চেরাপুঞ্জিতে জীবনের প্রথম দিন। ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শেব্দ। জানালার পর্দা সরাতেই বাকরুদ্ধ অবস্থা।
ঠিক যেন ক্যানভাসে আকা ছবি। একপাশে একের পর এক পূর্ব মেঘালয়ের খাসি পাহাড়। আর এক পাশে পাহাড় শেষ হয়ে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। দিগন্তজোড়া বাংলাদেশের সূর্মা নদীর বদ্বীপ অঞ্চল। সকালের রোদ পড়ে নদীর জল চিকচিক করছে। আর এই দুয়ের মধ্যিখানে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম লাইতকেনসিও। রাস্তা সোজা গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে। স্থানীয় মানুষরা কাজে বেরিয়ে পড়েছেন। আর টিপ টিপ বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়েই একদল কচিকাচা বাড়ির আঙিনাতেই সচিন তেণ্ডুলকর হওয়ার নেশায় মত্ত।
অল্প ঠাণ্ডা লাগছিল। তাই জ্যাকেট চাপিয়ে রিসর্টের সদর দরজায় এসে দাড়ালাম। চিত্রকরের ক্যানভাসের সূক্ষ কাজগুলো এ বার নজরে এল। পাহাড়ের পর পাহাড়। মেঘের রাজ্যে প্রায় ঢেকে রয়েছে তারা। দূরে মনে হল আরেকটা সমতল পাহাড় চূড়া দেখলাম। ঠিক যেন ছোটবেলায় অরণ্যদেবের বইতে পড়া টেব্ল টপ মাউেন্টন। আর দূর থেকে ভেসে এল জলের শব্দ। বিভিন্ন পাহাড়ের গা থেকে নাচতে নাচতে নেমে আসছে ঝরণা। এতদূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাদের কলতান।
রিসর্টের সামনে মন কেড়ে নেওয়া সবুজ গালিচা। সেখানে ইতস্তত বসা এবং খাওয়ার ব্যবস্থাও মজুত। রয়েছে গোলাপ আর নাম না জানা অর্কিডের পশরা। রয়েছে প্রজাপতির দলও। বস্তুত আমাদের যাত্রাপথের গোটাটাই জুড়ে ছিল প্রজাপতির আনাগোনা। নানান রংয়ের জলছবি হয়ে চারধারে উড়ে বেড়াচ্ছিল তারা। আমাদের সঙ্গে থাকা ছোট্ট মিঠি তো প্রজাপতি ধরাতে বেশ হাত পাকিয়েই ফেলল!
ব্রেককফাস্টের পরে বেরোতে বেলা ১২টা হয়ে গেল। ডেনিস পই পই করে আমাদের যাত্রাপথ বলে দিয়েছিলন। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম পাহাড়ি পথে অত ঘড়ির কাটা মেনে
চলা বেশ কঠিন কাজই।চেরাপুঞ্জিকে ছুয়েই বোলেরো চলল পিলার রক দেখতে। তা সেই রক দেখতে যাওয়াও তো ঘটনা। যেই না পথের পাশে ঝরণার দর্শন মিলছে অমনি হইহই করে সবাই নেমে পড়ছে। ক্যামেরা বেরোচ্ছে, মোবাইল বেরোচ্ছে। ছবি উঠছে। একখণ্ড চেরাপুঞ্জিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই উদগ্রীব। আর এই করতে করতেই বেলা দু’টো বেজে গেল পিলার রকে পৌছতে।
P}SMt} Prj rdvZ cM{ _MÉMi¥ fv cÌÜSÅSÜ PpMc AeMÜMi চারদিক। ফলে পিলার রক থেকে চারপাশ ভাল বোঝা গেল না। বহু নীচে পাহাড়ের পাদদেশ ঠাওর করা সম্ভব নয়।
বেশিক্ষণ থাকা হয়নি সেখানে। ভাবলাম, থাঙখারাঙ পার্কে গিয়ে কাইনরেম ফল্স দেখব। খিদেও পাচ্ছে। ফল্স দেখতে দেখ্তে খাওয়াও যাবে।
একটু পরে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম পার্কে। কিন্তু ৩টে ছুই ছুই সময়ে পার্কের তখন অন্য রূপ। মেঘেরা হানা দিয়েছে সেখানে। ১০ ফুট দূরের লোক ভাল দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কি আর ফল্স দর্শন হয়? যেখানে জলপ্রপাত সবচেয়ে ভাল দেখা যায় বলে আমাদের বলা হল, সেখানে গিয়ে দেখলাম চারদিক মেঘাচ্ছন্ন। আর তার মধ্যে থেকে ভেসে আসছে জলের কলতান। বহু নীচে পাহাড়ি রাস্তায় দাড়িয়ে রয়েছে নীল রংেয়র গাড়ি। আজ লিখতে বেস কেন জানি না সেই মায়াবি দৃশ্যে কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে দেখা ছোট্ট খেলনার মতো গাড়িটাকেই মনে পড়ল।
নোহসোঙিথিয়াং জলপ্রপাত দেখার কথাও ডেনিস বলেছিলেন। কিন্তু বেলা ৪টের সময় বেরিয়ে বুঝলাম সব দেখা অন্তত এই যাত্রায় আমাদের কপালে নেই। তাই ঠিক হল বোলেরো যাবে মউসমাই গুহায়।
চুনাপাথরের এক অত্যাশ্চর্য গুহা এটি। টিকিট কেটে প্রায় শ’খানেক ধাপ উঠে ঢুকতে হয়। স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইটের নানা রূপের সমাহার সেখানে। সহযাত্রী কাকলির জবানবন্দীতে পরবর্তী বিবরণ শোনা যাক।
‘‘গুহাতে ঢুকেই মনে হল এ কোথায় এসে পড়লাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ। চারিদিকে চুনাপাথরের নানান প্রাকৃতিক স্থাপত্য। জল পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। গুহার দেওয়ালগুলোও ভেজা। পায়ের পাতা ভেজানো জল রয়েছে। তা এড়ানোর ব্যবস্থা করতে কাঠের পাটাতন পাতা। মাঝে মধ্যেই চামচিকের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিঃস্তব্ধ সেই গুহায় তাদের ওড়ার শব্দ। চুনাপাথরের মধ্যের ফাক ফোকর গলেই অামাদের যেতে হল। কোথাও দিতে হল হামাগুড়ি। অনেক সময় যাওয়ার জন্য এতো কম জায়গা যে এক্স এল মাপের কারুর পক্ষে তা দিয়ে গলা প্রায় অসম্ভব। এক কথায় মিনিট পনেরোর এই গুহা পরিক্রমা মনে অন্য ছাপ ফেলে দেয়। তবে এর মধ্যে আলাদা করে মিঠির কথা না বললে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বড়রা যখন চুনাপাথরে পিছলে পড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে, কোনও ক্রমে গলে, চামচিকের শব্দে চমকে উঠে চলৎশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছে, সেই সময় পাচ বছরের এই ছোট্ট মেয়েরই ছিল অফুরান প্রাণশক্তি। ‘চল না, গুহাটা পুরো দেখি’ বলে সেই পুরো দলটাকে টনিক জুগিয়েছিল।’’
গুহার বাইরে তখন সন্ধ্যার অবগুণ্ঠন নামতে শুরু করেছে। সূর্য কিছুক্ষণ আগেই পাটে গিয়েছে।
আমরাও চা খেতে ঢুকলাম এক রেস্তোরায়। ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল। চেরাপুঞ্জিতে এসে এই প্রথম মোবাইলের রিং টোন শুনলাম। কলকাতা থেকে বন্ধুরা জানতে চাইছে চেরাপুঞ্জি কেমন ঘুরছি। তাদের ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের পিছনে থাকা ঢাকের বাদ্যিও কানে এল। মনে পড়ল কলকাতায় মহাষ্টমীর সন্ধ্যা নেমেছে। পথে নেমেছে আপামর মহানগরবাসী।
আর চেরাপুঞ্জিতে তখন রেেস্তারার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় চলা লরির হেডলাইটের আলো শুধু সেই অন্ধকারের চাদরকে ছিঁড়তে চেষ্টা করছে মাত্র। সামনের সিমেন্ট কারখানা থেকে সকালের শিফ্টে কাজ শেষে কয়েকজন হাটতে হাটতে বাড়ি ফিরছেন। তাদের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে। আর শব্দ বলতে সেই ঝিঁঝি পোকার ডাক।
৮টা নাগাদ রিসর্টে ফিরতেই অন্য চমক। স্থানীয় গায়করা এসে খাসি ভাষায় গান গাইছেন। রিসর্টের গোলাকৃতি ডাইনিং হলে সবাই মিলে সেই গান শোনা। ভাষা না বোঝা গেলেও কোথায় যেন মনকে ছুয়ে যায়।
রাতে ডেনিসের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠল। সুদূর মাদুরাইয়ের ছেলে ডেনিস। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে স্থানীয় এক মহিলার সঙ্গে গাটছড়া বেধেছিলেন তিনি। তারপর বেশ কয়েকটা জীবিকার সঙ্গে বোঝাপড়া। শেষমেষ বিংশ শতকের শেষে এই টিলায় রিসর্ট গড়ে তোলা। রায়েন দম্পতির গড়ে তোলা এই রিসর্টে যে সুদূর ইউরোপ থেকেও পর্যটক আসেন তা লাজুক মুখে জানালেন তিনি।
তবে চেরাপুঞ্জি নিয়ে মোটেই লাজুক নন তিনি। সোজা সাপটা বলেই দিলেন, চেরাপুঞ্জির রমরমার সেদিন আর নেই। সমুদ্র থেকে সাড়ে ৪ হাজার ফুট ওপরে থাকা ব্রিটিশদের আদরের ‘স্কটল্যাণ্ড অব দি ইস্ট’ সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের দৌড়ে ঘরের পাশের মৌসিনরাম বা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাউন্ট ওয়েলেলের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু তাতে মোটেই পিছপা নন তিনি। বিশ্বের কাছে চেরাপুঞ্জিকে তুলে ধরতে তিনি প্রচেষ্টা শুরু করেছেন ব্র্যাণ্ড চেরাপুঞ্জিকে নিয়ে আসার। চেরাপুঞ্জির আশপাশের এলাকাকে নিয়েই এই ব্র্যাণ্ড গড়ে উঠবে। স্বাভাবিক ভাবেই ১৫ কিলোমিটার দূরে থাকা মৌসিনরামও আসবে এই বৃত্তের মধ্যে।
ডেনিসের কথায়,‘‘বিশ্ব চেরাপুঞ্জিকে আজও একডাকে চেনে। তাই সময় থাকতে এই এলাকাকে বাচাতে, এই এলাকার মানুষদের বাচাতে এই ব্র্যাণ্ডকে বিপণন করতে হবে। তবে শুধু কত সেন্টিমিটার বৃষ্টি হল এই দিয়ে চেরাপুঞ্জিকে মাপতে যাওয়াও কোনও কাজের কথা নয়। প্রকৃতি একে এত কিছু উজাড় করে দিয়েছে যে সেখানে এই সব হিসেব অর্থহীন হয়ে পড়ে।’’
তাই বিশ্বের দরবারে নবরূপে চেরাপুঞ্জিকে হাজির করার জন্যে তিনি উদ্যোগী।
তবে প্রযুক্তির ভিড়ে চেরাপুঞ্জির আসল রূপ যেন হারিয়ে না যায় তার দিকেও ডেনিসের নজর রয়েছে। ডেনিসের কথায়, ‘‘রোপ ওয়ে হল, এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টার হল, বিশ্ব থেকে লাখে লাখে পর্যটক চলে এল তা কিন্তু আমরা চাই না। অত চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ছোট্ট চেরাপুঞ্জির নেই। আধুনিকতার সঙ্গে মিশেল করেই আদিমতাকে ধরে রাখতে চাই আমরা। বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলের পথে ট্রেকিং করতে করতে যেন অজানা অর্কিড দেখে মন ভরে যায়, রঙিন প্রজাপতি যেন উড়ে বেড়ায়, অজানা পাখি যেন ডেকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। এই সব অভিজ্ঞতাকে বাচিয়ে রেখেই ব্র্যাণ্ড চেরাপুঞ্জির পরিকল্পনা।’’
পরের দিন বোলেরো যখন চেরাপুঞ্জি ছাড়ল, তখনও ডেনিসের কথাগুলো মনে পড়ছিল। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে গাড়ি যখন শিলংয়ের দিকে ছুটছে, উপত্যকার পর উপত্যকায় যখন গ্রামের দেখা মিলছে, পাহাড় কেটে প্রগতির সোপান বানানো হচ্ছে, তখন মনে পড়ল কত কিছু না-দেখা রয়ে গেল দেড়দিনের চেরাপুঞ্জি ভ্রমনে। দেখা হল না বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম জলপ্রপাত নোহকালিকাই ফল্স, রবার গাছের দোতলা প্রাকৃতিক সেতু। করা হল না পাহাড়ি খরেস্রাতায় রিভার ক্যানোয়িং বা বিভিন্ন দুলর্ভ পাখি আর অর্কিড দেখতে ট্রেকিং।
কিন্তু যা দেখলাম বা শুনলাম তাই বা কম কীসে!
ঠিক যেন ক্যানভাসে আকা ছবি। একপাশে একের পর এক পূর্ব মেঘালয়ের খাসি পাহাড়। আর এক পাশে পাহাড় শেষ হয়ে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। দিগন্তজোড়া বাংলাদেশের সূর্মা নদীর বদ্বীপ অঞ্চল। সকালের রোদ পড়ে নদীর জল চিকচিক করছে। আর এই দুয়ের মধ্যিখানে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম লাইতকেনসিও। রাস্তা সোজা গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে। স্থানীয় মানুষরা কাজে বেরিয়ে পড়েছেন। আর টিপ টিপ বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়েই একদল কচিকাচা বাড়ির আঙিনাতেই সচিন তেণ্ডুলকর হওয়ার নেশায় মত্ত।
অল্প ঠাণ্ডা লাগছিল। তাই জ্যাকেট চাপিয়ে রিসর্টের সদর দরজায় এসে দাড়ালাম। চিত্রকরের ক্যানভাসের সূক্ষ কাজগুলো এ বার নজরে এল। পাহাড়ের পর পাহাড়। মেঘের রাজ্যে প্রায় ঢেকে রয়েছে তারা। দূরে মনে হল আরেকটা সমতল পাহাড় চূড়া দেখলাম। ঠিক যেন ছোটবেলায় অরণ্যদেবের বইতে পড়া টেব্ল টপ মাউেন্টন। আর দূর থেকে ভেসে এল জলের শব্দ। বিভিন্ন পাহাড়ের গা থেকে নাচতে নাচতে নেমে আসছে ঝরণা। এতদূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাদের কলতান।
রিসর্টের সামনে মন কেড়ে নেওয়া সবুজ গালিচা। সেখানে ইতস্তত বসা এবং খাওয়ার ব্যবস্থাও মজুত। রয়েছে গোলাপ আর নাম না জানা অর্কিডের পশরা। রয়েছে প্রজাপতির দলও। বস্তুত আমাদের যাত্রাপথের গোটাটাই জুড়ে ছিল প্রজাপতির আনাগোনা। নানান রংয়ের জলছবি হয়ে চারধারে উড়ে বেড়াচ্ছিল তারা। আমাদের সঙ্গে থাকা ছোট্ট মিঠি তো প্রজাপতি ধরাতে বেশ হাত পাকিয়েই ফেলল!
ব্রেককফাস্টের পরে বেরোতে বেলা ১২টা হয়ে গেল। ডেনিস পই পই করে আমাদের যাত্রাপথ বলে দিয়েছিলন। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম পাহাড়ি পথে অত ঘড়ির কাটা মেনে
চলা বেশ কঠিন কাজই।চেরাপুঞ্জিকে ছুয়েই বোলেরো চলল পিলার রক দেখতে। তা সেই রক দেখতে যাওয়াও তো ঘটনা। যেই না পথের পাশে ঝরণার দর্শন মিলছে অমনি হইহই করে সবাই নেমে পড়ছে। ক্যামেরা বেরোচ্ছে, মোবাইল বেরোচ্ছে। ছবি উঠছে। একখণ্ড চেরাপুঞ্জিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই উদগ্রীব। আর এই করতে করতেই বেলা দু’টো বেজে গেল পিলার রকে পৌছতে।
P}SMt} Prj rdvZ cM{ _MÉMi¥ fv cÌÜSÅSÜ PpMc AeMÜMi চারদিক। ফলে পিলার রক থেকে চারপাশ ভাল বোঝা গেল না। বহু নীচে পাহাড়ের পাদদেশ ঠাওর করা সম্ভব নয়।
বেশিক্ষণ থাকা হয়নি সেখানে। ভাবলাম, থাঙখারাঙ পার্কে গিয়ে কাইনরেম ফল্স দেখব। খিদেও পাচ্ছে। ফল্স দেখতে দেখ্তে খাওয়াও যাবে।
একটু পরে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম পার্কে। কিন্তু ৩টে ছুই ছুই সময়ে পার্কের তখন অন্য রূপ। মেঘেরা হানা দিয়েছে সেখানে। ১০ ফুট দূরের লোক ভাল দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কি আর ফল্স দর্শন হয়? যেখানে জলপ্রপাত সবচেয়ে ভাল দেখা যায় বলে আমাদের বলা হল, সেখানে গিয়ে দেখলাম চারদিক মেঘাচ্ছন্ন। আর তার মধ্যে থেকে ভেসে আসছে জলের কলতান। বহু নীচে পাহাড়ি রাস্তায় দাড়িয়ে রয়েছে নীল রংেয়র গাড়ি। আজ লিখতে বেস কেন জানি না সেই মায়াবি দৃশ্যে কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে দেখা ছোট্ট খেলনার মতো গাড়িটাকেই মনে পড়ল।
নোহসোঙিথিয়াং জলপ্রপাত দেখার কথাও ডেনিস বলেছিলেন। কিন্তু বেলা ৪টের সময় বেরিয়ে বুঝলাম সব দেখা অন্তত এই যাত্রায় আমাদের কপালে নেই। তাই ঠিক হল বোলেরো যাবে মউসমাই গুহায়।
চুনাপাথরের এক অত্যাশ্চর্য গুহা এটি। টিকিট কেটে প্রায় শ’খানেক ধাপ উঠে ঢুকতে হয়। স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইটের নানা রূপের সমাহার সেখানে। সহযাত্রী কাকলির জবানবন্দীতে পরবর্তী বিবরণ শোনা যাক।
‘‘গুহাতে ঢুকেই মনে হল এ কোথায় এসে পড়লাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ। চারিদিকে চুনাপাথরের নানান প্রাকৃতিক স্থাপত্য। জল পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। গুহার দেওয়ালগুলোও ভেজা। পায়ের পাতা ভেজানো জল রয়েছে। তা এড়ানোর ব্যবস্থা করতে কাঠের পাটাতন পাতা। মাঝে মধ্যেই চামচিকের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিঃস্তব্ধ সেই গুহায় তাদের ওড়ার শব্দ। চুনাপাথরের মধ্যের ফাক ফোকর গলেই অামাদের যেতে হল। কোথাও দিতে হল হামাগুড়ি। অনেক সময় যাওয়ার জন্য এতো কম জায়গা যে এক্স এল মাপের কারুর পক্ষে তা দিয়ে গলা প্রায় অসম্ভব। এক কথায় মিনিট পনেরোর এই গুহা পরিক্রমা মনে অন্য ছাপ ফেলে দেয়। তবে এর মধ্যে আলাদা করে মিঠির কথা না বললে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বড়রা যখন চুনাপাথরে পিছলে পড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে, কোনও ক্রমে গলে, চামচিকের শব্দে চমকে উঠে চলৎশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছে, সেই সময় পাচ বছরের এই ছোট্ট মেয়েরই ছিল অফুরান প্রাণশক্তি। ‘চল না, গুহাটা পুরো দেখি’ বলে সেই পুরো দলটাকে টনিক জুগিয়েছিল।’’
গুহার বাইরে তখন সন্ধ্যার অবগুণ্ঠন নামতে শুরু করেছে। সূর্য কিছুক্ষণ আগেই পাটে গিয়েছে।
আমরাও চা খেতে ঢুকলাম এক রেস্তোরায়। ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল। চেরাপুঞ্জিতে এসে এই প্রথম মোবাইলের রিং টোন শুনলাম। কলকাতা থেকে বন্ধুরা জানতে চাইছে চেরাপুঞ্জি কেমন ঘুরছি। তাদের ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের পিছনে থাকা ঢাকের বাদ্যিও কানে এল। মনে পড়ল কলকাতায় মহাষ্টমীর সন্ধ্যা নেমেছে। পথে নেমেছে আপামর মহানগরবাসী।
আর চেরাপুঞ্জিতে তখন রেেস্তারার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় চলা লরির হেডলাইটের আলো শুধু সেই অন্ধকারের চাদরকে ছিঁড়তে চেষ্টা করছে মাত্র। সামনের সিমেন্ট কারখানা থেকে সকালের শিফ্টে কাজ শেষে কয়েকজন হাটতে হাটতে বাড়ি ফিরছেন। তাদের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে। আর শব্দ বলতে সেই ঝিঁঝি পোকার ডাক।
৮টা নাগাদ রিসর্টে ফিরতেই অন্য চমক। স্থানীয় গায়করা এসে খাসি ভাষায় গান গাইছেন। রিসর্টের গোলাকৃতি ডাইনিং হলে সবাই মিলে সেই গান শোনা। ভাষা না বোঝা গেলেও কোথায় যেন মনকে ছুয়ে যায়।
রাতে ডেনিসের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠল। সুদূর মাদুরাইয়ের ছেলে ডেনিস। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে স্থানীয় এক মহিলার সঙ্গে গাটছড়া বেধেছিলেন তিনি। তারপর বেশ কয়েকটা জীবিকার সঙ্গে বোঝাপড়া। শেষমেষ বিংশ শতকের শেষে এই টিলায় রিসর্ট গড়ে তোলা। রায়েন দম্পতির গড়ে তোলা এই রিসর্টে যে সুদূর ইউরোপ থেকেও পর্যটক আসেন তা লাজুক মুখে জানালেন তিনি।
তবে চেরাপুঞ্জি নিয়ে মোটেই লাজুক নন তিনি। সোজা সাপটা বলেই দিলেন, চেরাপুঞ্জির রমরমার সেদিন আর নেই। সমুদ্র থেকে সাড়ে ৪ হাজার ফুট ওপরে থাকা ব্রিটিশদের আদরের ‘স্কটল্যাণ্ড অব দি ইস্ট’ সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের দৌড়ে ঘরের পাশের মৌসিনরাম বা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাউন্ট ওয়েলেলের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু তাতে মোটেই পিছপা নন তিনি। বিশ্বের কাছে চেরাপুঞ্জিকে তুলে ধরতে তিনি প্রচেষ্টা শুরু করেছেন ব্র্যাণ্ড চেরাপুঞ্জিকে নিয়ে আসার। চেরাপুঞ্জির আশপাশের এলাকাকে নিয়েই এই ব্র্যাণ্ড গড়ে উঠবে। স্বাভাবিক ভাবেই ১৫ কিলোমিটার দূরে থাকা মৌসিনরামও আসবে এই বৃত্তের মধ্যে।
ডেনিসের কথায়,‘‘বিশ্ব চেরাপুঞ্জিকে আজও একডাকে চেনে। তাই সময় থাকতে এই এলাকাকে বাচাতে, এই এলাকার মানুষদের বাচাতে এই ব্র্যাণ্ডকে বিপণন করতে হবে। তবে শুধু কত সেন্টিমিটার বৃষ্টি হল এই দিয়ে চেরাপুঞ্জিকে মাপতে যাওয়াও কোনও কাজের কথা নয়। প্রকৃতি একে এত কিছু উজাড় করে দিয়েছে যে সেখানে এই সব হিসেব অর্থহীন হয়ে পড়ে।’’
তাই বিশ্বের দরবারে নবরূপে চেরাপুঞ্জিকে হাজির করার জন্যে তিনি উদ্যোগী।
তবে প্রযুক্তির ভিড়ে চেরাপুঞ্জির আসল রূপ যেন হারিয়ে না যায় তার দিকেও ডেনিসের নজর রয়েছে। ডেনিসের কথায়, ‘‘রোপ ওয়ে হল, এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টার হল, বিশ্ব থেকে লাখে লাখে পর্যটক চলে এল তা কিন্তু আমরা চাই না। অত চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ছোট্ট চেরাপুঞ্জির নেই। আধুনিকতার সঙ্গে মিশেল করেই আদিমতাকে ধরে রাখতে চাই আমরা। বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলের পথে ট্রেকিং করতে করতে যেন অজানা অর্কিড দেখে মন ভরে যায়, রঙিন প্রজাপতি যেন উড়ে বেড়ায়, অজানা পাখি যেন ডেকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। এই সব অভিজ্ঞতাকে বাচিয়ে রেখেই ব্র্যাণ্ড চেরাপুঞ্জির পরিকল্পনা।’’
পরের দিন বোলেরো যখন চেরাপুঞ্জি ছাড়ল, তখনও ডেনিসের কথাগুলো মনে পড়ছিল। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে গাড়ি যখন শিলংয়ের দিকে ছুটছে, উপত্যকার পর উপত্যকায় যখন গ্রামের দেখা মিলছে, পাহাড় কেটে প্রগতির সোপান বানানো হচ্ছে, তখন মনে পড়ল কত কিছু না-দেখা রয়ে গেল দেড়দিনের চেরাপুঞ্জি ভ্রমনে। দেখা হল না বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম জলপ্রপাত নোহকালিকাই ফল্স, রবার গাছের দোতলা প্রাকৃতিক সেতু। করা হল না পাহাড়ি খরেস্রাতায় রিভার ক্যানোয়িং বা বিভিন্ন দুলর্ভ পাখি আর অর্কিড দেখতে ট্রেকিং।
কিন্তু যা দেখলাম বা শুনলাম তাই বা কম কীসে!
No comments:
Post a Comment