Monday, August 4, 2014

নদীর বুকে এক রাত

এলিফ্যান্ট রোড থেকে রিকশা করে সদরঘাটে ঢাকা নদীবন্দর যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তেমন একটা ভিড় নেই নদীবন্দরে। টার্মিনালে ছোট-বড় অনেক লঞ্চ ভেড়ানো। ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চগুলোই সবচেয়ে ভালো ও উন্নত মানের। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ লঞ্চে করে বাড়িতে যায়। খুব আরামদায়ক ভ্রমণ। পুরো রাত ঘুমিয়ে সকালে বরিশাল।
আমরা তখন বরিশালগামী লঞ্চ সুন্দরবন-৭-এর একটি ভিআইপি কেবিনে। আধুনিক সব ব্যবস্থাই আছে। কেবিন-বয় চা দিয়ে গেল। কাপটি নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একজনের সঙ্গে পরিচয়। উত্তরবঙ্গের মানুষ। এত বড় লঞ্চ দেখে হতবাক তিনি। বাস, ট্রাক দেখেই তিনি অভ্যস্ত। যমুনার বুকে তিনি কখনো এত বড় জলযান দেখেননি। কথা বলতে বলতে আটটা ত্রিশ বেজে গেল। হুইসেলের শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যে সুন্দরবন-৭ বরিশালের উদ্দেশে ঢাকা নদীবন্দর ত্যাগ করবে। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা রুটের নৌযানগুলো একটু তাড়াতাড়িই ছেড়ে চলে যায় গন্তব্যের দিকে।
বারান্দার টিউব লাইটের আলোটা নিভে গেল। লঞ্চ ছেড়ে দিল। ঢাকার কোলাহল আস্তে আস্তে কমে আসছিল। রাতের আঁধারে মাঝে মাঝে জ্বলছে বাতি। লঞ্চ বুড়িগঙ্গা ছেড়ে পড়ল গিয়ে ধলেশ্বরীর জলে।
রাতের খাবার এল ১০টার দিকে। রুপচাঁদা, পদ্মার ইলিশ ভাজা, ডাল চচ্চড়ি, সেই সঙ্গে কয়েক রকম ভর্তা-ভাজি। তোফা ব্যবস্থা। মুরগি ভুনাও আছে। অনেকে আবার বাসা থেকে খাবার সঙ্গে করে নিয়েও আসেন।
রাত দুটো। পদ্মা কিংবা মেঘনা নদীতে লঞ্চ। চাঁদ জেগে আছে মাথার ওপর। রাতজাগা চাঁদের অলোয় নদীর জলে অনন্য এক রুপালি আভা। গুমগুম করে জল কেটে চলে লঞ্চ। রাতে নদীর মাঝের বিশুদ্ধ বাতাসে দেহ-মন পুরোটাই জুড়িয়ে যায়। লঞ্চ ভ্রমণটা শীতের দিনে একরকম আনন্দের, আবার বর্ষাকালে আরেক ধরনের মজা। তবে বসন্ত ও বর্ষার সময় সবচেয়ে বেশি মজা। শীতের দিনে প্রকৃতি মোড়া থাকে কুয়াশার চাদরে। নদীপথে যেতে দেখা যায় নদীর জলের মধ্যে আলো জ্বলছে। আসলে এগুলো হলো ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। কখনো দেখা হয়ে যেতে পারে কোনো স্টিমারের সঙ্গে। দূরে কিছুক্ষণ পরপর জ্বলে ওঠে লাল, সবুজ আলো। নৌযানগুলো কোন পথ দিয়ে যাবে, এসব বাতিঘর আলো জ্বালিয়ে তার নির্দেশনা দেয়।
বড় নদী পাড়ি দিয়ে লঞ্চ একসময় ছোট নদীতে পড়ে। তখন আর বরিশাল বেশি দূরে নয়। রাতের নীরবতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ভোরের আলো জেগে ওঠে। ভোরের পাখিরা উড়ে যায় দূরে কোথাও। শান্ত এক নদীতে চলে আসে লঞ্চটি। তার নাম হলো কীর্তনখোলা। বরিশাল এ নদীর তীরেই অবস্থিত।
তখন ভোর ছয়টা। অনেক যাত্রী তখনই নামতে শুরু করেন। কেউ আবার লঞ্চেই একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নেন। ঢাকা বন্দরে লঞ্চ ভিড়লে অনেক কাকপাখি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু এখানে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন, একঝাঁক শালিক চেয়ে আছে আপনার দিকে।
লঞ্চ থেকে নেমে বরিশাল শহর ঘুরে দেখতে পারেন। ছোট্ট এক শহর। কিন্ত দেখার মতো রয়েছে কিছু স্থান। বিকেলের দিকে কীর্তনখোলা নদীর রূপটি দেখতে পারেন। অনেক পাল তোলা নৌকা, নদীর পাড়ের সবুজ আপনাকে মুগ্ধ করবে। ঘুরে আসতে পারেন কবি জীবনানন্দের বাড়ি, ব্রজমোহন কলেজ, শঙ্কর মঠ, বেলস লেক (বঙ্গবন্ধু উদ্যানসংলগ্ন), ত্রিশ গোডাউন, আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, অক্সফোর্ড মিশন চার্চ, শিশু পার্ক, পদ্মপুকুর, দুর্গা সাগর, অশ্বিনী কুমার হল, বিবির পুকুর। সবকিছু ঘুরে দেখতে দুই দিন লাগবে। অটোরিকশা ভাড়া করে নিলেই সবই হাতের কাছে। পরিচিত কেউ থাকলে অবশ্যই তার সাহায্য নেবেন।
কীভাবে যাবেন
বাস, সিএনজি, রিকশা করে সোজা চলে যাবেন গুলিস্তান বা সদরঘাট। সন্ধ্যা থেকেই অনেক লঞ্চ ছাড়ে। বরিশাল যেতে চাইলে বড় বড় নৌযান আছে। বিশেষ করে সুরভী-৭ ও ৮; সুন্দরবন-৭, পারাবত-২, ৭, ৯ ও ১১; কীর্তনখোলা, কালাম খান ইত্যাদি। অগ্রিম টিকিট বুকিংয়ের জন্য ফোন করতে পারেন। সুরভী-০১৭১২৭৭২৭৮৬, পারাবত-০১৭১১৩৪৬০৮০। স্টিমারে করে বরিশাল যেতে চাইলে চলে যান ঢাকার সদরঘাটের বাদামতলী ঘাটে। অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য বিআইডব্লিউটিএর অফিসে যোগাযোগ করুন।

No comments:

Post a Comment