Thursday, July 24, 2014

স্বর্ণালী অতীত রোমন্থনে পেদং

পর্যটন মানচিত্রে নবাগত পেদংয়ের আছে তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। পেদং হয়ে রেনক, কুপুপ, জেলেপ লা ও নাথু লা গিরিপথ ধরে গেছে তিব্বতে প্রবেশের পথ, ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ‘সিল্ক রুট’। এই পথ বেয়ে যুগে যুগে পণ্য নিয়ে প্রাচীন ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্রে পৌছত ভিনদেশি বণিকের দল। বেড়ানোর অবকাশে পেদংয়ে এসে ভারত তথা প্রতীচ্যের নানা চাঞ্চল্যকর অধ্যায়ের সাক্ষী সেই পথের সন্ধান পেয়েছেন লেখক।

হাল আমলের পর্যটন মানচিত্রে সাম্প্রতিক সংযোজন হলেও পেদংয়ের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এই জনপদের অবস্থান সিকিম তথা তিব্বতের খুব কাছে বলেই সুদূর অতীত থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে তার গুরুত্ব অপরিসীম। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকেই পেদং ইতিহাস চর্চিত ‘সিল্ক রুট’-এর অন্যতম ঘাটি। চিন থেকে তিব্বতের লাসা হয়ে জেলেপ লা গিরিপথ অতিক্রম করে কুপুপ, রেনক, পেদং, কালিম্পংয়ের ওপর দিয়ে সেই ঐতিহাসিক পথ পৌছে যেত পাতলিপুত্র নগরী এবং ভারতীয় অন্যান্য বাণিজ্যকেন্দ্রে। এই বাণিজ্য পথে প্রখ্যাত ‘মিউল ট্রেন’ বা মাল বোঝাই খচ্চরের সারি পৌছত ভারতে। রেশম দিয়ে আরম্ভ হলেও ক্রমে অন্যান্য সামগ্রিতে সমৃদ্ধ হয়েছে সিল্ক রুটের বর্ণাঢ্য পসরা। নানান বাণিজ্যিক দ্রব্যের মধ্যে পশমই অবশ্য কালক্রমে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা হয়ে উঠেছে। পথশ্রান্ত বণিকের দল তাদের আশ্রয় খুজে পেয়েছে পেদংয়ের ধুপিবন ঘেরা শান্ত পিল্লতে। স্থানীয় মানুষ আজও রোমন্থন করেন সেই স্মৃতি। আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন, ‘ওইখানে ছিল খচ্চরের আস্তাবল’, আর ‘ওই পাহাড়ের খাজে ছিল ইয়াকের গোয়াল।’

বণিকেরা অধিকাংশই তিব্বতি ও ভুটিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। ইয়াকের দুধ থেকে মাংস, সবই জনিপ্রয় ছিল তাদের রসনায়। বর্তমানে ইয়াক বিরল। কিন্তু ভিনদেশিদের চারিয়ে যাওয়া অভ্যেস রয়ে গেছে। তাই হয়তো এই এলাকার মানুষের দৈনিক খাদ্যাভাসে মোষের মাংসের জনিপ্রয়তা লক্ষণীয়। পেদংয়ের ঘরে ঘরে ‘বাফ’ অর্থাৎ মোষের মাংসের রকমারি পদ রাধা হয় প্রায় রোজই।
১৮৬৪ সালে ভুটানিদের যুদ্ধে পরাস্ত করে পেদং-সহ দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে ব্রিটিশ সরকার। সিকিমের দখল আগেই এসেছিল ইংরেজদের হাতে। এ বার দুই পাহাড়ি এলাকা জুড়ে তৈরি হল বিস্তৃর্ণ পার্বত্য রাজ্য যার অধীশ্বর ব্রিটিশ সরকার। নতুন রাজ্যে নেপালের অধিবাসীদের অনুপ্রবেশের ফলে তাদের সঙ্গে অঞ্চলের আদিবাসী লেপচা, ভুটিয়া ইত্যাদি উপজাতির মিশেল ঘটল। ফলস্বরূপ তৈরি হল এক সংকর পার্বত্য জাতি। জন্ম নিল অভিনব পার্বত্য সমাজ এবং তার অনন্য কৃষ্টি আর পরম্পরা। এক একটি উপজাতির আবার নানান বিভাজন। এই ভাবেই গুরুং, তামাং, রাই, প্রধান ইত্যাদি বৃহৎ গোষ্ঠী বা পরিবারে সৃষ্টি হয়। মূলত একই ট্রাডিশনের ধারক বা বাহক হওয়া সেত্ত্বও প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের আচার ব্যবহারে স্বতন্ত্র।


এই পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রথম প্রচার করেন গুরু পদ্মসম্ভব, যিনি সুপ্রাচীন সিল্ক রুট ধরেই তিব্বত পৌছেছিলেন। বুদ্ধের বাণী হৃদয়ঙ্গম করে প্রচুর মানুষ যেমন ধর্মান্তরিত হলেন, অন্য দিকে সনাতন হিন্দুধর্ম আকড়ে পড়ে থাকলেন জনতার এক বিরাট অংশ। তৎকালীন ভারতবর্ষের দিকে দিকে বৌদ্ধ-হিন্দু সংঘাত আকছার ঘটলেও আশ্চর্য ভাবে এই এলাকায় তার কোনও প্রভাব পড়েনি। ফলস্বরূপ কেবলমাত্র শান্তি বজায়ই নয়, এক অনন্য মিশ্রধমর্য়ী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে হিমালয়ে এই অংশ।
পেদংয়ে এক দিকে যেমন তিন খানা বৌদ্ধ মন্যাষ্ট্রি দেখা যায়, তেমনই কালী, শিব, বজরঙ্গবলীর মতো হিন্দু দেবদেবীর আরাধনা চলে বছরভর। হিন্দু-বৌদ্ধ বিয়ে যেমন বিরল নয়, পাশাপাশি গ্রামের কারও মৃত্যু হলে শবমিছিলে ধর্মমতনির্বিশেষে প্রতি বাড়ির একজন সদস্য যোগ দেন। নিজের চোখে দেখেছি, পেদংয়ে আনুষ্ঠানিক সাড়ম্বর শান্তি সেম্মলন, যেখানে হিন্দুমতে যেজ্ঞর আয়োজনের পাশাপাশি মাখনের প্রদীপে বোধিসেত্ত্বর প্রার্থনায় মগ্ন হয়েছেন আপামর পাহাড়ি জনতা। ভূত, প্রেত, অপদেবতার সংস্কারে বহুলাংশে আবদ্ধ সরল স্থানীয়রা। বিপদেআপদে মানত চড়ান মহাকালের চরণে। আরিধার হ্রদ সংলগ্ন শিবমন্দিরে পুজো পান বজ্রযান বৌদ্ধতেন্ত্র উল্লেখিত তিব্বতি শিব। পেদংয়ের সাংচেন দোরজি গুম্ফায় ফি-বছর অনুষ্ঠিত হয় লামাদের ‘ছাম নৃত্য’। ধর্মমতের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও এই পবিত্র বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান দেখতে ভিড় জমান দূরদূরান্তের পাহাড়িয়ারা। দীপাবলিতে ‘দেউসি-ভাইলো’ গানের ছেন্দ কোমর দোলান বৌদ্ধ ও হিন্দু, দুই সম্প্রদায়ের মানুষই।

খ্রিস্টান যাজকদের হাত ধরে এক দিকে যেমন শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছে পেদং ও সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে, তেমনই খেত খামারের উন্নতি সাধনেও তাদের অগ্রণী ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পেদংয়ের রাজা গেবো আচিয়ক তঁার দুর্গ লাগোয়া বন সাফ করে চা বাগান তৈরি করেন। এই বাগানের পত্তন, শ্রীবৃদ্ধি ও দেখভালে তাকে অনুপ্রাণিত করেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। ক্রমে এই বাগানের চায়ের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছিল বিদেশে। তাদের উৎসাহেই পেদংয়ে গড়ে ওঠে উন্নতমানের ডেয়ারি। গরু, মোষ ও ইয়াকের দুধের চিজ সেখানে তৈরি হত। কালিম্পং জনিপ্রয়তা পাবার অনেক আগেই। কিন্তু পরবর্তীকালে নানান অব্যবস্থা ও গাফিলতির ফলে তা স্থানান্তরিত হয় কালিম্পংয়ে। একই অবস্থা হয় শুয়োরের খামারের। ফরাসি যাজকদের সাহায্যে পেদংয়ের বাজার এলাকা ছাড়িয়ে গড়ে উঠেছিল পিগারি। বেশ কয়েক বছর সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করলেও বর্তমানে এই খামারের অিস্তত্ব বিপন্ন। অভিযোগ সেই সাংগঠনিক অবহেলার।
তবে আশায় দিন গুনছেন পেদংয়ের মানুষ। ভারত-চিন আন্তর্জাতিক সুসম্পর্কের উন্নতির দিকে তাকিয়ে আছেন তারা। এর জেরেই আবার চালু হতে পারে একদা বন্ধ হয়ে যাওয়া সিল্ক রুট। সারি সারি খচ্চরের বদলে হয়তো মুদুম খোলা পেরিয়ে এগিয়ে আসবে আধুনিক পণ্যে ঠাসা ভিনদেশি ট্রাক কেন্টনারের সুশৃঙ্খল শ্রেণি। সরাইখানায় রাতের আশ্রয়ের খোজে কড়া নাড়বেন তিব্বতি ট্রাক ড্রাইভার। পেদং ফেরত পাবে লক্ষ্মীর ভাড়ারের হারিয়ে যাওয়া চাবিকাঠি।

No comments:

Post a Comment