ভ্রমণ কাহিনী-৩
কম খরচে ঘুরে আসুন মালয়েশিয়া
কাজী রিপন :
জীবন একটাই। কখন চলে যাবে কেউ জানে না। এই ছোট্ট জীবনে একটু সময় করে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী এই সুন্দর জগতটা একটু ঘুরে দেখুন। জীবনটাকে উপভোগ করুন। আর তাই আমার সকল বন্ধুদের জন্য কম খরচে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করার বিষয়ে তথ্য জানার জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াশ : এ পর্যায়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশ মালয়েশিয়ার কথা। এত অল্প সময়ে কিভাবে এই দেশটা এত উন্নত হলো। তাহা না দেখলে অনুমান করা যাবে না। আবার লাখ লাখ বাংলাদেশী এই দেশে এসে নানারকম কাজ করছে। তাই অনেকের কাছে মালয়েশিয়া স্বপ্নের দেশ। এখানে বিশ্বখ্যাত কিছু স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান আছে। যাহা দেখার জন্য প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখে লাখে পর্যটক আসে মালয়েশিয়াতে। বিশেষ করে কুয়ালামপুর সিটির এক সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ বিল্ডিং “টুইন টাওয়ার”, গ্যাংটিং হাইল্যান্ড ও জগৎখ্যাত পর্যটন দ্বীপ লংকাউই আইল্যান্ড অন্যতম। তাই কম খরচে কিভাবে এগুলো দেখা যায় তার কাহিনী এবার বলছি।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে আমরা মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। আমাদের বিমান ছিল মালিন্দো এয়ারলাইন্সের। যাওয়ার পথে ঢাকা থেকে আমাদের বিমান ছেড়েছিল রাত সোয়া ১০টায়। আমরা পরের দিন ভোরে মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে পৌছানোর পর আমরা যে বিষয়ের মুখোমুখি হলাম। তাহা দুঃখজনক হলেও সত্য। সেটি হচ্ছে, যেহেতু আমরা বাংলাদেশী। আর আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ মালয়েশিয়ায় গেছে কাজ করার জন্য। আবার অনেকে চোরা পথে মালয়েশিয়ায় গেছে। আবার কেউ আদম বেপারীদের খপ্পরে পড়ে সেখানে ভাল কাজ না পেয়ে পালিয়ে অন্য স্থানে কাজ করে, কেউবা বেড়ানোর জন্য ভিসা নিয়ে অথবা পড়া-লেখা করার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে পালিয়ে কাজ করে ইত্যাদি কারণে আমাদের বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়ান পুলিশ, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষ এয়ারপোর্টে ভাল চোখে দেখে না। ঐ বছর বাংলাদেশ থেকে যে কোন এয়ারলাইন্সের বিমান এলেই,তারা ঘিরে ধরতো বিমান থেকে নামার পরই। যাহোক, আমাদের বিমানটি এয়ারপোর্টে পৌছানোর পর আমরা গেট দিয়ে নেমে আসার পরই আমাদের থামিয়ে দিল ইমিগ্রেশন পুলিশ। তারা ফ্লাইটের সমস্ত বাংলাদেশী যাত্রীদের টার্মিনালের একপাশে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করালেন। যেমন টুরিস্ট ভিসা, কাজের ভিসা, ছাত্র ভিসা, বিজনেস ভিসা, চিকিৎসা ভিসা আর ট্রানজিট ভিসা ইত্যাদি করে লাইন করালেন। এরপর শুরু হলো জিঙ্গাসাবাদ। শেষে প্রথমে নারী ও শিশুদের ছেড়ে দিলেন, এরপর পর্যায়ক্রমে সবাইকে। আর যাদের বিষয়ে সন্দেহ হলো তাদেরকে তারা আলাদা স্থানে নিয়ে গেলো। যাহোক, আমরা এরপর ইমিগ্রেশনে এসে সবাই এক রকম ইন্টারভিউ দিয়ে, দেশে ফেরার এয়ার টিকিট, হোটেল বুকিং এর কাগজপত্র এবং কে কত ডলার এনেছি তাহা দেখিয়ে পাসপোর্টে সিল পেলাম অর্থাৎ ছাড়পত্র পেলাম। পরে টার্মিনালের ব্যাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে কাস্টমস্ এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অবশেষে এয়ারপোর্টের বাহিরের টার্মিনালে এলাম।
এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, আমাদের ঐ বিমানে প্রায় ১৫/১৬ জন যাত্রী ছিল। যারা রংপুর অঞ্চল থেকে এসেছিল। এরা সবাই অশিক্ষিত এবং মনেহয় ক্ষেতমজুর। তারা ইংরেজী তো দুরের কথা ভাল করে বাংলাও বলতে পারেন না। তারা মালয়েশিয়া এসেছে ট্রানজিট নিয়ে লিবিয়া যাবে। এরা যখন আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন মালয়েশিয়ান পুলিশ বার বার তাদেরকে চরম অপমান করে বলছিল যে, তোরা লিবিয়া যাবি পশ্চিম দিকে। এই পূর্ব দিয়ে মালয়েশিয়া আইসো কেনো। তারা তো কোন কথার উত্তর দিতে পারছে না। তখন তাদেরকে নিয়ে আমাদের সামনে নানারকম অপমান ও তামাসা করতে লাগলো। আমরা এ ঘটনায় খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। পুলিশরা ওই লিবিয়াগামীদের ইশারায় বলতে লাগলো, তোরা কি লিবিয়ায় যুদ্ধ করতে যাবি অথবা এইদেশে পালাবি ইত্যাদি। একপর্যায়ে পুলিশরা আমাদেরকে বললো, দেখুনতো উনারা যাবে লিবিয়া অথচ কেনো মালয়েশিয়া এসেছে ট্রানজিট নিতে। উনাদের দালাল বা এজেন্ট কোথায়, তাদেরকে জিঙ্গেস করুন। পরে আমাদের এক বন্ধু ওদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু তারা পরিস্কার কিছু বলতে পারলো না। তাই আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম ইমিগ্রেশনে। এ ঘটনা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিছু আদম বেপারীর খপ্পরে পড়ে এদেশের সহজ-সরল অনেক মানুষ বিদেশের এয়ারপোর্টে এমন ঘটনা ঘটায়। আর তার জন্য আমরা পুরা দেশের মানুষ বিদেশী এয়ারপোর্টে কিছুক্ষেত্রে অবহেলিত হই। তবে দিন এখন অনেক পাল্টে গেছে, গত কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঘুরে এলাম। এবার কিন্তু ওই আগের অবস্থা দেখিনি।
যাহোক, আমরা এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে কুয়ালামপুর যাওয়ার জন্য প্ল্যান করলাম। প্রসঙ্গত: কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালামপুর সিটির দুরত্ব প্রায় ৮৭ কিলোমিটার। টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ঢাকার সমান দুরত্ব। যাওয়ার জন্য বাস, ট্রেন, মেট্রোরেল, টেক্সিসহ নানারকম গাড়ি আছে। তবে সবচেয়ে কম খরচ হবে ট্রেনে। এরপর বাসে গেলে। আমরা যেহেতু গ্রুপে ৬ জন ছিলাম। তাই আমরা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করলাম। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, এই ৮৭ কিলোমিটার দুরত্ব যাওয়ার জন্য আমাদের মাত্র পৌনে এক ঘন্টা সময় লেগেছিল। আমাদের মাইক্রোবাসের ভাড়া ছিল ১৫০ রিঙ্গিত। আমরা কুয়ালামপুরের সকেট এলাকায় জালান রাজা রোডের থ্রি স্টার হোটেল সান্দারে উঠেছিলাম। হোটেলটি আমরা আগেই বুকিং করেছিলাম। ডাবল বেডের সুপিরিয়র রুমের ভাড়া ছিল ১২০ রিঙ্গিত। এই হোটেলটি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা রিসোর্টের মালিকের ছিল। আর সকেট এলাকা হচ্ছে কুয়ালামপুরের বিভিন্ন দেশের দুতাবাস এলাকা। অর্থাৎ ঢাকার গুলশান-বারিধারা-বনানীর মতো। আশে-পাশে সবকিছুরই একটু দাম বেশি। যাহোক, আমরা হোটেলে দুইদিনের জন্য উঠেছিলাম। হোটেল কাউন্টারে একজন বাংলাদেশী বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো। তিনি জানালেন যে, যেহেতু আমরা বাংলাদেশ থেকে বুকিং নিয়ে এসেছি তাই তিনি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের হোটেল ভাড়ায় ডিসকাউন্ট দিতে পারলেন না। বুকিং করে না আসলে ভাল ডিসকাউন্ট দিতে পারতেন। আমরা যথারীতি হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘুরাঘুরির জন্য বের হয়ে পড়লাম। বের হয়েই একটি মোবাইল সিম কিনলাম ৪জি নেটওয়ার্ক এর ইন্টারনেটসহ।
এবার ঘুরাঘুরি পালা : আমরা প্রথমেই টুইন টাওয়ার দেখার জন্য চলে গেলাম কেএলসি এলাকায়। সেখানে টুইন টাওয়ার, কেএলসি টাওয়ার ইত্যাদি ঘুরে দেখলাম। এখানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য টুইন টাওয়ার বা প্রেট্রোনার্স টাওয়ার। যা দেখার জন্য প্রতিদিন অগণিত দশনার্র্থী আসে। পরের দিন আবার পুর্তজায়া, মেনেরা ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখলাম। উঠলাম মেট্রোরেলে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয় যে, মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর সিটিতে সরকারি বাসে কোন ভাড়া লাগে না। তাই এই সরকারি বাসে ঘুরলে কোন টাকা খরচ হবে না। আর এই বাসে উঠে দেখলাম, মালয়েশিয়ান লোকের চেয়ে বিদেশী যাত্রীই বেশি উঠে আছে। এছাড়া এই বাসগুলি এসি বাস। আবার সাথে আছে ফ্রি ৪জি নেটওয়ার্কের ওয়াইফাই ইন্টারনেট। কাজেই বাসে ভাড়া নেই আবার ফ্রি ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে পারবেন। এতেই ভাবুন, ওরা আমাদের চেয়ে কত উন্নত। বাসগুলি কিছুদুর পর পর বিভিন্ন স্টপসে গিয়ে থামছে। দরজা খুলে যাচ্ছে। যাত্রী নামছে আবার উঠছে। বাসে শুধু ড্রাইভার আছে। কোন হেলপার বা কনট্রাকটর নাই। তবে বেসরকারি কোম্পানীর গাড়িও আছে। সেখানে ভাড়া লাগে।
যাহোক, পরের দিন আমরা চললাম সেই বিশ্বখ্যাত পর্যটন দ্বীপ লংকাউই আইল্যান্ড এর উদ্দেশ্যে। আমরা আগেই দেশ থেকে একসাথে রিটার্নসহ কুয়ালামপুর টু ঢাকা এবং কুয়ালামপুর টু লংকাউই আইল্যান্ড এর এয়ার টিকেট কিনেছিলাম। এখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, বন্ধুবর সাংবাদিক, বর্তমানে ঢাকাতে একটি টেলিভিশনের নিউজ এডিটর রনজক রিজভী ভাইয়ের প্রতি। তিনি আমাদের কম দামে সবগুলো এয়ার টিকেট কিনে দিয়েছিলেন। যাহোক, আমরা হোটেলের এর বুফেতে সকালের ফ্রি নানারকম নাস্তা খেয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম। কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট যেতে আমাদের মাইক্রোবাসে ভাড়া লাগলো ১২০ রিঙ্গিত। আমরা মালিন্দো এয়ারের বিমানে করে মাত্র এক ঘন্টায় পৌছে গেলাম সেই স্বপ্নের দ্বীপ লংকাউই আইল্যান্ডে। ছোট-বড় শতাধিক দ্বীপ নিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড। এটি বর্তমানে মালয়েশিয়ার শাসনাধীন একটি জেলা। আন্দামান সাগরের মাঝে প্রায় একশত ছোট-বড় দ্বীপ দিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড। এক সময় ব্রিটিশদের শাসনে, পরে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের শাসনে আর এখন মালয়েশিয়ার শাসনে আছে।
যাহোক, লংকাউই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। আন্দামান সাগরের মাঝে প্রায় একশত ছোট-বড় দ্বীপ দিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড। একমাত্র এই আইল্যান্ডের এয়ারপোর্ট থেকে আপনি অতি নিকটে বিমান দেখতে পাবেন এবং বিমানের নিকটে তাড়াতাড়ি ছবিও উঠাতে পারবেন। যাহা অন্য কোন এয়ারপোর্টে সম্ভব নয়। আমরা মালিন্দো এয়ারের একটি বোয়িং ৭৩৭ থেকে এয়ারপোর্টে নেমেই ছবি তুলেছি। এরপর আমরা একটি মাইক্রোবাস নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে পানতাই চেনাং বিচের সবচেয়ে ভাল ভিউ এলাকার এবি মোটেল এর দোতলার একটি ফ্যামিলি ফ্লাটে উঠলাম ৩ রাত থাকার জন্য। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে যে, যারা মালয়েশিয়া গিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড দেখেন নাই তাদের ট্যুর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ এই দ্বীপে এতো সুন্দর সুন্দর ঘুরার স্পট রয়েছে যে, যাহা না দেখলে মালয়েশিয়া ভ্রমনই বৃথা। এই আইল্যান্ড টুরিষ্টদের জন্য ফ্রি জোন এলাকা। এখানে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশের টুরিষ্টরা বেড়াতে আসেন। এছাড়া এই আইল্যান্ডের প্রায় সব দোকান ও মাকের্ট ডিউটি ফ্রি শপ। তাই সবকিছুর দাম এখানে অনেক কম। যারা গেছেন তারা এটা জানেন। এই দ্বীপে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে উচ্চ ক্যাবল কার রয়েছে, এছাড়া এখানে রয়েছে বড় ঈগল স্কয়ার, স্কাই ব্রিজ, বিশাল পাখির পার্ক, কুমির, বানর এর ফিডিং, ওয়াটার আইল্যান্ডসহ অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ঘুরে দেখার স্পট। আর এই দ্বীপের সবচেয়ে ব্যস্ত বিচ হচ্ছে পানতাই চেনাং বিচ। এই পানতাই চেনাং বিচের সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান হচ্ছে দুটি বিশাল ঝাউ গাছ এলাকা। আর এই গাছই আমাদের হোটেল এর জায়গায়। সুতরাং আমাদের এবি মোটেল থেকে সবকিছুই দেখা যায় অসাম। যাহোক, আমরা লংকাউই আইল্যান্ডে এবি মোটেলে উঠার পর ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়েই সবার মাথা খারাপ অবস্থা। বাহিরের এতো সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে সাথে সাথে বের হয়ে পড়ি। রাত অবধি ১০ টা পর্যন্ত ঘুরলাম। এরপর হোটেল এর সামনে থেকে পরের দিনের বেড়ানোর ট্যুর প্যাকেজ কিনলাম। পরেরদিন সকালে ট্যুর কোম্পানী সকাল ৮টার মধ্যে আমাদের স্পীড বোর্ড দিয়ে আন্দামান সাগরের মাঝে বিভিন্ন দ্বীপে নিয়ে গেল। এরপর স্বচ্ছ পানির বিচ, ঈগল ফিডিং এলাকা, মানকি ফিডিং এলাকা, টুকরা টুকরা পাহাড়সহ নানাস্পটে সারাদিন ঘুরালেন। দুপুরে তারা আমাদের একটি দ্বীপে নিয়ে লাঞ্চের খাবার প্যাকেট দিলেন। সারাদিন খুবই আনন্দ পেলাম। আর আনন্দের দৃশ্য কখন যে ক্যামেরাবন্দী করেছেন স্থানীয় কিছু ট্যুর কোম্পানীর লোক। তাহা কেউ জানে না। তবে ফিরে আসার সময় আপনার চোখের সামনে সেই ছবিগুলি প্রিন্ট করে সাজিয়ে রাখবে তারা। যদি আপনার পছন্দ হয় তবে স্মৃতি ধরে রাখতে আপনি ছবি কিনতে পারেন।
পরেরদিনের সকাল বেলা নাস্তা খেয়েই আমরা ঘুরতে চললাম। প্রথমে আমরা সেই এশিয়ার সবচেয়ে উচ্চ ক্যাবল কারে উঠার জন্য চললাম। ঐ ক্যাবল কারে উঠার জন্য পর্যটকদের দীর্ঘ লাইনের সারি। আমরা যথারীতি টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাবল কারে উঠলাম। ক্যাবল কারে ইউরোপ-আমেরিকার টুরিষ্টরাই বেশি। যাহোক, ক্যাবল কারে উঠে কেউ কেউ ভয়ে অস্থির। কেউ আবার চোখ বন্ধ করে রাখে। কারণ এতো উচুতে উঠছি যে, নিচে তাকালে মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। আর এই আইল্যান্ডের ভিতরে যে এতো উচু পাহাড় আছে তাহা ক্যাবল কারে না উঠলে জানতে পেতাম না। প্রায় মেঘের কাছাকাছি ক্যাবল কারের শেষ মাথা। মাঝখানে একটু বিশ্রামের জন্য ল্যান্ডিং স্টেশন আছে। সেখানে সবাই নেমে বিশ্রাম নেয়। পরে যারা আরো উপরে উঠতে চায় তারা আবার কারে উঠে উপরের ল্যান্ডিং স্টেশনে যায়। আর এখানে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার স্কাই ব্রিজ আছে। সেখানে সাহসীরাই ঘুরে দেখেন। তবে ক্যাবল কারের উপরের ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে পুরো লংকাউই আইল্যান্ডের ভিউ দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। আমরা মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়েছিলাম এবং আল্লাহ্রর নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম এতো সুন্দর জায়গা দেখার জন্য। এরপর নামার পথে কারে একটু ভয় করে প্রায় সবারই। তবে চীরদিন মনে থাকবে এই দৃশ্য। আর এই কারে উঠার দৃশ্য কখন যে ক্যামেরাবন্দী করেছেন স্থানীয় কিছু ট্যুর কোম্পানীর লোক। তাহা কেউ জানে না। তবে ফিরে আসার সময় আপনার চোখের সামনে সেই ছবিগুলি প্রিন্ট করে সাজিয়ে রাখবে তারা। যদি আপনার পছন্দ হয় তবে স্মৃতি ধরে রাখতে আপনি ছবি কিনতে পারেন। এরপর আমরা আরো কয়েকটি স্পটে ঘুরে ফিরে এলাম হোটেলে। পরেরদিন সকালে আবার ঘুরতে বের হলাম। প্রথমে গেলাম বিখ্যাত ঈগল স্কয়ারে। তারপর আরো কয়েকটি স্পট ঘুরলাম। এই আইল্যান্ডে ঘুরার অনেক স্পট থাকলেও খাবার হোটেল এর একটু সমস্যা আছে। বিশেষ করে আমাদের মতো বাংলাদেশীদের জন্য এখানে কোন খাবার হোটেল নাই। ইউরোপ-আমেরিকান খাবার, থাই-চাইনিজ এর অনেক হোটেল আছে। আমরা অনেক খুজে একটি ইন্ডিয়ান হোটেল পেয়েছিলাম। কিন্তু খাবারের আইটেম মোটেই ইন্ডিয়ান ছিল না। তাই এখানে কয়েকদিন আমাদের খাবার খেতে একটু অসুবিধা হয়েছে।
এবার এই আইল্যান্ডে কেনা-কাটার পালা। আগেই বলেছি, এই আইল্যান্ডের প্রায় সব দোকান ও মাকের্ট ডিউটি ফ্রি শপ। তাই সবকিছুর দাম এখানে অনেক কম। এছাড়া এখানে সবকিছুর দামই পণ্যের গায়ে লেখা আছে। তাই ধরদাম করতে হয় না। আমাদের গ্রুপের অনেকেই এখান থেকে শিশুদের চকলেট, বিভিন্ন খাবার, ব্যাগ, জুতা, পানীয় ইদ্যাদি কম দামে কিনে এনেছেন।
যাহোক, এবার লংকাউই আইল্যান্ড থেকে ফেরার পালা। পরেরদিন দুপুরে গেলাম এয়ারপোর্টে। মাত্র এক ঘন্টায় চলে এলাম কুয়ালামপুর এয়ারপোর্টে। লংকাউই আইল্যান্ডের এয়ারপোর্ট থেকেও সরাসরি বিভিন্ন দেশে যাওয়া যায়। যদিও আমরা লংকাউই আইল্যান্ড এ গিয়েছিলাম বিমানে। তবে এখানে সড়ক পথে আসা যায়। কুয়ালামপুর থেকে সরাসরি বাস এসে পরে বড় ফেরীতে সাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসে এই লংকাউই আইল্যান্ডে। তাই যারা কম টাকা খরচ করে এখানে যেতে চান তাদের জন্য বাস সার্ভিসই উত্তম। বাসে একদিনেই আপনি পৌছে যাবেন লংকাউই আইল্যান্ড।
যাহোক, আমরা কুয়ালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে আবার কুয়ালামপুর সিটিতে গেলাম। এবার আমরা উঠলাম সিটির সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা বুকিত বিনতানের হোটেল আওরাতে। এ সময় আমাদের এক বন্ধুর চাচা নাজমুল, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন। তিনি আমাদের সাথে যোগ দিলেন। নাজমুল চাচা, আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে মাকেটিং করার সময় তার পরামর্শ অনেক কাজে লেগেছে। তাই তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা সেখানে বাংলাদেশী খাবার এর হোটেল পেলাম কয়েকটি। যার মধ্যে একুশে খাবার হোটেল এর খাবার ভাল লেগেছে। কয়েকদিন পর দেশী খাবার খেয়ে খুব মজা পেলাম। এখানে সারারাতই শহর জেগে থাকে। নানারকম কর্মকান্ড চলে। আমরা রাতে ঘুরলাম এবং নানারকম কর্মকান্ড দেখলাম। পরেরদিন আমরা গ্যাংটিং হাইল্যান্ড দেখতে গেলাম। সাথে আরো কয়েকটি স্পট ঘুরলাম।
এবার কুয়ালামপুরে কেনাকাটার পালা। কুয়ালামপুর শহরে অনেক বিশাল বিশাল মার্কেট আছে। সব মাকের্টই বহুতলবিশিষ্ট। এরমধ্যে জিএম প্লাজা ও মাইডিন প্লাজায় কসমেটিকসহ নানারকম পণ্য পাইকারী মাকের্ট। এখানে দাম অনেক কম। আর ইলেকট্রনিক্স পণ্য কেনার জন্য লয়েড প্লাজাই শ্রেষ্ট। এখানে অরিজিনাল সব ব্রান্ডের মাল পাওয়া যায়। দামও কম। আর সোনার গহনার জন্য জালান মসজিদ রোডের ইন্ডিয়া মাকের্টের হানিফা আছে। বিশাল স্বর্ণের মাকের্ট। এখানে ভাল মানের ২৩ ক্যারেট পর্যন্ত স্বর্ণ পাওয়া যায়। আছে হাজার হাজার স্বর্ণের বিস্কুট। যা দেখে আপনার মাথা ঘুরে যাবে। বাংলাদেশের চেয়ে সোনার দাম ভরিতে প্রায় ৫/৭ হাজার টাকা কম। কিন্তু স্বর্ণ আনুন দেশের কাস্টমস এর নিয়ম অনুয়ায়ী। তা না হলে ধরা খাবেন। একটি কথা, মালয়েশিয়ায় খারাপ পণ্য নাই বললেই চলে। এছাড়া এখানে সবকিছুর দামই পণ্যের গায়ে লেখা আছে। তাই ধরদাম করতে হয় না। আর কম দামের জিনিসপত্র কেনার জন্য আছে চায়না মাকের্ট। এখানে বিভিন্ন ধরণের মাল পাওয়া যায়। তবে অনেক দোকানে বাংলাদেশী সেলসম্যান পাবেন। আমাদের সময়ে মালয়েশিয়ার রিঙ্গিতের বিনিময় হার ছিল প্রতি রিঙ্গিতে প্রায় ২৩ টাকা। বর্তমানে এই রেট কমে হয়েছে ১ রিঙ্গিত সমান ২০ টাকা।
এবার ফেরার পালা। পরের দিন আমরা যথারীতি একটি মাইক্রো নিয়ে কুয়ালামপুর এয়াপোর্টে চলে আসি। সন্ধায় আমাদের ফ্লাইট ছিল। আমরা ওই রাতেই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসি। পরে রাতেই বাড়ি চলে আসি। এ পর্যায়ে একজন বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তার নাম জাকির ভাই। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। তিনিও মালয়েশিয়াতে সেই সময়ে ছিলেন পড়ালেখা করতে। তিনি আমাদের অনেক বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। আরও একটি বিষয় বলতেই হয় যে, মালয়েশিয়ার পথে-ঘাটে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশী শ্রমিকরা কাজ করছে। বিশেষ করে, ক্ষেত-খামারে, নির্মাণ কাজে, দোকানে, হোটেলে, রেস্টুরেন্টে। এরা অনেক পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে কথা হয়েছে। তাদের প্রতি রইল আমার লাখো সালাম ও স্যালুট। আবার অনেকে রাস্তাÑঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাজ না পেয়ে। যারা সম্মানের জন্যে দেশে আসছে না। তাদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করছি।
কম খরচের কিছু তথ্য :
১। প্রথমেই কোন দেশ ঘুরার জন্য এয়ার টিকেটই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দামী। তাই বর্তমানে যত আগে এয়ার টিকেট কিনবেন তত কম দামে পাবেন। অর্থাৎ আপনি ইচ্ছে করলে প্রায় এক বছর আগেও এয়ার টিকেট কিনতে পারবেন। এয়ার টিকেট অবশ্যই রির্টানসহ কিনবেন। এছাড়া বছরে বিভিন্ন বিমান সংস্থা ফেয়ার দিয়ে থাকে। সে সময়ে টিকিটও প্রায় অর্ধেক দামে পাওয়া যায়। বিশেষ করে রিজেন্ট এয়ারলাইন্স ও মালিনদো এয়ারলাইন্স বছরে একটি নিদিষ্ট মাসে ফেয়ার দিয়ে থাকে। তখন প্রায় অর্ধেক রেটে এয়ার টিকেট কিনে সারা বছরব্যাপি ভ্রমণ করা যায়। কাজেই এই সুযোগ কাজে লাগান।
২। ভিসা ফ্রি ও ভিসা ছাড়া ভ্রমন করা যায় এমন দেশ সম্পর্কে আপনার জানা থাকতে হবে। আর ভিসা ফ্রি সবচেয়ে কম খরচে করে (আমার দেখা) ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সী আছে। (নাম বললাম না, বললে এ্যাড. হয়ে যাবে)। অনেকে ভিসা ফ্রি সাধারণ রেটের চেয়ে এক থেকে দুই হাজার টাকা বেশি নিয়ে থাকে। তাই দরদাম করে ভিসা করতে হবে।
৩। আগেই বলেছি গ্রুপে বেশি লোক হলে খরচও কম হবে। তবে মিনিমাম দুইজন হতে হবে।
৪। বাজারে যখন ডলারের দাম কম থাকে তখন ডলার কিনে রাখতে হবে।
৫। বিদেশে গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ডলার না ভাঙ্গানোই ভালো। কারণ এয়ারপোর্টে ডলারের রেট কিছুটা কম থাকে। তাই ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা কম দেয়।
৬। আপনার হোটেলের আশে-পাশে অনেক মানি এক্সচেঞ্জ দোকান পাবেন। যেখানে রেট বেশি, সেখান থেকে ডলার ভাঙ্গান। তবে ডলারের রেট সকাল-বিকাল উঠা নামা করে এবং বড় শহরে ডলারের রেট সাধারণত বেশি পাওয়া যায়।
৭। খাবারের হোটেলগুলোতে দরদাম করে খাবেন। প্রয়োজনে অন্য হোটেলে যাবেন।
৮। ঘুরাঘুরির প্যাকেজ কিনতে দরদাম করুন। কারণ আশে-পাশে অনেক ট্রাভেল এজেন্ট পাবেন।
৯। ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করতে হোটেলের অথবা স্থানীয় ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করুন।
১০। কুয়ালামপুর সিটিতে ঘুরতে সরকারি বাস ব্যবহার করুন। এতে ভাড়া লাগবে না।
১১। সব সময় একসাথে গ্রুপ করে সব কিছু করুন। তাতে প্রায় সব কিছুতেই ডিসকাউন্ট পাবেন।
অবশেষে আমার এই লেখাতে কোন ভুল হলে ক্ষমা করবেন। তবে কোথায় ভুল হয়েছে তাহা জানালে সংশোধন হবো ও করবো। যে কোন পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করবো। যোগাযোগ করতে পারেন। ফোন : ০১৭১১-১০৬৯৭০, ০১৭১৩-৫৩২৩৬৩। ই-মেইল : ripon.kazi@gmail.com
আমার লেখা :
ভ্রমণ কাহিনী-১
কম খরচে ঘুরে আসুন থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও পাতায়া ।
ভ্রমণ কাহিনী-২
ঘুরে আসুন ভারতের হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং
কম খরচে ঘুরে আসুন মালয়েশিয়া
কাজী রিপন :
জীবন একটাই। কখন চলে যাবে কেউ জানে না। এই ছোট্ট জীবনে একটু সময় করে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী এই সুন্দর জগতটা একটু ঘুরে দেখুন। জীবনটাকে উপভোগ করুন। আর তাই আমার সকল বন্ধুদের জন্য কম খরচে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করার বিষয়ে তথ্য জানার জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াশ : এ পর্যায়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশ মালয়েশিয়ার কথা। এত অল্প সময়ে কিভাবে এই দেশটা এত উন্নত হলো। তাহা না দেখলে অনুমান করা যাবে না। আবার লাখ লাখ বাংলাদেশী এই দেশে এসে নানারকম কাজ করছে। তাই অনেকের কাছে মালয়েশিয়া স্বপ্নের দেশ। এখানে বিশ্বখ্যাত কিছু স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান আছে। যাহা দেখার জন্য প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখে লাখে পর্যটক আসে মালয়েশিয়াতে। বিশেষ করে কুয়ালামপুর সিটির এক সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ বিল্ডিং “টুইন টাওয়ার”, গ্যাংটিং হাইল্যান্ড ও জগৎখ্যাত পর্যটন দ্বীপ লংকাউই আইল্যান্ড অন্যতম। তাই কম খরচে কিভাবে এগুলো দেখা যায় তার কাহিনী এবার বলছি।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে আমরা মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। আমাদের বিমান ছিল মালিন্দো এয়ারলাইন্সের। যাওয়ার পথে ঢাকা থেকে আমাদের বিমান ছেড়েছিল রাত সোয়া ১০টায়। আমরা পরের দিন ভোরে মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে পৌছানোর পর আমরা যে বিষয়ের মুখোমুখি হলাম। তাহা দুঃখজনক হলেও সত্য। সেটি হচ্ছে, যেহেতু আমরা বাংলাদেশী। আর আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ মালয়েশিয়ায় গেছে কাজ করার জন্য। আবার অনেকে চোরা পথে মালয়েশিয়ায় গেছে। আবার কেউ আদম বেপারীদের খপ্পরে পড়ে সেখানে ভাল কাজ না পেয়ে পালিয়ে অন্য স্থানে কাজ করে, কেউবা বেড়ানোর জন্য ভিসা নিয়ে অথবা পড়া-লেখা করার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে পালিয়ে কাজ করে ইত্যাদি কারণে আমাদের বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়ান পুলিশ, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষ এয়ারপোর্টে ভাল চোখে দেখে না। ঐ বছর বাংলাদেশ থেকে যে কোন এয়ারলাইন্সের বিমান এলেই,তারা ঘিরে ধরতো বিমান থেকে নামার পরই। যাহোক, আমাদের বিমানটি এয়ারপোর্টে পৌছানোর পর আমরা গেট দিয়ে নেমে আসার পরই আমাদের থামিয়ে দিল ইমিগ্রেশন পুলিশ। তারা ফ্লাইটের সমস্ত বাংলাদেশী যাত্রীদের টার্মিনালের একপাশে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করালেন। যেমন টুরিস্ট ভিসা, কাজের ভিসা, ছাত্র ভিসা, বিজনেস ভিসা, চিকিৎসা ভিসা আর ট্রানজিট ভিসা ইত্যাদি করে লাইন করালেন। এরপর শুরু হলো জিঙ্গাসাবাদ। শেষে প্রথমে নারী ও শিশুদের ছেড়ে দিলেন, এরপর পর্যায়ক্রমে সবাইকে। আর যাদের বিষয়ে সন্দেহ হলো তাদেরকে তারা আলাদা স্থানে নিয়ে গেলো। যাহোক, আমরা এরপর ইমিগ্রেশনে এসে সবাই এক রকম ইন্টারভিউ দিয়ে, দেশে ফেরার এয়ার টিকিট, হোটেল বুকিং এর কাগজপত্র এবং কে কত ডলার এনেছি তাহা দেখিয়ে পাসপোর্টে সিল পেলাম অর্থাৎ ছাড়পত্র পেলাম। পরে টার্মিনালের ব্যাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে কাস্টমস্ এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অবশেষে এয়ারপোর্টের বাহিরের টার্মিনালে এলাম।
এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, আমাদের ঐ বিমানে প্রায় ১৫/১৬ জন যাত্রী ছিল। যারা রংপুর অঞ্চল থেকে এসেছিল। এরা সবাই অশিক্ষিত এবং মনেহয় ক্ষেতমজুর। তারা ইংরেজী তো দুরের কথা ভাল করে বাংলাও বলতে পারেন না। তারা মালয়েশিয়া এসেছে ট্রানজিট নিয়ে লিবিয়া যাবে। এরা যখন আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন মালয়েশিয়ান পুলিশ বার বার তাদেরকে চরম অপমান করে বলছিল যে, তোরা লিবিয়া যাবি পশ্চিম দিকে। এই পূর্ব দিয়ে মালয়েশিয়া আইসো কেনো। তারা তো কোন কথার উত্তর দিতে পারছে না। তখন তাদেরকে নিয়ে আমাদের সামনে নানারকম অপমান ও তামাসা করতে লাগলো। আমরা এ ঘটনায় খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। পুলিশরা ওই লিবিয়াগামীদের ইশারায় বলতে লাগলো, তোরা কি লিবিয়ায় যুদ্ধ করতে যাবি অথবা এইদেশে পালাবি ইত্যাদি। একপর্যায়ে পুলিশরা আমাদেরকে বললো, দেখুনতো উনারা যাবে লিবিয়া অথচ কেনো মালয়েশিয়া এসেছে ট্রানজিট নিতে। উনাদের দালাল বা এজেন্ট কোথায়, তাদেরকে জিঙ্গেস করুন। পরে আমাদের এক বন্ধু ওদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু তারা পরিস্কার কিছু বলতে পারলো না। তাই আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম ইমিগ্রেশনে। এ ঘটনা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিছু আদম বেপারীর খপ্পরে পড়ে এদেশের সহজ-সরল অনেক মানুষ বিদেশের এয়ারপোর্টে এমন ঘটনা ঘটায়। আর তার জন্য আমরা পুরা দেশের মানুষ বিদেশী এয়ারপোর্টে কিছুক্ষেত্রে অবহেলিত হই। তবে দিন এখন অনেক পাল্টে গেছে, গত কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঘুরে এলাম। এবার কিন্তু ওই আগের অবস্থা দেখিনি।
যাহোক, আমরা এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে কুয়ালামপুর যাওয়ার জন্য প্ল্যান করলাম। প্রসঙ্গত: কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালামপুর সিটির দুরত্ব প্রায় ৮৭ কিলোমিটার। টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ঢাকার সমান দুরত্ব। যাওয়ার জন্য বাস, ট্রেন, মেট্রোরেল, টেক্সিসহ নানারকম গাড়ি আছে। তবে সবচেয়ে কম খরচ হবে ট্রেনে। এরপর বাসে গেলে। আমরা যেহেতু গ্রুপে ৬ জন ছিলাম। তাই আমরা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করলাম। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, এই ৮৭ কিলোমিটার দুরত্ব যাওয়ার জন্য আমাদের মাত্র পৌনে এক ঘন্টা সময় লেগেছিল। আমাদের মাইক্রোবাসের ভাড়া ছিল ১৫০ রিঙ্গিত। আমরা কুয়ালামপুরের সকেট এলাকায় জালান রাজা রোডের থ্রি স্টার হোটেল সান্দারে উঠেছিলাম। হোটেলটি আমরা আগেই বুকিং করেছিলাম। ডাবল বেডের সুপিরিয়র রুমের ভাড়া ছিল ১২০ রিঙ্গিত। এই হোটেলটি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা রিসোর্টের মালিকের ছিল। আর সকেট এলাকা হচ্ছে কুয়ালামপুরের বিভিন্ন দেশের দুতাবাস এলাকা। অর্থাৎ ঢাকার গুলশান-বারিধারা-বনানীর মতো। আশে-পাশে সবকিছুরই একটু দাম বেশি। যাহোক, আমরা হোটেলে দুইদিনের জন্য উঠেছিলাম। হোটেল কাউন্টারে একজন বাংলাদেশী বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো। তিনি জানালেন যে, যেহেতু আমরা বাংলাদেশ থেকে বুকিং নিয়ে এসেছি তাই তিনি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের হোটেল ভাড়ায় ডিসকাউন্ট দিতে পারলেন না। বুকিং করে না আসলে ভাল ডিসকাউন্ট দিতে পারতেন। আমরা যথারীতি হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘুরাঘুরির জন্য বের হয়ে পড়লাম। বের হয়েই একটি মোবাইল সিম কিনলাম ৪জি নেটওয়ার্ক এর ইন্টারনেটসহ।
এবার ঘুরাঘুরি পালা : আমরা প্রথমেই টুইন টাওয়ার দেখার জন্য চলে গেলাম কেএলসি এলাকায়। সেখানে টুইন টাওয়ার, কেএলসি টাওয়ার ইত্যাদি ঘুরে দেখলাম। এখানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য টুইন টাওয়ার বা প্রেট্রোনার্স টাওয়ার। যা দেখার জন্য প্রতিদিন অগণিত দশনার্র্থী আসে। পরের দিন আবার পুর্তজায়া, মেনেরা ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখলাম। উঠলাম মেট্রোরেলে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয় যে, মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর সিটিতে সরকারি বাসে কোন ভাড়া লাগে না। তাই এই সরকারি বাসে ঘুরলে কোন টাকা খরচ হবে না। আর এই বাসে উঠে দেখলাম, মালয়েশিয়ান লোকের চেয়ে বিদেশী যাত্রীই বেশি উঠে আছে। এছাড়া এই বাসগুলি এসি বাস। আবার সাথে আছে ফ্রি ৪জি নেটওয়ার্কের ওয়াইফাই ইন্টারনেট। কাজেই বাসে ভাড়া নেই আবার ফ্রি ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে পারবেন। এতেই ভাবুন, ওরা আমাদের চেয়ে কত উন্নত। বাসগুলি কিছুদুর পর পর বিভিন্ন স্টপসে গিয়ে থামছে। দরজা খুলে যাচ্ছে। যাত্রী নামছে আবার উঠছে। বাসে শুধু ড্রাইভার আছে। কোন হেলপার বা কনট্রাকটর নাই। তবে বেসরকারি কোম্পানীর গাড়িও আছে। সেখানে ভাড়া লাগে।
যাহোক, পরের দিন আমরা চললাম সেই বিশ্বখ্যাত পর্যটন দ্বীপ লংকাউই আইল্যান্ড এর উদ্দেশ্যে। আমরা আগেই দেশ থেকে একসাথে রিটার্নসহ কুয়ালামপুর টু ঢাকা এবং কুয়ালামপুর টু লংকাউই আইল্যান্ড এর এয়ার টিকেট কিনেছিলাম। এখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, বন্ধুবর সাংবাদিক, বর্তমানে ঢাকাতে একটি টেলিভিশনের নিউজ এডিটর রনজক রিজভী ভাইয়ের প্রতি। তিনি আমাদের কম দামে সবগুলো এয়ার টিকেট কিনে দিয়েছিলেন। যাহোক, আমরা হোটেলের এর বুফেতে সকালের ফ্রি নানারকম নাস্তা খেয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম। কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট যেতে আমাদের মাইক্রোবাসে ভাড়া লাগলো ১২০ রিঙ্গিত। আমরা মালিন্দো এয়ারের বিমানে করে মাত্র এক ঘন্টায় পৌছে গেলাম সেই স্বপ্নের দ্বীপ লংকাউই আইল্যান্ডে। ছোট-বড় শতাধিক দ্বীপ নিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড। এটি বর্তমানে মালয়েশিয়ার শাসনাধীন একটি জেলা। আন্দামান সাগরের মাঝে প্রায় একশত ছোট-বড় দ্বীপ দিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড। এক সময় ব্রিটিশদের শাসনে, পরে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের শাসনে আর এখন মালয়েশিয়ার শাসনে আছে।
যাহোক, লংকাউই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। আন্দামান সাগরের মাঝে প্রায় একশত ছোট-বড় দ্বীপ দিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড। একমাত্র এই আইল্যান্ডের এয়ারপোর্ট থেকে আপনি অতি নিকটে বিমান দেখতে পাবেন এবং বিমানের নিকটে তাড়াতাড়ি ছবিও উঠাতে পারবেন। যাহা অন্য কোন এয়ারপোর্টে সম্ভব নয়। আমরা মালিন্দো এয়ারের একটি বোয়িং ৭৩৭ থেকে এয়ারপোর্টে নেমেই ছবি তুলেছি। এরপর আমরা একটি মাইক্রোবাস নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে পানতাই চেনাং বিচের সবচেয়ে ভাল ভিউ এলাকার এবি মোটেল এর দোতলার একটি ফ্যামিলি ফ্লাটে উঠলাম ৩ রাত থাকার জন্য। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে যে, যারা মালয়েশিয়া গিয়ে লংকাউই আইল্যান্ড দেখেন নাই তাদের ট্যুর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ এই দ্বীপে এতো সুন্দর সুন্দর ঘুরার স্পট রয়েছে যে, যাহা না দেখলে মালয়েশিয়া ভ্রমনই বৃথা। এই আইল্যান্ড টুরিষ্টদের জন্য ফ্রি জোন এলাকা। এখানে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশের টুরিষ্টরা বেড়াতে আসেন। এছাড়া এই আইল্যান্ডের প্রায় সব দোকান ও মাকের্ট ডিউটি ফ্রি শপ। তাই সবকিছুর দাম এখানে অনেক কম। যারা গেছেন তারা এটা জানেন। এই দ্বীপে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে উচ্চ ক্যাবল কার রয়েছে, এছাড়া এখানে রয়েছে বড় ঈগল স্কয়ার, স্কাই ব্রিজ, বিশাল পাখির পার্ক, কুমির, বানর এর ফিডিং, ওয়াটার আইল্যান্ডসহ অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ঘুরে দেখার স্পট। আর এই দ্বীপের সবচেয়ে ব্যস্ত বিচ হচ্ছে পানতাই চেনাং বিচ। এই পানতাই চেনাং বিচের সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান হচ্ছে দুটি বিশাল ঝাউ গাছ এলাকা। আর এই গাছই আমাদের হোটেল এর জায়গায়। সুতরাং আমাদের এবি মোটেল থেকে সবকিছুই দেখা যায় অসাম। যাহোক, আমরা লংকাউই আইল্যান্ডে এবি মোটেলে উঠার পর ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়েই সবার মাথা খারাপ অবস্থা। বাহিরের এতো সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে সাথে সাথে বের হয়ে পড়ি। রাত অবধি ১০ টা পর্যন্ত ঘুরলাম। এরপর হোটেল এর সামনে থেকে পরের দিনের বেড়ানোর ট্যুর প্যাকেজ কিনলাম। পরেরদিন সকালে ট্যুর কোম্পানী সকাল ৮টার মধ্যে আমাদের স্পীড বোর্ড দিয়ে আন্দামান সাগরের মাঝে বিভিন্ন দ্বীপে নিয়ে গেল। এরপর স্বচ্ছ পানির বিচ, ঈগল ফিডিং এলাকা, মানকি ফিডিং এলাকা, টুকরা টুকরা পাহাড়সহ নানাস্পটে সারাদিন ঘুরালেন। দুপুরে তারা আমাদের একটি দ্বীপে নিয়ে লাঞ্চের খাবার প্যাকেট দিলেন। সারাদিন খুবই আনন্দ পেলাম। আর আনন্দের দৃশ্য কখন যে ক্যামেরাবন্দী করেছেন স্থানীয় কিছু ট্যুর কোম্পানীর লোক। তাহা কেউ জানে না। তবে ফিরে আসার সময় আপনার চোখের সামনে সেই ছবিগুলি প্রিন্ট করে সাজিয়ে রাখবে তারা। যদি আপনার পছন্দ হয় তবে স্মৃতি ধরে রাখতে আপনি ছবি কিনতে পারেন।
পরেরদিনের সকাল বেলা নাস্তা খেয়েই আমরা ঘুরতে চললাম। প্রথমে আমরা সেই এশিয়ার সবচেয়ে উচ্চ ক্যাবল কারে উঠার জন্য চললাম। ঐ ক্যাবল কারে উঠার জন্য পর্যটকদের দীর্ঘ লাইনের সারি। আমরা যথারীতি টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাবল কারে উঠলাম। ক্যাবল কারে ইউরোপ-আমেরিকার টুরিষ্টরাই বেশি। যাহোক, ক্যাবল কারে উঠে কেউ কেউ ভয়ে অস্থির। কেউ আবার চোখ বন্ধ করে রাখে। কারণ এতো উচুতে উঠছি যে, নিচে তাকালে মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। আর এই আইল্যান্ডের ভিতরে যে এতো উচু পাহাড় আছে তাহা ক্যাবল কারে না উঠলে জানতে পেতাম না। প্রায় মেঘের কাছাকাছি ক্যাবল কারের শেষ মাথা। মাঝখানে একটু বিশ্রামের জন্য ল্যান্ডিং স্টেশন আছে। সেখানে সবাই নেমে বিশ্রাম নেয়। পরে যারা আরো উপরে উঠতে চায় তারা আবার কারে উঠে উপরের ল্যান্ডিং স্টেশনে যায়। আর এখানে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার স্কাই ব্রিজ আছে। সেখানে সাহসীরাই ঘুরে দেখেন। তবে ক্যাবল কারের উপরের ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে পুরো লংকাউই আইল্যান্ডের ভিউ দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। আমরা মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়েছিলাম এবং আল্লাহ্রর নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম এতো সুন্দর জায়গা দেখার জন্য। এরপর নামার পথে কারে একটু ভয় করে প্রায় সবারই। তবে চীরদিন মনে থাকবে এই দৃশ্য। আর এই কারে উঠার দৃশ্য কখন যে ক্যামেরাবন্দী করেছেন স্থানীয় কিছু ট্যুর কোম্পানীর লোক। তাহা কেউ জানে না। তবে ফিরে আসার সময় আপনার চোখের সামনে সেই ছবিগুলি প্রিন্ট করে সাজিয়ে রাখবে তারা। যদি আপনার পছন্দ হয় তবে স্মৃতি ধরে রাখতে আপনি ছবি কিনতে পারেন। এরপর আমরা আরো কয়েকটি স্পটে ঘুরে ফিরে এলাম হোটেলে। পরেরদিন সকালে আবার ঘুরতে বের হলাম। প্রথমে গেলাম বিখ্যাত ঈগল স্কয়ারে। তারপর আরো কয়েকটি স্পট ঘুরলাম। এই আইল্যান্ডে ঘুরার অনেক স্পট থাকলেও খাবার হোটেল এর একটু সমস্যা আছে। বিশেষ করে আমাদের মতো বাংলাদেশীদের জন্য এখানে কোন খাবার হোটেল নাই। ইউরোপ-আমেরিকান খাবার, থাই-চাইনিজ এর অনেক হোটেল আছে। আমরা অনেক খুজে একটি ইন্ডিয়ান হোটেল পেয়েছিলাম। কিন্তু খাবারের আইটেম মোটেই ইন্ডিয়ান ছিল না। তাই এখানে কয়েকদিন আমাদের খাবার খেতে একটু অসুবিধা হয়েছে।
এবার এই আইল্যান্ডে কেনা-কাটার পালা। আগেই বলেছি, এই আইল্যান্ডের প্রায় সব দোকান ও মাকের্ট ডিউটি ফ্রি শপ। তাই সবকিছুর দাম এখানে অনেক কম। এছাড়া এখানে সবকিছুর দামই পণ্যের গায়ে লেখা আছে। তাই ধরদাম করতে হয় না। আমাদের গ্রুপের অনেকেই এখান থেকে শিশুদের চকলেট, বিভিন্ন খাবার, ব্যাগ, জুতা, পানীয় ইদ্যাদি কম দামে কিনে এনেছেন।
যাহোক, এবার লংকাউই আইল্যান্ড থেকে ফেরার পালা। পরেরদিন দুপুরে গেলাম এয়ারপোর্টে। মাত্র এক ঘন্টায় চলে এলাম কুয়ালামপুর এয়ারপোর্টে। লংকাউই আইল্যান্ডের এয়ারপোর্ট থেকেও সরাসরি বিভিন্ন দেশে যাওয়া যায়। যদিও আমরা লংকাউই আইল্যান্ড এ গিয়েছিলাম বিমানে। তবে এখানে সড়ক পথে আসা যায়। কুয়ালামপুর থেকে সরাসরি বাস এসে পরে বড় ফেরীতে সাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসে এই লংকাউই আইল্যান্ডে। তাই যারা কম টাকা খরচ করে এখানে যেতে চান তাদের জন্য বাস সার্ভিসই উত্তম। বাসে একদিনেই আপনি পৌছে যাবেন লংকাউই আইল্যান্ড।
যাহোক, আমরা কুয়ালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে আবার কুয়ালামপুর সিটিতে গেলাম। এবার আমরা উঠলাম সিটির সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা বুকিত বিনতানের হোটেল আওরাতে। এ সময় আমাদের এক বন্ধুর চাচা নাজমুল, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন। তিনি আমাদের সাথে যোগ দিলেন। নাজমুল চাচা, আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে মাকেটিং করার সময় তার পরামর্শ অনেক কাজে লেগেছে। তাই তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা সেখানে বাংলাদেশী খাবার এর হোটেল পেলাম কয়েকটি। যার মধ্যে একুশে খাবার হোটেল এর খাবার ভাল লেগেছে। কয়েকদিন পর দেশী খাবার খেয়ে খুব মজা পেলাম। এখানে সারারাতই শহর জেগে থাকে। নানারকম কর্মকান্ড চলে। আমরা রাতে ঘুরলাম এবং নানারকম কর্মকান্ড দেখলাম। পরেরদিন আমরা গ্যাংটিং হাইল্যান্ড দেখতে গেলাম। সাথে আরো কয়েকটি স্পট ঘুরলাম।
এবার কুয়ালামপুরে কেনাকাটার পালা। কুয়ালামপুর শহরে অনেক বিশাল বিশাল মার্কেট আছে। সব মাকের্টই বহুতলবিশিষ্ট। এরমধ্যে জিএম প্লাজা ও মাইডিন প্লাজায় কসমেটিকসহ নানারকম পণ্য পাইকারী মাকের্ট। এখানে দাম অনেক কম। আর ইলেকট্রনিক্স পণ্য কেনার জন্য লয়েড প্লাজাই শ্রেষ্ট। এখানে অরিজিনাল সব ব্রান্ডের মাল পাওয়া যায়। দামও কম। আর সোনার গহনার জন্য জালান মসজিদ রোডের ইন্ডিয়া মাকের্টের হানিফা আছে। বিশাল স্বর্ণের মাকের্ট। এখানে ভাল মানের ২৩ ক্যারেট পর্যন্ত স্বর্ণ পাওয়া যায়। আছে হাজার হাজার স্বর্ণের বিস্কুট। যা দেখে আপনার মাথা ঘুরে যাবে। বাংলাদেশের চেয়ে সোনার দাম ভরিতে প্রায় ৫/৭ হাজার টাকা কম। কিন্তু স্বর্ণ আনুন দেশের কাস্টমস এর নিয়ম অনুয়ায়ী। তা না হলে ধরা খাবেন। একটি কথা, মালয়েশিয়ায় খারাপ পণ্য নাই বললেই চলে। এছাড়া এখানে সবকিছুর দামই পণ্যের গায়ে লেখা আছে। তাই ধরদাম করতে হয় না। আর কম দামের জিনিসপত্র কেনার জন্য আছে চায়না মাকের্ট। এখানে বিভিন্ন ধরণের মাল পাওয়া যায়। তবে অনেক দোকানে বাংলাদেশী সেলসম্যান পাবেন। আমাদের সময়ে মালয়েশিয়ার রিঙ্গিতের বিনিময় হার ছিল প্রতি রিঙ্গিতে প্রায় ২৩ টাকা। বর্তমানে এই রেট কমে হয়েছে ১ রিঙ্গিত সমান ২০ টাকা।
এবার ফেরার পালা। পরের দিন আমরা যথারীতি একটি মাইক্রো নিয়ে কুয়ালামপুর এয়াপোর্টে চলে আসি। সন্ধায় আমাদের ফ্লাইট ছিল। আমরা ওই রাতেই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসি। পরে রাতেই বাড়ি চলে আসি। এ পর্যায়ে একজন বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তার নাম জাকির ভাই। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। তিনিও মালয়েশিয়াতে সেই সময়ে ছিলেন পড়ালেখা করতে। তিনি আমাদের অনেক বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। আরও একটি বিষয় বলতেই হয় যে, মালয়েশিয়ার পথে-ঘাটে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশী শ্রমিকরা কাজ করছে। বিশেষ করে, ক্ষেত-খামারে, নির্মাণ কাজে, দোকানে, হোটেলে, রেস্টুরেন্টে। এরা অনেক পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে কথা হয়েছে। তাদের প্রতি রইল আমার লাখো সালাম ও স্যালুট। আবার অনেকে রাস্তাÑঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাজ না পেয়ে। যারা সম্মানের জন্যে দেশে আসছে না। তাদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করছি।
কম খরচের কিছু তথ্য :
১। প্রথমেই কোন দেশ ঘুরার জন্য এয়ার টিকেটই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দামী। তাই বর্তমানে যত আগে এয়ার টিকেট কিনবেন তত কম দামে পাবেন। অর্থাৎ আপনি ইচ্ছে করলে প্রায় এক বছর আগেও এয়ার টিকেট কিনতে পারবেন। এয়ার টিকেট অবশ্যই রির্টানসহ কিনবেন। এছাড়া বছরে বিভিন্ন বিমান সংস্থা ফেয়ার দিয়ে থাকে। সে সময়ে টিকিটও প্রায় অর্ধেক দামে পাওয়া যায়। বিশেষ করে রিজেন্ট এয়ারলাইন্স ও মালিনদো এয়ারলাইন্স বছরে একটি নিদিষ্ট মাসে ফেয়ার দিয়ে থাকে। তখন প্রায় অর্ধেক রেটে এয়ার টিকেট কিনে সারা বছরব্যাপি ভ্রমণ করা যায়। কাজেই এই সুযোগ কাজে লাগান।
২। ভিসা ফ্রি ও ভিসা ছাড়া ভ্রমন করা যায় এমন দেশ সম্পর্কে আপনার জানা থাকতে হবে। আর ভিসা ফ্রি সবচেয়ে কম খরচে করে (আমার দেখা) ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সী আছে। (নাম বললাম না, বললে এ্যাড. হয়ে যাবে)। অনেকে ভিসা ফ্রি সাধারণ রেটের চেয়ে এক থেকে দুই হাজার টাকা বেশি নিয়ে থাকে। তাই দরদাম করে ভিসা করতে হবে।
৩। আগেই বলেছি গ্রুপে বেশি লোক হলে খরচও কম হবে। তবে মিনিমাম দুইজন হতে হবে।
৪। বাজারে যখন ডলারের দাম কম থাকে তখন ডলার কিনে রাখতে হবে।
৫। বিদেশে গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ডলার না ভাঙ্গানোই ভালো। কারণ এয়ারপোর্টে ডলারের রেট কিছুটা কম থাকে। তাই ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা কম দেয়।
৬। আপনার হোটেলের আশে-পাশে অনেক মানি এক্সচেঞ্জ দোকান পাবেন। যেখানে রেট বেশি, সেখান থেকে ডলার ভাঙ্গান। তবে ডলারের রেট সকাল-বিকাল উঠা নামা করে এবং বড় শহরে ডলারের রেট সাধারণত বেশি পাওয়া যায়।
৭। খাবারের হোটেলগুলোতে দরদাম করে খাবেন। প্রয়োজনে অন্য হোটেলে যাবেন।
৮। ঘুরাঘুরির প্যাকেজ কিনতে দরদাম করুন। কারণ আশে-পাশে অনেক ট্রাভেল এজেন্ট পাবেন।
৯। ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করতে হোটেলের অথবা স্থানীয় ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করুন।
১০। কুয়ালামপুর সিটিতে ঘুরতে সরকারি বাস ব্যবহার করুন। এতে ভাড়া লাগবে না।
১১। সব সময় একসাথে গ্রুপ করে সব কিছু করুন। তাতে প্রায় সব কিছুতেই ডিসকাউন্ট পাবেন।
অবশেষে আমার এই লেখাতে কোন ভুল হলে ক্ষমা করবেন। তবে কোথায় ভুল হয়েছে তাহা জানালে সংশোধন হবো ও করবো। যে কোন পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করবো। যোগাযোগ করতে পারেন। ফোন : ০১৭১১-১০৬৯৭০, ০১৭১৩-৫৩২৩৬৩। ই-মেইল : ripon.kazi@gmail.com
আমার লেখা :
ভ্রমণ কাহিনী-১
কম খরচে ঘুরে আসুন থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও পাতায়া ।
ভ্রমণ কাহিনী-২
ঘুরে আসুন ভারতের হিমালয় কণ্যা দার্জিলিং
No comments:
Post a Comment