Saturday, July 19, 2014

নাটোরে কুঠিবাড়ী ঘুরে আসুন

কুঠিবাড়ীর মূল ফটক। পিতার আদেশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলকাতায় সেরেস্তায় বসে জমিদারি শিখতে হলো। একেবারে কেরানি থেকে শুরু করে নায়েবের কাজ পর্যন্ত। শিক্ষা শেষে তিনি পূর্ববঙ্গে পাড়ি দেন। এখানে তাঁদের তিনটি পরগনা—নদিয়া জেলার বিরাহিমপুর, যার কাছারি শিলাইদহ; পাবনা জেলার শাহজাদপুর আর রাজশাহী জেলার কালিগ্রাম, যার কাছারি হলো পতিসর। নাগর নদের তীরে অবস্থিত পতিসর নওগাঁ জেলার আত্রাই থানায় অবস্থিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীপথে পতিসর আসতেন। নাগর নদে বজরায় বসে তাঁর সাহিত্যচর্চা চলত। আর পতিসরে কুঠিবাড়ীতে চলত খাজনা আদায়। খাজনা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ভাগনে বীরেন্দ্রনাথ। পতিসরে কবি প্রথম আসেন ১৯১১ সালে। এখানে কবির বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা হলো খেয়া, চৈতালী, চিত্রা, আকাশ প্রদীপ, বিদায় অভিশাপ, গোরা, ক্ষণিকা ইত্যাদি। তিনি এখানকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট দেখে তা দূর করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৩৭ সালে তিনি পতিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সব সম্পদ প্রজাদের মধ্যে দান করে দেন। এবার নাটোরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী দেখতে পতিসর যাব ঠিক করলাম। নাটোর থেকে পতিসর খুব দূরের পথ নয়। নাটোরের নজরুল হার্ডওয়্যারের মালিক নজরুল আমার বন্ধু। তাঁর কাছেই জেনে নিলাম যাত্রার খুঁটনাটি।
পথের বিড়ম্বনা
নাটোর মাদ্রাসা মোড় থেকে বগুড়া রোডের দিকে গেলে নাটোর বাসস্ট্যান্ড। বগুড়ার বাসে চড়ে বসলাম, তারপর আধা ঘণ্টায় সিংড়া বাসস্ট্যান্ড। ইচ্ছে ছিল সিংড়া থেকে নদীপথে পতিসর যাব। নদীপথে পতিসর যাওয়ার মজাই আলাদা! কিন্তু সিংড়া নদীতে সে সময় পানি কম, নদীপথে যাওয়া হলো না। বাধ্য হয়ে আবার বাসে চড়া। এবার কালীগঞ্জের বাস ধরলাম। লোকাল বাস, তার ওপর ছুটির দিন, আমাদের ঘাড়ের ওপর মানুষ, আর এভাবেই দাঁত কামড়ে বসে থাকি। এক ঘণ্টায় সেই বাস আমাদের নিয়ে কালীগঞ্জ বাজারে পৌঁছাল। কালীগঞ্জ বাজার তেমন জমজমাট নয়। এখানে দোকানপাটও খুব কম। কাছেই একটা খাবারের হোটেল দেখে খেয়ে নিতে চাইলাম। কী মনে করে সামনে এগোলাম। হেঁটে একটা সেতু পার হয়ে আবার একটা বাজারের মতো এলাকায় চলে এলাম। এখান থেকে স্থানীয়ভাবে নির্মিত গাড়ি ভটভটি বা ভ্যানগাড়িতে যেতে হবে পতিসর। আমরা সময় বাঁচাতে একটি ভটভটি ভাড়া করে তাতে চড়ে পতিসরের দিকে এগিয়ে যাই।
এখানে প্রকৃতি অসাধারণ। রাস্তার দুই পাশ সবুজ আর সবুজ। একটু পরপর পুকুর। মন কেমন করা নির্জনতা চারদিকে। তা ভেঙে মাঝেমধ্যে বিকট শব্দ করে ভটভটি আর মোটরসাইকেল চলে যায়। এখানে কবুতর, হাঁস, ভেড়া লালন-পালন খুব বেশি। পথে পথে বরইগাছ, কলাগাছ, কড়ই, খেজুর, তাল আর প্রচুর শিমুলগাছ চোখে পড়ল। রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত। কৃষক জমিতে ধান রোপণ করছেন, কেউ আবার আগাছা পরিষ্কারে ব্যস্ত। চারপাশ দেখতে দেখতে পথের বিড়ম্বনা মনে থাকে না।
কুঠিবাড়ীতে
ভটভটি একেবারে কুঠিবাড়ীর মূল ফটকের সামনে গিয়ে থামে, তার পাশেই রবিসরোবর। আর মূল ফটকের ওপর দুটি সিংহের ভাস্কর্য, অতীতের পাহাদার যেন। আমাদের দেখে এখানকার তত্ত্বাবধায়ক আবদুল লতিফ দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে যান। বোঝাই গেল, কালেভদ্রে এখানে দর্শনার্থীরা আসে। কিন্তু তাতে কী, কুঠিবাড়ী একেবারে ঝকঝকে তকতকে। ভেতরে ঢুকেই রবিঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। এর ভাস্কর কণক কুমার পাঠান। লতিফ আমাদের দেখার জন্য রবিঠাকুরের শোবার ঘরসহ দুটি ঘর খুলে দেন। ঘরগুলো কবির ব্যবহার্য বিভিন্ন তৈজসপত্র, নানা রকম সামগ্রী, তাঁর হস্তলিপি আর বিভিন্ন ছবিতে ভরা। একটি বাথটাব দেখে খুবই আশ্চর্য হয়ে ভাবি, সে আমলে বাথটাব! তা ছাড়া এখানে আছে একটি নোঙর, বিশাল আয়না, আরাম কেদারা, ওয়্যারড্রব, ঘড়ি, গ্লোব, সিন্দুক, খাজনা আদায়ের টেবিল, খাট, আলমারি, দরজার পাল্লা, জানালা ইত্যাদি। আমরা এসব দেখে লতিফকে বিদায় জানিয়ে বের হই। পাশেই কবির ছেলের নামে প্রতিষ্ঠিত রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন। আর রয়েছে একটি সরকারি ডাকবাংলো। সুন্দর কাজ করা গেট। তালায় মরিচা ধরা। এখানে কোনো তত্ত্বাবধায়কও চোখে পড়ল না। কী আর করব, ডাকবাংলোয় অতিথি হয়ে রাত্রিযাপনের আশা বাদ দিয়ে ফিরতি পথ ধরি।
পতিসরের পথ
ঢাকা থেকে নাটোর পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ। নাটোর থেকে পতিসর যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। হাতে সময় নিয়ে যাবেন, যাতে নাটোর আর পতিসর একসঙ্গে ঘুরে আসা যায়। নাটোরে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে। চাইলে পতিসর ডাকবাংলোয় থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আগে থেকে অনুমতি নিতে হবে। তাহলে ভালো করে পতিসরসহ আশপাশের পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যাবে। ঘুরে আসতে পারেন আহসানগঞ্জ রেলস্টেশন। চাইলে এখান থেকে খুলনা মেইল বা তিতুমীর এক্সপ্রেসে চড়ে নাটোরেও ফিরে আসতে পারেন। যেভাবেই যান, হাতে সময় নিয়ে যাবেন, কারণ পতিসর ও নাটোর শহরে দেখার আছে অনেক কিছু। আর ফিরতি পথে কাঁচাগোল্লা তো আনবেনই।

No comments:

Post a Comment