ঢাকার রমনা উদ্যান থেকে মোটরসাইকেলে চেপে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা
দিয়েছিলাম বেলা ১১টায়। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যানজট কম থাকে, তবু
মহাখালী পেরোতেই যানজটে পড়লাম। গাজীপুরের কাছাকাছি এসে তা চূড়ান্ত রূপ নিল।
বাস ও ট্রাকচালকদের সহায়তায় রোড বিভাজকের ফাঁক গলে এধার-সেধার করে ছুটতেই
সামনে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে জয়দেবপুরে। সেই প্রতিরোধে শহীদ হন ১৪ বছরের বালক হুরমদ, মনু খলিফাসহ মোট চারজন। সেই স্মৃতি ধরে রাখতেই ১৯৭৩ সালে গাজীপুর চৌরাস্তায় নির্মিত হয় স্মৃতিভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী।
চেলাই থেকে বেলাই
আমাদের গন্তব্য বেলাই বিল। ঢাকার কাছে উন্নত ভূমির যেসব বিল রয়েছে, এর মধ্যে বেলাই বিল রূপ-সৌন্দর্যে অনন্য। বিশাল বিলটির কোনো কোনো স্থানে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে, তবে বর্ষায় এর রূপ বেড়ে যায় অনেক। বর্তমানে বিলটি আট বর্গমাইল এলাকায় বিস্তৃত হলেও একসময় এটি আরও বড় ছিল। বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বক্তারপুর ও বামচিনি মৌজা গ্রামঘেরা বেলাই বিল। তবে ৪০০ বছর আগের ইতিহাসে বেলাই বিলে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। খরস্রোতা চেলাই নদীর কারণে বিলটিও খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল। কিংবদন্তি আছে, ভাওয়ালের সেই সময়ের ভূস্বামী ঘটেশ্বর ঘোষ ৮০টি খাল কেটে চেলাই নদীর জল নিঃশেষ করে ফেলেন। তার পরই এটি প্রকাণ্ড বিলে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে ছেলেরা বিলের চারপাশে ডাঙ্গি খনন করে। এখানে ধরা হয় মাছ। আর শুষ্ক মৌসুমে বিলটি হয়ে ওঠে একফসলি জমি। তাতে চাষ হয় বোরো ধান।
বেলা দুটায় আমরা ভাওয়াল রাজবাড়ী হয়ে কানাইয়া পৌঁছাই। সেখান থেকেই চেলাই নদী ও বেলাই বিলের পথ। বাজারে মোটরবাইক থামাতেই চেলাই নদীর প্রবাহপথটি বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
ডাঙা ছেড়ে…
রমনা উদ্যান থেকে কানাইয়া বাজার। যানজটের কারণে এক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রা, সন্দেহ নেই। কিন্তু পড়ন্ত বেলায় কানাইয়া বাজারের কাছে তৈরি হওয়া নতুন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই সব ক্লান্তি উধাও। শাপলা-শালুকে ভরা বেলাই বিল। মোহাবিষ্ট হয়ে কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ধ্যান ভঙ্গ হলো সঙ্গীর ডাকে। শস্য ঝাড়াইয়ের দৃশ্য দেখার জন্য তার কী উল্লাস! যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই নারীরা এ কাজটি করছেন। বাতাসে উড়ছে তুষের গুঁড়া, ধুলো। আশপাশের সব চড়ুই পাখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শস্যদানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ছবির মতো সুন্দর সে দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম চেলাই নদীর তীরে। কী স্বচ্ছ টলটলে পানি! খুব বেশি চওড়া নয় চেলাই নদী, তবে খুব গভীর মনে হলো। আগের সেই খরস্রোতা রূপ আর নেই।
আমরা নৌকায় চড়লাম। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নয়। ডিঙি নৌকা। নৌকার মাঝি আবদুস সাত্তার। তাঁর সঙ্গে আলাপ জমতে সময় লাগল না। আলাপ চলল, নৌকাও চলল তরতর করে। এভাবেই আমরা চেলাই নদীর পথ ধরে বেলাই বিলের পাড়ে বসে পড়ি। দূর থেকে ক্যামেরা তাক করতেই উঁকি দিল বেলাই বিলের বিস্তৃত জলরাশি। বিলের চারপাশে দ্বীপের মতো গ্রাম। বামচিনি মৌজা বেলাই বিলের তেমনি একটি দ্বীপগ্রাম। এর বিশেষত্ব—এক মৌজায় এক বাড়ি। গাজীপুরে এই বামচিনি মৌজা ছাড়া এমন নজির দেশের অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বিল মানেই শাপলা। বেলাই বিলে সাদা ও নীল শাপলার ছড়াছড়ি। দূরে জাল পাতার কাজে ব্যস্ত লোকজন। কেউ কেউ আবার জাল টেনে তুলে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। বিলের নতুন পানিতে ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ পাশের কুমুনবাজারে ছুটে চলেছে। আজ যে হাটবার!
এখানকার গ্রামের মাটি লাল। লাল মাটিতে লাউ খুব ভালো জন্মে। আর রয়েছে সারি সারি তালগাছ। নৌকায় বসে দূরের তালগাছ দেখতে ভারি সুন্দর! আমরা নৌকায় চলেছি। তীরে দাঁড়িয়ে দ্বীপগ্রামবাসী আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখছে।
আমরা সাত্তার মাঝির বাড়ি গেলাম। ফেরার পথে বামচিনি মৌজার এক বাড়িতে নামতে ভুল করলাম না। এখানে ঢেঁকিতে ধান ভানছেন বাড়ির মহিলারা। বাড়ির মালিক এখন বরকত আলী। তাঁর বাড়ির উঠানে বসে চা খেতে খুব ইচ্ছে হলো। তিনি আমাদের খেতে দিলেন ডাবের পানি আর কাঁঠাল। বাড়ির চারপাশ তাল, কাঁঠাল, বাবলা, চালতা, আম আর ডাবগাছে ঘেরা। রয়েছে হিজলগাছও। এসব সৌন্দর্য ছাপিয়ে বেলাই বিল অসাধারণ! আমরা বাড়ির উঠানে বসে বেলাই বিলের রূপ দেখতে দেখতে একসময় সাত্তার মাঝির নৌকায় উঠলাম। তখন গোধূলি বেলা। গোধূলির আলোয় আলোকিত বেলাই বিলের মোহনীয় নিসর্গ দেখে মুখে আর কথা জোগাল না।
ঢাকা থেকে কানাইয়া বাজার
গুলিস্তান থেকে বাসে গাজীপুর বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিকশা বা টেম্পোতে কানাইয়া বাজার। কানাইয়া বাজার ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। দরদাম করে উঠে পড়ুন। চাইলে নিজস্ব বাহনেও যেতে পারেন দলবেঁধে। এ বর্ষায় বেলাই ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কানাইয়া বাজারে চা-বিস্কুট ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং বহনযোগ্য খাবার সঙ্গে নিন। নিজস্ব গাড়িতে টঙ্গী-পুবাইল হয়ে কানাইয়া যেতে সময় বাঁচবে, সঙ্গে যুক্ত হবে মনোরম পথসৌন্দর্য। এক দিনের জন্য দারণ বেড়ানো হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে জয়দেবপুরে। সেই প্রতিরোধে শহীদ হন ১৪ বছরের বালক হুরমদ, মনু খলিফাসহ মোট চারজন। সেই স্মৃতি ধরে রাখতেই ১৯৭৩ সালে গাজীপুর চৌরাস্তায় নির্মিত হয় স্মৃতিভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী।
চেলাই থেকে বেলাই
আমাদের গন্তব্য বেলাই বিল। ঢাকার কাছে উন্নত ভূমির যেসব বিল রয়েছে, এর মধ্যে বেলাই বিল রূপ-সৌন্দর্যে অনন্য। বিশাল বিলটির কোনো কোনো স্থানে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে, তবে বর্ষায় এর রূপ বেড়ে যায় অনেক। বর্তমানে বিলটি আট বর্গমাইল এলাকায় বিস্তৃত হলেও একসময় এটি আরও বড় ছিল। বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বক্তারপুর ও বামচিনি মৌজা গ্রামঘেরা বেলাই বিল। তবে ৪০০ বছর আগের ইতিহাসে বেলাই বিলে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। খরস্রোতা চেলাই নদীর কারণে বিলটিও খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল। কিংবদন্তি আছে, ভাওয়ালের সেই সময়ের ভূস্বামী ঘটেশ্বর ঘোষ ৮০টি খাল কেটে চেলাই নদীর জল নিঃশেষ করে ফেলেন। তার পরই এটি প্রকাণ্ড বিলে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে ছেলেরা বিলের চারপাশে ডাঙ্গি খনন করে। এখানে ধরা হয় মাছ। আর শুষ্ক মৌসুমে বিলটি হয়ে ওঠে একফসলি জমি। তাতে চাষ হয় বোরো ধান।
বেলা দুটায় আমরা ভাওয়াল রাজবাড়ী হয়ে কানাইয়া পৌঁছাই। সেখান থেকেই চেলাই নদী ও বেলাই বিলের পথ। বাজারে মোটরবাইক থামাতেই চেলাই নদীর প্রবাহপথটি বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
ডাঙা ছেড়ে…
রমনা উদ্যান থেকে কানাইয়া বাজার। যানজটের কারণে এক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রা, সন্দেহ নেই। কিন্তু পড়ন্ত বেলায় কানাইয়া বাজারের কাছে তৈরি হওয়া নতুন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই সব ক্লান্তি উধাও। শাপলা-শালুকে ভরা বেলাই বিল। মোহাবিষ্ট হয়ে কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ধ্যান ভঙ্গ হলো সঙ্গীর ডাকে। শস্য ঝাড়াইয়ের দৃশ্য দেখার জন্য তার কী উল্লাস! যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই নারীরা এ কাজটি করছেন। বাতাসে উড়ছে তুষের গুঁড়া, ধুলো। আশপাশের সব চড়ুই পাখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শস্যদানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ছবির মতো সুন্দর সে দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম চেলাই নদীর তীরে। কী স্বচ্ছ টলটলে পানি! খুব বেশি চওড়া নয় চেলাই নদী, তবে খুব গভীর মনে হলো। আগের সেই খরস্রোতা রূপ আর নেই।
আমরা নৌকায় চড়লাম। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নয়। ডিঙি নৌকা। নৌকার মাঝি আবদুস সাত্তার। তাঁর সঙ্গে আলাপ জমতে সময় লাগল না। আলাপ চলল, নৌকাও চলল তরতর করে। এভাবেই আমরা চেলাই নদীর পথ ধরে বেলাই বিলের পাড়ে বসে পড়ি। দূর থেকে ক্যামেরা তাক করতেই উঁকি দিল বেলাই বিলের বিস্তৃত জলরাশি। বিলের চারপাশে দ্বীপের মতো গ্রাম। বামচিনি মৌজা বেলাই বিলের তেমনি একটি দ্বীপগ্রাম। এর বিশেষত্ব—এক মৌজায় এক বাড়ি। গাজীপুরে এই বামচিনি মৌজা ছাড়া এমন নজির দেশের অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বিল মানেই শাপলা। বেলাই বিলে সাদা ও নীল শাপলার ছড়াছড়ি। দূরে জাল পাতার কাজে ব্যস্ত লোকজন। কেউ কেউ আবার জাল টেনে তুলে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। বিলের নতুন পানিতে ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ পাশের কুমুনবাজারে ছুটে চলেছে। আজ যে হাটবার!
এখানকার গ্রামের মাটি লাল। লাল মাটিতে লাউ খুব ভালো জন্মে। আর রয়েছে সারি সারি তালগাছ। নৌকায় বসে দূরের তালগাছ দেখতে ভারি সুন্দর! আমরা নৌকায় চলেছি। তীরে দাঁড়িয়ে দ্বীপগ্রামবাসী আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখছে।
আমরা সাত্তার মাঝির বাড়ি গেলাম। ফেরার পথে বামচিনি মৌজার এক বাড়িতে নামতে ভুল করলাম না। এখানে ঢেঁকিতে ধান ভানছেন বাড়ির মহিলারা। বাড়ির মালিক এখন বরকত আলী। তাঁর বাড়ির উঠানে বসে চা খেতে খুব ইচ্ছে হলো। তিনি আমাদের খেতে দিলেন ডাবের পানি আর কাঁঠাল। বাড়ির চারপাশ তাল, কাঁঠাল, বাবলা, চালতা, আম আর ডাবগাছে ঘেরা। রয়েছে হিজলগাছও। এসব সৌন্দর্য ছাপিয়ে বেলাই বিল অসাধারণ! আমরা বাড়ির উঠানে বসে বেলাই বিলের রূপ দেখতে দেখতে একসময় সাত্তার মাঝির নৌকায় উঠলাম। তখন গোধূলি বেলা। গোধূলির আলোয় আলোকিত বেলাই বিলের মোহনীয় নিসর্গ দেখে মুখে আর কথা জোগাল না।
ঢাকা থেকে কানাইয়া বাজার
গুলিস্তান থেকে বাসে গাজীপুর বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিকশা বা টেম্পোতে কানাইয়া বাজার। কানাইয়া বাজার ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। দরদাম করে উঠে পড়ুন। চাইলে নিজস্ব বাহনেও যেতে পারেন দলবেঁধে। এ বর্ষায় বেলাই ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কানাইয়া বাজারে চা-বিস্কুট ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং বহনযোগ্য খাবার সঙ্গে নিন। নিজস্ব গাড়িতে টঙ্গী-পুবাইল হয়ে কানাইয়া যেতে সময় বাঁচবে, সঙ্গে যুক্ত হবে মনোরম পথসৌন্দর্য। এক দিনের জন্য দারণ বেড়ানো হবে।
No comments:
Post a Comment