের কষ্ট হবে। আর আমার এখানে দামও কম। প্রসঙ্গত: ঐ মহিলাই এই ঢাকাইয়া হোটেল এর মালিক। যাহোক, আমরা ভাত-মাছ-সবজি খেলাম। সত্যিই দেশের মতো রান্না এবং দামও কম। পরে কথা প্রসঙ্গে জানতে পেলাম, ঐ মহিলার বাপ-দাদারা ঢাকায় থাকতেন। পরে তারা শিলিগুড়ি চলে আসেন। তিনি তার বাপ-মার নিকট থেকে রান্না শিখেছেন। তাই হোটেলের নাম দিয়েছেন ঢাকাইয়া হোটেল। আর বাংলা থেকে লোক আসলে তার হোটেলে খেয়ে শান্তি পায় বলে তিনি জানালেন। এরপর আমরা শহরে মোবাইল সিম কেনার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুচরা দোকানে আমাদের মোবাইল সিম দিলো না। যাহোক, ঐ হোটেল এবং শ্যামলী কাউন্টারের সামনে দিয়ে দার্জিলিং এর বাস ও জিপসহ বিভিন্ন গাড়ি যাচ্ছে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার সড়ক পথ দুটি। প্রথমটি হচ্ছে শিলিগুড়ি-শিমুলবাড়ি-পাঙ্খাবাড়ি-কার্শিয়াং-সোনাদা-ঘুম-দার্জিলিং এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শিলিগুড়ি-সুকনা-তিনধারিয়া-কার্শিয়াং-সোনাদা-ঘুম-দার্জিলিং। প্রথমটি ৬৭ পরেরটি ৮১ কিলোমিটার পথ। কার্শিয়াং এসে দুটি রাস্তাই একহয়ে গেছে। আমাদের টার্গেড ছিল দার্জিলিং যাওয়ার দুটি পথই আমরা দেখবো। কারণ দুটি পথে কিছু আলাদা স্পট আছে যাহা মনোমুগ্ধকর। তাই আমরা ঠিক করলাম যাবো এক পথে আর আসবো আরেক পথে। সাধারণত বাস একটু বড় বিধায় তারা দ্বিতীয় রোড দিয়ে যায় দার্জিলিং। আর জিপসহ ছোট গাড়িগুলি একটু সর্টকার্ট রাস্তা ও একটু বিপদজনক রোড প্রথমটি দিয়ে যায় দার্জিলিং। এছাড়া আপনি ইচ্ছে করলে টয় ট্রেনে যেতে পারবেন। তবে টয় ট্রেন বছরে একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত চলাচল করে। পরে বর্ষার সময় এটা কিছুদিন বন্ধ থাকে। বিশ্ব হেরিটেজ টয় ট্রেনে যেতে শিলিগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি টয়ট্রেন স্টেশনে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে টয়ট্রেনে আপনি যেতে পারবেন দার্জিলিং। তবে টয় ট্রেনে সময় অনেক বেশি লাগে এবং সকালের দিকে টয় ট্রেন চলে। যদি আপনি শিলিগুড়ি দুপুরের পর পৌছান তবে আপনার জন্য খোলা থাকবে শুধু সড়ক পথ। এছাড়া এখানে বিমানে আসা যায়। নিকটস্থ বিমানবন্দর হচ্ছে বাগডোগরাতে। এখান থেকে দার্জিলিং ৯০ কিলোমিটার।
যাহোক, আমরা আটজন একটি পাজোরো জিপ রিজার্ভ করলাম। প্রতিজন ভাড়া পড়লো মাত্র ২০০ রুপি। আপনি ইচ্ছে করলে ঐ জিপে ১০জন যেতে পারবেন। এছাড়া বাসে আরো ভাড়া কম। বাসে যেতে হলে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। যাহোক, আমরা ড্রাইভারকে বললাম প্রথম পথেই যাবো। চললো জিপ দার্জিলিং এর পথে। শিলিগুড়ি জেলা সদর শহর না। অথচ এত উন্নত একটি থানা শহর যাহা না দেখলে বুঝা যাবে না। শহর ছাড়িয়ে কিছুদুর যেতেই মহাসড়কের পাশ দিয়ে চোখে পড়লো ভারতের বিশাল সেনানিবাস এলাকা। পরে চারিদিকে বন আর গাছ। এই এলাকার নাম সুকনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “কাজল ঢালা গহন বন”। এরপর সামনে কালো মেঘের মতো হিমালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের উঠার আগেই বিশাল টোল প্লাজা। পাহাড়ের রাস্তায় উঠায় আগে সব গাড়িকেই টোল দিতে হয়। সেখানে লেখা আছে হিমালয়ান হাইওয়ে শুরু। যাহোক, আমাদের জিপ সামনে কিছুদুর যেতেই মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। বিশাল পাহাড় বেয়ে বিভিন্ন গাড়ি উঠছে। নিচ থেকে দেখে মনে হচ্ছে, কচ্ছপ যাচ্ছে। আমি গাড়ির সামনে ছিলাম। আমাদের জিপ যখন বিশাল পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো। তখন কারো চোখে ভয়ের ছাপ, আবার কারো চোখ বন্ধ। আমি প্রথমে ভয়ে আল্লাহ্র নাম নিলাম। পরে আস্তে আস্তে কৌতুহল হয়ে দেখলাম আর আল্লাহ্র নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম। চারিদিকে এত সুন্দর প্রকৃতি ও পাহাড়। তার বুক চিড়ে আমাদের গাড়ি শুধু উপরের দিকে উঠছে। এরপর আমরা প্রায় মেঘের কাছাকাছি রাস্তায় পাহাড়ের ঢালে একটি চায়ের দোকানে থামলাম। গাড়ি থেকে নেমেই দমকা ঠান্ডা হাওয়া লাগলো। খুবই শীত। যতই সামনে যাচ্ছি ঠান্ডা ততই বাড়ছে। দোকানে পাহাড়ী মহিলা তরতাজা দুধ চা দিলেন। কারণ এ অঞ্চলে রং চা নেই। খেতে খুবই সুস্বাধু। পরে আবার চললাম পাহাড়ের ঢালে বয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে। কিছুদুর পর পর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়। এরপর ছোট ছোট শহর পাহাড়ের ঢালে, উপরে ও নিচে। এক সময় আমরা পৌছালাম সেই দুইপথের মিলনস্থলের কার্শিয়াং শহর। শহরটি ছবির মতো সুন্দর। এরপর আমরা প্রথম দেখলাম রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া টয় ট্রেন লাইন। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেছে। এরপর দেখি কুয়াচ্ছন্ন মেঘ আমাদের গাড়ির জানালা দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। যেতে যেতে তখন শেষ বিকেল। আমাদের গাড়ির বাতি জ্বলে উঠলো। আমরা থমকে গেলাম। আমরা আনন্দে হইচই করতে লাগলাম। এটা ঘুম শহর। একটু পর অন্ধকার কেটে গেল। আমরা এবার মেঘের উপরে উঠে গেছি। আমরা পৌছালাম ঘুম শহরে।
রাস্তার সাথেই রেলস্টেশন। দার্জিলিং এ এই পর্যন্তই রেললাইন গেছে। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম রেলস্টেশন। যার নাম ওয়ার্ল্ড বুক অফ গিনেজে উঠেছে। জায়গাটি বছরের প্রায় দশমাসই মেঘলা থাকে। তাই দিনের বেলাতেও গাড়িগুলো ফগ লাইট জ্বালিয়ে চলে। এই স্থানের উচ্চতা সাড়ে ৮ হাজার ফিট। এখানে অন্যরকম এক অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন। গল্প লিখেছেন ঘুমমনেস্টি নিয়ে। তার ভাষায় এলাকাটি ঘুমন্ত ও শান্ত সৃষ্ট স্থান। অবশেষে সন্ধার পর আমরা পৌছালাম সেই হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং শহরে। শহরে নেমেই শীতের তীব্রতা টের পেলাম। তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ছুই ছুই। এরইমধ্যে ড্রাইভারকে আগেই বলেছিলাম যে, আমাদের থাকার হোটেল লাগবে মধ্যম কিন্তু ভাল মানের। যে হোটেলের উপর থেকে দার্জিলিং শহরের ভাল ভিউ দেখা যাবে। পাশাপাশি খাবার হোটেল আছে এই রকম হলে ভাল হয়। ড্রাইভার আমাদের কথা বিবেচনা করে মধ্যম ভাল মানের “সোসাইটি হোটেলে” নিয়ে গাড়ি থামালেন। আমরা নেমে দরদাম করে রুম ঠিক করে ফেলনাম তিন রাতের জন্য।
পরে হোটেলের রুমে লাগেজ রেখেই হোটেলের নিচে রেস্টুরেন্টে খেতে এলাম। কিন্তু খাবার ভাল না পেয়ে হোটেলের বাহিরে যেতেই পেয়ে গেলাম মোবাইল কোম্পানী বোডা ফোনের কাস্টমার সেন্টার। সেখান থেকে ১০০ রুপি আর পাসপোর্ট ফটোকপি ও ছবি দিয়ে একটি সিম কিনলাম ডাটাপ্যাকেজসহ। পরে একটু নিচে যেতেই পেয়ে গেলাম মুসলিম খাবার হোটেল। হোটেলের ভিতরে ঢুকতেই মালিক দাঁড়িওয়ালা সালাম দিলেন। হুজুরদের মতো টুপি পড়ে বসে আসে। আমরা বললাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমরা মুসলিম। শুনেই উনি খুশি হলেন। বললেন, দার্জিলিং শহরে দুটি মুসলিম খাবার হোটেল আছে। যাহা এখানেই। আর এই হোটেলের পাশেই শহরের একমাত্র মসজিদ। যাহোক, রাতের খাবার খেলাম। তখন হোটেল মালিক বললো, তার কয়েকটি জিপসহ অন্যান্য গাড়ি আছে। আমাদের আগামীকালের ঘুরাঘুরির ট্যুর প্যাকেজ তিনি দিতে পারেন। আমরা তার নিকট থেকে পরের সারাদিনের ঘুরাঘুরির ট্যুর প্যাকেজ দরদাম করে জেনে নিলাম। হোটেলে ফিরে কাউন্টারে ঐ একই প্যাকেজ এর দরদাম করলাম। কিন্তু আগে ওই খাবার হোটেল এর মালিকের ট্যুর প্যাকেজটিই আমাদের নিকট ভাল, কম মূল্য ও ভাল জিপ গাড়ি মনে হলো। তাই আমরা ওই খাবার হোটেলের মুসলিম মালিক এর ট্যুর প্যাকেজ কিনলাম। তিনি আমাদের বললেন, প্রথমেই শেষ রাতে উঠে যেতে হবে টাইগার হিলে। তাই রাত ৪টায় উঠে পড়বেন। আপনাদের হোটেলের সামনে গাড়ি থাকবে এবং গাড়ির ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর দিলেন। আমরা তো খুবই ক্লান্ত। আগেরদিন থেকে শুধু জার্নির মধ্যে আছি। তাই শেষ রাতে উঠতে হবে ভেবে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
এবার ঘুরাঘুরির পালা :
টাইগার হিল: শেষ রাতে উঠে যথারীতি তৈরি হয়ে হোটেলের সামনে আসতেই দেখি গাড়ি। তারপর বের হলাম টাইগার হিলের সেই বিখ্যাত সূর্যোদয় দেখতে। টাইগার হিল হচ্ছে দার্জিলিং এর সব্বোর্চ্য চুড়া। এখান থেকে সুর্যোদয়ের সময় হিমালয়ের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। বিশেষ করে যখন সূর্যের আলো হিমালয়ের বরফাচ্ছিত চুড়ার উপর পড়ে তখন সেটা সোনালী রং ধারণ করে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। আর সেটা এত অপরূপ দেখা যায় যে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। টাইগার হিল শহর থেকে ১১ কি.মি.দূরে ২৫৯০ মিটার উঁচুতে। সূর্যোদয়ের দৃশ্য ও এভারেস্ট শৃঙ্গটি দেখবার জন্য এটা বেস্ট। তবে এখানে ঠান্ডা অনেক বেশি হলেও এটার সৌন্দর্য না দেখলে জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। টাইগার হিলে ঢুকতে জনপ্রতি ১০ রুপি করে টিকিট।
এরপর আমরা পর্যায়ক্রমে চৌরাস্তা থেকে এগিয়ে অবজারভেটরি হিলে অনুপম নিসর্গ দৃশ্য, পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চ রেলস্টেশন ঘুম, রেল স্টেশনের নিচে ধীরধাম মন্দির, চৌরাস্তা থেকে হাঁটা পথে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম(টিকিট জনপ্রতি ২০ রুপি), ন্যাশনাল চিড়িয়াখানা (চিড়িয়াখানার টিকিট জনপ্রতি ২০ রুপি), মার্কেট মটর স্ট্যান্ডের কাছে লয়েডস্ বোটানিক্যাল গার্ডেন, শহর থেকে ৩ কি.মি.দূরে নর্থ পয়েন্টে দার্জিলিং - রঙ্গিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার রোপওয়ে চড়ে ৪ কি.মি.দূরে সিংলা বাজারে যাওয়া ও ঘুরে দেখলাম। পরেরদিন বাতাশিয়া ওয়ার মেমোরিয়াল পার্ক ও ইকো গার্ডেন এ গেলাম। টিকিট জনপ্রতি ১০ রুপি। এখানে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে অনেক সৈন্য নিহত হয়। তাদের স্মরণে এখানে স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে। এরপর আমরা ৮ হাজার ফিট উপরে একটি চা বাগান, হিমালয়ান মাউন্টরিং ট্রেনিং ইন্সস্টিটিউট, দার্জিলিং এর ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ফটো এক্সিবিশন হল, তিব্বতি রিফিউজি সেন্টারসহ কয়েকটি স্পটে ঘুরলাম।
এবার কেনাকাটার পালা : শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যাল। দার্জিলিং শহর মুলত শীত প্রধান। তাই এর মাকের্টগুলোতে শীতের বিভিন্ন ধরণের স্থানীয় ও চায়না পোশাক ও মালে ঠাসা। এরমধ্যে লেদার জ্যাকেট, পশমী চাদর ও শাল ইত্যাদি একটু কম দামে পাওয়া যায়। তবে চা বাগানে গেলে গ্রীন টি কিনতে ভুলবেন না। এটি খুবই উপকারী। আর সবকিছুতেই দরদাম করে কিনবেন। সব দোকান ও মাকের্টগুলো শীতের দিনে সন্ধার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া এখানে বিভিন্ন ধরণের হাতে তৈরি হস্তশিল্পের জিনিস পাবেন কম দামে। আর শহরে কেভেন্টার্সের কাউন্টার থেকে হটডগ খেতে ভুলবেন না। কারণ এটা জগৎ বিখ্যাত হটডগ খাবার প্রস্তুতকারী দোকান।
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে ট্রয় ট্রেনের টিকিট কিনতে গিয়ে জানতে পারলাম, মেরামত কাজের জন্য কিছুদিন ধরে টয় ট্রেন বন্ধ আছে। পরে আবার আরেকটি জিপ ভাড়া করে সকালে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম দ্বিতীয় পথটা ধরে। আসার পথে আরো কয়েকটি সুন্দর পাহাড়ী শহর ও কমলা লেবুর বাগান দেখলাম। দুপুরের আগেই শিলিগুড়ি পৌছালাম। এরপর শিলিগুড়ি শহরের হিলকার্ট রোডের “হোটেল নিলাদ্রি প্লাজা”য় উঠলাম। পরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে শিলিগুড়ি শহরের আশে পাশে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরলাম।
শেষে শুরু হলো মাকেটিং এর পালা। শিলিগুড়ির বিধান মাকের্টে অনেক ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া-রাজশাহীর লোক। সেখানেও দেখলাম শাড়ীর দোকানে টাঙ্গাইল শাড়ী বিক্রি হচ্ছে। যাহোক, শিলিগুড়িতে কসমেটিক্স, চাদর, শাল, চা ইত্যাদি একটু কম দামে পাওয়া যায়। আর মজার বিষয় হচ্ছে, শিলিগুড়ি শহরে কাঁচা বাজারে হরেক রকম সবজি দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। ভোর সকালে তরতাজা লাল, হলুদ, সবুজ আরো কত রংয়ের ক্যাপচিক্যাপ আর আছে সালাদ খাওয়ার আধ হাত লম্বা ও মোটা কাঁচামরিচ। এছাড়া বড় বড় কমলা লেবু ও আমলকি দেখে খুব ভাল লাগবে। আমরা চলে আসার দিন সকালে অনেক বড় সাইজের কমলা লেবু মাত্র ২০ রুপি হালি দরে(যা এদেশে ২০০ টাকা হালি)আর লাল ও হলুদ ক্যাপচিক্যাপ মাত্র ৩০ রুপি কেজি (যা এ দেশে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি) আর সবুজ ক্যাপচিক্যাপ মাত্র ১০ রুপি কেজি (যা এদেশে প্রায় ১০০ টাকা কেজি) ধরে ও লম্বা কাঁচা মরিচ কিনেছিলাম। আর ভাল মানের চা পাতার দামও অনেক কম। তবে আমরা চিন্তায় ছিলাম যে, হয়তো এই কাঁচা সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের সবকিছু পরের দিন সকালে একদম তাজাই ছিল। যাহোক, ফেরার সময় শিলিগুড়িতে শ্যামলী পরিবহনের সরাসরি গাড়ি পায়নি। কারণ সেদিন ছিলো রবিবার। আর রবিবার শ্যামলী পরিবহনের ঢাকাগামী সরাসরি গাড়িটি সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। তাই আমরা একটি পাজেরো জিপ ভাড়া করে শিলিগুড়ি থেকে চেংরাবান্ধা সীমান্তে পৌছালাম। পরে সেখান থেকে যথারীতি ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে চলে এলাম বুড়িমাড়ি। পরে বুড়িমারি থেকে রাতে বাসে করে চলে এলাম ভোরে টাঙ্গাইল শহরে। আর বুড়িমারি থেকে অনেক পরিবহনের বাস ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তম্ব্যে ছেড়ে যায় রাতে। তাই এখানে গাড়ির কোন সমস্যা নেই।
এই অঞ্চলে বেড়ানোর সময় মনে রাখবেন, দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি শহরে বেশিরভাগ খাবার হোটেলগুলোতে খাবার অর্ডার দিলে ডাবল দিয়ে দেয়। অর্থাৎ আপনি ডিম চাইলে দুটি ডিম দিবে, কারণ ওদের সিস্টেমই হচ্ছে ডাবল দেয়া। আর বিলও কিন্তু ডাবল এর নিবে। তাই প্রথমে টেষ্ট করুন।
প্রয়োজনীয় তথ্য :
দার্জিলিং = টয় ট্রেনে আসতে= নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে = সকাল ৭:১৫ অথবা ৯টায় ট্রেন ছাড়ে = পৌছে কার্শিয়াং = ১২:৩২ ও ০২:০৬ এবং দার্জিলিং পৌছে = ০৩:৩০ ও ১৭:৩০। আবার দার্জিলিং থেকে ০৮:২৫ এবং ১০:০০ ছেড়ে কার্শিয়াং পৌছে ১১:০৫ ও ১২:৩৭ এবং নিউ জলপাইগুড়ি পৌছে ১৬:২০ ও ১৭:৪৫।
বাসে যেতে = শিলিগুড়ি শহরের মহানন্দা ব্রিজ পাড় হয়ে যেতে হবে তেনজিং নোরগে বাসটার্মিনাল। মিনিবাসে জানালার পাশে যেতে হবে। তাহলে জানালা দিয়ে অরূপ দৃশ্য দেখতে পাবেন। সড়ক = শিলিগুড়ি - সুকনা - তিনধারিয়া - কার্শিয়াং - সোনাদা - ঘুম - দার্জিলিং। দুরত্ব ৮১ কি.মি.। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ছাড়ার ২ ঘন্টা পর গাড়ি পৌছবে কার্শিয়াং। কিছু সময় বিরতি। এ সময় মেঘ উড়ে যাবে গা ছুঁয়ে। নিচে তাকিয়ে দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এর পর আরো ১-২ ঘন্টা পর দার্জিলিং পৌছাবে। মোট সময় লাগে ৩-৪ ঘন্টা। দার্জিলিং এ বেড়ানোর ভাল মৌসুম = এপ্রিল - জুনের মাঝামাঝি এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর।
দার্জিলিং এ কম খরচের হোটেল হচ্ছে = গান্ধি রোডে সুইচ হোটেল / শবনম হোটেল / ক্যাপিটাল হোটেল / কদমবাড়ি হোটেল / স্পিং হোটেল / আশোকা হোটেল / কন্টিনেন্টাল হোটেল / রকভিল হোটেল। কোচবিহার রোডে ব্রডওয়ে হোটেল / সানরাইজ হোটেল। ক্লার্ক রোডে সামার বন হোটেল / সম্রাট হোটেল। বেলেম্পাং রোডে দার্জিলিং হোটেল / ওয়েসাইড ইন্টারন্যাশনাল / মিলন হোটেল। এছাড়া রবার্টসন রোডে / টংসু রোডে / বর্ধমান রোডে / ল্যাডনেলা রোডে কম রেটের হোটেল আছে। হোটেল ভাড়া ৪০০ থেকে ২,০০০ রুপি পর্যন্ত। এছাড়া দামী স্টার মানের হোটেলও আছে। খাবার এর জন্য মুসলিম হোটেল এর কথা আগেই বলেছি। এছাড়া মহাত্মা গান্ধি রোডে কুনডু হোটেল খাওয়ার জন্য ভাল।
ঢাকা থেকে ভারতের শিলিগুড়ি শ্যামলী বাস ছাড়ে রাত ৮টায়। ভাড়া = ১৬০০/- টাকা। আর শিলিগুড়ি থেকে বাস ছাড়ে দুপুর ১২টায় পৌছে পরদিন ভোরে ঢাকা। এছাড়া কলকাতা থেকেও বাসে এবং ট্রেনে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার ট্রেন ঃ শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেস ছাড়ে ০৬:২৫,পৌছে ১৮:১০/তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস ছাড়ে ১৩:৪০,পৌছে পরদিন ভোর ০৪:১৫/দার্জিলিং মেল ছাড়ে ১৯:১৫,পৌছে পরদিন সকাল ০৮:৪০।
কম খরচের কিছু তথ্য :
১। আপনার গ্রুপে বেশি লোক হলে খরচও কম হবে। তবে মিনিমাম দুইজন হতে হবে।
২।। বাজারে যখন ডলারের দাম কম থাকে তখন ডলার কিনে রাখতে হবে।
৩। চেংরাবান্ধা গিয়ে বেশি ডলার না ভাঙ্গানোই ভালো। কারণ শিলিগুড়ি শহরে ডলারের রেট কিছুটা বেশি। আর দার্জিলিং এ
ডলারের রেট কিন্তু কিছুটা কম। তাই শিলিগুড়ি থেকেই ভাঙ্গানোই উত্তম। আর যেখানে রেট বেশি, সেখান থেকে ডলার
ভাঙ্গান। তবে ডলারের রেট সকাল-বিকাল উঠা নামা করে এবং বড় শহরে ডলারের রেট সাধারণত বেশি পাওয়া যায়।
৪। খাবারের হোটেলগুলোতে দরদাম করে খাবেন। প্রয়োজনে অন্য হোটেলে যাবেন।
৫। ঘুরাঘুরির প্যাকেজ কিনতে দরদাম করুন। কারণ আশে-পাশে অনেক ট্রাভেল এজেন্ট পাবেন।
৬। ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করতে হোটেলের অথবা স্থানীয় ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করুন।
৭। সব সময় একসাথে গ্রুপ করে সব কিছু করুন। তাতে প্রায় সব কিছুতেই ডিসকাউন্ট পাবেন।
অবশেষে আমার এই লেখাতে কোন ভুল হলে ক্ষমা করবেন। তবে কোথায় ভুল হয়েছে তাহা জানালে সংশোধন হবো ও করবো। যে কোন পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করবো। যোগাযোগ করতে পারেন। ফোন : ০১৭১১-১০৬৯৭০, ০১৭১৩-৫৩২৩৬৩। ই-মেইল : ripon.kazi@gmail.com
আমার লেখা প্রথম ভ্রমণ কাহিনী-১
কম খরচে ঘুরে আসুন থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও পাতায়া ।
এই লিংকে পাবেন : http://freetouristguide24.blogspot.com/2017/10/blog-post.html
ঘুরে আসুন ভারতের হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং
কাজী রিপন :
জীবন একটাই। কখন চলে যাবে কেউ জানে না। এই ছোট্ট জীবনে একটু সময় করে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী এই সুন্দর জগতটা একটু ঘুরে দেখুন। জীবনটাকে উপভোগ করুন। আর তাই আমার সকল বন্ধুদের জন্য কম খরচে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করার বিষয়ে তথ্য জানার জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াশ : এ পর্যায়ে ভারতের হিমালয় কণ্যা দাজিলিং এর কথা। যেখানে সড়ক পথে মেঘের উপর দিয়ে আপনি যাবেন। মেঘ এসে আপনাকে ঘিরে ধরবে। কখনও হিমালয়ের ঠান্ডা হাওয়া, আবার কখনও ছায়া, কখনও রাতের মতো অন্ধকার, আবার কখনও ভয়, তারপরেই পাকা কমলালেবুর গ্রাণ, প্রতিটি মুহুতেই আপনি রোমান্স অনুভব করবেন। আর দার্জিলিং ঘুরে আসতে, আপনার কক্সবাজার ঘুরতে যে রকম খরচ হয়, সেইরকম খরচই হবে।
২৯ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং গিয়েছিলাম। আমাদের পথ ছিল লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানার বুড়িমারি স্থল বন্দর হয়ে ভারতের কুচবিহার জেলার চেংরাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে শিলিগুড়ি। তারপর শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং। কারণ এই রোডে দার্জিলিং যেতে সবচেয়ে কম সময় লাগে এবং সবচেয়ে কম খরচ লাগে। আমরা শ্যামলী পরিবহনের সরাসরি ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাসের টিকিট নিয়েছিলাম। যেহেতু, আমরা টাঙ্গাইল জেলার লোক। তাই আমাদের জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল যে, শ্যামলী পরিবহনের গাড়িটি রাত ৮ টায় ঢাকার আরামবাগ থেকে ছাড়ে। আর এই গাড়ি টাঙ্গাইল হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে উত্তরবঙ্গ হয়ে চলে যায় বুড়িমারি। এরপর সীমান্তের ওপারে চেংরাবান্ধায় তাদের আরেকটি গাড়ি থাকে।
সেটাতে শিলিগুড়ি নিয়ে যায়। যাহোক, আমরা আর কষ্ট করে ঢাকা যাইনি। রাতে নিজের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে পরে বিশ্রাম নিয়ে টাঙ্গাইল শহর বাইপাসের রাবনা থেকে রাত ১১ টার দিকে আমাদের গাড়িতে উঠি। আর যারা ঢাকা থেকে যেতে চান, তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসটার্মিনাল থেকে বিভিন্ন পরিবহনের গাড়িতেও বুড়িমারি আসতে পারেন। তবে যারা প্রথমবার ঐ রোডে দার্জিলিং যাবেন। তাদের জন্য সরাসরি ঢাকা টু শিলিগুড়ির বাসে যাওয়াই ভালো। কারণ সরাসরি বাসে একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, বাস কর্তৃপক্ষ বুড়িমারি ও চেংরাবান্ধা সীমান্তের দুই স্থানেই আপনার ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসে আনুষ্ঠানিকতার সকল কাজে সহায়তা করবে। এছাড়া চেংরাবান্ধা থেকে বাসের সংখ্যা কম। তবে গ্রুপে বেশি লোক থাকলে সমস্যা হয় না। তখন সেখানে জিপসহ নানারকম গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু একা বা দুইজন হলে একটু সমস্যা হয়। তবে যদি টাকা থাকে আপনার বেশি, তবে কোথাও কোন সমস্যা নেই। একাই আপনি ট্যাক্সি ভাড়া করে যেতে পারবেন শিলিগুড়ি। যাহোক, আমরা ভোরে বুড়িমারি পৌছালাম। বুড়িমারি পৌছে আমরা টের পেলাম যে, আমরা হিমালয়ের দিকে যাচ্ছি আর শীতে ঠান্ডার মাত্রা কত বেশি তাহা বুঝতে পারলাম। পরে সেখানে ফ্রেস হয়ে ঐতিহ্যবাহী সেই বুড়ির হোটেলে সকালে নাস্তা খেয়ে ইমিগ্রেশনসহ যাবতীয় কাজ সেরে ভারতের চেংরাবান্ধা পৌছালাম। পরে সেখানকার মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙ্গিয়ে রুপি নিলাম। এরপর শ্যামলী পরিবহনের তাদের আরেকটি বাসে শিলিগুড়ি রওনা হলাম। চারিদিকে সবুজ-শ্যামল আর নতুনত্ব দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। চেংরাবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি যেতে ২ থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগে। পরে আমরা শিলিগুড়ি শহরের মালাগুড়ি মোড়ে শ্যামলীর কাউন্টারে নামলাম। সেখানে নেমে ফ্রেস হয়ে আমাদের চোখে পড়লো একটি খাবার হোটেল। তার নাম “ঢাকাইয়া হোটেল”। পেটে ক্ষুধাও অনেক। তাই দেরি না করে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলে ঢুকতেই এক মহিলা এসে বলল, আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন। আমরা বললাম বাংলাদেশ থেকে। শুনেই ঐ মহিলা বলল, আমিই একমাত্র যে, এই শিলিগুড়ি শহরে বাংলার মতো অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো ভাত-মাছ রান্না করি। আমার এখানে খেলে শান্তি পাবেন। অন্য হোটেলে খেলে আপনাদের কষ্ট হবে। আর আমার এখানে দামও কম। প্রসঙ্গত: ঐ মহিলাই এই ঢাকাইয়া হোটেল এর মালিক। যাহোক, আমরা ভাত-মাছ-সবজি খেলাম। সত্যিই দেশের মতো রান্না এবং দামও কম। পরে কথা প্রসঙ্গে জানতে পেলাম, ঐ মহিলার বাপ-দাদারা ঢাকায় থাকতেন। পরে তারা শিলিগুড়ি চলে আসেন। তিনি তার বাপ-মার নিকট থেকে রান্না শিখেছেন। তাই হোটেলের নাম দিয়েছেন ঢাকাইয়া হোটেল। আর বাংলা থেকে লোক আসলে তার হোটেলে খেয়ে শান্তি পায় বলে তিনি জানালেন। এরপর আমরা শহরে মোবাইল সিম কেনার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুচরা দোকানে আমাদের মোবাইল সিম দিলো না। যাহোক, ঐ হোটেল এবং শ্যামলী কাউন্টারের সামনে দিয়ে দার্জিলিং এর বাস ও জিপসহ বিভিন্ন গাড়ি যাচ্ছে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার সড়ক পথ দুটি। প্রথমটি হচ্ছে শিলিগুড়ি-শিমুলবাড়ি-পাঙ্খাবাড়ি-কার্শিয়াং-সোনাদা-ঘুম-দার্জিলিং এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শিলিগুড়ি-সুকনা-তিনধারিয়া-কার্শিয়াং-সোনাদা-ঘুম-দার্জিলিং। প্রথমটি ৬৭ পরেরটি ৮১ কিলোমিটার পথ। কার্শিয়াং এসে দুটি রাস্তাই একহয়ে গেছে। আমাদের টার্গেড ছিল দার্জিলিং যাওয়ার দুটি পথই আমরা দেখবো। কারণ দুটি পথে কিছু আলাদা স্পট আছে যাহা মনোমুগ্ধকর। তাই আমরা ঠিক করলাম যাবো এক পথে আর আসবো আরেক পথে। সাধারণত বাস একটু বড় বিধায় তারা দ্বিতীয় রোড দিয়ে যায় দার্জিলিং। আর জিপসহ ছোট গাড়িগুলি একটু সর্টকার্ট রাস্তা ও একটু বিপদজনক রোড প্রথমটি দিয়ে যায় দার্জিলিং। এছাড়া আপনি ইচ্ছে করলে টয় ট্রেনে যেতে পারবেন। তবে টয় ট্রেন বছরে একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত চলাচল করে। পরে বর্ষার সময় এটা কিছুদিন বন্ধ থাকে। বিশ্ব হেরিটেজ টয় ট্রেনে যেতে শিলিগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি টয়ট্রেন স্টেশনে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে টয়ট্রেনে আপনি যেতে পারবেন দার্জিলিং। তবে টয় ট্রেনে সময় অনেক বেশি লাগে এবং সকালের দিকে টয় ট্রেন চলে। যদি আপনি শিলিগুড়ি দুপুরের পর পৌছান তবে আপনার জন্য খোলা থাকবে শুধু সড়ক পথ। এছাড়া এখানে বিমানে আসা যায়। নিকটস্থ বিমানবন্দর হচ্ছে বাগডোগরাতে। এখান থেকে দার্জিলিং ৯০ কিলোমিটার।
যাহোক, আমরা আটজন একটি পাজোরো জিপ রিজার্ভ করলাম। প্রতিজন ভাড়া পড়লো মাত্র ২০০ রুপি। আপনি ইচ্ছে করলে ঐ জিপে ১০জন যেতে পারবেন। এছাড়া বাসে আরো ভাড়া কম। বাসে যেতে হলে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। যাহোক, আমরা ড্রাইভারকে বললাম প্রথম পথেই যাবো। চললো জিপ দার্জিলিং এর পথে। শিলিগুড়ি জেলা সদর শহর না। অথচ এত উন্নত একটি থানা শহর যাহা না দেখলে বুঝা যাবে না। শহর ছাড়িয়ে কিছুদুর যেতেই মহাসড়কের পাশ দিয়ে চোখে পড়লো ভারতের বিশাল সেনানিবাস এলাকা। পরে চারিদিকে বন আর গাছ। এই এলাকার নাম সুকনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “কাজল ঢালা গহন বন”। এরপর সামনে কালো মেঘের মতো হিমালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের উঠার আগেই বিশাল টোল প্লাজা। পাহাড়ের রাস্তায় উঠায় আগে সব গাড়িকেই টোল দিতে হয়। সেখানে লেখা আছে হিমালয়ান হাইওয়ে শুরু। যাহোক, আমাদের জিপ সামনে কিছুদুর যেতেই মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। বিশাল পাহাড় বেয়ে বিভিন্ন গাড়ি উঠছে। নিচ থেকে দেখে মনে হচ্ছে, কচ্ছপ যাচ্ছে। আমি গাড়ির সামনে ছিলাম। আমাদের জিপ যখন বিশাল পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো। তখন কারো চোখে ভয়ের ছাপ, আবার কারো চোখ বন্ধ। আমি প্রথমে ভয়ে আল্লাহ্র নাম নিলাম। পরে আস্তে আস্তে কৌতুহল হয়ে দেখলাম আর আল্লাহ্র নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম। চারিদিকে এত সুন্দর প্রকৃতি ও পাহাড়। তার বুক চিড়ে আমাদের গাড়ি শুধু উপরের দিকে উঠছে। এরপর আমরা প্রায় মেঘের কাছাকাছি রাস্তায় পাহাড়ের ঢালে একটি চায়ের দোকানে থামলাম। গাড়ি থেকে নেমেই দমকা ঠান্ডা হাওয়া লাগলো। খুবই শীত। যতই সামনে যাচ্ছি ঠান্ডা ততই বাড়ছে। দোকানে পাহাড়ী মহিলা তরতাজা দুধ চা দিলেন। কারণ এ অঞ্চলে রং চা নেই। খেতে খুবই সুস্বাধু। পরে আবার চললাম পাহাড়ের ঢালে বয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে। কিছুদুর পর পর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়। এরপর ছোট ছোট শহর পাহাড়ের ঢালে, উপরে ও নিচে। এক সময় আমরা পৌছালাম সেই দুইপথের মিলনস্থলের কার্শিয়াং শহর। শহরটি ছবির মতো সুন্দর। এরপর আমরা প্রথম দেখলাম রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া টয় ট্রেন লাইন। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেছে। এরপর দেখি কুয়াচ্ছন্ন মেঘ আমাদের গাড়ির জানালা দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। যেতে যেতে তখন শেষ বিকেল। আমাদের গাড়ির বাতি জ্বলে উঠলো। আমরা থমকে গেলাম। আমরা আনন্দে হইচই করতে লাগলাম। এটা ঘুম শহর। একটু পর অন্ধকার কেটে গেল। আমরা এবার মেঘের উপরে উঠে গেছি। আমরা পৌছালাম ঘুম শহরে।
রাস্তার সাথেই রেলস্টেশন। দার্জিলিং এ এই পর্যন্তই রেললাইন গেছে। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম রেলস্টেশন। যার নাম ওয়ার্ল্ড বুক অফ গিনেজে উঠেছে। জায়গাটি বছরের প্রায় দশমাসই মেঘলা থাকে। তাই দিনের বেলাতেও গাড়িগুলো ফগ লাইট জ্বালিয়ে চলে। এই স্থানের উচ্চতা সাড়ে ৮ হাজার ফিট। এখানে অন্যরকম এক অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন। গল্প লিখেছেন ঘুমমনেস্টি নিয়ে। তার ভাষায় এলাকাটি ঘুমন্ত ও শান্ত সৃষ্ট স্থান। অবশেষে সন্ধার পর আমরা পৌছালাম সেই হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং শহরে। শহরে নেমেই শীতের তীব্রতা টের পেলাম। তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ছুই ছুই। এরইমধ্যে ড্রাইভারকে আগেই বলেছিলাম যে, আমাদের থাকার হোটেল লাগবে মধ্যম কিন্তু ভাল মানের। যে হোটেলের উপর থেকে দার্জিলিং শহরের ভাল ভিউ দেখা যাবে। পাশাপাশি খাবার হোটেল আছে এই রকম হলে ভাল হয়। ড্রাইভার আমাদের কথা বিবেচনা করে মধ্যম ভাল মানের “সোসাইটি হোটেলে” নিয়ে গাড়ি থামালেন। আমরা নেমে দরদাম করে রুম ঠিক করে ফেলনাম তিন রাতের জন্য।
পরে হোটেলের রুমে লাগেজ রেখেই হোটেলের নিচে রেস্টুরেন্টে খেতে এলাম। কিন্তু খাবার ভাল না পেয়ে হোটেলের বাহিরে যেতেই পেয়ে গেলাম মোবাইল কোম্পানী বোডা ফোনের কাস্টমার সেন্টার। সেখান থেকে ১০০ রুপি আর পাসপোর্ট ফটোকপি ও ছবি দিয়ে একটি সিম কিনলাম ডাটাপ্যাকেজসহ। পরে একটু নিচে যেতেই পেয়ে গেলাম মুসলিম খাবার হোটেল। হোটেলের ভিতরে ঢুকতেই মালিক দাঁড়িওয়ালা সালাম দিলেন। হুজুরদের মতো টুপি পড়ে বসে আসে। আমরা বললাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমরা মুসলিম। শুনেই উনি খুশি হলেন। বললেন, দার্জিলিং শহরে দুটি মুসলিম খাবার হোটেল আছে। যাহা এখানেই। আর এই হোটেলের পাশেই শহরের একমাত্র মসজিদ। যাহোক, রাতের খাবার খেলাম। তখন হোটেল মালিক বললো, তার কয়েকটি জিপসহ অন্যান্য গাড়ি আছে। আমাদের আগামীকালের ঘুরাঘুরির ট্যুর প্যাকেজ তিনি দিতে পারেন। আমরা তার নিকট থেকে পরের সারাদিনের ঘুরাঘুরির ট্যুর প্যাকেজ দরদাম করে জেনে নিলাম। হোটেলে ফিরে কাউন্টারে ঐ একই প্যাকেজ এর দরদাম করলাম। কিন্তু আগে ওই খাবার হোটেল এর মালিকের ট্যুর প্যাকেজটিই আমাদের নিকট ভাল, কম মূল্য ও ভাল জিপ গাড়ি মনে হলো। তাই আমরা ওই খাবার হোটেলের মুসলিম মালিক এর ট্যুর প্যাকেজ কিনলাম। তিনি আমাদের বললেন, প্রথমেই শেষ রাতে উঠে যেতে হবে টাইগার হিলে। তাই রাত ৪টায় উঠে পড়বেন। আপনাদের হোটেলের সামনে গাড়ি থাকবে এবং গাড়ির ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর দিলেন। আমরা তো খুবই ক্লান্ত। আগেরদিন থেকে শুধু জার্নির মধ্যে আছি। তাই শেষ রাতে উঠতে হবে ভেবে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
এবার ঘুরাঘুরির পালা :
টাইগার হিল: শেষ রাতে উঠে যথারীতি তৈরি হয়ে হোটেলের সামনে আসতেই দেখি গাড়ি। তারপর বের হলাম টাইগার হিলের সেই বিখ্যাত সূর্যোদয় দেখতে। টাইগার হিল হচ্ছে দার্জিলিং এর সব্বোর্চ্য চুড়া। এখান থেকে সুর্যোদয়ের সময় হিমালয়ের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। বিশেষ করে যখন সূর্যের আলো হিমালয়ের বরফাচ্ছিত চুড়ার উপর পড়ে তখন সেটা সোনালী রং ধারণ করে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। আর সেটা এত অপরূপ দেখা যায় যে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। টাইগার হিল শহর থেকে ১১ কি.মি.দূরে ২৫৯০ মিটার উঁচুতে। সূর্যোদয়ের দৃশ্য ও এভারেস্ট শৃঙ্গটি দেখবার জন্য এটা বেস্ট। তবে এখানে ঠান্ডা অনেক বেশি হলেও এটার সৌন্দর্য না দেখলে জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। টাইগার হিলে ঢুকতে জনপ্রতি ১০ রুপি করে টিকিট।
এরপর আমরা পর্যায়ক্রমে চৌরাস্তা থেকে এগিয়ে অবজারভেটরি হিলে অনুপম নিসর্গ দৃশ্য, পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চ রেলস্টেশন ঘুম, রেল স্টেশনের নিচে ধীরধাম মন্দির, চৌরাস্তা থেকে হাঁটা পথে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম(টিকিট জনপ্রতি ২০ রুপি), ন্যাশনাল চিড়িয়াখানা (চিড়িয়াখানার টিকিট জনপ্রতি ২০ রুপি), মার্কেট মটর স্ট্যান্ডের কাছে লয়েডস্ বোটানিক্যাল গার্ডেন, শহর থেকে ৩ কি.মি.দূরে নর্থ পয়েন্টে দার্জিলিং - রঙ্গিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার রোপওয়ে চড়ে ৪ কি.মি.দূরে সিংলা বাজারে যাওয়া ও ঘুরে দেখলাম। পরেরদিন বাতাশিয়া ওয়ার মেমোরিয়াল পার্ক ও ইকো গার্ডেন এ গেলাম। টিকিট জনপ্রতি ১০ রুপি। এখানে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে অনেক সৈন্য নিহত হয়। তাদের স্মরণে এখানে স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে। এরপর আমরা ৮ হাজার ফিট উপরে একটি চা বাগান, হিমালয়ান মাউন্টরিং ট্রেনিং ইন্সস্টিটিউট, দার্জিলিং এর ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ফটো এক্সিবিশন হল, তিব্বতি রিফিউজি সেন্টারসহ কয়েকটি স্পটে ঘুরলাম।
এবার কেনাকাটার পালা : শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যাল। দার্জিলিং শহর মুলত শীত প্রধান। তাই এর মাকের্টগুলোতে শীতের বিভিন্ন ধরণের স্থানীয় ও চায়না পোশাক ও মালে ঠাসা। এরমধ্যে লেদার জ্যাকেট, পশমী চাদর ও শাল ইত্যাদি একটু কম দামে পাওয়া যায়। তবে চা বাগানে গেলে গ্রীন টি কিনতে ভুলবেন না। এটি খুবই উপকারী। আর সবকিছুতেই দরদাম করে কিনবেন। সব দোকান ও মাকের্টগুলো শীতের দিনে সন্ধার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া এখানে বিভিন্ন ধরণের হাতে তৈরি হস্তশিল্পের জিনিস পাবেন কম দামে। আর শহরে কেভেন্টার্সের কাউন্টার থেকে হটডগ খেতে ভুলবেন না। কারণ এটা জগৎ বিখ্যাত হটডগ খাবার প্রস্তুতকারী দোকান।
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে ট্রয় ট্রেনের টিকিট কিনতে গিয়ে জানতে পারলাম, মেরামত কাজের জন্য কিছুদিন ধরে টয় ট্রেন বন্ধ আছে। পরে আবার আরেকটি জিপ ভাড়া করে সকালে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম দ্বিতীয় পথটা ধরে। আসার পথে আরো কয়েকটি সুন্দর পাহাড়ী শহর ও কমলা লেবুর বাগান দেখলাম। দুপুরের আগেই শিলিগুড়ি পৌছালাম। এরপর শিলিগুড়ি শহরের হিলকার্ট রোডের “হোটেল নিলাদ্রি প্লাজা”য় উঠলাম। পরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে শিলিগুড়ি শহরের আশে পাশে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরলাম।
শেষে শুরু হলো মাকেটিং এর পালা। শিলিগুড়ির বিধান মাকের্টে অনেক ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া-রাজশাহীর লোক। সেখানেও দেখলাম শাড়ীর দোকানে টাঙ্গাইল শাড়ী বিক্রি হচ্ছে। যাহোক, শিলিগুড়িতে কসমেটিক্স, চাদর, শাল, চা ইত্যাদি একটু কম দামে পাওয়া যায়। আর মজার বিষয় হচ্ছে, শিলিগুড়ি শহরে কাঁচা বাজারে হরেক রকম সবজি দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। ভোর সকালে তরতাজা লাল, হলুদ, সবুজ আরো কত রংয়ের ক্যাপচিক্যাপ আর আছে সালাদ খাওয়ার আধ হাত লম্বা ও মোটা কাঁচামরিচ। এছাড়া বড় বড় কমলা লেবু ও আমলকি দেখে খুব ভাল লাগবে। আমরা চলে আসার দিন সকালে অনেক বড় সাইজের কমলা লেবু মাত্র ২০ রুপি হালি দরে(যা এদেশে ২০০ টাকা হালি)আর লাল ও হলুদ ক্যাপচিক্যাপ মাত্র ৩০ রুপি কেজি (যা এ দেশে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি) আর সবুজ ক্যাপচিক্যাপ মাত্র ১০ রুপি কেজি (যা এদেশে প্রায় ১০০ টাকা কেজি) ধরে ও লম্বা কাঁচা মরিচ কিনেছিলাম। আর ভাল মানের চা পাতার দামও অনেক কম। তবে আমরা চিন্তায় ছিলাম যে, হয়তো এই কাঁচা সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের সবকিছু পরের দিন সকালে একদম তাজাই ছিল। যাহোক, ফেরার সময় শিলিগুড়িতে শ্যামলী পরিবহনের সরাসরি গাড়ি পায়নি। কারণ সেদিন ছিলো রবিবার। আর রবিবার শ্যামলী পরিবহনের ঢাকাগামী সরাসরি গাড়িটি সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। তাই আমরা একটি পাজেরো জিপ ভাড়া করে শিলিগুড়ি থেকে চেংরাবান্ধা সীমান্তে পৌছালাম। পরে সেখান থেকে যথারীতি ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে চলে এলাম বুড়িমাড়ি। পরে বুড়িমারি থেকে রাতে বাসে করে চলে এলাম ভোরে টাঙ্গাইল শহরে। আর বুড়িমারি থেকে অনেক পরিবহনের বাস ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তম্ব্যে ছেড়ে যায় রাতে। তাই এখানে গাড়ির কোন সমস্যা নেই।
এই অঞ্চলে বেড়ানোর সময় মনে রাখবেন, দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি শহরে বেশিরভাগ খাবার হোটেলগুলোতে খাবার অর্ডার দিলে ডাবল দিয়ে দেয়। অর্থাৎ আপনি ডিম চাইলে দুটি ডিম দিবে, কারণ ওদের সিস্টেমই হচ্ছে ডাবল দেয়া। আর বিলও কিন্তু ডাবল এর নিবে। তাই প্রথমে টেষ্ট করুন।
প্রয়োজনীয় তথ্য :
দার্জিলিং = টয় ট্রেনে আসতে= নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে = সকাল ৭:১৫ অথবা ৯টায় ট্রেন ছাড়ে = পৌছে কার্শিয়াং = ১২:৩২ ও ০২:০৬ এবং দার্জিলিং পৌছে = ০৩:৩০ ও ১৭:৩০। আবার দার্জিলিং থেকে ০৮:২৫ এবং ১০:০০ ছেড়ে কার্শিয়াং পৌছে ১১:০৫ ও ১২:৩৭ এবং নিউ জলপাইগুড়ি পৌছে ১৬:২০ ও ১৭:৪৫।
বাসে যেতে = শিলিগুড়ি শহরের মহানন্দা ব্রিজ পাড় হয়ে যেতে হবে তেনজিং নোরগে বাসটার্মিনাল। মিনিবাসে জানালার পাশে যেতে হবে। তাহলে জানালা দিয়ে অরূপ দৃশ্য দেখতে পাবেন। সড়ক = শিলিগুড়ি - সুকনা - তিনধারিয়া - কার্শিয়াং - সোনাদা - ঘুম - দার্জিলিং। দুরত্ব ৮১ কি.মি.। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ছাড়ার ২ ঘন্টা পর গাড়ি পৌছবে কার্শিয়াং। কিছু সময় বিরতি। এ সময় মেঘ উড়ে যাবে গা ছুঁয়ে। নিচে তাকিয়ে দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এর পর আরো ১-২ ঘন্টা পর দার্জিলিং পৌছাবে। মোট সময় লাগে ৩-৪ ঘন্টা। দার্জিলিং এ বেড়ানোর ভাল মৌসুম = এপ্রিল - জুনের মাঝামাঝি এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর।
দার্জিলিং এ কম খরচের হোটেল হচ্ছে = গান্ধি রোডে সুইচ হোটেল / শবনম হোটেল / ক্যাপিটাল হোটেল / কদমবাড়ি হোটেল / স্পিং হোটেল / আশোকা হোটেল / কন্টিনেন্টাল হোটেল / রকভিল হোটেল। কোচবিহার রোডে ব্রডওয়ে হোটেল / সানরাইজ হোটেল। ক্লার্ক রোডে সামার বন হোটেল / সম্রাট হোটেল। বেলেম্পাং রোডে দার্জিলিং হোটেল / ওয়েসাইড ইন্টারন্যাশনাল / মিলন হোটেল। এছাড়া রবার্টসন রোডে / টংসু রোডে / বর্ধমান রোডে / ল্যাডনেলা রোডে কম রেটের হোটেল আছে। হোটেল ভাড়া ৪০০ থেকে ২,০০০ রুপি পর্যন্ত। এছাড়া দামী স্টার মানের হোটেলও আছে। খাবার এর জন্য মুসলিম হোটেল এর কথা আগেই বলেছি। এছাড়া মহাত্মা গান্ধি রোডে কুনডু হোটেল খাওয়ার জন্য ভাল।
ঢাকা থেকে ভারতের শিলিগুড়ি শ্যামলী বাস ছাড়ে রাত ৮টায়। ভাড়া = ১৬০০/- টাকা। আর শিলিগুড়ি থেকে বাস ছাড়ে দুপুর ১২টায় পৌছে পরদিন ভোরে ঢাকা। এছাড়া কলকাতা থেকেও বাসে এবং ট্রেনে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার ট্রেন ঃ শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেস ছাড়ে ০৬:২৫,পৌছে ১৮:১০/তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস ছাড়ে ১৩:৪০,পৌছে পরদিন ভোর ০৪:১৫/দার্জিলিং মেল ছাড়ে ১৯:১৫,পৌছে পরদিন সকাল ০৮:৪০।
কম খরচের কিছু তথ্য :
১। আপনার গ্রুপে বেশি লোক হলে খরচও কম হবে। তবে মিনিমাম দুইজন হতে হবে।
২।। বাজারে যখন ডলারের দাম কম থাকে তখন ডলার কিনে রাখতে হবে।
৩। চেংরাবান্ধা গিয়ে বেশি ডলার না ভাঙ্গানোই ভালো। কারণ শিলিগুড়ি শহরে ডলারের রেট কিছুটা বেশি। আর দার্জিলিং এ
ডলারের রেট কিন্তু কিছুটা কম। তাই শিলিগুড়ি থেকেই ভাঙ্গানোই উত্তম। আর যেখানে রেট বেশি, সেখান থেকে ডলার
ভাঙ্গান। তবে ডলারের রেট সকাল-বিকাল উঠা নামা করে এবং বড় শহরে ডলারের রেট সাধারণত বেশি পাওয়া যায়।
৪। খাবারের হোটেলগুলোতে দরদাম করে খাবেন। প্রয়োজনে অন্য হোটেলে যাবেন।
৫। ঘুরাঘুরির প্যাকেজ কিনতে দরদাম করুন। কারণ আশে-পাশে অনেক ট্রাভেল এজেন্ট পাবেন।
৬। ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করতে হোটেলের অথবা স্থানীয় ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করুন।
৭। সব সময় একসাথে গ্রুপ করে সব কিছু করুন। তাতে প্রায় সব কিছুতেই ডিসকাউন্ট পাবেন।
অবশেষে আমার এই লেখাতে কোন ভুল হলে ক্ষমা করবেন। তবে কোথায় ভুল হয়েছে তাহা জানালে সংশোধন হবো ও করবো। যে কোন পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করবো। যোগাযোগ করতে পারেন। ফোন : ০১৭১১-১০৬৯৭০, ০১৭১৩-৫৩২৩৬৩। ই-মেইল : ripon.kazi@gmail.com
আমার লেখা প্রথম ভ্রমণ কাহিনী-১
কম খরচে ঘুরে আসুন থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও পাতায়া ।
এই লিংকে পাবেন : http://freetouristguide24.blogspot.com/2017/10/blog-post.html
Enter your comment...বুড়িমারী বা পাটগ্রাম নীলফামারী জেলাতে না ভাই, লালমনিরহাট জেলায়।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteআমার অজান্তেই ভুল হয়েছে ভাই। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মঙ্গল কামনা করি।
Delete