Tuesday, August 5, 2014

নিষিদ্ধ রাজ্যে

তিব্বত! সে এক অবাক করা নাম, জাদুময় ভূখণ্ড, যার তুলনা কেবল সে নিজেই! হাজার হাজার কিলোমিটার চলে যাওয়া ঊষর, রুক্ষ, পাথুরে ভূমি, পৃথিবীর উচ্চতম সফেদ পর্বতশৃঙ্গগুলোকে বুকে রাখা বিশ্বের সর্বোচ্চ মালভূমি আর বরফগলা রুপালি নদীর সমন্বয়ে গঠিত তিব্বতের জুড়ি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের গ্রহে আর নেই। হাজার বছর ধরেই তিব্বত এক নিষিদ্ধ বিস্ময় বহির্বিশ্বের কাছে। কারণ বিদেশিদের অনুপ্রবেশ একবারেই নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন, আজও তা নানা নিয়মকানুন শৃঙ্খলের নিগড়ে ঘেরা। ছোটবেলার সাধারণ জ্ঞানের বইয়েই দেখতাম, নিষিদ্ধ দেশ তিব্বত, নিষিদ্ধ নগর তিব্বতের রাজধানী লাসা, সেসব নাম যেন ফেনিয়ে ওঠা গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় ঘোর আলো-আঁধারে ঢাকা। এ বছর সৌভাগ্য হয়েছিল সেই স্বপ্নময়, জাদুঘেরা প্রায় মায়া বাস্তবতার আড়ালেই থাকা তিব্বত স্পর্শ করার। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে জিপগাড়িতে চেপে তিব্বতের সীমান্তে অবস্থিত কোদারি শহরে পৌঁছাই। আমরা বলতে পর্বতারোহণের সঙ্গী শেরপারা, সেই সঙ্গে দুজন বাংলাদেশি—অভিজ্ঞ পর্বতারোহী এম এ মুহিত ও আমি। এর আগে আমরা নেপালে এলেও এই প্রথম পা রাখতে যাচ্ছি তিব্বতের ভূখণ্ডে। মনের কোণে উত্হাসের বান ডেকেছে। হিমালয় থেকে বয়ে আসা বটেকোশি নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত এক সেতু সংযোগ করেছে এই দুই ভূখণ্ডকে। একনজর তাকাতেই কেন জানি ধনী-গরিবের পার্থক্যটা প্রকট হয়ে ধরা দিল খালি চোখেই। নেপালের সীমানায় কোনোমতে দাঁড় করানো কয়েকটা ভবন, অনেকটা ছাপড়া ধরনের কিছু খাবারের হোটেল, জনা কয়েক পুলিশ—এই শেষ; অন্যদিকে তিব্বতের সীমান্তের ভেতর চীনা সামরিক বাহিনীর প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গের মতোই স্থাপনা, সারি সারি ভবন, সর্বদাই টহলরত অস্ত্রধারী সৈনিক, সর্বক্ষণ কড়া পাহারা, যেন দর্শনার্থীদের কেউ সীমান্তবর্তী কোনো স্থাপনার, বিশেষ করে সেতুটার ছবি তুলতে না পারে। কাছের দেশ মানজালা (বাংলাদেশের চীনা নাম) থেকে এলেও ভিসার ঝামেলা শেষ করতে বেশ খানিকক্ষণ লেগে গেল। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য দুই বছর ধরে কোনো রকম রাজনৈতিক গোলযোগ এড়ানোর জন্য তিব্বতে কোনো রকম পর্বতাভিযান চালানোর অনুমতি দেয়নি চীন সরকার। কাস্টমসে গোমড়ামুখো চীনা পুলিশ কর্মকর্তার মূল আকর্ষণ ছিল আমার সঙ্গে বয়ে আনা চারটি বই। বই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা দালাই লামার লেখা কি না, তা-ই ছিল তাঁর উত্কণ্ঠার মূল কারণ। তবে আমার মাথায় কিছুতেই এল না, উচ্চশিক্ষিত এই সরকারি কর্মচারীরা আমার প্রতিটি ইংরেজি বই-ই কেন উল্টো করে ধরে যাচাই করলেন! সেই সঙ্গে চলল প্রত্যেকের ব্যাগে চিরুনি তল্লাশি। আমরা সবাই পার পেলেও এই ব্রাজিলীয় পর্যটকের ব্যাগে মিলল তিব্বতের পতাকা, ভিসা থাকা সত্ত্বেও সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশাধিকার বাতিল হয়ে গেল তাঁর! অন্যদের মুখে শুনলাম, কারও সঙ্গে মাওবিরোধী কোনো বই, এমনকি দালাই লামার ছবি থাকলেও তাঁর কপালে একই পরিণতি ঘটত।
নায়লামের যাত্রী
সীমান্তের অতি কাছের মেঘের কোলে জাংমু শহরে অবস্থান আর দুপুরের খাবারের আয়োজন ছিল। যেকোনো জায়গাতেই তিব্বতি মহিলাদের কর্মতত্পরতা চোখে পড়ার মতো। মিষ্টি হেসে তারা সম্বোধনের ভঙ্গিতে দুই হাত জোড় করে বলে, থাসিডেলি—নমস্তে। খানিক পরই গাড়িতে করে দারুণ পিচঢালা রাস্তায় তিন হাজার ৬৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত খুদে জনপদ নায়লামে আগমন। রাস্তাটির খানিক অংশ নির্মাণরত থাকলেও বাকি অতিচমত্কার অংশে এই দুর্গম এলাকায় কী করে যে চীনা সরকার এই বন্ধুর পথ হিমালয়ের বুক চিরে তৈরি করল! তবে এটিও ঠিক মনের অজান্তেই খচখচ করে বিঁধছিল, তিব্বতের মতো দুর্গম জায়গায় এত আধুনিক যানবাহনে প্রবেশ, ইয়াকের পিঠে এলেই হয়তো বেশি সার্থক মনে হতো। নায়লামে তখন দারুণ ঠান্ডা, কনকনে বাতাস, সঙ্গে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে সমতলের বাংলাদেশে মানুষের হঠাত্ করেই এতটা উঁচুতে অনেক কম অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাসে আসার কারণে স্বল্প মাথাব্যথা। এই অল্প অক্সিজেনে খাপ খাওয়ানোর জন্যই আমরা আস্তানা গাড়লাম দুই দিনের জন্য নায়লামের হোটেল স্নো ল্যান্ডে। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে দিয়ে বিখ্যাত তিব্বতি চা দিয়ে (প্রতি কাপে কমপক্ষে দুই চামচ লবণ আর ইয়াকের দুধের এক ডেলা মাখন, সেই চায়ে আবার ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ, বাঙালি রসনার জন্য মোটেও উপাদেয় কিছু নয়) সকালের নাশতার পর প্রতিদিনই হাইকিং করতে হতো উচ্চতর শৃঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য। পথে নজরে আসে তিব্বতিদের আলুর ক্ষেত, ইয়াকের সাহায্যে লাঙল টানা, ইয়াক চরানো রাখালদের আস্তানা ও ভেড়া-ছাগলের পাল গণনা করে কাঠমান্ডুর পূজায় সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা। ভেড়া গণনার সময় অবাক হয়ে শুনলাম, ১ থেকে ১০ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যার উচ্চারণ তিব্বতি আর বাংলায় হুবহু এক! এত উঁচুতে সে কী অপূর্ব নয়নাভিরাম প্রকৃতি! দূরে বটেকোশি নদী দেখা যায়, আর চারদিকে সবুজে ছাওয়া পর্বতমালা, আরও দূরে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। আস্তে আস্তে এই বাতাস সয়ে আসছে আমাদের, সেই সঙ্গে বাড়ছে সহ্যক্ষমতা, পর্বতারোহণের জন্য যা অতিগুরুত্বপূর্ণ।

ট্রেকিং শেষে শহরে ফেরার পথে চোখে পড়ে ক্রীড়ারত তিব্বতি শিশু, ইয়াকের মাংস নিয়ে খোলা জায়গায় কসাইয়ের দোকান, অতি সুসজ্জিত চীনা সামরিক বাহিনীর অফিস। পরে খুঁজে খুঁজে এক সাইবার ক্যাফে পেয়ে সেখানে ঢুকতেই চক্ষু চড়কগাছ, তিব্বতি ছেলে-ছোকরারা ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে বসে গেম খেলছে দস্তুরমতো, ভিড়ে আর সেখানে বসতেই পারলাম না। প্রায় সব ব্যবসার মালিক তিব্বতে গত কয়েক দশকে আসা হান চায়নিজরা। মনের গহিনে প্রশ্নের ঝড় ওঠে—এই কি আমার স্বপ্নের তিব্বত, যেখানে যন্ত্রসভ্যতাতেই অভ্যস্ত সবাই, অধিকাংশ স্থানীয় শিশুর ধূলিধূসরিত গায়ে মলিন পোশাক। আর কাকভোরে ঘুম ভেঙে যায় সৈনিকদের কুচকাওয়াজে।
এক সকালে যাত্রা শুরু হয়েছিল নায়লাম থেকে, মাইলের পর মাইল রুক্ষ, ঊষর, বন্ধুর, আপাতদৃষ্টিতে প্রাণহীন, অনুর্বর তিব্বতের মালভূমি, পর্বত আর উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত অদ্বিতীয় ভূখণ্ড, এর মধ্যে চড়াই-উতরাই, মালভূমি, উপত্যকা, নদী, এমনকি প্রায় পর্বতশিখর অতিক্রম করে চলে গেছে এই বিশ্বের উচ্চতম হাইওয়ে, এত মসৃণ সে রাস্তা, এমন নিপুণ দক্ষতায় এর সমাপ্তি টানা হয়েছে, সত্যিকার অর্থেই মনে হয় মাখনের তৈরি, আর চলে গেছে এই গ্রহের বন্ধুরতম জায়গাগুলোর একটির বুক চিরে। জানা গেল বেইজিং অলিম্পিকের জন্য মাউন্ট এভারেস্টের বেসক্যাম্প পর্যন্ত এই পিচঢালা পথ নিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনা হাতে নেই সে দেশের সরকার, অবধারিতভাবেই শ্রমিক হিসেবে ব্যবহূত হয় দরিদ্র তিব্বতিরা। পথে অনেক জায়গায়ই দেখা হলো ছোট ছোট তিব্বতি গ্রাম, কোনো গ্রামে উঁচু জায়গায় বৌদ্ধমন্দির, অনেক গ্রামে সৌরশক্তি ব্যবহারের জন্য সোলার প্যানেলের ব্যবহার, ইয়াক, ভেড়া, পার্বত্য ছাগল, টাট্টু ঘোড়ার পাল নিয়ে চারণরত রাখালদের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার গাড়ি থামাতে হলো রাস্তা আটকে থাকা গবাদিপশুর ভিড়ের কারণে। বিচিত্র সেই রাখালদের বেশভূষা, লম্বা চুল নানাভাবে সজ্জিত, কারও কারও এক কানে বিশাল মাকড়ি, মাথায় টুপি, এককালের রংচঙে কাপড় বহুব্যবহারে বিবর্ণ। অনেক শিশুকে দেখা গেল চারণকাজে নিয়োজিত। নয়নহারী এদের বাড়িগুলো। অধিকাংশ সাদা রঙের হলেও জানালাগুলো নানা রঙে ঝলমলে। বাড়ির দেয়ালের ওপর ইয়াকের গোবরের ঘুঁটের সমাহার। প্রতিটি লোকালয়েই একদল কুকুর সদা প্রহরারত, বিশালাকৃতির রোমশ কুকুরগুলো স্থানীয় বাসিন্দদের চোখের মণি।
মনের পর্দাজুড়ে বিরাজ করছিল তিব্বতের অপার্থিব ভয়ংকর সৌন্দর্যময় ঊষরভূমির কথা, আর এতটা রুক্ষ বলেই হয়তো তিব্বতের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে এত অলঙ্ঘনীয়, অমোঘ, হাজার বছর ধরে আছে সে ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে।
সেই সঙ্গে এটাও ভুললে চলবে না, যে কারণে আমাদের পলিমাটি দিয়ে তৈরি বাংলাদেশ এত সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, সেই একই কারণে তিব্বত এতটা রুক্ষ, বন্ধুর। কারণটা গিরিরাজ হিমালয়, এক বিশাল প্রাচীরের মতো সীমানা আগলে দাঁড়িয়ে আছে তা। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ মেঘ কোনোমতেই সেই সুউচ্চ বাধা ডিঙাতে পারে না। ফলে বৃষ্টিপাত একতরফাভাবে সব সময়ই পক্ষপাতিত্ব করে আমাদের দিকটাতে, গড়ে তোলে উর্বর ভূমি, আর হিমালয়-প্রাচীরের অন্য পাশে তিব্বত থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে শুষ্ক, রিক্ত।
গোটা পঞ্চাশেক বাড়ি আর হোটেলের এক খুদে তিব্বতি জনপদ তিংরি। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার হাজার ২০০ মিটার। পশ্চিমে শত শত মাইল চলে গেছে তিব্বতের রুক্ষ মালভূমি আর পূর্বে খানিক পরই দৃষ্টি আটকে দাঁড়ায় বিশ্বের বিস্ময় এই গ্রহের উচ্চতম পর্বতমালায়। আমাদের লজের পূর্ব দিগন্তে গোটা বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট এভারেস্ট। তিংরির হোটেলের যে সদা তত্পর দিদিমা পাহারাদার থেকে শুরু করে হেঁশেলদারির কাজ পর্যন্ত করতেন, তাঁর শত ভাঁজ পড়া মুখের রেখাগুলো বলে দেয়, শতবর্ষী না হলেও অন্তত ৯০ বছরের হবেনই মহিলা। এ এক জিনিস আমরা দেখেছি সেখানকার পাহাড়িদের মধ্যে, অদম্য প্রাণশক্তি, নির্মেদ শরীর, জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমরত। লাঠি হাতে সেই কয়েক সপ্তাহে কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অনেকের হাতেই জপমালা অথবা জপযন্ত্র, ওম মণি পদ্মে ওম (তিব্বতিদের প্রার্থনার মূল বাক্য) আউড়ে যাচ্ছে অবিরাম। তবে তিতিবিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম সবাই সেখানকার খাবারে। তিব্বতিদের প্রধান খাবার চমবা (গম ও যবের সমন্বয়ে তৈরি) আমাদের দেওয়া হতো না। ছিল মাত্রাতিরিক্ত তেলে ভাজা সবজি, ডিম, কখনো বা ইয়াকের মাংস। সেই ডিম ভাজিতে না কোনো নুন, না কোনো ঝাল। শেষে তিংরি বাজারে অবস্থিত নামকাওয়াস্তে এক নেপালি রেস্তোরাঁ ছিল আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। আর বাজারগুলোতে যেন ধুলো সব সময় থই থই করছে। কসাইয়ের দোকানে ঝোলানো ভেড়া বা ইয়াকের মাংসে ধুলোর পুরু আস্তরণ। তিব্বতিদের শরীরেও তা-ই। এমনিতেই তাদের দুর্নাম আছে, স্নান থেকে যত দূর সম্ভব দূরে থাকার। ছবি তুললে অনেকেই এসে টাকা দাবি করে। পথে এক ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানকারী মহিলা আমার গলায় ঝোলানো বাংলাদেশের গামছা খুব পছন্দ করায় একটি চমত্কার টুপির সঙ্গে বিনিময়ের প্রস্তাব দেন। আমিও প্রস্তাব গ্রহণ করি, তবে সেই রোমশ টুপির বিনিময়ে নয়, তাঁর দুটি ছবি তোলার অনুমতির বিনিময়ে। তিব্বতের প্রায় ৮০০ জনবসতির আরও দু-একটি ঘুরে আমরা রওনা দিই গন্তব্যের পানে।

No comments:

Post a Comment