Thursday, July 24, 2014

অজানা রূপে বিভোর হতেই হয়

‘পেডং’ না ‘পেদং’- নাম নিয়ে বিভ্রান্তিতে সময় নষ্ট না করে নতুন নাম শোনা ছোট্ট পাহাড়ি জনপদের অজানা রূপে বিভোর হতেই হয়। ঐতিহাসিক আমল থেকেই বণিকদলের আনাগোনায় সমৃদ্ধ হয়েছে যে গ্রাম, তারই আধুনিক অথচ আটপৌরে রূপ দেখে সেম্মাহিত হয়েছেন লেখক। তাঁর কলমে পেদং-এর মনকাড়া ছবি।

কালিম্পং বাস স্ট্যাণ্ডে পৌছতেই কানে এল ‘‘পেদং, পেদং’’ হাক। হ্যা, জায়গার আদত নাম ‘পেডং’ নয়, ‘পেদং’। ভুটিয়া ভাষায় পেদং মানে সুগিন্ধ গাছের জায়গা। সুগিন্ধ, অর্থাৎ ধুপি গাছ। জুনিপার গোত্রের এই গাছ হিমালয়ের এই অঞ্চলে ৪০০০ ফুটের ওপরে দেখা যায়। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই তার গুণ। ধুপি কাঠে কখনও উই বা ঘূণ ধরে না। এর পাতা শুকিয়ে জ্বাললে অপূর্ব সুগন্ধ বের হয়। ধূপের মতো গন্ধ বলেই নাম ধুপি। স্থানীয়দের বিশ্বাসে, অতি পবিত্র এই গাছ আকৃষ্ট করে স্বর্গবাসী দেবতাদেরও।
কালিম্পং থেকে পেদং ২১ কিলোমিটার। কালিম্পংয়ের ঘন বসতি ছাড়াতেই পাহাড় হাট করে খুলে দিল তার অপরূপ অন্দরমহলের দরজা। গ্রীেষ্মর শেষে বর্ষারেম্ভর প্রস্তুতির চিহ্ন আকাশ জুড়ে। মেঘের পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিচ্ছে ম্লান সূর্য। পাকদিণ্ড পথের এক পাশে গভীর খাদ আর অন্য পাশে শ্যাওলা, ফার্ন আর রকমারি রংবেরঙের অচেনা ফুলে সাজানো পাহাড়ের ধাপ। কখনও পাহাড়ের বাকে কয়েক ঘরের এক ফেঁাটা গ্রাম। টিনের চালওয়ালা কাঠের বাড়ির জানালায় হালকা নেটের পর্দা আর এক চিলতে বারান্দায় ঠাসাঠাসি করা টবে ফুলের মেলা।
শুনলাম, আর একটু চড়াই ভাঙলে দেখা মিলতে পারে নানা রঙের গুরাস-এর, মানে রডোডেনড্রন। ১৫ কিলোমিটার পাকদণ্ডি পথের শেষে ছোট শহর আলগারা। গাড়ি এখানে ১৫ মিনিট থামল। টুক করে নেমে এক চক্কর হেঁটে এলাম। বাজারে বিকোচ্ছে টাটকা ফল আর সবজি। মোষের মাংসের দোকানে বেশ ভিড়। শহুরে হাবভাব এখানে যথেষ্টই, আছে সাইবার কাফে, সি ডি লাইব্রেরি আর বৈদ্যুতিন জিনিসপত্রের দোকান। পেদং এখান থেকে আর ছয় কিলোমিটার। দু’ কিলোমিটার চড়াই ভেঙে গাড়ি উতরাই পথ ধরল। কুড়ি মিনিটেই পৌছলাম ৪৭০০ ফিট উচ্চতার পেদংয়ের বাজার সংলগ্ন ট্যাক্সি আড্ডায়।

স্ট্যাণ্ডের পাশে ফুটবল মাঠ। স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলের দল সেখানে বল পিটছে। মাঠের উেল্টা দিকে বিশাল স্কুলবাড়ির বারান্দায় হুটোপুটি করছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। ক্রিশ্চান মিশনারিদের স্কুল সেন্ট জেভিয়ারের নামে। পাশেই আছে ক্যাথলিক গির্জা। অনেক বছর ধরেই এখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কনভেন্ট। সেন্ট জেভিয়ার্স ছাড়াও আছে সেন্ট জর্জ, গ্রেস স্কুল এবং টেণ্ডার বাড্‌স, স্প্রিং বণ্ড, সানরাইজ, কিড্‌স ক্যাস্‌ল-এর মতো কয়েকটা প্রাইমারি স্কুলও।
হোটেলের পোশাকি নাম ‘পেদং হলিডে রিসর্ট’ হলেও ‘রাই নিবাস’ নামেই লোকে চেনে। পেদং বাজারের কাছে পাহাড়ের ঢালের ওপর দোতলা বাড়ির চার দিক ঘিরে বাগান। একটু অগোছালো সেই বাগানের রূপ যেন বেশি খুলেছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুলের মেলায়। ফলের গাছও আছে। পিচ, চেরি, আলুবোখরা এমনকী ছোট ছোট ষ্ট্রবেরির ঝোপও। গৃহস্বামী সপরিবার ওপরতলায় বাস করেন। একতলার পুরোটা জুড়ে অতিথিশালা। রিসেপশন কাউন্টারে রসিদপত্র বুঝে নিল যে ছেলেটি, তার নাম শ্রাবণ। সম্পর্কে রাই মশাইয়ের ভাইপো। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স নিয়ে এম.এ. পড়ছে। তার সঙ্গী ভিকির পড়াশোনা বারো ক্লাস পর্যন্ত। দু’জনে ভারী দোিস্ত। হোটেলের ম্যানেজার- কাম- রাধুনি- কাম- ওয়েটার ভিকি থাকে বাজারের পাশেই। সে নাকি আঞ্চলিক সিনিয়র ফুটবল টিমের অধিনায়কও! যাই হোক, লােঞ্চ তার রাধা চিকেন কারির স্বাদ যে অমৃতসম তা কবুল করতেই হল।

বিকেলে চললাম মন্যািষ্ট্র দেখতে। এই দিকে সর্বত্র বৌদ্ধ গোম্ফার ছড়াছড়ি। পেদং শহরে আছে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সেনা ছাউনি। তার রাস্তা ধরে উঠতে হয় পাহাড়ের মাথায়, যেখানে কাঠ আর সিমেেন্টর তৈরি প্রাচীন গোম্ফা দাড়িয়ে। ১৮৩২ সালে তৈরি এই সিকিমি গোম্ফার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৮২ সালে লেখা কালিম্পংয়ের তদানীন্তন ডেপুটি কালেক্টর সি. আর. ম্যারিনডিনের পেশ করা রিপোর্টে। বহরে ক্ষুদ্র হলেও গাম্ভীর্যে তুলনাহীন তার উপিস্থতি। অন্যান্য মন্যািষ্ট্রর তুলনায় পেদং গোম্ফার চাকচিক্য কম। এক তলার প্রার্থনাকক্ষের মেঝে আর সিলিং কাঠের, দেওয়াল কংক্রিটের। অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম— বিশাল মাপের বুদ্ধমূর্তি এখানে নেই। তার বদলে সারিবদ্ধ কাচের শো-কেসে রাখা তিন ফুটের বিভিন্ন মূর্তি। বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, গুরু পদ্মসম্ভব, অতীশ দীপঙ্কর ও বৌদ্ধ তারাকে চিনতে পারলাম। তাংখার ঝালরে মোড়া থামগুলো। ঘরের দুই পাশে টানা মাদুর পাতা, যার সামনে সার সার জলচৌকির ওপর তিব্বতি হরফে লেখা পুথি, মণিচক্র আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। যেমন শিঙা, মৃদঙ্গ, ঝাঝর, ঢোল। প্রার্থনার সময় লামারা এই সব বাজনার সঙ্গতেই মেন্ত্রাচ্চারণ করেন। গোম্ফার ওপর তলায় ছোট ঘরে তিন ধাপ জুড়ে জ্বলছে মাখনের প্রদীপ। সেখানে বুদ্ধের নানান রূপের ধাতব মূর্তি সাজানো। ধূপের গেন্ধ হাওয়া ভারী হয়ে আছে। ভাব-গাম্ভীর্যে ভরপুর গোম্ফা দেখে আমরা চললাম বাজারের দিকে।

পেদং বাজারে ঢোকার মুখে ভিকির সঙ্গে দেখা। আমাদের রাতের খাবারের মালমশলা জোগাড় করতেই যে সে এসেছে তা এক কথায় জানাল। মোমোর অমোঘ হাতছানি না এড়াতে পেরে তিব্বতি রেেস্তারায় বসে পড়লাম। মোষের মাংস, স্থানীয় মানুষের ভাষায় ‘বাফ’-এর মোমো। সঙ্গে ধোয়া-ওঠা স্যুপ। আটটা মোমোর েপ্লটের দাম পনেরো টাকা। ছোট বাটিতে আছে টম্যাটো ও ডেল্লর ঝাল-টক আচার। অপূর্ব স্বাদ! নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল প্লেট।

হোটেলে ঢুকতে না ঢুকতেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। মুষলধারার ঘোলা পর্দায় ঢাকা পড়ে গেল সমস্ত চরাচর। কাচের জানলায় মুখ ঠেকিয়ে বাদলধারার তাণ্ডব দেখলাম অনেকক্ষণ। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি আর তীব্র শেব্দ অশনিপাত। তবে আধ ঘন্টা জোরে বৃষ্টি হয়ে আচমকাই থেমে গেল। ঠাণ্ডা বাড়ল জাঁকিয়ে। ঝিঁঝির একটানা ডাক আর ক্ল্যাপিং বিট্‌লসের কটাকট সঙ্গতে অজােন্তই ঘুম এসে জড়িয়ে ধরল।
সকালে চায়ের ট্রে নিয়ে ভিকি যখন ঘুম ভাঙাল ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ছ’টা। জানলার পর্দা সরাতেই ঘরে ঝলমলে রোদ ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্রেকফাস্ট সেরে শ্রাবণের সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম ড্যামস্যাং দুর্গের দিকে। মন্যাষ্ট্রির রাস্তা ডান হাতে রেখে, আরও ২ কিলোমিটার এগিয়ে ডান হাতে খাড়া পাহাড়। শীতে এই পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং শেখানো হয়। এইখানে গাড়ির রাস্তা ছেড়ে উঠে গেছে ড্যামস্যাং জং-এ যাওয়ার কাচা রাস্তা। ‘জং’ ভুটিয়া শব্দ, যার মানে দুর্গ। জানা গেল, ফোর হুইল ড্রাইভওয়ালা গাড়ি নিয়ে এই পথে দুর্গ যাওয়া যায়। তবে হেঁটে যাওয়ার আনন্দ বেশি। চার পাশের দৃশ্য চাখতে চাখতে যাওয়া যায়। এক কিলোমিটার হেঁটে চোখে পড়ল পাহাড় কেটে ইমারত তৈরির কাজ চলছে। বোর্ডিং হাউজ হবে। পর্যায়ক্রমে পাকা হবে রাস্তাও।

পথের দু’পাশে কোনও লোকালয় নেই। এ দিক ও দিক ছড়িয়ে আছে চিলৌনি আর ধুপি গাছের জটলা। আরও এক-দেড় কিলোমিটার পরে দেখতে পেলাম চা বাগান। যেত্নর অভাবে অবশ্য সে বাগানের অিস্তত্ব লোপ পেতে বসেছে। শ্রাবণ জানাল, এক সময় সুগিন্ধ লিকারের জন্য এই উদ্যানের চায়ের খ্যাতি ছিল। তখন বিদেশের বাজারে রপ্তানি হত এই চা। চা বাগানের মালিক ছিলেন রাজ পরিবার। কালেস্রাতে ভেসে গেছে রাজেত্বর গরিমা আর তার ছাপ পড়েছে চা বাগান পরিচর্যার ক্ষেত্রেও।

চা বাগান ছেড়ে ঢুকে পড়লাম পাইনের জঙ্গলে। সুপ্রাচীন মহাদ্রুম রক্ষীরা আগলে রেখেছে দুর্গের প্রবেশপথ। তাদের ঘন ডালপালার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে পৌছয় না। স্যাতস্যাতে ভেজা ভেজা আবহে একটানা ঝিঁঝির কোরাস বেজে চলেছে।
কোথাও গাছের পাতা থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে হিমের ফোটা নীচের পচা পাতার স্তূপে। পায়ের তলায় মখমলি ঘাসের ওপরে চলতে হচ্ছে খুব সাবধানে, কারণ সেখানে জোকের উপদ্রব। জঙ্গলের শেষে, পাহাড়ের মাথায় তার যাবতীয় ঐতিহাসিক নিঃসঙ্গতা নিয়ে দাড়িয়ে ড্যামস্যাং দুর্গ। সময় তার বলিষ্ঠতায় জরার প্রলেপ দিয়েছে।
১৬৯০ সালে তৈরি এই দুর্গের সৃষ্টি প্রধানত ব্রিটিশ ফৌজকে ঠেকাতে। তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমল। ব্রিটিশ রাজদরবার কোম্পানির আবেদনে সাড়া দিয়ে, তাদের সুষ্ঠু ভাবে ব্যবসাবাণিজ্য করায় সাহায্য করতে সেনা পাঠান। সে সময় তিব্বতের প্রবেশপথ হিসেবে পেদংয়ের গুরুত্ব বাড়ে। তাই দার্জিলিং অঞ্চলে হানা দেয় ইংরেজ ফৌজ। এই পার্বত্য রাজ্যের শাসক তখন ভুটিয়া রাজা গেবো আচিয়ক। আসন্ন হামলার মহড়া নিতে পেদংয়ের কাছে তিনি নির্মাণ করেন ড্যামস্যাং জং। ব্রিটিশ শক্তি ছাড়াও বছরভর উত্ত্যক্ত করা ছোটখাটো প্রতিবেশী রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিহত করতেও এই দুর্গের পত্তন হয়। ড্যামস্যাংয়ের স্থান নির্বাচন সুপরিকিল্পত। দুর্গের বুরুজে দাড়ালে নেপাল, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর নজর রাখা যায়। রাজা গেবো আচিয়কের দূরদৃষ্টির তারিফ করতে হয়। সুশাসক এই রাজার নানা কীর্তি আজও লোকমুখে ফেরে। মানুষ তাকে স্মৃতিতে ধরে রেখেছে ‘‘ত্রিনয়নেশ্বর’’ রূপে। বলা বাহুল্য, তার বুদ্ধিমত্তার প্রশিস্ততে এ এক আলংকারিক সংযোজন।
ড্যামস্যাং জং বর্তমানে রক্ষাবেক্ষণের দায়িেত্ব আছেন স্থানীয় লেপচা সম্প্রদায়। অদ্ভুত লাগল, সিকিমের রাবডান্টসে প্রাসাদের মতো এখানে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কোনও উপিস্থতি না দেখতে পেয়ে। সরকারি সাহায্য ছাড়া এই বিশাল প্রত্নসৌধের সঠিক ভাবে যত্ন নেওয়া অসুবিধের। নেই কোনও পাহারাদার অথবা প্রদর্শক। প্রতিদিনের রোদ জল ঝড় মাথায় নিয়ে একটু একটু করে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে জং। বাধ্য হয়েই জংয়ের অনেক স্মারকই ঠাঁই পেয়েছে স্থানীয় কিছু গোম্ফায়। আশ্চর্য হলাম সরকারি তরফে কোনও প্রদর্শনশালার অভাবেও।

ড্যামস্যাং থেকে ফেরার পথে পড়ল ‘হর্সেস লেক’। এই জলাধার থেকে পেদং ও সংলগ্ন অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। জলাধারের নামেও আছে ইতিহাসের ছোয়া। ১৮৬৪ সালে ইংরেজের সঙ্গে যুেদ্ধ হার মানে ভুটানিরা। দুর্গের দখল আসে ব্রিটিশ ফৌজের হাতে। সেনাবাহিনীর ঘোড়াদের জল খাওয়ানো হত এই প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে। সেই থেকে এই নাম জুটে যায় তার বরাতে। ইদানীং মানুষের কাজে লাগলেও নাম মাহাত্ম্যে লেক রয়ে গেছে ঘোড়াদের জিম্মাতেই। পেদং বাজারে নেমে দেখলাম ১৫০ বছরের পুরনো স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসে পবিত্র প্রায় ৬০ ফুট উচু ধুপি গাছ। এক সময় নাকি আরও লম্বা ছিল এই গাছ। বাজ পড়ে তার আগার খানিকটা খসে গিয়েছিল বলেই হ্রাস পেয়েছে তার উচ্চতা। মগডালে বাধা ধর্মীয় নিশান আর গুড়ি বেষ্টন করে তৈরি হয়েছে দেবমিন্দর। পেদংয়ে বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষই বাস করেন বেশি। কিছু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষও আছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে মেলামেশা বেশ আন্তরিক স্তরেই। শুনে অবাক হলাম, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়েও হয় হামেশা। এমনকী, পেদং বাজারে যৌথ উদ্যোগে একই মেঞ্চ পূজার্চনাও হতে দেখলাম।
দুপুরের খাওয়া সেরে স্ট্যাণ্ড থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে চললাম পূর্ব সিকিমের আরিটার লেক দেখতে। পেদং থেকে উতরাই পথে চিল্লশ মিনিট নামার পর বাংলা-সিকিম সীমান্ত। এখানে মুদুম খোলার ওপর লম্বা সেতুর এ পাশে পশ্চিমবঙ্গ আর ও পাশে সিকিম রাজ্য। ব্রিজ পেরিয়ে চেক পোস্ট ছেড়ে এগোতেই পড়ল মুদুম ও ঋষি নদীর সঙ্গম। ঋষি নদী এর পর বয়ে গেছে পাহাড়তলির তিস্তাতে যোগ দিতে। এবার রাস্তা ঊধ্বর্মুখী। পাহাড়ের প্যাচে পাক খেয়ে চলতে চলতে দেখছি সবুজের রকমফের। পাইন, ওক, শিমুল, চিলৌনি, ধুপি, উত্তিসের মেলায় চোখ ধাধিয়ে যায়। পেদং ছেড়ে ২৩ কিলোমিটার এসে সিকিমের প্রথম শহর রেনক। দোকানপাট, থানা, ডাকঘর আর হাতে গোনা সরকারি অফিস-কাছারি নিয়ে ছোট্ট জনপদ। বেশ কিছু তিন-চার তলা বাড়িও নজরে পড়ল। গাড়ি এখানে দশ মিনিট দঁাড়াল তেল নিতে। আরও ১৪ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে পৌছলাম আরিটার হ্রদ।

চার পাশের ঘন জঙ্গলের ছায়া পড়ে জলের রং পান্না-সবুজ। সেই জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছের দল। হ্রদ ঘিরে সুন্দর বাধানো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবার গোল চত্বর, মাথায় রঙিন ছাতা। লেকের জলে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। লেকের পূর্ব পাড়ে টিলার মাথায় ছবির মতো রিসর্ট। পশ্চিম পাড়ে শিবমিন্দর। অধিষ্ঠিত বিগ্রহ তান্ত্রিক বৌদ্ধরূপী মহাদেব। উত্তর পাড়ে খাড়া টিলাকে বেড় দিয়ে উঠেছে সিঁড়ির ধাপ। টিলার ওপরে ছাতা লাগানো কয়েকটা ভিউ পয়েন্ট। সিঁড়ি ভাঙার ক্লান্তি দূর হয়ে যায় সেখানে বসে নীচের উপত্যকার মনোরম দৃশ্য দেখে। পাহাড়ের অন্য ঢালে ছড়িয়ে আছে আরিটার গ্রাম। ধাপচাষের ছোট খেত দেখলে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের ‘বুড়ো আংলা’য় বর্ণিত শতরঞ্জ খেলার ছকের উপমা। একটু তফাতে এক টুকরো জমির ওপর হেলিপ্যাড। শুনলাম, সেনাবাহিনীর কপ্টার মাঝেমধ্যে সেখানে নামে। ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু বসতেই কঁাপুনি ধরাল। ঢুকে পড়লাম লেকের পাড়ের তিব্বতি গুমটিতে। পর্ক, মোমো আর তোংবা দিয়ে জমে গেল বিকেলের জলখাবার।
আরিটার ছেড়ে পেদং পৌছলাম অন্ধকার মাথায় নিয়ে। হোটেলে ঢুকতেই শ্রাবণ হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল তার পরিবারের সঙ্গে কফি পানের আড্ডায়। তার কাকা রাই মশায় ও শ্রীমতী রাইও যোগ দিলেন। দোতলার বারান্দায় তাদের সঙ্গে বসে মজে গেলাম নানা গেল্প। ওঁদের কথায় জানতে পারলাম, শিক্ষার প্রসারে পেদং কালিম্পং অঞ্চলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে সেই ষাটের দশক থেকে। এই শিক্ষা আেন্দালনের আরম্ভ কিন্তু আরও প্রাচীন কালে।
কালিম্পংয়ের পূর্বোল্লেখিত ডেপুটি কালেক্টর সি.আর.ম্যারিনডিন তার ১৮৮২ সালের রিপোর্টে পেদং বাজারের এক কিলোমিটার দূরের গোম্ফার কথা লিখেছেন যেখানে প্রথাগত বৌদ্ধ পুথি ছাড়াও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হত। আধুনিক শিক্ষার আলো এই এলাকায় জ্বেলেছিলেন যে খ্রিস্টান মণীষী, তিনি ফরাসি যাজক ফাদার দেগোদ্যা। ইনি কঠোর সংকেল্পর অধিকারী ছিলেন। তিব্বতে সুদীর্ঘ কুড়ি বছর বাস করেও ধর্ম প্রচারে বিফল হয়ে তিনি পেদংয়ে এসে বসবাস শুরু করেন। ১৮৮২-৮৩ সাল নাগাদ তিনি এখানে মিশন পোস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তার বরাবরের স্বপ্ন ছিল তিব্বতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। পেদঁয়ের কুরুস দাড়া পাহাড়চূড়ায় তিনি এক বিশাল ক্রুসিফিক্স প্রোথিত করেন যা তিব্বতের দিকে মুখ তুলে থাকে। পরবর্তী কালে তার স্মৃতির উেদ্দশে এই পাহাড়ের উপর তৈরি হয়েছে বিশাল ক্রস যা এই অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্য। ফাদার দেগোদ্যা গোর্খা ভাষায় বাইবেলের বড় অংশ অনুবাদ করেছিলেন। লিথোগ্রাফের সাহায্যে তা ছাপিয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে উৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন। ১৮৯৯ সালে আর এক ফরাসি যাজক ফাদার দাউনেল গোর্খা ভাষায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পূর্ণাঙ্গ পুস্তিকা প্রকাশ করেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের সৌজন্যে ১০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় পেদংয়ের প্রথম স্কুল। তার দশ বছর পরে প্রথম হাসপাতালও গড়ে ওঠে তাদেরই প্রচেষ্টায়। পুরনো গির্জা সংস্কার করে ১৯৭১ সালে রোমের একটি চার্চের অনুকরণে সাজানো হয়।

কথা বলতে গিয়ে সময় জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে লোডশেডিং হয়েছে। চতুর্দিক অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। আকাশে চাদ নেই। তবে তারার মেলায় কোনও কার্পণ্য নেই। কুয়াশার ঘোমটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত তামাম শিখররাজি। দূরপিন দাড়া, ড্যামস্যাং গিরিশিরার গাঢ় অবয়ব ঠাহর করা যায়। রাই দম্পতির কাছে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরলাম। ইতিহাসের অস্পষ্ট স্মৃতির মেদুরতায় মন আচ্ছন্ন। কয়েক ঘন্টার জন্য টাইম মেশিনে চেপে যেন ঘুরে এলাম দেড়-দুশো বছর আগের প্রাচীন পেদংয়ে। অপার সারল্য মাখা অতি সাধারণ সেই পাহাড়ি গ্রামের পথে পথেই হল আজকের সান্ধ্য ভ্রমণ। টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ-শো’র প্রচণ্ড আওয়াজে বাস্তবে ফিরলাম। অতীতের ধুলো মাখা স্মৃতি-রঙিন প্রেক্ষাপট ছেড়ে আচমকা এসে পড়লাম ঝা-চকচকে বর্তমানের অলিন্দে। নিঃস্বার্থ ধর্মযাজকের অকুণ্ঠ আত্মত্যাগ ভুলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৈনিন্দন চাওয়া-পাওয়ার অভ্যস্ত জীবনে প্রত্যাবর্তন ঘটল আমাদের। কাল ফেরার পালা।

1 comment: