ট্রেন থেকে নেমে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি মেঘের ভীষণ ঘনঘটা। কালিদাসের
মেঘদূত কিসের বার্তা নিয়ে যেন ছোটাছুটি করছে সারাক্ষণ। এই বুঝি নামবে
ঝুপঝাপ বৃষ্টি। সামনে পেয়ে গেলাম সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা। যাব ঘিলাছড়া
যুধিষ্ঠিপুর। হাকালুকি হাওরের কোলঘেঁষা গ্রাম এটি। ‘কিতারে আর কত দূর…’
ফোনে বন্ধু শাফখাতের এমন প্রশ্নের জবাব কয়েকবার দিতে দিতে সিলেটের
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও রেলস্টেশনে যখন নামলাম, তখন বিকেল ঠিক চারটা।
স্টেশন থেকে ঘিলাছড়া মাত্র তিন কিলোমিটার। কিন্তু কিছু দূর যেতে না-যেতেই
মেঘদূত এই লোকালয়ে নেমে পড়ল অঝোরধারায়। সবুজে ঘেরা ছোট ছোট পাহাড় ও টিলা,
সেই সঙ্গে সবুজ ধানখেত এবং টিলার ফাঁকে আঁকাবাঁকা সুন্দর সব পথঘাট যেন
ক্ষণিকের মধ্যেই হারিয়ে গেল অবিরাম বাদলধারায়। এমন বৈচিত্র্যময় খেলা না
দেখে বিশ্বাসের উপায় কী! এখানে বৃষ্টি নামে যেন একটু ভিন্নরূপে, ভিন্ন
আয়োজনে। অবশ্য বৃষ্টির এমন আয়োজনই তো কামনা করেছিলাম মনে মনে। ঢাকা থেকে
ছুটে এলাম এমন সব দৃশ্য উপভোগ করব ভেবেই। ঢাকায় যেখানে বৃষ্টি হলে কিছুটা
বিরক্তি লাগে রাস্তায় বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করে; এখানে ঠিক তার উল্টোটাই
অনুভূত হলো। বৃষ্টির এমন অঝোরধারা সত্যিই যেন বন্ধুত্বের আহ্বান জানায়
বারবার। ‘এই বৃষ্টি আমার, এই বর্ষা আমাকে সস্নেহে তার দীর্ঘ আঙ্গুলে ছুঁয়ে
যায়…’ শামসুর রাহমানের কবিতার এই লাইনটি আওড়াতে আওড়াতে কখন জানি
গন্তব্যস্থল ওই টিলার পাশে পৌঁছে গেলাম।
সাইফুল্লাহ নামের আট-নয় বছরের এক ছেলে টিলার নিচে ছাতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার আতিথেয়তায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। পৌঁছামাত্রই খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল। ক্ষুধাও লেগেছিল প্রচণ্ড। সুতরাং বিলম্ব না করে হাওরের ছোট মাছ দিয়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আতপ চালের ভাত খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নেব ভাবছি। কিন্তু বৃষ্টির হাতছানি এড়ানোর সাধ্য আমার কোথায়! নেমে পড়লাম পানিতে। বাদলের ধারা তখনো চলছে অবিরাম। সন্ধ্যা হতে অনেক বাকি। তার পরও যেন সাঁঝের আবহ এই ধরায় নামতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির ক্রমেই বেড়ে চলেছে। লিচুর ডালে কয়েকটা কাক ভিজে জবুথবু বসে ঝিমুচ্ছে। শালিকের হাঁকডাকও শোনা যাচ্ছে বেশ। ওদিকে পাড়ার শিশু-কিশোরেরা দাবড়ে বেড়াচ্ছে টিলার একূল-ওকূল মনের আনন্দে। কেউ গ্যালন নিয়ে, কেউ ভেলায়, কেউ বা আবার নির্ভয়ে পানিতে যেন রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ধ্যা অবধি হাওরের বুকে খেলা শেষে যখন ফিরলাম, দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি মুছে গেল যেন নিমেষেই।
সিলেটের ভূমধ্যসাগর
এ যেন সত্যি এক সাগর। চারদিকে ভূবেষ্টিত বিশাল এক জলরাশি। টিলার ওপর থেকে যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। পূর্ব-দক্ষিণ দিকে অনেক দূরে বড়লেখা ও জুড়ীর পাহাড়গুলো মনে হয় পানির মধ্যে মাথা জাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ব দিকে আরও দূরে আসামের পাহাড় চোখে পড়ে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও আসামের পাহাড় থেকে আসা ঢলে এই অঞ্চলের সব খালবিল ও হাওর রূপ নেয় যেন এক সাগরের। বৃহত্তর সিলেটের পূর্বাঞ্চলে এর অবস্থান। পাশে ভারতের আসাম সীমান্ত। সিলেটের গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা এবং জুড়ী উপজেলার প্রায় অধিকাংশ এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতি। সাগরের মতো ঢেউ ও গর্জন হয়তো হাওরে নেই; তবে যা আছে, তা-ই বা কম কিসের! কত টিলাই না হাওরগর্ভে হারিয়ে গেছে এর ঢেউয়ের তোড়ে। ফেঞ্চুগঞ্জের ব্যবসায়ী আবদুল ওহাব তাঁর কয়েকটা টিলা নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা দুঃখের সঙ্গে জানান। যুধিষ্ঠিপুরে টিলার ওপর পর্যটনকেন্দ্র গোছের কিছু একটা করার তাঁর ইচ্ছা থাকলেও সে আশা ভেস্তে গেছে। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা এই মৌসুমের আবাদ করতে পারেননি। তার পরও এখানে বৃষ্টির মৌসুম আসে অনেকের কাছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। বিশেষত, জেলেপাড়াগুলো জেগে ওঠে নতুন প্রাণের উদ্দীপনায়। তাদের ঘরে ঘরে শুরু হয় যেন জীবনের নতুন আয়োজন। বেড়াতে আসার কথা শুনে ঘিলাছড়ার মুদি দোকানদার সাইফুল ইসলাম দারুণ খুশি হলেন। ‘কিতা ভাইসব, বৃষ্টির জ্বালাই আমরা ফেডআপ হইয়া গেছি। তবে ভালা, এই সিজিনে হাওরে গোসল করতে পারবেন, ডিঙ্গি নোকায় কিতা ঘুরতে পারবেন।’ ক্ষোভ ও ভালো লাগার দুই রকম প্রতিক্রিয়াই জানান তিনি। আসার সময় ট্রেনে পরিচয় হওয়া ফেঞ্চুগঞ্জের ছেলে বিমানবাহিনীতে কর্মরত সিদ্দিক জানান, তাঁরা আগে বৃষ্টি হলেই দল বেঁধে ঘিলাছড়া, যুধিষ্ঠিপুরে ছুটে যেতেন। সবাই মিলে সারা দিন হইহুল্লোড় করতেন, ভেলায় ভাসতেন, নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু এখন আর সময় পান না বলে আক্ষেপের সুরই যেন ধ্বনিত হলো তাঁর কণ্ঠে।
হাওরের মাঝি ও কুবেরদের কলরব
সূর্য ওঠার আগেই হাওরপারের জেলেপাড়াগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠে ভীষণ। রাত জেগে মাছ ধরার জন্য যে প্রতীক্ষা, তার প্রহর যেন শেষ হয় ভোরের পাখি ডাকার আগেই। এই যুগের কুবেরদের নৌকা নিয়ে ছোটাছুটি ও জাল টানাটানিতে মুখরিত হয়ে ওঠে হাওরের শান্ত সকাল। ‘কিতাবা মাছ কিলা ফাইরায়…?’ অন্যদিক থেকে উত্তর ভেসে আসে, ‘বাক্কা ভালা…।’ আবার কারও মুঠোফোনের রিংটোন বেজে ওঠে টুংটাং। আড়তদার বা পাইকারেরা খবর নেন মাছের। ‘মাছ ভালা হইলেও বাকিত কিতা দিতাম ফারতাম নায়…’ জাল টানতে টানতে অনেক জেলে এভাবে সরাসরি জবাব দেন পাইকারদের। আশাতীত মাছ ধরা না পড়ায় অনেকেরই মন খারাপ হতে দেখা যায়। আবার অনেকের চোখে-মুখে আনন্দের ছটা। মাছ পড়েছে ভালো; বাজারটাও মন্দ না। এখানে জেলেদের এমন কর্মচাঞ্চল্য দেখে মনটা ভরে যায়। আগেই জেনেছি ভোরে এখানকার জেলেপাড়াগুলোর ব্যস্ততার কথা। খুব সকালে তাই ঘুম থেকে উঠে টিলার ওপর বসে পড়ি। সকালবেলার এমন পরিবেশ না দেখলে এখানে আসার সার্থকতা যেন পূর্ণ হয় না। দেখতে দেখতে সূর্যের তেজও বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যে নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকও পড়ে গেল। তাঁদের এমন কোলাহল চলে দু-তিন ঘণ্টা। এভাবে প্রতিদিন তাঁদের ধরা মাছ স্থানীয় বাজার হয়ে চলে যায় সিলেটে। তারপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সকালবেলায় নৌকা ভাড়া পাওয়া একটু দুষ্কর। তাই আগেই ঠিক করা হয়েছিল ছোট্ট একটি নৌকা। কোটন মাঝি আমাদের হাওর ঘোরাবেন, সাঁতার কাটার সময় সহযোগিতা করবেন—এমনই এক বন্দোবস্ত। দলের সবাই কমবেশি সাঁতার জানি। অতএব, ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় এক বিপত্তিকর সংবাদ শুনে। ঢাকা থেকে আরও দু-তিনজন বন্ধু এবং চট্টগ্রাম থেকে আরেকজন আসছে না। পরে অবশ্য জানতে পারলাম, হরতালের কারণে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। তবে যা-ই হোক, আমরা চারজন এককাট্টা। কিন্তু আরেক গোলমাল বাধল আমাদের দলেরই অতি উৎ সাহী চারজনের একজনকে নিয়ে। বিপত্তির নাম তানভীর। হাওরের পানিতে নেমেই বেচারা একেবারে জবুথবু। ডুবতে ডুবতে কোনো রকমে বেঁচে গেল সে। আমরাও তৎ ক্ষণাৎ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম বৈকি। ও গায়ে-গতরে ভালো। ওজনও কম নয়।
পানিতে নামার আগে ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের এতটুকু কমতি ছিল না। কিন্তু নেমে বেশি পানি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল এই আর কি। সে যাই হোক, এই দফা পেলাম কোনো রকম রক্ষা। আর বোনাস হিসেবে ওর পেটে গেল ভারত-বাংলাদেশের যৌথ পানিভান্ডার। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে তটস্থ না হয়ে উপায় কী! এতএব, জরুরি ভিত্তিতে পানিতে ভাসমান সংসদের অধিবেশন আহ্বান এবং যথারীতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ। তানভীর বেচারা আর পানিতে নামবে না; নৌকায় বসে শুধু হাওরের দৃশ্য উপভোগ করবে। সেই সঙ্গে বাড়তি একটা চাকরিও তার কপালে জুটে গেল—ফটোগ্রাফি। সে যেভাবে সুনিপুণ হাতে ছবি তুলল, তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনি।
বিকেলে এবার শুধু নৌকায় ঘোরার পালা। পানিতে নামার কোনো ব্যাপারস্যাপার নেই। কোটন মাঝি যথাসময়ে এসে যখন নৌকা চালালেন হাওরের বুকে, আমরা সবাই বিস্ময়াভিভূত! এ কী! হাওরের পানিতে এত কিসের রঙের আয়োজন! সাতটি রঙের স্পন্দনে দোল খাচ্ছে ঢেউগুলো অনবরত। আকাশে হালকা মেঘ, রোদও আছে অনুজ্জ্বল। ‘শুধু রোদ্র কি পারে রাঙাতে রংধনু, বৃষ্টিতে ভেজা আকাশ যদি না থাকে…’ হ্যাঁ, আকাশটা নিশ্চিতভাবে বৃষ্টিভেজা। দুপুরের পর যে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে, এর কিছুটা আবহ এখনো রয়েছে। হাওরের পানিতে রংধনুর খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ যেন কিসের এক টান অনুভূত হলো। সবারই হূদয় যেন উৎ ফুল্ল হয়ে উঠল নিবিড় এক ভালোলাগায় ও আনন্দে। তাই কিনা শাখাওয়াত বায়না ধরে বসলেন সহসা, ‘কোটন মামা, একটা গান ধরেন না।’ এ কথা শুনে কোটন মাঝির মুখ থেকে একঝলক লাজুক হাসি বের হলো; সেই হাসি রংধনুকেও যেন হার মানাল। বিড়িটা তখনো শেষ হয়নি। বৈঠা বেয়ে চলেছেন অনবরত। হালকা ঘাম ঝরছে মাথার দুই ধারে। ‘নিশা লাগিলো রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে…’ হাওরের মাঝি হয়ে উঠলেন যেন হাসন রাজা। টিপটিপ বৃষ্টির মাঝে ঠিক সন্ধ্যামুহূর্তে যখন ফিরে এলাম পাড়ে, তখনো সত্যিই যেন কিসের এক নেশা, কিসের যেন মহাঘোর।
কারা যাবেন
অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন এবং সাঁতার জানেন, কেবল তাঁরাই।
কীভাবে যাবেন কোথায় থাকবেন
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে গ্রিনলাইন ও সোহাগ পরিবহনের ভলভোসহ সিলেটগামী যেকোনো বাস ধরতে পারেন। সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। এ ছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন তিনটি ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা ও উপবন সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। থাকবেন সিলেট শহরের যেকোনো হোটেল বা গেস্টহাউসে। কেননা, ফেঞ্চুগঞ্জে তেমন ভালো মানের হোটেল নেই। সিলেট থেকে সরাসরি বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে ফেঞ্চুগঞ্জে যাওয়া যায়। সেখান থেকে ঘিলাছড়া যেতে হবে শুধু সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। তবে সিলেট থেকে রিজার্ভ অটোরিকশায় সরাসরি ঘিলাছড়া যাওয়াই ভালো। দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। সময় লাগে ৪০ থেকে ৬০ মিনিট। যেতে হবে দুপুরের পর যেকোনো সময়। সকালবেলায় নৌকা ভাড়া পাওয়া কঠিন। প্রয়োজনে যোগাযোগ করে যাওয়া ভালো। নৌকাভাড়া পড়বে ঘণ্টাপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
সঙ্গে নিতে পারেন পানিরোধী ব্যাকপ্যাক, ছাতা, রেইনকোট, টর্চ, ক্যামেরা ইত্যাদি। সঙ্গে একজন সিলেটি বন্ধু বা সহযোগী থাকলে ভালো। এই সময়ে কিনতে পারবেন হাওরের তাজা মাছ। তা ছাড়া খেতে পারবেন কাঁঠাল, আনারস, লটকন, পেয়ারাসহ নানা জাতের ফল।
সাইফুল্লাহ নামের আট-নয় বছরের এক ছেলে টিলার নিচে ছাতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার আতিথেয়তায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। পৌঁছামাত্রই খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল। ক্ষুধাও লেগেছিল প্রচণ্ড। সুতরাং বিলম্ব না করে হাওরের ছোট মাছ দিয়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আতপ চালের ভাত খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নেব ভাবছি। কিন্তু বৃষ্টির হাতছানি এড়ানোর সাধ্য আমার কোথায়! নেমে পড়লাম পানিতে। বাদলের ধারা তখনো চলছে অবিরাম। সন্ধ্যা হতে অনেক বাকি। তার পরও যেন সাঁঝের আবহ এই ধরায় নামতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির ক্রমেই বেড়ে চলেছে। লিচুর ডালে কয়েকটা কাক ভিজে জবুথবু বসে ঝিমুচ্ছে। শালিকের হাঁকডাকও শোনা যাচ্ছে বেশ। ওদিকে পাড়ার শিশু-কিশোরেরা দাবড়ে বেড়াচ্ছে টিলার একূল-ওকূল মনের আনন্দে। কেউ গ্যালন নিয়ে, কেউ ভেলায়, কেউ বা আবার নির্ভয়ে পানিতে যেন রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ধ্যা অবধি হাওরের বুকে খেলা শেষে যখন ফিরলাম, দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি মুছে গেল যেন নিমেষেই।
সিলেটের ভূমধ্যসাগর
এ যেন সত্যি এক সাগর। চারদিকে ভূবেষ্টিত বিশাল এক জলরাশি। টিলার ওপর থেকে যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। পূর্ব-দক্ষিণ দিকে অনেক দূরে বড়লেখা ও জুড়ীর পাহাড়গুলো মনে হয় পানির মধ্যে মাথা জাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ব দিকে আরও দূরে আসামের পাহাড় চোখে পড়ে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও আসামের পাহাড় থেকে আসা ঢলে এই অঞ্চলের সব খালবিল ও হাওর রূপ নেয় যেন এক সাগরের। বৃহত্তর সিলেটের পূর্বাঞ্চলে এর অবস্থান। পাশে ভারতের আসাম সীমান্ত। সিলেটের গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা এবং জুড়ী উপজেলার প্রায় অধিকাংশ এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতি। সাগরের মতো ঢেউ ও গর্জন হয়তো হাওরে নেই; তবে যা আছে, তা-ই বা কম কিসের! কত টিলাই না হাওরগর্ভে হারিয়ে গেছে এর ঢেউয়ের তোড়ে। ফেঞ্চুগঞ্জের ব্যবসায়ী আবদুল ওহাব তাঁর কয়েকটা টিলা নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা দুঃখের সঙ্গে জানান। যুধিষ্ঠিপুরে টিলার ওপর পর্যটনকেন্দ্র গোছের কিছু একটা করার তাঁর ইচ্ছা থাকলেও সে আশা ভেস্তে গেছে। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা এই মৌসুমের আবাদ করতে পারেননি। তার পরও এখানে বৃষ্টির মৌসুম আসে অনেকের কাছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। বিশেষত, জেলেপাড়াগুলো জেগে ওঠে নতুন প্রাণের উদ্দীপনায়। তাদের ঘরে ঘরে শুরু হয় যেন জীবনের নতুন আয়োজন। বেড়াতে আসার কথা শুনে ঘিলাছড়ার মুদি দোকানদার সাইফুল ইসলাম দারুণ খুশি হলেন। ‘কিতা ভাইসব, বৃষ্টির জ্বালাই আমরা ফেডআপ হইয়া গেছি। তবে ভালা, এই সিজিনে হাওরে গোসল করতে পারবেন, ডিঙ্গি নোকায় কিতা ঘুরতে পারবেন।’ ক্ষোভ ও ভালো লাগার দুই রকম প্রতিক্রিয়াই জানান তিনি। আসার সময় ট্রেনে পরিচয় হওয়া ফেঞ্চুগঞ্জের ছেলে বিমানবাহিনীতে কর্মরত সিদ্দিক জানান, তাঁরা আগে বৃষ্টি হলেই দল বেঁধে ঘিলাছড়া, যুধিষ্ঠিপুরে ছুটে যেতেন। সবাই মিলে সারা দিন হইহুল্লোড় করতেন, ভেলায় ভাসতেন, নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু এখন আর সময় পান না বলে আক্ষেপের সুরই যেন ধ্বনিত হলো তাঁর কণ্ঠে।
হাওরের মাঝি ও কুবেরদের কলরব
সূর্য ওঠার আগেই হাওরপারের জেলেপাড়াগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠে ভীষণ। রাত জেগে মাছ ধরার জন্য যে প্রতীক্ষা, তার প্রহর যেন শেষ হয় ভোরের পাখি ডাকার আগেই। এই যুগের কুবেরদের নৌকা নিয়ে ছোটাছুটি ও জাল টানাটানিতে মুখরিত হয়ে ওঠে হাওরের শান্ত সকাল। ‘কিতাবা মাছ কিলা ফাইরায়…?’ অন্যদিক থেকে উত্তর ভেসে আসে, ‘বাক্কা ভালা…।’ আবার কারও মুঠোফোনের রিংটোন বেজে ওঠে টুংটাং। আড়তদার বা পাইকারেরা খবর নেন মাছের। ‘মাছ ভালা হইলেও বাকিত কিতা দিতাম ফারতাম নায়…’ জাল টানতে টানতে অনেক জেলে এভাবে সরাসরি জবাব দেন পাইকারদের। আশাতীত মাছ ধরা না পড়ায় অনেকেরই মন খারাপ হতে দেখা যায়। আবার অনেকের চোখে-মুখে আনন্দের ছটা। মাছ পড়েছে ভালো; বাজারটাও মন্দ না। এখানে জেলেদের এমন কর্মচাঞ্চল্য দেখে মনটা ভরে যায়। আগেই জেনেছি ভোরে এখানকার জেলেপাড়াগুলোর ব্যস্ততার কথা। খুব সকালে তাই ঘুম থেকে উঠে টিলার ওপর বসে পড়ি। সকালবেলার এমন পরিবেশ না দেখলে এখানে আসার সার্থকতা যেন পূর্ণ হয় না। দেখতে দেখতে সূর্যের তেজও বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যে নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকও পড়ে গেল। তাঁদের এমন কোলাহল চলে দু-তিন ঘণ্টা। এভাবে প্রতিদিন তাঁদের ধরা মাছ স্থানীয় বাজার হয়ে চলে যায় সিলেটে। তারপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সকালবেলায় নৌকা ভাড়া পাওয়া একটু দুষ্কর। তাই আগেই ঠিক করা হয়েছিল ছোট্ট একটি নৌকা। কোটন মাঝি আমাদের হাওর ঘোরাবেন, সাঁতার কাটার সময় সহযোগিতা করবেন—এমনই এক বন্দোবস্ত। দলের সবাই কমবেশি সাঁতার জানি। অতএব, ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় এক বিপত্তিকর সংবাদ শুনে। ঢাকা থেকে আরও দু-তিনজন বন্ধু এবং চট্টগ্রাম থেকে আরেকজন আসছে না। পরে অবশ্য জানতে পারলাম, হরতালের কারণে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। তবে যা-ই হোক, আমরা চারজন এককাট্টা। কিন্তু আরেক গোলমাল বাধল আমাদের দলেরই অতি উৎ সাহী চারজনের একজনকে নিয়ে। বিপত্তির নাম তানভীর। হাওরের পানিতে নেমেই বেচারা একেবারে জবুথবু। ডুবতে ডুবতে কোনো রকমে বেঁচে গেল সে। আমরাও তৎ ক্ষণাৎ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম বৈকি। ও গায়ে-গতরে ভালো। ওজনও কম নয়।
পানিতে নামার আগে ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের এতটুকু কমতি ছিল না। কিন্তু নেমে বেশি পানি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল এই আর কি। সে যাই হোক, এই দফা পেলাম কোনো রকম রক্ষা। আর বোনাস হিসেবে ওর পেটে গেল ভারত-বাংলাদেশের যৌথ পানিভান্ডার। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে তটস্থ না হয়ে উপায় কী! এতএব, জরুরি ভিত্তিতে পানিতে ভাসমান সংসদের অধিবেশন আহ্বান এবং যথারীতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ। তানভীর বেচারা আর পানিতে নামবে না; নৌকায় বসে শুধু হাওরের দৃশ্য উপভোগ করবে। সেই সঙ্গে বাড়তি একটা চাকরিও তার কপালে জুটে গেল—ফটোগ্রাফি। সে যেভাবে সুনিপুণ হাতে ছবি তুলল, তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনি।
বিকেলে এবার শুধু নৌকায় ঘোরার পালা। পানিতে নামার কোনো ব্যাপারস্যাপার নেই। কোটন মাঝি যথাসময়ে এসে যখন নৌকা চালালেন হাওরের বুকে, আমরা সবাই বিস্ময়াভিভূত! এ কী! হাওরের পানিতে এত কিসের রঙের আয়োজন! সাতটি রঙের স্পন্দনে দোল খাচ্ছে ঢেউগুলো অনবরত। আকাশে হালকা মেঘ, রোদও আছে অনুজ্জ্বল। ‘শুধু রোদ্র কি পারে রাঙাতে রংধনু, বৃষ্টিতে ভেজা আকাশ যদি না থাকে…’ হ্যাঁ, আকাশটা নিশ্চিতভাবে বৃষ্টিভেজা। দুপুরের পর যে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে, এর কিছুটা আবহ এখনো রয়েছে। হাওরের পানিতে রংধনুর খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ যেন কিসের এক টান অনুভূত হলো। সবারই হূদয় যেন উৎ ফুল্ল হয়ে উঠল নিবিড় এক ভালোলাগায় ও আনন্দে। তাই কিনা শাখাওয়াত বায়না ধরে বসলেন সহসা, ‘কোটন মামা, একটা গান ধরেন না।’ এ কথা শুনে কোটন মাঝির মুখ থেকে একঝলক লাজুক হাসি বের হলো; সেই হাসি রংধনুকেও যেন হার মানাল। বিড়িটা তখনো শেষ হয়নি। বৈঠা বেয়ে চলেছেন অনবরত। হালকা ঘাম ঝরছে মাথার দুই ধারে। ‘নিশা লাগিলো রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে…’ হাওরের মাঝি হয়ে উঠলেন যেন হাসন রাজা। টিপটিপ বৃষ্টির মাঝে ঠিক সন্ধ্যামুহূর্তে যখন ফিরে এলাম পাড়ে, তখনো সত্যিই যেন কিসের এক নেশা, কিসের যেন মহাঘোর।
কারা যাবেন
অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন এবং সাঁতার জানেন, কেবল তাঁরাই।
কীভাবে যাবেন কোথায় থাকবেন
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে গ্রিনলাইন ও সোহাগ পরিবহনের ভলভোসহ সিলেটগামী যেকোনো বাস ধরতে পারেন। সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। এ ছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন তিনটি ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা ও উপবন সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। থাকবেন সিলেট শহরের যেকোনো হোটেল বা গেস্টহাউসে। কেননা, ফেঞ্চুগঞ্জে তেমন ভালো মানের হোটেল নেই। সিলেট থেকে সরাসরি বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে ফেঞ্চুগঞ্জে যাওয়া যায়। সেখান থেকে ঘিলাছড়া যেতে হবে শুধু সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। তবে সিলেট থেকে রিজার্ভ অটোরিকশায় সরাসরি ঘিলাছড়া যাওয়াই ভালো। দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। সময় লাগে ৪০ থেকে ৬০ মিনিট। যেতে হবে দুপুরের পর যেকোনো সময়। সকালবেলায় নৌকা ভাড়া পাওয়া কঠিন। প্রয়োজনে যোগাযোগ করে যাওয়া ভালো। নৌকাভাড়া পড়বে ঘণ্টাপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
সঙ্গে নিতে পারেন পানিরোধী ব্যাকপ্যাক, ছাতা, রেইনকোট, টর্চ, ক্যামেরা ইত্যাদি। সঙ্গে একজন সিলেটি বন্ধু বা সহযোগী থাকলে ভালো। এই সময়ে কিনতে পারবেন হাওরের তাজা মাছ। তা ছাড়া খেতে পারবেন কাঁঠাল, আনারস, লটকন, পেয়ারাসহ নানা জাতের ফল।
No comments:
Post a Comment