Friday, July 18, 2014

মধ্যপ্রদেশে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ

বছর খানেক আগে হঠাৎই মধ্যপ্রদেশে গিয়ে পড়ি। তখন আমার কোনও ধারণাই ছিল না কী ঘটতে চলেছে। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। সেই জঙ্গলের নাম কানহা। কানহা আমাকে অভিভূত করে দেয়। আমার মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনধারা এক ঝটকায় পাল্টে যায়। কোনও জায়গার সঙ্গে যে এমন গভীর প্রেম সম্ভব এ কথা আমার জানা ছিল না। ধীরে ধীরে বাকি রাজ্যের প্রতি নজর দিই। কী নেই এখানে! হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনদের মিন্দর, মসজিদ, কেল্লা, জঙ্গল, জন্তু জানোয়ার, পাহাড়, গুহা, গুহাচিত্র, মিঞা তানসেনের গ্বালিয়ার, আলাউদ্দিন খা সাহেবের মাইহার… দেখার জায়গার দীর্ঘ তালিকা সামনে নিয়ে আমি দিশেহারা। অথচ কী আশ্চর্য, এমন অসাধারণ রাজ্য নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না, উৎসাহ নেই, উত্তেজনা নেই, নেই কোনও প্রচার। অগত্যা আমিই বেরিয়ে পড়ি। সেই বেড়ানোর গল্প এই সংখ্যা থেকে শুরু হল।
বম্বে মেল যখন বিলাসপুর স্টেশনে ঢুকল, তখন ঠিক সকাল সাতটা। নতুন রাজ্য ছত্তিশগড়ের বড় শহর বিলাসপুর কুয়াশায় ঢাকা। মাঝারি েস্টশন পরিষ্কার, কুলির উপদ্রব নেই। আমাদের পাচজনের দলের মধ্যে দু’জন চলে গেল অটো নিয়ে ট্যাক্সির খোজে। কুড়ি মিনিটের মধ্যে হাজির হল খৈরুল বাসার ওরফে গুড্ডা তার বোলেরো নিয়ে। খৈরুলের বয়স তিরিশ বত্রিশের বেশি নয়, মাথায় সামান্য টাক, মুখভর্তি মশলা। বিলাসপুর থেকে অচানক্‌মারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অমরকন্টক, পরের দিন পেণ্ড্রা রোড স্টেশনে পৌছে দিতে চোদ্দ’শ টাকা চাইল। কলকাতার বাড়িতে বসে নানান রকম হিসেব নিকেশ হয়েছিল, সে সব মুলতুবি রেখে আমরা খৈরুলের কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
বিলাসপুর থেকে গাড়ি ছুটছে চকচকে পিচের রাস্তা ধরে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদে খিদে পাচ্ছে। ভাবতে না ভাবতেই গুড্ডা গাড়ি থামাল।
‘‘নাশতা করতে হবে…’’
যেন খিদে একা ওরই পেয়েছে। আসলে মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ের মানুষের অমায়িক ভদ্রতা আমাদের মতো শহুরে বাঙালির কাছে বড় আশ্চর্য ঠেকে। ওদের ভদ্রতা আদৌ পোশাকি নয়, প্রকৃত আচরণেরই অংশ, অনেকটা ইংল্যাণ্ডের মানুষদের মতো।
ছোট গঞ্জ কোটার ধাবা। সিঙাড়া, জিলিপি আর চা দিয়ে জলখাবার সেরে ন’টা নাগাদ আবার গাড়িতে উঠে বসেছি। আধ ঘন্টার মধ্যে চারপাশে গাছের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। গাড়ি অচানক্‌মারের জঙ্গলে ঢুকেছে। প্রধানত শাল গাছের জঙ্গল হলেও মাঝেমাঝেই বাশের ঝাড় দেখা যায়। রাস্তার দু’ধারে শাশ্বত সান্ত্রীর মতো লম্বা লম্বা গাছ পাহারা দিচ্ছে আর মাঝখান দিয়ে কালো রাস্তা একেবেকে চলেছে। সকালের রোদ হলদে হয়ে যাওয়া শীতের পাতার ওপর পড়ে এক অসামান্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বিলাসপুর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে সাতপুড়া পর্বতমালার মায়কল পাহড়ের পুবদিক থেকে অচানক্‌মারের জঙ্গল শুরু। ৫৫১.৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে কারণ এখানে বাঘ ভাল্লুক চিতাবাঘ গৌর চিতল হায়না বন্য কুকুর প্রভৃতি নানা পশু আছে। কিন্তু এই অভয়ারণ্য এখন বিপন্ন। অচানক্‌মারের আশেপাশে গজিয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটা গো শিবির। এই সব শিবির থেকে দিনে অন্তত ২০ হাজার গরু জঙ্গলে চরতে যায়। ফলে চিতল ও অন্যান্য জন্তুদের খাবারে টান পড়ে। আবার গরুদের রোগ জঙ্গলের গৌর ও চিতলের মধ্যে ছড়িয়ে মৃত্যুও ঘটাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এত বেশি সংখ্যক গরু জঙ্গলে চরার ফলে বনের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ছে। মুশকিল হল, এই সব গো শিবিরের মালিকেরা প্রভাবশালী এবং থাকেন অচানক্‌মারের বাইরে। কাজেই স্থানীয় মানুষের মতো তাদের মনেও জঙ্গলের প্রতি দরদ নেই। বন বিভাগ সমস্যাটি সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল। কিন্তু প্রভাবশালী আর প্রতাপশালী লোকেদের প্রতি আমাদের সরকার কবে আর কঠোর হয়েছে

নেচার ক্লাব নামে এক বেসরকারি সংগঠন অচানক্‌মার নিয়ে কাজ করছে। জঙ্গল বাচানোর ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন অনুরাগ শুক্লা। কিন্তু একা হাতে এ কাজ করা শক্ত। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় চিঠি কিংবা ফোনে।
অনুরাগ শুক্লার ঠিকানা হল:
Nature Club,
Mans Association,
Magarpara Road,
Bilaspur,
Chattisgarh.
Phone: 07752 22181
অচানক্‌মারের ওই অপূর্ব জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বোঝার উপায় নেই ওই এলাকা আজ মরতে বসেছে। বস্তুত, ছত্তিশগড় আর মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল আপাতদৃেষ্ট অক্ষত হলেও এই সব জঙ্গল আজ বিপন্ন। পরবতর্ী প্রজেন্মর কথা ভেবে জঙ্গলগুলিকে আর অবহেলা করা যাবে না। এখন থেকে বিশেষ যত্ন না নিলে পরে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য, প্রাণিজগতের ভারসাম্য বজায় রাখতে জঙ্গলকে বাচিয়ে রাখা যে কতটা জরুরি তা বারবার বললেও কম বলা হয়। প্রকৃতির এই অকুণ্ঠ দান দেখতে দেখতে মনে হয় জঙ্গল বাচাতে আমাদের কি একেবারে কিছুই করণীয় নেই?
অমরকন্টক
আড়াই ঘন্টার পথ কোথা দিয়ে কেটে গেল টেরও পেলাম না। সাতপুড়ার কোল দিয়ে ওঠানামা করতে করতে এক সময় অমরকন্টক পৌছে গেলাম। হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান অমরকন্টক। আমাদের দলের গড় বয়স ৫১ হলেও ধর্মভাব তেমন প্রকট নয়। আমরা অমরকন্টক দেখতে এসেছি এই কারণে যে এখানে ভারতের দুটি বৃহৎ নদনদীর উৎপত্তি। সাতপুড়া আর বিন্ধ্যর মিলনস্থল থেকে নর্মদা যায় পিশ্চমে আর সোন যায় পুবে গঙ্গার সঙ্গে মিশতে। এই আশ্চর্য ভৌগোলিক ঘটনা দেখতেই আমাদের এখানে আসা। তবে শুনেছি এ ছাড়াও কয়েকটা দেখার জিনিস আছে। কাজেই সময় নষ্ট না করে আমরা স্নান খাওয়া সেরে খৈরুলের গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম অমরকন্টক চষতে।
পিচের রাস্তা থেকে মেঠো পথে গাড়ি নামল। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি থেকে আমাদেরই নেমে পড়তে হল। এ বার পায়ে হেঁটে দেখতে হবে ভৃগু কমণ্ডল। বিশাল বিশাল শাল হরীতকী মহুয়া গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি পথ মাঝদুপুরেও অন্ধকার, ঠাণ্ডা। মিনিট কুড়ির মধ্যে কমণ্ডল দেখা গেল। কল্পনাশক্তির সাহায্য ছাড়া অবশ্য কমণ্ডল বলে বোঝা যাবে না। কমণ্ডলে মন না ভরলেও পথের কথা ভোলা যায় না। যাওয়ার সময়েই দেখেছিলাম জঙ্গলের এক জায়গায় কাটা তার ফেলা আছে। এ বার গাইডকে তাৎপর্য জিগ্যেস করতে জানা গেল, এই তারের এক দিকে ছত্তিশগড় অন্য দিকে মধ্যপ্রদেশ। সেই হিসেবে ভৃগু কমণ্ডল সম্ভবত মধ্যপ্রদেশে পড়েছে। বনের রাস্তা দিয়ে এ বার ত্রিবেণী কুণ্ড। ছায়া ঘেরা কুটিরের পাশে সবুজ পুকুর। এখানে পর্যটকের তেমন দাপট নেই। জঙ্গলের মধ্যে কোনও সাড়াশব্দ নেই। রিসাস মেক্যাক নামে পরিচিত দু’একটা লালমুখো বাদর ছাড়া অন্য কোনও জন্তু চোখে পড়ে না। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অবাধে হাটার অভিজ্ঞতা মনে থেকে যায়। অভয়ারণ্যে মানুষের হাটা নিষিদ্ধ, কাজেই এখানে হাটা চলার সুযোগ পেয়ে আমাদের ভারী ফুর্তি।
সেন্ধ নামার আগে ফেরার কথা মনে করে আমরা ফের গাড়িতে উঠলাম। এ বার নর্মদা উদগম আর সোনমুড়া। তার আগে গাড়ি থামল মাঠের মাঝখানে প্রাচীন কয়েকটা মিন্দরের সামনে। আমাদের গাইডের কাছ থেকে এই মিন্দর সম্পর্কে কিছু জানা গেল না। ভেতরে ঢোকারও উপায় নেই, দরজায় তালা ঝুলছে। এমন সময় চোখে পড়ল পিছন দিকে বড়সড় বটগাছের ছায়ায় ছবির মতো এক মিন্দর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মিন্দরের পুরোহিত উদয় হলেন।
‘‘মিন্দরের নাম পাতালেশ্বর। একাদশ শতাব্দীর শিবমিন্দর, ভেতরে প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ রয়েছে,’’ জানালেন তিনি।
আমার ধারণা ছিল শিবলিঙ্গ মাত্রেই প্রাকৃতিক, কিন্তু সেই মুহূর্তে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না। পাতালেশ্বর মিন্দরের পুরোহিতের কাছে জানতে পারলাম, প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের কোনও না কোনও সোমবারে মিন্দরের ভেতরের বিগ্রহ জলে ডুবে যায়। ততক্ষণে আমরা সিড়ি দিয়ে নেমে মিন্দরের তলায় শিবলিঙ্গের সামনে দাড়িয়েছি। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয় বিগ্রহ দেখতে। সম্ভবত এই কারণেই মিন্দরের নাম পাতালেশ্বর। শান্ত পরিবেশে প্রাচীন মিন্দর দেখার মধ্যে যে অন্য একটা স্বাদ পাওয়া যায় তা পাতালেশ্বরের সামনে দাড়িয়ে বিলক্ষণ টের পেলাম। অজানা হলেও পুরনো মিন্দরগুলো তাকিয়ে দেখার মতোই।
এর পর নর্মদার উৎস। চুনকাম করা দেওয়াল ঘেরা প্রাঙ্গণের মধ্যে বেশ কয়েকটা সাদা সাদা মিন্দর । মাঝখানে সবুজ রঙের বড়সড় হ্রদ। গাইড বলল, এই হ্রদই নর্মদার উৎস। আমরা অবিশ্বাসভরে লেকের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পাহাড়ের গা থেকে তিরতির করে নর্মদা বেরোচ্ছে, এমন কত স্বিপ্নল চিন্তা নিয়ে উৎস দেখতে এসে শেষে এই হ্রদে পৌছে বড় বিপন্ন বোধ করতে থাকি। আশেপাশে মিন্দরে অনেক দর্শনাথর্ী, মিন্দর দর্শন করে কপালে টিপ নিয়ে প্রসন্নমুখে প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু আমরাই নর্মদার উৎস দেখে অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে চললাম পরের লক্ষ্য, সোননদের উৎসের দিকে।
লম্বা এক সারি ঁসিড়ি নেমে গিয়েছে। ধাপের শেষে বাধানো চত্তর, এক ধারে পাহাড়ের গা থেকে দুটো ফুটো দিয়ে তিরতির করে জল বেরোচ্ছে। সেই ফুটো ঘিরে একটা চৌবাচ্চা, তার মধ্যে এক দেবমূর্তি। বাধানো চত্তরের তলা দিয়ে চলেছে সোন। একটু এগোতেই দেখা গেল লোহার পাইপ দিয়ে হু হু করে জল বেরিয়ে অল্প দূরে জলাশয় মতো তৈরি করেছে। সেই জলাশয় থেকে জল ধীরে ধীরে পাহাড়ের ধারে পৌছে ঝরনা হয়ে পড়ছে কয়েকশো ফুট নীচে। সোন নদ যাত্রা শুরু করছে পুবে গঙ্গার দিকে।

তাই বলে লোহার পাইপের মধ্যে দিয়ে সোননদের উৎপত্তি? কিছুতেই কথাটা মেনে নিতে পারলাম না। বারবার মনে হতে লাগল ভারতীয়দের ধর্মভাবের সঙ্গে সৌন্দর্যবোধের এতটা শত্রুতা কেন। একটা রক্ষা করতে গিয়ে অন্যটাকে কি ধ্বংস না করলেই নয়? নর্মদা বা সোনের মতো নদনদী পরে অসাধারণ চেহারা নেয়। তবু এই দুই বড় নদনদীর উৎপত্তিস্থলকে এমন বিচিত্রভাবেই কি রক্ষা করতে হবে?
দূরের মিন্দর থেকে ভজনের সুর ভেসে আসছে। সেন্ধ নামছে অমরকন্টকে। এতক্ষণে সারাদিনের ক্লািন্ত জানান দিতে শুরু করেছে। অল্প অল্প ঠাণ্ডাও পড়তে আরম্ভ করেছে। পরের দিন কপিলধারা দেখতে যেতে হবে।
সকাল সাতটায় ফের বেরোলাম। কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে সূর্যের ছটা এসে পড়েছে নর্মদার জলের ওপর। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ওই জলাশয় থেকে জল বিশাল ঝরনা হয়ে পড়ছে অনেক নীচে, তারপর একেবেকে চলেছে আরব সাগরের দিকে। ঝরনারই নাম কপিলধারা। অবশেষে নর্মদার রূপে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। নদীর উৎস বুঝি এমনই হওয়া উচিত। অমরকন্টক ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। ৪৫ কিলোমিটার দূরে পেণ্ড্রা রোডে আমাদের নামিয়ে দিয়ে খৈরুল বাশার চলে গেল। সুন্দর মানুষ, মিিষ্ট ব্যবহারের স্মৃতি রেখে গেল আমাদের কাছে।
বান্ধবগড়
পেণ্ড্রা রোড থেকে উমরিয়া পৌছতে ঘন্টা চারেক সময় লাগে। েট্রনের নাম বিলাসপুর-ইেন্দার নর্মদা এক্সেপ্রস। জানলার বাইরে ডিসেম্বরের বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। কখনও জঙ্গল কখনও ধান, গম বা সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে েট্রন চলেছে। রোদ ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে উঠছে আর অদ্ভুত মায়াবি আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ছোট্ট েস্টশন উমরিয়া। পচিশ টাকায় অটো নামিয়ে দিল বাস আর ট্যািক্স স্ট্যােণ্ড। বাস দেখলে অবশ্য ভক্তি হয় না, আর ট্যািক্স বলতে তেমন কোনও বাহন চোখে পড়ল না। এক মুহর্তের জন্য অনিিশ্চত লেগেছিল মানতেই হয়। পরক্ষণেই মনে হল, এ তো আমার জায়গা এখানে কখনও অসুবিধেয় পড়তে হয় নাকি! মফস্‌সল শহর। কিছুক্ষণ ধরে একদল ভিনদেশি দাড়িয়ে আছে লক্ষ্য করতেই ভিড় জমে যায়। ওরা আমাদের অবস্থা দেখে মজা পায় না। ওরা মধ্যপ্রদেশবাসী, সব সময় সাহায্যের হাত বাড়াতে চায়। একটা জিপ আছে, জানা গেল। চারশো টাকা লাগবে, আমরা নেব কী? অবশ্যই নেব, বলে উঠলাম আমরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে এক ঝরঝরে জিপ এসে দাড়াল। সঙ্গে এক সহযাত্রীও, বান্ধবগড়ের লাগোয়া গ্রাম, তালা থানার কন্সটেবল। পুলিশি প্রহরায় আমরা এ বার বান্ধবগড়ের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগে। গরুরা ঘরে ফিরছে। তাদের পায়ের ধুলো আকাশে বাতাসে ছেয়ে যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে গোধূলির মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। দূরে সাতপুড়ার আভাস দেখা যাচ্ছে, কখনও শাল গাছের সারি এসে তা ঢেকে দিচ্ছে। রয়ে যাচ্ছে গোধূলির গোলাপি আভা। চারিদিকে জনমানুষ নেই। এমন পরিবেশ সাধারণত দেখা যায় না। আমাদের পরিচিত বলয়ের কত বাইরে, কত নতুন, কত বিচিত্র। আমরা যে চলেছি জঙ্গলের কাছে এ সব যেন তারই আয়োজন।
ভারতের যে কয়েকটা রাজ্যে দেখার মতো জঙ্গল এখনও রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মধ্যপ্রদেশ। কানহা বান্ধবগড় পেচ পান্না সঞ্জয় মাধব বোরি রাতাপানি… তালিকা নেহাত ছোট নয়। সব জঙ্গল আমার দেখা হয়নি, তা সেত্ত্বও অনায়াসে বলতে পারি এই সব জঙ্গলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল কানহা। বান্ধবগড়ের প্রচার অবশ্য কানহার চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই বান্ধবগড় সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ ছিল। যেমন আছে পেচ বা শিবপুরী সম্পর্কেও।
রাতের অন্ধকার সবে গাঢ় হচ্ছে জিপ এসে থামল মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোয়াইট টাইগার ফরেস্ট লজের সামনে। চিফ ম্যানেজার মি প্যাটেলের সাদর অভ্যর্থনা মন ছুয়ে গেল। সবে খাতায় নামধাম লেখা শেষ করেছি, পিঠে টোকা পড়ল। ঘুরে দাড়াতে দেখি জাভেদ মনসুরি। কানহার বাঘিরা লগ হাটে কতবার জাভেদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, হয়েছে বন্ধুত্বও। এ বারের যাত্রায় আমরা জাভেদকে পেয়ে গেলাম শুধু সহকারী ম্যানেজার হিসেবে নয়, একজন বন্ধু হিসেবেও বটে।
উমরিয়া জেলায় ৩২টি পাহাড়ে ঘেরা জলা জঙ্গল পশু পাখি নিয়ে বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যান। শাল মহুয়া কেন্দু সেজ নানা বড়বড় গাছ জঙ্গলে, এ ছাড়া জায়গায় জায়গায় বাশবনও আছে। আছে জলাশয় ময়দান নদী নালা; নানা রকমের জন্তু জানোয়ার পাখি সরীসৃপ পোকামাকড়। একটু কান পাতলে শোনা যায় প্রাণের ঝঙ্কারে জঙ্গল গমগম করছে। তবে যে সাদা বাঘের জন্য বান্ধবগড় বিখ্যাত, সেই সাদা বাঘ থাকলেও তাকে চোখে দেখা যায় না। ১৯৬৮ সালে বান্ধবগড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সময় এর আয়তন ছিল ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের পর বোঝা গেল বান্ধবগড়কে বাড়িয়ে তুলতে হবে। ১৯৮২ সালে খিটৌলি, মাগধী আর কাল্লাওয়াকে বান্ধবগড়ের আওতায় আনা হলে আয়তন বেড়ে দাড়ায় ৪৪৮ বর্গ কিলোমিটারে। ১৯৯৩ সালে বান্ধবগড় আসে ব্যাঘ্র প্রকেল্পর আওতায়। সেই সময় পানপাতা অভয়ারণ্যকে বান্ধবগড়ের অংশ করে নেওয়া হয়। আপাতত বান্ধবগড়ের প্রধান বা কোর এলাকা ৬৯৪ আর পারিপািশ্বর্ক বা বাফার এলাকা হল ৪৩৭ বর্গ কিলোমিটার।
পরের দিন ভোর ছ’টায় খোলা জিপসিতে চড়ে বসলাম আমরা পাচজন। আলো ভালভাবে ফোটেনি। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তালা থেকে বান্ধবগড় টাইগার রিজার্ভ খুব দূরে নয়। পৌছতে দেখা গেল সারি দিয়ে পনেরো কুড়িটা জিপসি দাড়িয়ে আছে। খুব চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে, অনেকটা বাজারের মতো। আমাদের মতো যাদের জঙ্গলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কানহা দিয়ে তাদের কাছে এই অদ্ভুত পরিবেশ অব্যবস্থার মতোই মনে হয়। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে। সাড়ে ছ’টা নাগাদ গেট খুলল। জিপসির সারি নড়ে উঠল। আমাদের বাহনচালক অনিল শর্মা জঙ্গলের সমস্ত নিয়মকানুনকে লবডঙ্কা দেখিয়ে অনর্গল জোর গলায় কথা বলতে শুরু করেছে আর ৩০-৩৫ কিলোমিটার বেগে গাড়ি ছোটাচ্ছে। আমরা মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। একে তো ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা, তার ওপর অত জোরে গাড়ি ছোটানোয় গায়ের মধ্যে হাওয়া কেটে বসছে। তা ছাড়া অত জোরে গাড়ি চালালে জন্তু জানোয়ার দেখব কী করে। শেষে বাধ্য হলাম গাড়ির গতি কমাতে বলতে।
‘‘আসলে কী জানেন, সবাই তো বাঘ দেখতে চায়, একবার জঙ্গলে ঢুকলে সেই দিকেই ছুটে যায়,’’ অজুহাতের মতো বলল অনিল শর্মা।
‘‘কিন্তু আমরা তো জঙ্গল দেখতে এসেছি। জঙ্গলে বাঘ ছাড়াও অনেকে আছে, তাদেরও দেখতে চাই। এর পরেও যদি বাঘ পাওয়া যায় তবে তো কথাই নেই।’’
অনিল শর্মা অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাক হলাম আমরাও। জঙ্গলে বেড়াতে আসার সঙ্গে অন্যান্য বেড়ানোর তো এইখানেই সবচেয়ে বড় তফাত। জঙ্গলের কাছ থেকে কত কী যে পাওয়ার আছে তার হিসেব নেই। একটাই শর্ত। নিজের অহংকে মুলতুবি রেখে জঙ্গলের সামনে দাড়াতে পারলে তবেই জঙ্গল িদ্বধাহীনভাবে দান করে। জঙ্গলকে ভালবাসতে হয়, যত্ন করতে হয়, মনের মধ্যে জঙ্গলকে জায়গা দিতে হয়। তবেই জঙ্গল তার অপার রহস্য উেন্মাচন করে। জঙ্গলে যাওয়া মানে তো শুধু হই হই করে বাঘ দেখা নয়; বাঘ দেখা তো আছেই, জঙ্গলে যাওয়ার আরও বড় মানেও তো আছে। বড় বড় গাছের সামনে সরব না হয়ে নীরব হলে তবেই জঙ্গলের সেই সুর শোনা যায়। সেই ছেন্দর লহর প্রাণের দরজায় এসে দাড়ায়। সেই সুর, সেই ছন্দ বেটোভেনের নাইনথ সিমফনি কিংবা মোৎজার্টের ক্ল্যারিনেট কনচেরটোর সঙ্গে অনায়াসেই তুলনীয়। প্রকৃতির ভেতরে বাইরে যে অন্তর্নিহিত হারমনি বা সাযুজ্য তার সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের হারমনির খেলার মধ্যে কোনও মৌলিক মিল আছে হয়তো, যে কারণে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আগে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কথা মনে হয়।
অনিল শর্মার মুখের দিকে তাকিয়ে একটাই কথা মনে হল: তবে কি জঙ্গল দেখার মন নিয়ে এখানে খুব বেশি লোক আসে না? জঙ্গলকে ভালবাসে না? সে ক্ষেত্রে ওরা যে অনেক কিছু থেকে বিঞ্চত হচ্ছে! গাড়ির স্পিড কুড়িতে নেমে এল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডানদিকের জঙ্গলের মধ্যে ফাকা জায়গায় দেখা গেল সামবার। মানে, অবশেষে বান্ধবগড়ের জঙ্গল দেখা শুরু হল।
শীতের শুরু কাজেই চিতলের শিংয়ে ভেলভেটের আস্তরণ। গরমকাল যত এগিয়ে আসবে ততই শিং শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে। বাদামি গায়ে সাদা বুটিদার চিতল ভারতের প্রায় সব জঙ্গলে হামেশাই দেখা গেলেও ওদের সৌন্দর্য যেন কিছুতেই একঘেয়ে হয় না। ভাসাভাসা কাজলটানা চোখ, চকচকে শরীর, লম্বা লম্বা পা ফেলে নড়ে চড়ে বেড়াতে দেখলে প্রকৃতির কারুকাজে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
আড়াই ঘন্টা বনজঙ্গলের আনাচে কানাচে ঘুরে বান্ধবগড় নামে ৩২টির মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ পাহাড়ের কোলে চক্রধারা মাঠে এসে পৌছলাম। এখানে গাড়ি থেকে নেমে হাটাচলা করা যায়, যা জঙ্গলের অন্য কোথাও যায় না; চা পাওয়া যায় আর সবচেয়ে বড় কথা বাঘের খবরও পাওয়া যায়। জানা গেল বাঘ দেখা গিয়েছে, মানে টাইগার শো হবে। কিন্তু বহু জিপসি সারি দিয়ে আছে, কাজেই সময় লাগবে। অতএব কী করণীয়?
অনিল আমাদের নিয়ে চলল বান্ধবগড়ের হাতিখানায়। সেখানে দেখা ভানুর সঙ্গে। ছোট্ট হাতি সবার সঙ্গে ভাব, সবার কাছে ছুটে ছুটে যাচ্ছে রুটি খাওয়ার আশায়। ভানুর সঙ্গে খেলা করে কিছু সময় কাটালাম। জঙ্গলেও সচরাচর এমন অভিজ্ঞতা বিরল। তারপর চললাম বাঘ দেখার লাইন দিতে।
মধ্যপ্রদেশের বড় বড় জঙ্গলে টাইগার শোয়ের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্কও হয় মাঝেমাঝে। টাইগার শোয়ের ব্যাপারটা হল এইরকম: ভোর চারটে নাগাদ হাতির পিঠে চড়ে মাহাওয়াতেরা জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে বাঘের খোজে। এই প্রথাকে ট্র্যাকিং বলা হয়। বাঘ পাওয়া গেলে বেতার মারফত সে খবর পৌছে দেওয়া হয় কেন্টাল রুমে। এইবার বেশ কয়েকটি হাতি দিয়ে বাঘকে ঘিরে রাখা হয় আর অন্যান্য হাতির পিঠে চড়ে পর্যটকেরা গিয়ে বাঘ দেখে আসে।
আমি কানহার জঙ্গলে প্রথম টাইগার শোয়ে বাঘ দেখি। মনে আছে, মোটেই মন ভরেনি। পরে অবশ্য বুঝলাম বাঘের ছবি তুলতে হলে হাতির পিঠ হল অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা। বান্ধবগড়ে সারা সকাল ঘুরে বাঘ পাওয়া গেল না দেখে টাইগার শোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
হাতির নাম ইন্দ্রজিৎ। ঘন জঙ্গল, এখানে জিপসিও ঢুকবে না, তার ওপর পাহাড়ি। থেকে থেকেই মুখে বাশ ঝাড়ের ঝাপটা লাগছে। সাধারণত এমন হয় না। কানহার মাহাওয়াতেরা হয়তো বান্ধবগড়ের মাহাওয়াতদের চেয়ে বেশি সাবধানী। মনে পড়ে না কখনও চোখেমুখে ডালপালার খোচা লেগেছে। যাই হোক, সাবধানে চোখ বাচিয়ে অবশেষে হাজির হলাম যথাস্থানে। মা আর তার দুই সন্তান। মা তো চিতপাত হয়ে শুয়ে; হাতির ওপর থেকে আমাদের উৎসাহিত কলরব শুনে একবার মুখ তুলে আমাদের দেখে আবার শুয়ে পড়ল। বাচ্চারা দেখলাম অতটা ক্লান্ত নয়। ওদের মুখ দেখলেই বোঝা যায়, নেহাতই শিশু। মা পাশে থাকা সেত্ত্বও, ভিতু অথচ কৌতূহলী চোখে প্রকাণ্ড হাতির পিঠে চারটি বিচিত্র জিব দেখে ওরা বিিস্মত।
হাতি ফিরল। সত্যিই তো, এতকাল জেনে এসেছি মানুষই শ্রেষ্ঠ প্রাণী। মানুষের সঙ্গে, মানুষের মধ্যে থেকে এমন ধারণা গড়ে উঠেছে। তা হলে আর মৌলবাদীদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? মানুষকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর একটা বড় জায়গা রয়েছে, যেখানে আমাদের প্রায় কোনও ভূমিকাই নেই এমন কথা স্বীকার করতে কষ্ট হয়। কিন্তু এ কথাও তো সত্যি! বিশেষ করে এমন মন মাতানো বড় বড় জঙ্গলে নিজেদের সীমিত ক্ষমতার কথা ফিরে ফিরে মনে পড়ে। মনে হয় আমরা বাইরের লোক, অতিথি হিসেবে এসেছি। এখানে আমাদের জোর জুলুম চলবে না, চালানো উচিতও হবে না। জঙ্গলের নিয়ম, প্রকৃতির নিয়মকে সমাদর করে চলতে হবে। সামান্য কথা, তবু মনে না পড়লে হয়তো মনে রাখতে হবে। আমরা যেন ধরে না নিই, জঙ্গলে এসে জঙ্গলকে উদ্ধার করছি; এখন সমস্ত জন্তুর উচিত সার্কাসের মতো আমাদের সামনে দিয়ে প্যারেড করা, যাতে আমরা জঙ্গলের পশু সহজে দেখতে পারি।
ঘন্টা তিনেক বিরতির পর আমরা আবার জঙ্গলে ফিরলাম। এ হল বিকেলের রাউণ্ড। এ বার দেখা গেল অনেক ময়ূর, চিতল, রিসাস ম্যাকাক বা লালমুখো বাদর, পেলাম বন শুয়োর আর বন মুরগির দেখাও। ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো এ বেলাও বাঘের দেখা পাব। কিন্তু আলো কমে আসছে, এ যাত্রা বোধহয় হল না। ভাবতে ভাবতে মোড় ঘুরতেই দেখি বাশঝাড়ে ঘেরা খানিকটা খেলা জায়গায় বসে একটা বাঘ। চারদিকে তখন গোটা বারো জিপসি। মানুষের উত্তেজিত গোলমাল সহ্য করতে না পেরে ধীরে ধীরে উঠে দাড়াল বাঘটি। তারপর বাশবনের ভেতরে ঢুকে গেল।
অনিল শর্মার চোখমুখ জ্বলজ্বল করছে। আসলে ওঁরা যারা জঙ্গলে থাকেন তারা সব সময়েই চান অতিথিদের বাঘ চিতাবাঘ ভাল্লুকের মতো বিরল প্রাণী দেখাতে। আমরা শহরে থেকে সেন্দহ আর অবিশ্বাসের পাঠশালায় শিক্ষা পেয়ে এসেছি, সহজে মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না। ওঁরা জঙ্গলে থাকতে থাকতে এক ধরনের শুিদ্ধকরণের মধ্যে দিয়ে উন্নততর মানুষ হয়ে রয়েছেন। ওঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা তা মানতে চাই না। ভুলে যাই পশুদের গতিবিধি পার্কের বাহনচালক বা গাইডরা নিয়ন্ত্রণ করেন না। ওঁদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি না থাকলেও অনেক সময় কোনও জন্তুর দেখা নাও পাওয়া যেতে পারে। তখন ওঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, জঙ্গলে ভাগ্য বড় ভূমিকা পালন করে। সে কথা মনে রাখতে পারলে কিন্তু অনেক অসেন্তাষের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পরের দিনটা কাটল বান্ধবগড় ফোর্টে। জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে এই গড়। কিছুটা পথ জিপসি করে যাওয়া যায়, তারপর পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সারাদিন ওখানেই কাটল। ফিরতি পথে রাজধনেশ দেখা গেল। দেখা হল এক দল লঙ্গুরের সঙ্গেও, পাথরের ওপর সভা করছিল ওরা। সূর্য ডুবতে চলেছে। শেষবারের মতো বান্ধবগড় চক্কর দিলাম আমরা। আর একটা রাত। কাল ভোরবেলা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব, ফসিল পার্ক হয়ে কানহা পৌছনোর কথা আছে।
ফসিল পার্ক
‘‘ইেম্প্রসনিস্টরা যদি ভারতীয় হত তবে তারা নিঃসেন্দহে মধ্যপ্রদেশে এসে থাকত।’’ কিছুক্ষণ আগে আমরা বান্ধবগড় আর তালা ছেড়েছি। দু’ধারের আসাধারণ দৃশ্য দেখে আমাদের বন্ধু সৌম্য কথাটা বললেও আমাদের সবারই এ কথা মনে হয়েছে। কালো রাস্তা পাহাড়ের ওপর উঠছে, নামছে, যত দূর চোখ যায় সোজা রাস্তার ওঠানামা চোখে পড়ছে। দু’ধারে বিভিন্ন শস্যের ক্ষেত। চৌকো চৌকো কার্পেটের মতো, এক একটাতে এক একটা রং। কোনওটা সবুজ, কোনওটা হলুদ, ইটে লাল, ধুসর। এতগুলো রং একের ওপর আর এক। তার ওপরে সমতল নয়, দু’ধারের জমিই পাহাড়ি। এক সময় দেখা গেল মাইলের পর মাইল শুধু ঢেউ খেলানো সবুজ ক্ষেত, মাঝেমাঝে দু’এক সারি গাছ। নিজের থেকেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল, এ যে ইংল্যােণ্ডর কািন্ট্র সাইডের মতো! মনে পড়ে গেল অক্সফোর্ডশায়ারে একদিনের কথা। সেখানে এক পাহাড়ের মাথার ওপর গাড়ি থেকে দু’ধারের রোলিং কািন্ট্রসাইড আর ভুট্টার ক্ষেত দেখেছিলাম। দৃশ্যের তফাত খুব বেশি নেই। মধ্যপ্রদেশের এই রূপ আমি আগে দেখিনি। এতদিন তার ধূসর কঠিন চেহারা দেখেই মুগ্ধ হয়েছি। এবারে দেখলাম সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ। প্রস্তরিভূত গাছপালায় আগ্রহ থাক বা না থাক, বান্ধবগড় থেকে ফসিল পার্ক যাওয়ার পথটি প্রত্যেকের অন্তত একবার দেখা উচিত। এমন অপূর্ব দৃশ্য, এমন আশ্চর্য রঙের খেলা সাধারণত চোখে পড়ে না।
গভীর রাতে সেই জবলপুর থেকে টয়োটা কোয়ালিস নিয়ে রবি চলে এসেছে। এখন সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটা বাজে, কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আমাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে, গল্প করছে, মনেই হচ্ছে না, কয়েক ঘন্টা আগে আমরা জীবনে প্রথম ওকে চোখে দেখেছি। রবি যেন আমাদের অতি পরিচিত প্রাণের বন্ধু। এতবার জবলপুর কানহা বান্ধবগড় করলেও রবি এই প্রথম ফসিল পার্কে যাচ্ছে।
ফসিল পার্ক প্রস্তরিভূত গাছপালার উদ্যান। খুব বেশি পর্যটক এখানে আসেন না। অথচ, ম্যাপে ফসিল পার্ক দেখেই আমাদের কী উৎসাহ। জুরাসিক পার্ক, ডাইনোসর, অ্যাটেনবরোর লাঠির ডগায় মশা, একসঙ্গে কত কিছু মনে পড়ে যায়। সেই সব কারণে ফসিল পার্ক আমাদের তালিকায় ছিল। বান্ধবগড় থেকে ৭০ কিলোমটার দূরে। পৌছতে পৌছতে বেলা বারোটা হল। জনমানবহীন ফঁাকা পার্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উত্তম। অনেক যত্ন করে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন গাইড। তারপর খেজুর গাছ আমগাছ ও অন্যান্য বিভিন্ন গাছপালার প্রস্তরিভূত অবস্থা বা ফসিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। দেশের মধ্যে এমন সুন্দর ও পরিকিল্পতভাবে উদ্যান তৈরি ও রক্ষা করা হচ্ছে দেখে মাঝেমাঝেই সেন্দহ হয়, মধ্যপ্রদেশটা ভারতের অংশই তো? কলকাতার জাদুঘরেও রক্ষণাবেক্ষণে যে যত্ন চোখে পড়ে না, এই পাণ্ডববর্জিত উদ্যানে দেখলাম তার হাজারগুণ দরদ। পাহাড়ের গায়ে পার্কের জায়গায় জায়গায় বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন নমুনা রাখা আছে খোলা আকাশের তলায়, সারি দিয়ে, লেবেল লাগানো অবস্থায়।
একদল েপ্রৗঢ়ের উৎসাহ দেখে উদ্যানের মানুষগুলিও খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। প্রায় নেড়া এই পাহাড়ের গায়ে এক সময় যে খেজুর গাছের অভাব ছিল না তারই প্রমাণ হল এতগুলি খেজুর গাছের ফসিল। ফসিল শুধু গাছ বা পাতার নয়, খেজুরের বীজের ফসিলও পাওয়া যায় এখানে। তারই একটা আমাদের হাতে তুলে দিলেন উদ্যানের গাইড। সেই ছোট্ট অথচ মনে রাখার মতো স্মৃতিচিহ্ণ নিয়ে আমরা ফের গাড়িতে উঠলাম, যাত্রার এখনও কিছু অংশ বাকি।
দুপুর দুটোর দিকে গাড়ির কঁাটা এগোচ্ছে। ফসিল পার্ক থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ফুলসাগর, তার চোেদ্দা কিলোমিটারের মধ্যে মণ্ডলা। মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের মোটেলে যখন আমরা খেতে বসলাম, তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। মাত্র পাচ রাত্তির আমরা বাড়ি ছাড়া অথচ মনে হচ্ছে সারা বিশ্ব পরিক্রমা করে ফেলেছি। অনেক পথ পরিক্রম করেছি, অনেক দৃশ্যে দেখেছি, অনেক কাহিনী শুনেছি, গল্প কথা গান গেয়েছি। অনেকের প্রাণের উষ্ণতা গভীরভাবে অনুভব করেছি। এই অবস্থায় ঘন্টা মিনিট বা দিনের হিসেব আর বহাল থাকে না। স্মৃতি যত ভরে ওঠে, মন যত নতুনের সন্ধানে আলোড়িত হয়, তত মনে হয়, দৈনিন্দন জীবনের ক্লািন্ত এক দিকে, আর অনেক ভারী পাল্লা নিয়ে রত্নখচিত এই সব অম্লান মুহূর্ত অন্য দিকে; সেই মুহূর্ত যা কোনও দিন হারাবার নয়।
মণ্ডলা ছাড়লাম যখন তখন বিকেল চারটে পেরিয়েছে। এ বার কানহার পথে। তবে কানহার গল্প এ বার নয়, পরের সংখ্যায়।
বান্ধবগড়ের এই গল্প যখন লিখছি তখন জানা গেল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দেশের বন্য প্রাণী, বিশেষ করে বাঘ রক্ষার জন্য বিশেষ টাস্ক ফোর্স গড়ছেন। কারণ দেশের নাম করা বেশ কয়েকটা জাতীয় উদ্যান থেকে বাঘ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এই সব উদ্যানের মধ্যে রয়েছে পান্না, পেচ, রানথামবোর এমন কি বান্ধবগড়ও। ব্যাপার কি জানতে যোগযোগ করি পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে। যা জানতে পারলাম তা মোটামুটি এই রকম:
বহু বছর ধরেই জাতীয় উদ্যান থেকে বাঘ কমছে। শুধুু পেচ বা বান্ধবগড় নয়, কানহার মতো জঙ্গল থেকেও বাঘ কমছে। নয়ত, গত কুড়ি বছরে কানহার জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা ১০০ থেকে বেড়ে মাত্র ১২৮ হয় কী করে? বাকি বাঘ গেল কোথায়? আসল কথা হল এখনও জঙ্গলে ঠাকুর রাজ চলছে। এক সময় ভারতের জঙ্গলগুলো ছিল স্থানীয় রাজাদের হাতে। তাদের ধারণা জঙ্গলের ওপর তাদের এখনও আগের মতো অধিকার বহাল আছে। তারা যখন তখন জঙ্গলে ঢুকে চিতল মেরে খায়। বাঘও শিকার করা হয়। এতে লাভ প্রচুর। চামড়া বিক্রি হয় অনেক দামে। তা ছাড়া, বাঘের প্রায় প্রতিটি অংশ ওষুধ তৈরির কাজে লাগে। বাঘ তাই বিপুল সংখ্যায় মারা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। স্থানীয় মানুষ টাকার জন্যে এই সব কাজ করতে পিছিয়ে নেই। দৈবাৎ মাঝেসাঝে ধরা পড়লে তখন চামড়া উদ্ধার হয়। বেশির ভাগ সময় ওরা ধরা পড়ে না। কারণ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বিপজ্জনক। গুণ্ডা লাগিয়ে আইন প্রণয়নকারীদের সপরিবারে নির্মূল করার ক্ষমতা ও মনোবৃত্তি এদের আছে। আইনরক্ষকেরাও হয় নিজেরা এই কাজে যুক্ত আর নয়ত প্রাণভয়ে মুখ খোলে না। এ ঘটনা যে ঘটছে তা অঞ্চলের সবাই জানে।
বাঘ আমাদের দেশের গর্ব। তাকে রক্ষা করতে ভারত ও রাজ্য সরকার তাদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে। দেশটা কিন্তু শুধু সরকারের নয়। আমাদেরও। বাঘের এই দুর্গতিতে হাত গুটিয়ে হা হুতাশ করা ছাড়া আমাদের কি আর কিছুই করার নেই?

No comments:

Post a Comment