কার কাছে যেন শুনেছিলাম গল্পটা। এক আগন্তুক বাংলার কোনো এক গাঁয়ে গিয়ে
এক লোকের কাছে জানতে চাইলেন, এখানে কপোতাক্ষ নদ কোথায়। লোকটি আগন্তুককে
বললেন, যে নদীতে দেখবেন কোনো পালতোলা নৌকা চলে না, ধরে নেবেন সেটাই
কপোতাক্ষ নদ।’
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত সেই নদ দেখব, এমন আশা অনেক দিনের।
‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’
কবির লেখা এ লাইন দুটো যেন মনে গেঁথে ছিল। হঠাৎ করেই সুযোগ জুটে গেল। সিইজিআইএস থেকে পরিবেশ গবেষণার কাজে যেতে হয়েছিল যশোর। আর বেশ কটা দিন পথ চলতে হয়েছিল সেই কপোতাক্ষের বাঁকে বাঁকে। সে কথাই লিখছি।
যশোর নেমে যাত্রা করলাম গঙ্গানন্দপুর গ্রামের উদ্দেশে। গ্রামের ভেতর পায়ে হেঁটে ২০ গজ এ গানোর পরই প্রথমে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে দেখা। নদীতে কচুরিপানা থাকে জানি, কিন্তু কপোতাক্ষ নদে কচুরিপানা দেখে মনে হলো এত কচুরিপানা দেশের অন্য কোনো নদীতে নেই। পালতোলা নৌকা চলবে কী করে? নদের পানি শান্ত ও স্থির। এক বৃদ্ধ তালের ডোঙায় বসে আছেন মাছ ধরার জন্য। নদের দুই পাড়েই সবুজের সমারোহ। কয়েকটা জলমোরগ ঘোরাফেরা করছে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে কচুরির বনে। পাখির ছবি তুলতে দেখে গাঁয়ের এক ছেলে আমাকে দুর্গাটুনটুনির বাসা দেখাতে নিয়ে গেল।
এবার পৌঁছলাম ঝিকরগাছা। যশোর রোড়ের বিখ্যাত সেই সব রেইনট্রির সারি প্রথমে চোখে পড়বে এখানে। ঝিকরগাছা গিয়েও নদের সেই একই রূপ। তবে এখানে কচুরিপানা আরও বেশি।
এরপর পানিসারা হয়ে হরিহরনগর যাওয়ার পথে খেজুরগাছের সারি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। বাংলাদেশের সব খেজুরগাছ যেন নিয়ে আসা হয়েছে যশোরের মাঠেঘাটে। গোপালগঞ্জ যেমন তালগাছের জন্য বিখ্যাত, যশোর তেমনি খেজুরগাছের জন্য। এরপর জগিখালী, ত্রিমোহনীর পথ ধরলাম। ত্রিমোহনী এসে আরেকটি নদীর সঙ্গে দেখা হলো, নাম তার বুড়িভদ্রা। বিকেল গড়িয়ে এল। পথে নীলগলা বসন্তবৌরির ডাকে মনটা আনচান করতে থাকে। বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় এত নীলগলা বসন্তবৌরি দেখিনি। চাকলা নামের এক গ্রামে এসে দেখি রশি টানা খেয়া। নদের দুই পাড়ে খুঁটি গেড়ে এপার-ওপার রশি বেঁধে দেওয়া। নদীতে আছে নৌকা। নৌকায় দাঁড়িয়ে যদি কেউ রশি টান দেয়, তাহলে নৌকা সামনের দিকে চলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ফেরার পথে প্রায় ৩০টি গরুর গাড়ির দেখা মিলল। ছেলেমেয়ে, যুবক, বুড়ো সবাই মিলে বেড়াতে বের হয়েছেন। নানা রকম সাজসজ্জা, গান ও বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে তাঁরা চলছেন।
পরের দিন সকালে সাগরদাঁড়ির পথ ধরি। কেশবপুর উপজেলায় এসে কিছুক্ষণ যশোরের হনুমানদের খোঁজ করি। কিন্তু এ যাত্রা তাদের দেখা মিলল না। ওরা দলবেঁধে অন্যদিকে চলে গেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসি সাগরদাঁড়ি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটায়। নদের ঘাটেই প্রথম যাই। ঘাটে নাও ভেড়ানো আছে। কয়েক ঝাঁক মাঝলা ও গো-বগ খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। দত্তবাড়ির ঘাট থেকে একটু দূরেই কবির বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাড়ি ও অন্য সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে। টিকিট কেটে কবির বাড়ি ঢুকতে হবে। বেশ কিছু বড় আমগাছ আছে বাড়িটিতে। আরও আছে ঘাট বাঁধানো পুকুর। পাতিমাছরাঙা সব সময় আনাগোনা করে এ পুকুরে। বাড়ির ভেতরে আছে কবিপরিবারের ব্যবহূতসামগ্রী। যেমন—দা, আলনা, খাট, থালা, কাঠের সিন্দুক, কবির লিখিত পাণ্ডুলিপি, পারিবারিক ছবিসহ নানা কিছু।
সাগরদাঁড়ি দেখে কুমিরা, ইসলামকাঠি হয়ে আমরা তালা উপজেলায় পৌঁছালাম। পথে বেশ কিছু বিল পড়ে। শালিখা ও জালালপুর বিল এর মধ্যে অন্যতম। তালা গিয়ে কপোতাক্ষ নদে জোয়ার দেখা গেল। কিছু বড় নৌকা ছিল নদে। জোয়ারের পানিতে বেশ পলি। পলি জমে ওখানে নদ ভরাট হয়েযাচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির প্রবাহ। সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা গিয়ে দেখা গেল নদের পাশের কেওড়াগাছ মরে গেছে। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হলে এ গাছগুলো মারা যেত না।
কপোতাক্ষ নদের উৎপত্তি দর্শনার কাছে মাথাভাঙা নদী থেকে। এরপর চৌগাছা, ঝিকরগাছা, চাকলা, ত্রিমোহনী, জীবনগর, কোটচাঁদপুর, সাগরদাঁড়ি, তালা, কপিলমনি, বারুলী, চাঁদখালী, বড়দল, আমাদী, বেদকাশী প্রভৃতি স্থানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়া নদীর সঙ্গে মিশেছে। এখন সাগরদাঁড়ি থেকে কপিলমনিয়া পর্যন্ত হাঁটু কিংবা কোমর অবধি পানি। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা নেই বলে স্রোতও নেই। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে কপোতাক্ষের সঙ্গে গঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল বর্ষার সময় নদীতে অল্প পরিমাণ পানি আসে। এখন একমাত্র বর্ষার পানিই কপোতাক্ষের পানির প্রধান উৎস। কথিত আছে, কপোতের অক্ষের (কবুতরের চোখ) মতো স্বচ্ছ পানি বলে এ নদের নাম হয়েছিল কপোতাক্ষ। কিন্তু কপোতাক্ষের পানি আজ ঘোলা। এলাকাবাসীর অভিমত, ঠিকভাবে খনন করা হলে আবার কিছুটা হলেও সজিব হয়ে উঠবে কপোতাক্ষ। সেদিন হয়তো একটি পালতোলা নৌকার
দেখা পাবেন সেই আগন্তুক।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
সাগরদাঁড়িতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যেতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে যশোর। এরপর যশোর শহর থেকে বাসে করে কেশবপুর। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে করে সাগরদাঁড়ি যেতে হবে।
যশোর শহর থেকে সাগরদাঁড়ি পর্যন্ত প্রায় দু্ই-আড়াই ঘণ্টা পথ। দত্তবাড়ির কাছেই আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের রেস্টহাউস। সেখানে থাকতে পারেন অথবা থাকতে পারেন কেশবপুর উপজেলা ডাকবাংলোতে। তবে আগে থেকেই কথা বলে রাখতে হবে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত সেই নদ দেখব, এমন আশা অনেক দিনের।
‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’
কবির লেখা এ লাইন দুটো যেন মনে গেঁথে ছিল। হঠাৎ করেই সুযোগ জুটে গেল। সিইজিআইএস থেকে পরিবেশ গবেষণার কাজে যেতে হয়েছিল যশোর। আর বেশ কটা দিন পথ চলতে হয়েছিল সেই কপোতাক্ষের বাঁকে বাঁকে। সে কথাই লিখছি।
যশোর নেমে যাত্রা করলাম গঙ্গানন্দপুর গ্রামের উদ্দেশে। গ্রামের ভেতর পায়ে হেঁটে ২০ গজ এ গানোর পরই প্রথমে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে দেখা। নদীতে কচুরিপানা থাকে জানি, কিন্তু কপোতাক্ষ নদে কচুরিপানা দেখে মনে হলো এত কচুরিপানা দেশের অন্য কোনো নদীতে নেই। পালতোলা নৌকা চলবে কী করে? নদের পানি শান্ত ও স্থির। এক বৃদ্ধ তালের ডোঙায় বসে আছেন মাছ ধরার জন্য। নদের দুই পাড়েই সবুজের সমারোহ। কয়েকটা জলমোরগ ঘোরাফেরা করছে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে কচুরির বনে। পাখির ছবি তুলতে দেখে গাঁয়ের এক ছেলে আমাকে দুর্গাটুনটুনির বাসা দেখাতে নিয়ে গেল।
এবার পৌঁছলাম ঝিকরগাছা। যশোর রোড়ের বিখ্যাত সেই সব রেইনট্রির সারি প্রথমে চোখে পড়বে এখানে। ঝিকরগাছা গিয়েও নদের সেই একই রূপ। তবে এখানে কচুরিপানা আরও বেশি।
এরপর পানিসারা হয়ে হরিহরনগর যাওয়ার পথে খেজুরগাছের সারি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। বাংলাদেশের সব খেজুরগাছ যেন নিয়ে আসা হয়েছে যশোরের মাঠেঘাটে। গোপালগঞ্জ যেমন তালগাছের জন্য বিখ্যাত, যশোর তেমনি খেজুরগাছের জন্য। এরপর জগিখালী, ত্রিমোহনীর পথ ধরলাম। ত্রিমোহনী এসে আরেকটি নদীর সঙ্গে দেখা হলো, নাম তার বুড়িভদ্রা। বিকেল গড়িয়ে এল। পথে নীলগলা বসন্তবৌরির ডাকে মনটা আনচান করতে থাকে। বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় এত নীলগলা বসন্তবৌরি দেখিনি। চাকলা নামের এক গ্রামে এসে দেখি রশি টানা খেয়া। নদের দুই পাড়ে খুঁটি গেড়ে এপার-ওপার রশি বেঁধে দেওয়া। নদীতে আছে নৌকা। নৌকায় দাঁড়িয়ে যদি কেউ রশি টান দেয়, তাহলে নৌকা সামনের দিকে চলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ফেরার পথে প্রায় ৩০টি গরুর গাড়ির দেখা মিলল। ছেলেমেয়ে, যুবক, বুড়ো সবাই মিলে বেড়াতে বের হয়েছেন। নানা রকম সাজসজ্জা, গান ও বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে তাঁরা চলছেন।
পরের দিন সকালে সাগরদাঁড়ির পথ ধরি। কেশবপুর উপজেলায় এসে কিছুক্ষণ যশোরের হনুমানদের খোঁজ করি। কিন্তু এ যাত্রা তাদের দেখা মিলল না। ওরা দলবেঁধে অন্যদিকে চলে গেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসি সাগরদাঁড়ি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটায়। নদের ঘাটেই প্রথম যাই। ঘাটে নাও ভেড়ানো আছে। কয়েক ঝাঁক মাঝলা ও গো-বগ খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। দত্তবাড়ির ঘাট থেকে একটু দূরেই কবির বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাড়ি ও অন্য সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে। টিকিট কেটে কবির বাড়ি ঢুকতে হবে। বেশ কিছু বড় আমগাছ আছে বাড়িটিতে। আরও আছে ঘাট বাঁধানো পুকুর। পাতিমাছরাঙা সব সময় আনাগোনা করে এ পুকুরে। বাড়ির ভেতরে আছে কবিপরিবারের ব্যবহূতসামগ্রী। যেমন—দা, আলনা, খাট, থালা, কাঠের সিন্দুক, কবির লিখিত পাণ্ডুলিপি, পারিবারিক ছবিসহ নানা কিছু।
সাগরদাঁড়ি দেখে কুমিরা, ইসলামকাঠি হয়ে আমরা তালা উপজেলায় পৌঁছালাম। পথে বেশ কিছু বিল পড়ে। শালিখা ও জালালপুর বিল এর মধ্যে অন্যতম। তালা গিয়ে কপোতাক্ষ নদে জোয়ার দেখা গেল। কিছু বড় নৌকা ছিল নদে। জোয়ারের পানিতে বেশ পলি। পলি জমে ওখানে নদ ভরাট হয়েযাচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির প্রবাহ। সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা গিয়ে দেখা গেল নদের পাশের কেওড়াগাছ মরে গেছে। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হলে এ গাছগুলো মারা যেত না।
কপোতাক্ষ নদের উৎপত্তি দর্শনার কাছে মাথাভাঙা নদী থেকে। এরপর চৌগাছা, ঝিকরগাছা, চাকলা, ত্রিমোহনী, জীবনগর, কোটচাঁদপুর, সাগরদাঁড়ি, তালা, কপিলমনি, বারুলী, চাঁদখালী, বড়দল, আমাদী, বেদকাশী প্রভৃতি স্থানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়া নদীর সঙ্গে মিশেছে। এখন সাগরদাঁড়ি থেকে কপিলমনিয়া পর্যন্ত হাঁটু কিংবা কোমর অবধি পানি। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা নেই বলে স্রোতও নেই। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে কপোতাক্ষের সঙ্গে গঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল বর্ষার সময় নদীতে অল্প পরিমাণ পানি আসে। এখন একমাত্র বর্ষার পানিই কপোতাক্ষের পানির প্রধান উৎস। কথিত আছে, কপোতের অক্ষের (কবুতরের চোখ) মতো স্বচ্ছ পানি বলে এ নদের নাম হয়েছিল কপোতাক্ষ। কিন্তু কপোতাক্ষের পানি আজ ঘোলা। এলাকাবাসীর অভিমত, ঠিকভাবে খনন করা হলে আবার কিছুটা হলেও সজিব হয়ে উঠবে কপোতাক্ষ। সেদিন হয়তো একটি পালতোলা নৌকার
দেখা পাবেন সেই আগন্তুক।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
সাগরদাঁড়িতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যেতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে যশোর। এরপর যশোর শহর থেকে বাসে করে কেশবপুর। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে করে সাগরদাঁড়ি যেতে হবে।
যশোর শহর থেকে সাগরদাঁড়ি পর্যন্ত প্রায় দু্ই-আড়াই ঘণ্টা পথ। দত্তবাড়ির কাছেই আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের রেস্টহাউস। সেখানে থাকতে পারেন অথবা থাকতে পারেন কেশবপুর উপজেলা ডাকবাংলোতে। তবে আগে থেকেই কথা বলে রাখতে হবে।
No comments:
Post a Comment