অসম ভ্রমণে গিয়ে কামাখ্যা দর্শন করেননি এমন পর্যটক বিরল। ৫১ পিঠের
অন্যতম কামাখ্যা মন্দিরের প্রসিদ্ধি প্রাচীন কাল থেকে। এখানে বসে সাধনায়
সিদ্ধিলাভ না করলে তন্ত্র মার্গ পরিক্রমা অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলে কথিত। এই
বহুচর্চিত ধর্মস্থান ঘোরার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন ‘ভবঘুরে’।
দক্ষযজ্ঞ।
হিমালয় রাজের প্রাসাদে মহাযজ্ঞ। আর সেখানে কি না তাঁর আদরের কন্যা সতী নিমিন্ত্রত নন! পরণে বাঘছাল, গলায় সাপ, গায়ে ভস্ম, সঙ্গীসাথি বলতে ভুতেপ্রত— এ হেন চালচুলোহীন যার স্বামী, তাঁকে গণ্যমান্য অতিথিদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লজ্জায়ই এই কাণ্ড। কিন্তু খবর পেয়ে সতী গো ধরে বসলেন। যাবেনই সেই যেজ্ঞ অংশ নিতে। স্বামী দেবাদিদেব অনেক বুঝিয়েও তাকে ঠেকাতে পারলেন না। এবং অঘটন ঘটল দক্ষের প্রাসাদে। সকল অতিথিদের মাঝেই অপমানিতা হলেন সতী। কিন্তু স্বামীর উদ্দেশে পিতার কটূক্তি সহ্য করতে পারলেন না। রাগে-দুঃখে তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করলেন। খবর পেয়ে মহাদেব ছুটে গেলেন প্রাসাদে এবং সতীর প্রাণহীন দেহ কাধে তুলে নিয়ে শুরু করলেন বিধ্বংসী প্রলয় নাচন। তাণ্ডব নৃত্য। অন্যান্য দেবদেবী অনেক চেষ্টা করলেন তাঁকে শান্ত করার। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। সৃষ্টি যখন রসাতলে যায় যায়, তখন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দিলেন। এক সময় ভৈরব বুঝলেন তাঁর কাঁধে প্রিয় পত্নীর দেহ আর নেই। শান্ত হলেন তিনি।
পুরাণ কথিত এই গল্প এখানেই শেষ নয়। সতীর দেহ একান্ন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে। যার প্রত্যেকটি জায়গায় একটি মাতৃমিন্দর স্থাপিত হয়েছে। পোশাকি নাম ‘পিঠ’। সেই একান্ন পিঠের একটিই হল কামরূপ কামাখ্যা। এখানে সতীদেহের স্ত্রী-অঙ্গ পড়েছিল।
চেরাপুঞ্জি, শিলং, বরাপানি এবং সব শেষে গুয়াহাটি হয়ে এবার ঘরে ফেরার পালা। কিন্তু এত কাছে গিয়ে কামাখ্যা দর্শন না করে চলে আসা— মনে একটা খুতখুতুনি হচ্ছিল। ঠিক হল, বিমানবন্দর পৌছনোর আগে মিন্দরে একবার যাবই।
গুয়াহাটি স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই নীলাচল পর্বত। সেখানেই অধিষ্ঠান দেবী কামাখ্যার। ইতিহাস হাতড়ালে, সমুদ্রগুপ্তর রাজত্বকালে এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে বিধর্মীদের আক্রমণে মন্দির প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ১৬৬৫ সালে কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ নতুন মিন্দর তৈরি করেন। বর্তমানে সেই মিন্দরেই বিরাজমানা দেবী।
পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে সিরাজ, আমাদের যানচালক, নিয়ে চলেছেন কামাখ্যা মিন্দরের দিকে। পথের এক দিকে রেলিং, অন্য দিকটা কখনও পাথুরে, কখনও ঝোপঝাড়ে ভরা। গাড়ি যত ওপরে উঠছে গাছগুলো যেন ক্রমশ ঝুকে পড়ছে। শীতের সকালে আড়মোড়া খেয়ে সবে গুয়াহাটি শহর জেগে উঠছে। রাস্তায় লোকজন চলাচলও শুরু হয়েছে। পুজো সবে শেষ হয়েছে, তবে তার রেশ তখনও কাটেনি। সামনে আবার লক্ষ্মীপুজো। ফলে শহর জুড়ে পুরোপুরি পুজোর আমেজ। সকালের বাজার রোজকার মতই বসেছে। অনেক জায়গায় ফল ফুলের বাজারের রমরমা। কয়েক জায়গায় মাটির মূর্তিরও ঢালাও প্রদর্শনী। তবে ছুটির দিনের আমেজ ছিল বারো আনাই। বহু দোকানেরই ঝাপ খোলেনি। অনেকের আবার অর্ধেক ঝাপ খোলা।
এইসব দেখতে দেখতেই এক সময় পৌছে গেলাম মন্দিরে।
এবার পুজো দেওয়ার পালা। প্রবেশদ্বারের বাইরে জুতো খুলে এক পুরোহিতকে জোগাড় করা হল। তিনি আশ্বাস দিলেন, মিন্দরে পুজো পর্ব নিয়ে কোনও ভাবনাই ভাবতে হবে না। তার কথামতো চললেই হবে। কথার খেলাপ তিনি করেননি।
প্রধান মিন্দরের বাইরের কুণ্ড থেকে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে শুরু হল পুজো পর্ব। দেখলাম অসমিয়া ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘যখনই মুখ খুলিবেন, মা কামাখ্যার নাম বলিবেন।’ দেশের আর পাচটা বড় মিন্দরের মতোই নগদমূল্যে
পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন। অেনকেই বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে। কিন্তু আমাদের বিমান ধরার তাড়া। তাই কিঞ্চিত উধ্বর্মূল্য দিয়েই দেবী দর্শনের ব্যবস্থা হল। আধো অন্ধকারে ভিড়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে সে কাজও এক সময় শেষ হল। মিন্দরে অনেক কুমারী পুজোও হচ্ছিল। এক জায়গায় অনেক ঘন্টা বাধা। পুরোহিতকে জিেজ্ঞস করে জানতে পারলাম, দেবীর কাছে প্রার্থনা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে তারা ঘন্টা বেধে যান।
কামাখ্যা মিন্দরের চুড়ো সপ্তরত্ন আকৃতির। তার গড়নে পাওয়া যায় মৌচাকের আদল। সাতটি ডিম্বাকৃতি গম্বুজের প্রতিটির ওপর তিনখানা স্বর্ণকলস বসানো আছে। মিন্দরের বহিরাংশে গণেশ ও অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিকৃতি ও পুরাণ কাহিনীর নানা খণ্ডচিত্র খোদাই করা প্যানেলের সারি। মিন্দরের ভেতরে তিনটি প্রকোষ্ঠ। সবচেয়ে বড় পিশ্চম প্রকোষ্ঠটি আয়তাকার। এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবী কামাখ্যার ছোট মূর্তি আছে। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা শিলালিপি, মহারাজ নরনারায়ণ এবং অন্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দেখা যায়। এই প্রকোষ্ঠর পরেই গুহা সংবলিত গর্ভগৃহ শুরু হয়েছে। গুহার দেওয়ালে কোনও ছবি বা খোদাইয়ের কাজ নেই। সরু সিঁড়ির ধাপের শেষে যোনি আকৃতির পাথরের ফাটল থেকে ঝরে পড়ছে প্রাকৃতিক ঝরণাধারা। জলের ধারা সৃিষ্ট করেছে একরত্তি জলাশয় যার ধারে অবিরাম পূজার্চনা চলে। ধারার উৎসমুখ ঢাকা এক টুকরো লাল কাপড়ে।
মিন্দরের চাতালে, ঝলমলে রোদে পায়রার দল রীতিমতো কোলাহল করে দানা খেয়ে বেড়াচ্ছে। একদিকে বসে রয়েছেন জটাজূটধারী এক সাধু। কারও কাছেই কিছু চাওয়ার নেই তার। চেষ্টা করলাম তার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। সম্ভবত মৌনব্রত নিয়েছেন। মিন্দরে ঢোকার পথে দু’ধারে পসরা সাজিয়ে দোকানের পর দোকান। অনেকের মত আমরাও মিন্দরে আসার স্মারক কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ছোট্ট মিঠিকে ভরিয়ে দেওয়া হল মালায়।
আর বেশী সময় নেই। সিরাজের রথে চড়ে এবার সোজা বিমানবন্দরের দিকে। মাঝে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সিরাজের অনুরোধে হেঁটে পৌছলাম রাস্তার ধারে, ওপর থেকে গুয়াহাটি শহরটাকে দেখতে। দুটি রাস্তা সমান্তরাল ভাবে শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। রোদ পড়ে তার জল চিক্ চিক্ করছে। অসাধারণ সুন্দর ও অভিনব সেই দৃশ্য। যথারীতি চলল ফটোসেশন।
সেখানে দাঁড়িয়েই কথায় কথায় কামাখ্যা নিয়ে জানতে পারলাম আমার অজানা আরও গল্প। আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা মিন্দর তিন দিন বন্ধ থাকে। এই সময় গর্ভগৃহের চারপাশের জল রক্তিম হয়ে যায়। দেবী রজঃস্বলা হন। তাই মিন্দরে প্রবেশ করা সকলের জন্য নিষিদ্ধ। এক তরুণ পূজারি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় দেবীর কোপে তিনি দৃিষ্টহীন হয়ে যান।
শোনা যায়, কোচবিহারের যে রাজবংশ দেবীর প্রধান ভক্ত ছিল, দেবীর আদেশে তাদেরই মন্দিরে পুজো দেওয়া বারণ ছিল। এখনও রাজবংশের কেউ নীলাচল পর্বতের পাশ দিয়ে গেলে মিন্দরের দিকে তাকান না।
এই মন্দির ‘কামরূপ কামাখ্যা’ নামেও পরিচিত। তারও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। কোনও এক কারণে কামদেবের ওপর বিরক্ত হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দেন। মুক্তির একমাত্র পথ ছিল টুকরো হয়ে যাওয়া সতী দেহের স্ত্রী-অঙ্গ খুজে বের করা। নীলাচল পর্বতে এসে তিনি তা পেয়েছিলেন। এবং দেবীর আরাধনাও করেছিলেন। সেই থেকে এই নাম।
যেতে ইচ্ছে একেবারেই করছিল না। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তখন সতর্কবাণী
শোনাচ্ছে। আর দেরি করলে ফ্লাইট মিস করব। পথে সিরাজ শোনালেন আরও এক লোকগাথা। বেশ মজার সে গল্প। নরকাসুরের ইচ্ছে হল দেবী কামাখ্যাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু দেবী তো আর অসুরকে বিয়ে করতে পারেন না। তাই তিনি ছলের আশ্রয় নিলেন।
অসুরকে শর্ত দিলেন এক রাতের মধ্যে যদি সে মন্দির নির্মান করতে পারে তবেই তার সাধ পূর্ণ হবে। প্রবল উৎসাহে অসুরও কাজে নেমে পড়ল। রাত শেষ হওয়ার আগেই মন্দিরের কাজ প্রায় শেষ। বিপদ বুঝে মন্দিরের সিড়ি বানানো শেষ হওয়ার আগেই একখানা মোরগ ছেড়ে দিলেন। ভোর না হতেই সে ডেকে উঠল। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় শেষ। অথচ কাজ তখনও বাকি। তাই নরকাসুরের আর দেবীকে বিয়ে করা হল না। অনেকের মতে বর্তমান মন্দির সেই নরকাসুরেরই তৈরি।
শুনে মনে হল, তা হলে দেবদেবীরাও খুনসুটি করেন!
দক্ষযজ্ঞ।
হিমালয় রাজের প্রাসাদে মহাযজ্ঞ। আর সেখানে কি না তাঁর আদরের কন্যা সতী নিমিন্ত্রত নন! পরণে বাঘছাল, গলায় সাপ, গায়ে ভস্ম, সঙ্গীসাথি বলতে ভুতেপ্রত— এ হেন চালচুলোহীন যার স্বামী, তাঁকে গণ্যমান্য অতিথিদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লজ্জায়ই এই কাণ্ড। কিন্তু খবর পেয়ে সতী গো ধরে বসলেন। যাবেনই সেই যেজ্ঞ অংশ নিতে। স্বামী দেবাদিদেব অনেক বুঝিয়েও তাকে ঠেকাতে পারলেন না। এবং অঘটন ঘটল দক্ষের প্রাসাদে। সকল অতিথিদের মাঝেই অপমানিতা হলেন সতী। কিন্তু স্বামীর উদ্দেশে পিতার কটূক্তি সহ্য করতে পারলেন না। রাগে-দুঃখে তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করলেন। খবর পেয়ে মহাদেব ছুটে গেলেন প্রাসাদে এবং সতীর প্রাণহীন দেহ কাধে তুলে নিয়ে শুরু করলেন বিধ্বংসী প্রলয় নাচন। তাণ্ডব নৃত্য। অন্যান্য দেবদেবী অনেক চেষ্টা করলেন তাঁকে শান্ত করার। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। সৃষ্টি যখন রসাতলে যায় যায়, তখন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দিলেন। এক সময় ভৈরব বুঝলেন তাঁর কাঁধে প্রিয় পত্নীর দেহ আর নেই। শান্ত হলেন তিনি।
পুরাণ কথিত এই গল্প এখানেই শেষ নয়। সতীর দেহ একান্ন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে। যার প্রত্যেকটি জায়গায় একটি মাতৃমিন্দর স্থাপিত হয়েছে। পোশাকি নাম ‘পিঠ’। সেই একান্ন পিঠের একটিই হল কামরূপ কামাখ্যা। এখানে সতীদেহের স্ত্রী-অঙ্গ পড়েছিল।
চেরাপুঞ্জি, শিলং, বরাপানি এবং সব শেষে গুয়াহাটি হয়ে এবার ঘরে ফেরার পালা। কিন্তু এত কাছে গিয়ে কামাখ্যা দর্শন না করে চলে আসা— মনে একটা খুতখুতুনি হচ্ছিল। ঠিক হল, বিমানবন্দর পৌছনোর আগে মিন্দরে একবার যাবই।
গুয়াহাটি স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই নীলাচল পর্বত। সেখানেই অধিষ্ঠান দেবী কামাখ্যার। ইতিহাস হাতড়ালে, সমুদ্রগুপ্তর রাজত্বকালে এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে বিধর্মীদের আক্রমণে মন্দির প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ১৬৬৫ সালে কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ নতুন মিন্দর তৈরি করেন। বর্তমানে সেই মিন্দরেই বিরাজমানা দেবী।
পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে সিরাজ, আমাদের যানচালক, নিয়ে চলেছেন কামাখ্যা মিন্দরের দিকে। পথের এক দিকে রেলিং, অন্য দিকটা কখনও পাথুরে, কখনও ঝোপঝাড়ে ভরা। গাড়ি যত ওপরে উঠছে গাছগুলো যেন ক্রমশ ঝুকে পড়ছে। শীতের সকালে আড়মোড়া খেয়ে সবে গুয়াহাটি শহর জেগে উঠছে। রাস্তায় লোকজন চলাচলও শুরু হয়েছে। পুজো সবে শেষ হয়েছে, তবে তার রেশ তখনও কাটেনি। সামনে আবার লক্ষ্মীপুজো। ফলে শহর জুড়ে পুরোপুরি পুজোর আমেজ। সকালের বাজার রোজকার মতই বসেছে। অনেক জায়গায় ফল ফুলের বাজারের রমরমা। কয়েক জায়গায় মাটির মূর্তিরও ঢালাও প্রদর্শনী। তবে ছুটির দিনের আমেজ ছিল বারো আনাই। বহু দোকানেরই ঝাপ খোলেনি। অনেকের আবার অর্ধেক ঝাপ খোলা।
এইসব দেখতে দেখতেই এক সময় পৌছে গেলাম মন্দিরে।
এবার পুজো দেওয়ার পালা। প্রবেশদ্বারের বাইরে জুতো খুলে এক পুরোহিতকে জোগাড় করা হল। তিনি আশ্বাস দিলেন, মিন্দরে পুজো পর্ব নিয়ে কোনও ভাবনাই ভাবতে হবে না। তার কথামতো চললেই হবে। কথার খেলাপ তিনি করেননি।
প্রধান মিন্দরের বাইরের কুণ্ড থেকে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে শুরু হল পুজো পর্ব। দেখলাম অসমিয়া ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘যখনই মুখ খুলিবেন, মা কামাখ্যার নাম বলিবেন।’ দেশের আর পাচটা বড় মিন্দরের মতোই নগদমূল্যে
পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন। অেনকেই বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে। কিন্তু আমাদের বিমান ধরার তাড়া। তাই কিঞ্চিত উধ্বর্মূল্য দিয়েই দেবী দর্শনের ব্যবস্থা হল। আধো অন্ধকারে ভিড়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে সে কাজও এক সময় শেষ হল। মিন্দরে অনেক কুমারী পুজোও হচ্ছিল। এক জায়গায় অনেক ঘন্টা বাধা। পুরোহিতকে জিেজ্ঞস করে জানতে পারলাম, দেবীর কাছে প্রার্থনা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে তারা ঘন্টা বেধে যান।
কামাখ্যা মিন্দরের চুড়ো সপ্তরত্ন আকৃতির। তার গড়নে পাওয়া যায় মৌচাকের আদল। সাতটি ডিম্বাকৃতি গম্বুজের প্রতিটির ওপর তিনখানা স্বর্ণকলস বসানো আছে। মিন্দরের বহিরাংশে গণেশ ও অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিকৃতি ও পুরাণ কাহিনীর নানা খণ্ডচিত্র খোদাই করা প্যানেলের সারি। মিন্দরের ভেতরে তিনটি প্রকোষ্ঠ। সবচেয়ে বড় পিশ্চম প্রকোষ্ঠটি আয়তাকার। এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবী কামাখ্যার ছোট মূর্তি আছে। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা শিলালিপি, মহারাজ নরনারায়ণ এবং অন্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দেখা যায়। এই প্রকোষ্ঠর পরেই গুহা সংবলিত গর্ভগৃহ শুরু হয়েছে। গুহার দেওয়ালে কোনও ছবি বা খোদাইয়ের কাজ নেই। সরু সিঁড়ির ধাপের শেষে যোনি আকৃতির পাথরের ফাটল থেকে ঝরে পড়ছে প্রাকৃতিক ঝরণাধারা। জলের ধারা সৃিষ্ট করেছে একরত্তি জলাশয় যার ধারে অবিরাম পূজার্চনা চলে। ধারার উৎসমুখ ঢাকা এক টুকরো লাল কাপড়ে।
মিন্দরের চাতালে, ঝলমলে রোদে পায়রার দল রীতিমতো কোলাহল করে দানা খেয়ে বেড়াচ্ছে। একদিকে বসে রয়েছেন জটাজূটধারী এক সাধু। কারও কাছেই কিছু চাওয়ার নেই তার। চেষ্টা করলাম তার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। সম্ভবত মৌনব্রত নিয়েছেন। মিন্দরে ঢোকার পথে দু’ধারে পসরা সাজিয়ে দোকানের পর দোকান। অনেকের মত আমরাও মিন্দরে আসার স্মারক কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ছোট্ট মিঠিকে ভরিয়ে দেওয়া হল মালায়।
আর বেশী সময় নেই। সিরাজের রথে চড়ে এবার সোজা বিমানবন্দরের দিকে। মাঝে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সিরাজের অনুরোধে হেঁটে পৌছলাম রাস্তার ধারে, ওপর থেকে গুয়াহাটি শহরটাকে দেখতে। দুটি রাস্তা সমান্তরাল ভাবে শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। রোদ পড়ে তার জল চিক্ চিক্ করছে। অসাধারণ সুন্দর ও অভিনব সেই দৃশ্য। যথারীতি চলল ফটোসেশন।
সেখানে দাঁড়িয়েই কথায় কথায় কামাখ্যা নিয়ে জানতে পারলাম আমার অজানা আরও গল্প। আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা মিন্দর তিন দিন বন্ধ থাকে। এই সময় গর্ভগৃহের চারপাশের জল রক্তিম হয়ে যায়। দেবী রজঃস্বলা হন। তাই মিন্দরে প্রবেশ করা সকলের জন্য নিষিদ্ধ। এক তরুণ পূজারি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় দেবীর কোপে তিনি দৃিষ্টহীন হয়ে যান।
শোনা যায়, কোচবিহারের যে রাজবংশ দেবীর প্রধান ভক্ত ছিল, দেবীর আদেশে তাদেরই মন্দিরে পুজো দেওয়া বারণ ছিল। এখনও রাজবংশের কেউ নীলাচল পর্বতের পাশ দিয়ে গেলে মিন্দরের দিকে তাকান না।
এই মন্দির ‘কামরূপ কামাখ্যা’ নামেও পরিচিত। তারও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। কোনও এক কারণে কামদেবের ওপর বিরক্ত হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দেন। মুক্তির একমাত্র পথ ছিল টুকরো হয়ে যাওয়া সতী দেহের স্ত্রী-অঙ্গ খুজে বের করা। নীলাচল পর্বতে এসে তিনি তা পেয়েছিলেন। এবং দেবীর আরাধনাও করেছিলেন। সেই থেকে এই নাম।
যেতে ইচ্ছে একেবারেই করছিল না। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তখন সতর্কবাণী
শোনাচ্ছে। আর দেরি করলে ফ্লাইট মিস করব। পথে সিরাজ শোনালেন আরও এক লোকগাথা। বেশ মজার সে গল্প। নরকাসুরের ইচ্ছে হল দেবী কামাখ্যাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু দেবী তো আর অসুরকে বিয়ে করতে পারেন না। তাই তিনি ছলের আশ্রয় নিলেন।
অসুরকে শর্ত দিলেন এক রাতের মধ্যে যদি সে মন্দির নির্মান করতে পারে তবেই তার সাধ পূর্ণ হবে। প্রবল উৎসাহে অসুরও কাজে নেমে পড়ল। রাত শেষ হওয়ার আগেই মন্দিরের কাজ প্রায় শেষ। বিপদ বুঝে মন্দিরের সিড়ি বানানো শেষ হওয়ার আগেই একখানা মোরগ ছেড়ে দিলেন। ভোর না হতেই সে ডেকে উঠল। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় শেষ। অথচ কাজ তখনও বাকি। তাই নরকাসুরের আর দেবীকে বিয়ে করা হল না। অনেকের মতে বর্তমান মন্দির সেই নরকাসুরেরই তৈরি।
শুনে মনে হল, তা হলে দেবদেবীরাও খুনসুটি করেন!
No comments:
Post a Comment