উত্তরবঙ্গের আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে
বেশি আম উৎপাদিত হয় এ জেলাতেই। এ জেলার সর্বত্রই মাইলের পর মাইল জুড়ে
ছড়িয়ে আছে আমবাগান। এ জেলাতে আছে প্রাচীন গৌড়ের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। এ
জেলার উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে রাজশাহী ও নওগাঁ
জেলা অবস্থিত। মহানন্দা এ জেলার প্রধান নদী। রাজধানী থেকে চাঁপাই
নবাবগঞ্জের দূরত্ব ৩১৭ কিলোমিটার।
মহানন্দা নদী ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী। এককালের প্রমত্তা মহানন্দা এখন অনেকটা মরে গেলেও এর সৌন্দর্য কমেনি কোনো অংশে। নদীর উপরে শহরের কাছেই রয়েছে মহানন্দা সেতু। আমের সময়ে শহরের থানাঘাটে প্রতিদিন সকালবেলা দূর-দূরান্ত থেকে অনেক নৌকা ভিড় জমায়। খুব ভোরে শুরু হয়ে এ বাজার, বেলা ওঠার কিছু পরেই শেষ হয়ে যায়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দিনে দিনে নৌকার সংখ্যা কমে আসছে এ বাজারে।
কোতোয়ালি দরওয়াজা ঃ ভারত- বাংলাদেশের সিমান্তে ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতের প্রবেশপথে অবস্থিত। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়ালের অনুকরণে এর নামকরণ। এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশপথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলি দিয়ে শত্রুর ওপর গুলি কিংবা তীর ছোড়া হতো বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কোতোয়ালি দরওয়াজাটি সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনা মসজিদ স্থলবন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ এটি ভারতের অংশে পড়েছে।
খনিয়াদিঘি মসজিদ ঃ সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে আমবাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত মসজিদটি। ইটের তৈরি এ মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। প্রার্থনাকক্ষের ঠিক উপরে বিশাল আকারের এ গম্বুজটির অবস্থান। মসজিদের মূল প্রার্থনা কক্ষের বাইরে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মূল মেহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটায় আচ্ছাদিত ছিল, যার অনেকগুলো এখনো বিদ্যমান।
ধুনিচক মসজিদ ঃ খনিয়াদিঘি মসজিদের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মসজিদ। মসজিদটির উত্তর ও দক্ষিণের দেয়াল এবং ভেতরের পাথরের স্তম্ভ এখনো টিকে আছে। ছাদ এবং পূর্ব দেয়াল পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইটের তৈরি এ মসজিদটি আয়তকার। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে নির্মাণশৈলী বিবেচনায় এ মসজিদটিও পনেরো শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।
দরসবাড়ি মাদ্রাসা ঃ সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ। চারপাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনাটিতে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ৪১.৫ মিটার আঙিনার চার পাশে ঘিরে ছিল ৩ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো। এখানে একটি ঢিবির কাছে চাষ করার সময় কৃষকরা কয়েকটি ইট নির্মিত প্রাচীর ও একটি শিলালিপির সন্ধান পান। এ কারণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে পরীক্ষামূলক খনন কাজ চালায়। আর সে খননের ফলেই আবিষ্কৃত হয় মাদ্রাসাটির ভিত্তির। শিলালিপি থেকে জানা যায় মাদ্রাসাটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৫০৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন। দরস অর্থ শিক্ষা আর দরসবাড়ি অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র। আর দরসবাড়িই কালক্রমে দারাসবাড়ি নামে রূপান্তরিত হয়েছে।
দরসবাড়ি মসজিদ ঃ দরসবাড়ি মাদ্রাসা থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের ওপারে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ। কলকাতার ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয় মসজিদটি। এর বাইরের দিকের পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ২০.৬ মিটার। আর ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য৩০.৩ এবং প্রস্থ ১১.৭ মিটার। মসজিদটির ছাদ বহু আগে ভেঙে পড়েছে। আর সামনে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ আছে। বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সংবলিত এ মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটা স্থান পেয়েছে। মসজিদের দুটি অংশণ্ড একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ ।
তাহ্খানা ঃ সোনা মসজিদ স্থলবন্দর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সোনা মসজিদের পশ্চিম পাশে কিছুটা ভেতরের দিকে বিশাল একটি দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সর্বদক্ষিণেরটি হলো তাহখানা। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। ভবনটির লাগোয়া পূর্ব দিকে আছে দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তার বসবাসের জন্য। আবার কারো কারো মতে শাহ সুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ ঃ তাহ্খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটির পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙিনার চার পাশে আছে অনুচ্চ দেয়াল। পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ। মসজিদটির পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। মসজিদটি নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহান শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগদখল করেন এবং এর আয় থেকে তার খানকার ব্যয় নির্বাহ করে উদ্বৃত্ত অংশ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি ঃ মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গাজুড়ে সমাধি এলাকার বেস্টনী প্রাচীর । দক্ষিণ দেয়ালে আছে প্রবেশপথ। এখান থেকে পাকা পথ ধরে কিছুটা সামনেই সমাধিসৌধ। সৌধটির চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধানো বেশ কিছু কবর। দিল্লির করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে, ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি এসে উপস্থিত হন গৌড় এলাকায়। শাহ সুজা তখন বাংলার সুবাদার। শাহ সুজা নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন। ১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান। তবে তার কবরের উপরে সৌধটি কে নির্মাণ করেন, সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না।
ছোট সোনা মসজিদ ঃ তাহ্খানা থেকে পূর্বপাশে প্রধান সড়ক লাগোয়া অবস্থিত সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোট সোনা মসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদটির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সংবলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মানের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত।
মসজিদটির মূল ভবনটি আয়তকার। বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশপথ আছে। পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঁচটি অর্ধবৃত্তকার মেহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে একটি পাথরের প্লাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি রয়েছে। এখানে কারা সমাহিত হয়েছেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিক কানিংহাম সমাধি দুটি মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন। মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে, যার একটিতে সমাহিত আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
কানসাট বাজার ঃ সোনামসজিদ থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ফেরার পথে পড়বে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাজারে চলে আমের বিকিকিনি। দূর-দূরান্ত থেকে সাইকেল কিংবা রিকশা-ভ্যানে করে আম নিয়ে সকাল থেকেই এখানে জড়ো হতে থাকেন আম চাষিরা। বাজারটি ঘুরে দেখতে পারেন।
আমবাগান ঃ মহানন্দা সেতু পেরিয়ে সোনা মসজিদ স্থল বন্দর পর্যন্ত সড়কের দুপাশে যে দিকে চোখ যাবে সেদিকেই শুধু আম বাগান আর আম বাগান। পছন্দের যে কোনো বাগোনে নেমেই ঘুরে দেখতে পারেন।
কখন যাবেন ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জে সারা বছরই বেড়ানো সম্ভব। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় মে থেকে জুলাই। কারণ এ সময়ে জেলার সর্বত্র আম বাগানগুলোতে ফলে পূর্ণ থাকে।
কীভাবে যাবেন ঃ রাজধানী থেকে সরাসরি সড়কপথে চাঁপাই নবাবগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। এ পথের বাস সার্ভিস হলো- মডার্ন এন্টারপ্রাইজ (০১৭১১২২৮২১৭), ন্যাশনাল ট্রাভেলস (০১৭১১২২৮২৮৬), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০১৮১৩০৪৯৫৪৩), লতা পরিবহন, দূর-দূরান্ত পরিবহন ইত্যাদি বাসগুলো সরাসরি যায় চাঁপাই নবাবগঞ্জ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে এ পথের বাসগুলো। ভাড়া ৩০০-৩২০ টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনামসজিদ স্থল বন্দরে যাবার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা।
কোথায় থাকবেন ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের শান্তি মোড়ে হোটেল আল নাহিদ (০৭৮১-৫৫৭০১-৩, ০১৭১৩৩৭৬৯০২), আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী (০৭৮১-৫৬২৫০), লাখেরাজ পাড়ায় হোটেল রাজ (০৭৮১-৫৬১৯৩), একই এলাকায় হোটেল রংধনু (০৭৮১-৫৫৮০৭)। এছাড়াও আরো বেশ কিছু হোটেল আছে এ শহরে। এসব হোটেলে ২০০-১০০০ টাকায় অবস্থান করা যাবে।
ফোনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা (০৭৮১-৫৫২২০), সদর হাসপাতাল (০৭৮১-৫৫২০৭), ফায়ার সার্ভিস (০৭৮১-৫৫২১২)
মহানন্দা নদী ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী। এককালের প্রমত্তা মহানন্দা এখন অনেকটা মরে গেলেও এর সৌন্দর্য কমেনি কোনো অংশে। নদীর উপরে শহরের কাছেই রয়েছে মহানন্দা সেতু। আমের সময়ে শহরের থানাঘাটে প্রতিদিন সকালবেলা দূর-দূরান্ত থেকে অনেক নৌকা ভিড় জমায়। খুব ভোরে শুরু হয়ে এ বাজার, বেলা ওঠার কিছু পরেই শেষ হয়ে যায়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দিনে দিনে নৌকার সংখ্যা কমে আসছে এ বাজারে।
কোতোয়ালি দরওয়াজা ঃ ভারত- বাংলাদেশের সিমান্তে ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতের প্রবেশপথে অবস্থিত। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়ালের অনুকরণে এর নামকরণ। এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশপথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলি দিয়ে শত্রুর ওপর গুলি কিংবা তীর ছোড়া হতো বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কোতোয়ালি দরওয়াজাটি সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনা মসজিদ স্থলবন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ এটি ভারতের অংশে পড়েছে।
খনিয়াদিঘি মসজিদ ঃ সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে আমবাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত মসজিদটি। ইটের তৈরি এ মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। প্রার্থনাকক্ষের ঠিক উপরে বিশাল আকারের এ গম্বুজটির অবস্থান। মসজিদের মূল প্রার্থনা কক্ষের বাইরে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মূল মেহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটায় আচ্ছাদিত ছিল, যার অনেকগুলো এখনো বিদ্যমান।
ধুনিচক মসজিদ ঃ খনিয়াদিঘি মসজিদের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মসজিদ। মসজিদটির উত্তর ও দক্ষিণের দেয়াল এবং ভেতরের পাথরের স্তম্ভ এখনো টিকে আছে। ছাদ এবং পূর্ব দেয়াল পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইটের তৈরি এ মসজিদটি আয়তকার। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে নির্মাণশৈলী বিবেচনায় এ মসজিদটিও পনেরো শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।
দরসবাড়ি মাদ্রাসা ঃ সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ। চারপাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনাটিতে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ৪১.৫ মিটার আঙিনার চার পাশে ঘিরে ছিল ৩ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো। এখানে একটি ঢিবির কাছে চাষ করার সময় কৃষকরা কয়েকটি ইট নির্মিত প্রাচীর ও একটি শিলালিপির সন্ধান পান। এ কারণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে পরীক্ষামূলক খনন কাজ চালায়। আর সে খননের ফলেই আবিষ্কৃত হয় মাদ্রাসাটির ভিত্তির। শিলালিপি থেকে জানা যায় মাদ্রাসাটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৫০৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন। দরস অর্থ শিক্ষা আর দরসবাড়ি অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র। আর দরসবাড়িই কালক্রমে দারাসবাড়ি নামে রূপান্তরিত হয়েছে।
দরসবাড়ি মসজিদ ঃ দরসবাড়ি মাদ্রাসা থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের ওপারে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ। কলকাতার ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয় মসজিদটি। এর বাইরের দিকের পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ২০.৬ মিটার। আর ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য৩০.৩ এবং প্রস্থ ১১.৭ মিটার। মসজিদটির ছাদ বহু আগে ভেঙে পড়েছে। আর সামনে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ আছে। বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সংবলিত এ মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটা স্থান পেয়েছে। মসজিদের দুটি অংশণ্ড একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ ।
তাহ্খানা ঃ সোনা মসজিদ স্থলবন্দর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সোনা মসজিদের পশ্চিম পাশে কিছুটা ভেতরের দিকে বিশাল একটি দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সর্বদক্ষিণেরটি হলো তাহখানা। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। ভবনটির লাগোয়া পূর্ব দিকে আছে দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তার বসবাসের জন্য। আবার কারো কারো মতে শাহ সুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ ঃ তাহ্খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটির পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙিনার চার পাশে আছে অনুচ্চ দেয়াল। পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ। মসজিদটির পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। মসজিদটি নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহান শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগদখল করেন এবং এর আয় থেকে তার খানকার ব্যয় নির্বাহ করে উদ্বৃত্ত অংশ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি ঃ মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গাজুড়ে সমাধি এলাকার বেস্টনী প্রাচীর । দক্ষিণ দেয়ালে আছে প্রবেশপথ। এখান থেকে পাকা পথ ধরে কিছুটা সামনেই সমাধিসৌধ। সৌধটির চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধানো বেশ কিছু কবর। দিল্লির করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে, ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি এসে উপস্থিত হন গৌড় এলাকায়। শাহ সুজা তখন বাংলার সুবাদার। শাহ সুজা নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন। ১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান। তবে তার কবরের উপরে সৌধটি কে নির্মাণ করেন, সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না।
ছোট সোনা মসজিদ ঃ তাহ্খানা থেকে পূর্বপাশে প্রধান সড়ক লাগোয়া অবস্থিত সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোট সোনা মসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদটির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সংবলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মানের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত।
মসজিদটির মূল ভবনটি আয়তকার। বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশপথ আছে। পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঁচটি অর্ধবৃত্তকার মেহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে একটি পাথরের প্লাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি রয়েছে। এখানে কারা সমাহিত হয়েছেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিক কানিংহাম সমাধি দুটি মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন। মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে, যার একটিতে সমাহিত আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
কানসাট বাজার ঃ সোনামসজিদ থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ফেরার পথে পড়বে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাজারে চলে আমের বিকিকিনি। দূর-দূরান্ত থেকে সাইকেল কিংবা রিকশা-ভ্যানে করে আম নিয়ে সকাল থেকেই এখানে জড়ো হতে থাকেন আম চাষিরা। বাজারটি ঘুরে দেখতে পারেন।
আমবাগান ঃ মহানন্দা সেতু পেরিয়ে সোনা মসজিদ স্থল বন্দর পর্যন্ত সড়কের দুপাশে যে দিকে চোখ যাবে সেদিকেই শুধু আম বাগান আর আম বাগান। পছন্দের যে কোনো বাগোনে নেমেই ঘুরে দেখতে পারেন।
কখন যাবেন ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জে সারা বছরই বেড়ানো সম্ভব। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় মে থেকে জুলাই। কারণ এ সময়ে জেলার সর্বত্র আম বাগানগুলোতে ফলে পূর্ণ থাকে।
কীভাবে যাবেন ঃ রাজধানী থেকে সরাসরি সড়কপথে চাঁপাই নবাবগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। এ পথের বাস সার্ভিস হলো- মডার্ন এন্টারপ্রাইজ (০১৭১১২২৮২১৭), ন্যাশনাল ট্রাভেলস (০১৭১১২২৮২৮৬), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০১৮১৩০৪৯৫৪৩), লতা পরিবহন, দূর-দূরান্ত পরিবহন ইত্যাদি বাসগুলো সরাসরি যায় চাঁপাই নবাবগঞ্জ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে এ পথের বাসগুলো। ভাড়া ৩০০-৩২০ টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনামসজিদ স্থল বন্দরে যাবার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা।
কোথায় থাকবেন ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের শান্তি মোড়ে হোটেল আল নাহিদ (০৭৮১-৫৫৭০১-৩, ০১৭১৩৩৭৬৯০২), আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী (০৭৮১-৫৬২৫০), লাখেরাজ পাড়ায় হোটেল রাজ (০৭৮১-৫৬১৯৩), একই এলাকায় হোটেল রংধনু (০৭৮১-৫৫৮০৭)। এছাড়াও আরো বেশ কিছু হোটেল আছে এ শহরে। এসব হোটেলে ২০০-১০০০ টাকায় অবস্থান করা যাবে।
ফোনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা (০৭৮১-৫৫২২০), সদর হাসপাতাল (০৭৮১-৫৫২০৭), ফায়ার সার্ভিস (০৭৮১-৫৫২১২)
No comments:
Post a Comment