Friday, August 1, 2014

পাহাড়ি জনপদ জমজমাট হয়ে ওঠে

শীতে কেদারনাথের মন্দির প্রবল তুষারপাতের ফলে অগম্য হয়ে যায়। ওই সময় দেবতার আরাধনা হয় উখিমঠের ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে। বানাসুর কন্যা ঊষার নামে নামাঙ্কিত এই পাহাড়ি জনপদ জমজমাট হয়ে ওঠে দেবতার আবির্ভাবে। এখানে আছে ঊষা ও অনিরুদ্ধের এবং অবশ্যই শিব-পার্বতীর মন্দির। একদা প্রচলিত পদযাত্রার রুটে উখিমঠের গুরুত্ব বেড়েছিল চটি হিসেবে। মোটর-যানের প্রাবল্যে ভাটা পড়েছে তার বাণিজ্যিক ব্যস্ততায় কিন্তু ফিরে এসেছে আদত শান্ত চেহারা। পর্যটন প্রচারের ফোকাস এড়িয়ে উখিমঠ তাই আজও আনকোরা। লেখক উখিমঠের টানে ফিরে এসেছেন বারংবার। তার নির্ভেজাল হিমালয়-অনুরাগ কী পেয়েছিল এখানে এসে তা ব্যক্ত হয়েছে তারই কলমে।


জন্মান্তর বলে আদৌ কিছু আছে কি না জানা নেই আমার। যদি থাকে, পরের জন্ম আমি পৃথিবীতে প্রথম শ্বাস নিতে চাই গাড়োয়ালের উখিমঠে। জন্ম-মৃত্যু কোনওটাই মানবের স্বেচ্ছাধীন নয়। তবু কেন যেন মনে হয়, আপাত-অনাদৃত ওই পাহাড়তলির মৃত্তিকায় মিশে আছে আমার জন্ম-জন্মান্তরের অস্তিত্ব।
গাড়োয়াল আমার রক্তে এমন ভাবে মিশে আছে, এই অঞ্চল নিয়ে লিখতে আমায় নোটবই হাতড়াতে হয় না। চোখ বুজলেই স্পষ্ট দেখতে পাই, উখিমঠের সেই পাহাড়ি বাকটা। বাকের মুখে নীল ফুলে ছাওয়া সেই গাছ। ওই গাছের তিরতিরে পাতার মধ্য দিয়ে ঝলমল করে উকি দেয় কেদারশৃঙ্গ। সকালের শুভ্র রৌদ্রালোকে সে স্বমহিম, ধ্যানগম্ভীর। সন্ধ্যায় মনে হয়,
‘অস্তগিরির পরে,
ঝড় উঠেছে রঙের বনে
আলোর বৃষ্টি ঝরে।’
অঙ্কে চিরদিনই কাঁচা এ অধম। ছোটবেলা থেকে মাস্টারমশাইদের বিস্তর কানমলাতেও দোষটা শোধরায়নি। জীবনপথের অঙ্ক কষাতে তাই আজও ঠোক্কর খাই পদে পদে। তবে অঙ্ক কষে জীবনের পথ চলি না বলেই বোধহয় হিমালয় এসেছিল জীবনে। আর এই সূত্রেই পঞ্চকেদার পরিক্রমার সুবাদে এসে পড়েছিলাম আপাত অ-কুলীন বিগতগৌরব উখিমঠে। যে উখিমঠ অতীতে কেদার-বদরি যাত্রীদের কাছে ছিল এ পথের অন্যতম বিশিষ্ট তীর্থ তথা চটি। বাধানো বাসরাস্তা হয়ে যাওয়ার পর সেই চটি আজ পুরাবস্তু। ফলে চটির গৌরব উখিমঠ হারিয়েছে বেশ কয়েক দশক আগেই। আবার প্যাকেজ ট্যুরের ব্যস্ত পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো বিনোদনের অন্য সম্ভারেও সে সেজে উঠতে পারেনি অন্যান্য হিল স্পটের মতো। ফলে প্যাকেজ ট্যুরের ঝলমলে বৃত্ত থেকেও সে প্রায় নির্বাসিত। আর এই পিছিয়ে পড়ার ‘সৌভাগ্যেই’ হয়তো পুরাতনী হিমালয়ের কিছুটা আবেগ এখনও রয়ে গিয়েছে উখিমঠে।
হিমালয় মানে যে আদতে হৃদয়ের লেনদেন— এই আপ্তবাক্যটি আজও লেখা উখিমঠের নিভৃত পাহাড়তলির প্রতিটি নুড়িপাথরে, গিরিনির্ঝরে, লতাগুল্মে এবং এখানকার গিরিজনদের বুকে। তবে ব্যাপারটা পারস্পরিক। শহুরে সভ্যতার রঙিন চশমাটা খুলে ফেললে তবেই পরশ পাবেন এই হৃদয়ের। আর পাবেন চির-আমন্ত্রণের উদার আহ্বান। ফিরে ফিরে সে ডাক পাঠাবেই। আর এমন ডাকের অপেক্ষাতেই তো আমরা ‘কান পেতে রই’।

চারধামের যাত্রীরা বেশির ভাগই কেদারনাথ দর্শন করে গৌরীকুণ্ডে নেমে, সেখান থেকে বাস ধরে নেমে যান রুদ্রপ্রয়াগে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকেই কেদার ও বদরি যাওয়ার পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে। কেদারের যাত্রাপথটি মন্দাকিনী, ও বদরির পথটি অলকানন্দার গতিপথ ধরে। কেদার-ফেরত যে যাত্রীরা বদরি, হেমকুণ্ড যেতে চান— তাঁরা রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ডাইনের পথটি ধরেন— কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, চামোলি হয়ে যে-পথ যোশিমঠ ছুয়ে সোজা ঊেধ্বর্ উঠে গিয়েছে অলকানন্দা উপত্যকা ধরে। তবে বদরি যাওয়ার বিকল্প হ্রস্ব পথও একটি আছে। গৌরীকুণ্ড থেকে নামার পথে, কুণ্ড থেকে একটি রাস্তা গুপ্তকাশী, উখিমঠ, চোপতা গোপেশ্বর হয়ে চামোলিতে মিশেছে বদরি যাওয়ার রাস্তায়। তবে এ রাস্তাটি ভাঙাচোরা বলে অনেকেই এড়িয়ে যান। মরশুমে ভোর পাচটায় একটি বাস গৌরীকুণ্ড থেকে ছেড়ে বেলাবেলি পৌছয় বদরিতে। দিনে একবারই। বহু আেন্দালন ও অনশনের পর এই বাস চালু হয়েছে বলে লোকমুখে এই বাসের নাম হয়ে গিয়েছে ‘ভুখ হরতাল’। বদরিগামী যাত্রীরা এ বাসে সরাসরি চলে যেতে পারেন গৌরীকুণ্ড থেকে। আর স্বল্পসংখ্যক যে যাত্রীরা পঞ্চকেদার পরিক্রমার পরিকল্পনা করেন, তাঁরা নেমে যান উখিমঠ বা নালা চটিতে (এখান থেকে কালীমঠ হয়ে মদমহেশ্বর যাওয়া যায়)।

‘ভুখ হরতাল’ বাসের চালককে বলেছিলাম, ‘‘আমরা পঞ্চকেদার পরিক্রমা করতে চাই। তাই মাঝামাঝি যেখানে নামলে সুবিধে হয়, আমাদের নামিয়ে দেবেন।’’ অতি ভদ্র গাড়োয়ালি বাসচালক বলেছিলেন, ‘‘চিন্তা করবেন না। এমন জায়গায় নামিয়ে দেব, কোনও অসুবিধা হবে না আপনাদের।’’ ভোররাতে কনকনে ঠাণ্ডায় ঘুম-জড়ানো চোখেই বাসে উঠে বসেছিলাম। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক পাচটাতেই বাস ছাড়ল। কুয়াশা জড়ানো কালো অন্ধকার বিদীর্ণ করে জ্বলছিল বাসের হেডলাইট। ওই গাঢ় কুয়াশায় সহস্র বাক-কণ্টকিত পথে কী করে যে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তিনিই জানেন। চোখ দুটো জুড়ে আসছিল। হিমেলি হাওয়ায় ফাটা চটির কাছে এসে একটা বাক ঘুরতেই চোখে পড়ল নবীন রবির প্রস্ফুটন। যেন রাতের পাপড়ি খুলে বেরিয়ে এল লোধ্ররেণু। নীলচে পাহাড় পেলব আলোর অঞ্জলিতে স্নিগ্ধ হয়ে মায়াবি রূপ নিচ্ছে। পাশেই অতলস্পর্শী খাদে তখনও অাধারের কালো ছায়া। স্তব্ধবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাইরে।

তাল কেটে গেল দুই বঙ্গললনার ক্ষিপ্ত কণ্ঠধ্বনিতে। জানালার ধারের সিট নিয়ে ঝামেলা। গৌরীকুণ্ডে এদের বিস্তর মাল তুলে দিয়েছি বাসের ছাদে। মুখও চেনা হয়ে গিয়েছে। সেই সুবাদেই বললাম, ‘‘বাইরে একবার তাকিয়ে দেখুন। ঝগড়াটা কলকাতায় ফিরে করবেন।’’ আবেদন বৃথাই গেল। কিন্তু বাঙালি হিসাবে লজ্জায় মাথা কাটা গেল, যখন চালক বাস থামিয়ে হাতজোড় করে তাঁদের বললেন, ‘‘দোহাই, দিমাগ খারাপ করে দেবেন না। এতগুলো লোকের প্রাণ আমার হাতে। স্টিয়ারিংয়ের সামান্য ভুলে বাস গিয়ে পড়বে খাদে। বাচবেন না আপনারাও।’’
বাস আবার চলতে শুরু করল ভোরের আলো গায়ে মেখে। কিন্তু বাসের ভেতরে আবার সেই দুই মহিলার তর্জনগর্জন। গোটা বাসের লোক বিরক্ত। কিন্তু তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। গুপ্তকাশী পেরিয়ে বাস ছুটছে কুণ্ডচটির দিকে। পাহাড়ি ধাপে ছোট ছোট খেত। মাঝেমধ্যে খেলনার মতো বাড়িঘর। পাহাড়ের কোলে ঝুলে। কিছুক্ষণ পর সাংঘাতিক একটা ইউ-টার্ন নিয়ে মন্দাকিনী পেরিয়ে নীল ফুলে ছাওয়া একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে গেল বাসটা। বাসচালক ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, ‘‘এইখানে নেমে যান। সব কুছ বেন্দাবস্ত হো জায়েগা।’’
তড়িঘড়ি করে বাসের ছাদ থেকে রুকস্যাকগুলো নামালাম। দুই বঙ্গললনার কাজিয়ার সৌজন্যে ভুলে গেলাম তাদের সিটের তলায় রাখা ছিল আমাদের একটি ব্যাগ। নীল ফুলের গাছটার উেল্টা দিকেই ছোট্ট একটা বাড়ি। তার সামনে টানা বারান্দায় একটা চায়ের দোকান। বাসটা থামতেই দোকান ফেলে দৌড়ে এলেন দীর্ঘদেহী বয়স্ক এক বৃদ্ধ। হাবভাবে মনে হল, কতকালের চেনা। আমাদের সঙ্গেই হাত লাগিয়ে রুকস্যাকগুলো তুলে নিয়ে গিয়ে রাখলেন বারান্দায়। যেন বিশ বছরের জোয়ান। চায়ের অর্ডার দিয়ে বারান্দায় বাশের আড়ায় ঠেস দিয়ে জমিয়ে বসলাম।
সম্পূর্ণ অচেনা অজানা এক পাহাড়ি জনপদে নেমেছি। কিন্তু কী আশ্চর্য, মনে হচ্ছে এ যেন আমার কত কালের চেনা! দোকানের সামনেই ছোট্ট ফুলের বাগান। তার সামনেই পিচ-মোড়া রাস্তাটা নিকোনো উঠোনের মত তকতকে। অল্প দূরেই মন্দাকিনী। তাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু কানে আসছে তার কলকল। একটু দূরেই নীল ফুলে ছাওয়া গাছটা। তার পাশে ঝিমোচ্ছে হলুদ রঙের লজঝড়ে একটা ট্রাক। দূরে ডাইনে সবুজ বনানীর শেষে রুপোলি তবকে মোড়া কেদারশৃঙ্গ ঝকঝক করছে। মে মাস, কিন্তু আকাশের তীব্র নীলে যেন শরতের আভাস। মাঝেমধ্যে গাছ থেকে পাতা ঝরছে টুপটাপ। সেই পাতা ঝরার শব্দও কানে আসছে।

দোকানির নাম ইন্দর সিংহ পুষ্পিয়ান। বা দিকেই তাঁর রান্নাঘর। দরজার গায়ে লেখা ‘ইয়ে কিচেন হ্যায়। অন্দর আনে কা কষ্ট্‌ না করে’। অর্থাৎ বহিরাগতেরা ওই হেঁসেলে ঢুকো না। বারান্দায় নড়বড়ে কয়েকটা বেঞ্চ ও টেবিল। বারান্দায় বসে থাকতে থাকতেই দেখলাম, বৃদ্ধ কাঠের উনুনে ঝটপট বানিয়ে ফেললেন ঘন দুধের চা। সঙ্গে হাতে গড়া গরম রুটি ও সিব্জ। প্রথম দফার চা প্রায় এক নিশ্বাসে শেষ করতেই, হেসে আবার ভর্তি করে দিলেন হাতের চায়ের গ্লাস। কোনও বাহুল্য নেই, নেই লোক-দেখানো বাড়তি উচ্ছ্বাস। যেন ঘরে-ফেরা বাড়ির লোককেই আপ্যায়ন করছেন গৃহস্বামী। বললেন, ‘‘কোন ভোরে বেরিয়েছ। তাই শুধু চা না দিয়ে একটু রুটি-সিব্জও খাইয়ে দিলাম। এ বার যেখানে যাবে, যাও।’’
যাবে কে? আমার তো উঠতেই ইচ্ছে করছে না। একটু আগেই টের পেয়েছি, একটা ব্যাগ বাসেই রয়ে গিয়েছে। সমতল হলে মেজাজটা খিঁচড়ে থাকত। কিন্তু উখিমঠের হাওয়াতেই বোধহয় অন্য রসায়ন কিছু আছে। প্রভাতী সূর্যের কবোষ্ণ রোদ, ওই নীল আকাশ, পাতার মর্মর, সামনে ফুলের বাগানে ঘাসফড়িঙের সরসর, ফরফর— আমার সব ক্ষোভ যেন িস্তমিত করে দিয়েছে কোন জাদুস্পর্শে। কে যেন কানে কানে বলছে, ‘‘পাহাড়ে এ সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করলে তোমারই লোকসান।’’
এরই মধ্যে কখন দেখি, আমার স্ত্রী গিয়ে ঢুকেছে রান্নাঘরে। ষাটোধ্বর্ ওই বৃদ্ধ মহা উৎসাহে তাকে তালিম দিচ্ছেন
কাঠের জ্বালে রান্নার। আমার বালক-পুত্র ইতিমধ্যেই মিতালি পাতিয়ে ফেলেছে এলাকার বাচ্চাগুলোর সঙ্গে। সে তার নিজস্ব হিন্দিতে তাদের হাত ছোট এবং বড় করার ম্যাজিক দেখাচ্ছে। সঙ্গী ইন্দ্র বিস্কুট খাওয়াচ্ছে ইয়া বড় লোমশ এক পাহাড়ি কুকুরকে। কে বলবে, আমরা এখানে এসেছি মাত্র এক ঘণ্টা আগে! ভাল লাগার একটা ঘোর, এক পরম নিশ্চিন্তর ভাব আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আমাদের সকলকেই। কেন এই অমোঘ টান বুঝলাম একটু পরেই। বাশের একটা বিশাল হুকো ফুকতে ফুকতে ইন্দর সিংহ নিবেদন করলেন, ‘‘উমাপ্রসাদজির খবর জানেন? কেমন আছেন উনি? মানুষ নয়, দেবতা! আমার এই ভাঙা কোঠিতে হাসিমুখে থেকে গেছেন।’’

আমি আর ইন্দ্র পরস্পরের দিকে তাকালাম। দৃষ্টিতেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, উখিমঠে যে ক’দিন আছি, এ ঠঁাই ছেড়ে নড়ছি না কোথাও। ভাগ্যিস অঙ্কে কাঁচা ছিলাম। তা না হলে সমতলের সাবধানী পথিকের মত গিয়ে উঠতাম কোনও হোটেলে। পরিচয় ঘটত না সনাতনী হিমালয়ের শেষ প্রজন্মর এই হৃদয়বান পুরুষটির সঙ্গে। এই ভাঙা ঘরে না থাকলে আমার হিমালয়-অ্যালবামে ধরা থাকত না সবচেয়ে উজ্জ্বল চিত্রটি!
ইন্দর সিংহ আমার জীবনে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এমন মরমী, হৃদয়বান, নির্লোভ, তীব্র আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি। পঞ্চকেদার পরিক্রমায় সব মিলিয়ে বড় জোর দিন-দশেক ছিলাম তাঁর দোকান-সংলগ্ন কোঠিতে। একটি দিনের জন্যও নিজেকে বহিরাগত মনে হয়নি। আমাদের পঞ্চকেদার পরিক্রমার সকল আয়োজন সুচারু ভাবে করে দিয়েছেন তিনি। বাসের ড্রাইভার, পশুপালক, রানার— এদের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে পোর্টার, গাইডের ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের ঠিক-করা জিপের ভাড়া শুনে ধমক দিয়ে তা অর্ধেক করতে বাধ্য করেছেন জিপচালককে। কীসে আমাদের দুটো পয়সা সাশ্রয় হয়, সব সময় তা দেখেছেন। অভিভাবকের মত হরবখত বকুনি দিয়েছেন আমাদের। আর মাঝে মাঝেই দুঃখ করে বলেছেন, ‘‘পাহাড়ি মানুষও বদলে যাচ্ছে। কীসের ভরসায় তবে পাহাড়ে আসবে সমতলের মানুষ!’’

কথক ইন্দর সিংহকে চিরজীবন মনে থাকবে আমার। ভাত বা রুটি তৈরি করতে করতে গেল্পর মতো বলে যেতেন গাড়োয়ালের ইতিকথা। রাতের অন্ধকারে মন্দাকিনীর ও-পারে গুপ্তকাশী যখন তারার মতন আকাশে ভাসছে, তাঁর মুখে শুনেছি পুরনো দিনের তীর্থপথের দুর্গমতার কথা: শনের পাকানো দড়ির পুল বেয়ে খরেস্রাতা নদী পেরনো; গাছের শিকড় ধরে মদমহেশ্বর যাত্রা; বুনো ভালুকের উপদ্রব; তুষারঝড়ে গুহায় রাত কাটানো; আর ‘দেওতা’ উমাপ্রসাদজির ভালবাসার কথা। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে যখন বলে যেতেন, সে-কালের ছড়িদার ও চটিওয়ালাদের সঙ্গে যাত্রীদের হৃদয়ের সম্পর্কের কথা, মনটা ভারী হয়ে উঠত। আমাদের শহুরে জ্ঞান-বুিদ্ধতে তিনি নিছক এক চায়ের দোকানি। অথচ গাড়োয়ালের ইতিহাস, রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের কাহিনি এ মানুষটির কণ্ঠস্থ। উখিমঠের নাম নিয়ে যে কল্পকাহিনি প্রচলিত, তা-ও শুনেছি তাঁর মুখেই।
ভাগবত ও স্কন্দপুরাণের মতে, শিবভক্ত বাণাসুরের কন্যা ঊষার সঙ্গে শ্রীকৃেষ্ণর প্রপৌত্র অনিরুেদ্ধর গান্ধর্ব বিবাহ এখানেই অনুিষ্ঠত হয়েছিল। রাজকন্যা ঊষার নামেই ‘উষী’ বা ‘উখি’ মঠ। ঊষার সখী চিত্রলেখা ছিলেন এই প্রণয়ের প্রধান দূতী। কুপিত বাণরাজা বিন্দ করলেন অনিরুদ্ধকে। সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাঁকে ছাড়াতে এলেন খোদ শ্রীকৃষ্ণ। বাধল তুমুল যুদ্ধ। অবশেষে মহাদেবের হস্তক্ষেপে থামল লড়াই। উখিমঠের কাছেই ছিল শোণিতপুর। যুেদ্ধর রক্তেস্রাতেই নাকি ওই নাম! অনেক কাল আগে নাকি দেখা যেত বাণরাজার গড়। সেই গড় থেকেই এ অঞ্চলের নাম ‘গাড়োয়াল’, এমন কথাও শোনা যায়।
ইন্দর সিংহের বিজলিবিহীন রান্নাঘরের দাওয়ায় উনুনের কাঁপা কাঁপা আলোয় এ কাহিনি শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, হয়তো সাহসিনী এক পাহাড়ি কিশোরীর দুর্বার েপ্রমগাথা এক সময় পুরাণের খাপে মুড়ে পরিবেশন করতেন গ্রাম্য কথক। ঊষা-অনিরুদ্ধ সত্য কি না, জানার উপায় নেই। কিন্তু েপ্রম যে অবিনশ্বর, এ কাহিনিই তার প্রমাণ।
ছোট্ট জনপদ হলেও তীর্থ হিসাবে উখিমঠ প্রসিদ্ধ। শীতে কেদার ও মদমহেশ্বরের পুজো হয় এই উখিমঠেই। কেদােরর মোহান্ত বা রাওয়ালের গদি এখানেই। উখিমঠে মন্দিরটি বেশ জমকালো। গায়েই রাওয়ালের প্রাসাদ। প্রধান মন্দিরে ওঙ্কারেশ্বর শিব ও পঞ্চকেদারের পঞ্চ মূর্তি। মূল মন্দিরের পাশে গঙ্গা, মান্ধাতা ও নবদুর্গার মূর্তি। দেখলাম েপ্রম-কাহিনির অনিরুদ্ধ, ঊষা ও ঊষার সখী চিত্রলেখার মূর্তিও। তবে ঊষার মূর্তিটি বড়ই খাদা-বোচা। অথচ এ কন্যার জন্যই একদা লেগেছিল শৈব-বৈষ্ণবের ধুন্ধুমার যুদ্ধ!

তথ্য হিসাবে জানিয়ে রাখি, বাসপথে গৌরীকুণ্ড থেকে উখিমঠের দূরত্ব ৪৩ কিলোমিটার। উচ্চতা ১৩১১ মিটার। না খুব ঠাণ্ডা, না খুব গরম। শীত ও বর্ষার কালটুকু বাদে অন্য সময় মনোরম আবহাওয়া। বাহুল্যহীন নিভৃতিতে কেউ যদি কয়েকটা দিন কাটাতে চান, এই শান্ত জনপদ তাকে নিরাশ করবে না। সবুজ বনানী ঘেরা নিভৃত এই ছোট্ট জনপদে ধর্মশালা, ডাকঘর, হাসপাতাল, দোকানপাট, স্কুল— সবই আছে। শুধু নেই গলা বাড়িয়ে ঘোষণার উচ্চকিত উদ্ধত ভাব। পায়ে হেঁটেই ঘুরে নেওয়া যায় গোটা উখিমঠ। শান্ত জীবনছন্দ। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মৃদু জ্যোৎস্নায় আমরা বেড়াতাম রাস্তায়। নদীর কলরোল, পাতার মর্মর ও ঁঝিঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
উখিমঠকে কেন্দ্র করে ঘুরে আসা যায় তুঙ্গনাথ, দেওরিয়াতাল, মদমহেশ্বর (পাচ দিনের েট্রক) ও কালীমঠ। মদমহেশ্বর ও তুঙ্গনাথ যাওয়ার আগে এক দিনের
সফরে ৬ কিলোমিটার দূরে মাস্তুরায় গিয়ে দেখে এসেছিলাম দেওরিয়াতাল। মাস্তুরায় নেমে উঠতে হবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট। এই হ্রদের পরিধি প্রায় সাতশো মিটার।
উখিমঠ থেকে বাসে আধঘণ্টার মধ্যেই মাস্তুরা। সেখানে নামতেই এগিয়ে এল বছর ষোলোর কিশোর যোগিন্দর। ইন্দর সিংহ আগেই চিঠি পাঠিয়ে তাকে খবর দিয়ে রেখেছিলেন। বনপথে মাঝারি চড়াই ভেঙে সারি গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হল। রামদানা ও গমের খেতের মাঝে মাঝে স্লেট পাথরের ছাউনি দেওয়া কুটির। এ গ্রামেই বাড়ি যোগিন্দরের। বাড়িগুলির এক তলায় শস্য রাখার ঘর, দোতলায় থাকার ব্যবস্থা। গ্রামে এক বৃদ্ধা চা খাইয়ে তবে যেতে দিলেন আমাদের। এর পর কখনও পাকদণ্ডি, কখনও শুড়িপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঘণ্টাখানেক পরে হাজির হলাম ঘন সবুজ বনানী-ঘেরা এক কাকচক্ষু সরোবরের সামনে। সেই জলে চৌখাম্বার প্রতিচ্ছায়া। মনে হয়, সবুজ এক পাহাড়ের মাথাটা কেটে, নিপুণ এক কারিগর বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে এক মায়ামুকুর। যে আয়নায় প্রকৃতিই নিভৃতে দেখে নেয় তার মুখ। শনশন বাতাস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। ভাগ্যিস প্রচারের আলোয় এখনও তেমন ভাবে উঠে আসেনি এই তাল। শঙ্কায় আছি, কবে এর তীরে গড়ে উঠবে হলিডে রিসর্ট। সাউণ্ড সিেস্টমের উদ্ধত ঝঙ্কারে খানখান হয়ে যাবে বনস্থলীর এই নিভৃতি।
দিন দশেক উখিমঠবাসের শেষে যে-দিন রওনা দিলাম বদরির পথে, মনে হল স্বর্গ থেকে বিদায় নিচ্ছি। পাহাড়ি বাকটা ঘুরতেই মিলিয়ে গেল নীল ফুলের গাছটা। বাসের পিছু পিছু অনেক দূর অবধি দৌড়ে এল কালো কুকুরটা। গলার মধ্যে কী যেন একটা আটকে গেল!
ইন্দর সিংহ আর নেই। কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেছে তাঁর চিঠি। সেই খামে পোরা নীল ফুলের পাপড়ি। উখিমঠে চির-আমন্ত্রণের ডাক!

No comments:

Post a Comment