ডিসেম্বর মাস। বিকেল সাড়ে চারটে বেজেছে কিছুক্ষণ আগে। রাস্তার দু’ধারের
ক্ষেতে ফসল ঝলমল করছে, মাঝখানের রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। ছড়ানো
ছেটানো গ্রাম দূরে দূরে। আরও কিছুক্ষণ চলতেই প্রথমে একটা, তারপর সারি সারি
শাল গাছ চোখে পড়ল। সেই সব গাছ এই প্রখর শীতেও সবুজ। আসলে মধ্যপ্রদেশের
অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মণ্ডলা জেলার এই জায়গায় জল বেশি বলে এখানকার জঙ্গল
চিরসবুজ। সারা বছর এমন সবুজ জঙ্গল মধ্যপ্রদেশের অন্য কোনও জেলাতে আছে কি
না সন্দেহ।
ধীরে ধীরে পরিচিত গ্রাম দেখা দিতে লাগল। টিকরিয়া, টাটরি, মোচা, রাতা। ছোট ছোট গ্রামের বাড়িগুলো অর্ধেক সাদা অর্ধেক ঝকঝকে নীল। দোরঙা ওই ঘর দেখলেই বোঝা যায় পৌছতে আর খুব বেশিক্ষণ নেই। এই কানহার নদী পেরোল। অনেকের মতে কানহা জঙ্গলের নাম এই নদীর নাম থেকেই। সত্যি মিথ্যে জানি না। দু’দিকে এখন রীতিমতো জঙ্গল। ঘন শালপাতার সামিয়ানার ওপর গেরুয়া রোদ চমকাচ্ছে। সিরসির করে উঠল। এ হল জঙ্গলের নিয়ম। শীতকালেও রোদ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ঠাণ্ডা লাগে না। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের ঠাণ্ডা আত্মপ্রকাশ করে।
বানজার নদীর পুল পেরনোর আগেই পাশাপাশি অনেকগুলো সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। প্যানথার হোয়াইট শ্যালে তুলি কৃষ্ণা মোগলি। এমন ধূসর জায়গায় অমন বাহারি সব নাম দেখলে মুগ্ধ হওয়ার বদলে ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। মনে হতে বাধ্য এগুলো সত্যিই আছে, নাকি কারও অত্যুৎসাহিত কল্পনাশক্তির প্রকোপের ফল। আসলে ওগুলো সত্যিই আছে। কানহা কিসলির গায়ে খাটিয়া নামের গ্রামে বেসরকারি হোটেল আর রিসর্ট ওই সব বাহারি নামের মালিক।
রাস্তার দু’ধারে লোকালয়ের উপদ্রব নেই। কয়েকটা অস্থায়ী ঝুপড়ি চোখে পড়ে। এ হল খাটিয়ে গ্রামের ধাবা। অনেক সময় কাটানো গিয়েছে ওদের একটিতে, অনেক স্মৃতি, অনেক অনুভূতি রয়ে গিয়েছে। আপাতত আমাদের চোখ পড়েছে দূরে বাশের গেটে। গাড়ি থামল তার সামনে। ডানদিকে বিরাট ফলকে লেখা কানহা ন্যাশনাল পার্ক। ওই ফলক অতি নম্রভাবে ঘোষণা করে কানহার মতো উৎকৃষ্ট রাষ্ট্রীয় উদ্যান অন্য কোথাও নেই। গেটে নামধাম এনিট্র করা হল। বাশের বাধা উঠল, গাড়ি ঢুকল কানহা রাষ্ট্রীয় উদ্যানে। গেট থেকে চার কিলোমিটারের ভেতরে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের বাঘিরা লগ হাট। সেখানে পৌছতে ঘন জঙ্গল পেরোতে হয়। সেন্ধ নামছে বিশাল বিশাল শালের জঙ্গলে। গাড়ির এিঞ্জনের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। কানহা কিসলি যেতে দিনে তিনবার বাস এই রাস্তা নেয়। সকালে একবার, দুপুরে একবার আর সেন্ধবেলা একবার। এ ছাড়া, জঙ্গল দেখার বাধা সময়ে গাড়ি চলে। সেই পার্ক রাউণ্ড শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। বাস ধারেকাছে নেই। সেন্ধর জঙ্গল এই সুযোগে তার অতি মনোরম রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই পরিবেশ বড় বিচিত্র, বড়ই অদ্ভুত। হাওয়ার গন্ধ পালটে যায় এই সময়। শহুরে মানুষ সচরাচর এমন পরিবেশের মুখোমুখি হয় না। এ সময় বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে ব্যবধান ক্ষীণ হতে হতে এক সময় উধাও হয়ে যায়। নিজের সম্পকে,র্ নিজের অিস্তত্ব, নিজের চেতনা সম্পর্কে এমন সব প্রশ্ন মনে আসে যা কখনও কল্পনাও করিনি মনে আসতে পারে।
বাক পেরোল। ডানদিকে গাছের সারি পাতলা হয়েছে। অন্ধকার এখানে গাঢ়। ওখানে জলাশয় আছে। সারাদিন অনেক পাখি আসে ওখানে। আর একটু এগোলেই বাদিকে মোড় নিয়ে টিলার ওপর ওঠে গাড়ি। জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি আকাবাকা রাস্তা শেষে বাঘিরা লগ হাট। অসাধারণ এক জঙ্গলের একেবারে ভেতরে থাকার এমন সুন্দর জায়গা আর কোথায়! বাঘিরার ম্যানেজার, পুরনো বন্ধু, ঝঁাসির সজ্জন মানুষ রায় সাহেব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন সীতারাম মাসকুলে মুন্না নিতাই রায়। সামনের কয়েক দিন ওঁদের আদরযেত্ন দিন কাটবে ভেবে গভীর আরাম পেলাম।
কানহা রাষ্ট্রীয় উদ্যান মধ্যপ্রদেশের অন্যতম বড় পার্ক। ৯৪০ বর্গ কিলোমিটারের কোর বা প্রধান এলাকা। ১০০৫ বর্গ কিলোমিটারের বাফার বা আশেপাশের এলাকা। তবে শুধু আয়তনের কারণেই কানহা শ্রেষ্ঠ নয়। কানহার সৌন্দর্য আজও অটুট কারণ ওই রুদ্র রূপকে পেলব করতে মানুষের মলিন হাত উঠেপড়ে লাগেনি। প্রথম দেখায় কানহা মরুভূমির মতো কঠিন সুনশান। প্রথম দেখায় েপ্রম হয় না। কানহাকে প্রথম দেখলে অবাক লাগে, স্তিম্ভত হতে হয় আর তারপর ধীরে ধীরে অভিভূত লাগে। বিনা কারণে কানহাকে কুইন অব দ্য উইলডারনেস বলা হয় না। এখানে মোবাইল চলে না, টিভি (এখনও পর্যন্ত) চলে না, এমনকি দিনের অনেকটা সময় বিদ্যুৎ পর্যন্ত থাকে না। তবু কানহা কানহাই। চারিদিকে নিিশ্ছদ্র নীরবতা রাজত্ব করে। দৈবাৎ অর্বাচীন মানুষ গলা তুললে বহুদূর থেকে যা স্পষ্ট ভেসে আসে, আরও একবার মনে পড়ায় প্রকৃতির সভ্যতার পাশে মানুষের মতো এমন বর্বর আর নির্বোধ খুব কম জীবই আছে। এখানে সারাদিন সারারাত ল্যাপউইং ওদের ডিড ইউ ডু ইঠ ডাকে আকাশ বাতাস মুখরিত করে। ময়ূর ডাকে সময় অসময়। ডাকে চিতল সামবার চিতাবাঘ।
হাতমুখ ধুয়ে ঘরের বাইরের ঁসিড়িতে জড়ো হয়েছি আমরা পাচজন। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। গাঢ় অন্ধকার নেমেছে সামনে যেখানে জানি মাঠ আর পাহাড় আছে। মাথার ওপর চোখ পড়তে আমরা বাক্যহারা। কালো ভেলভেটের মতো আকাশ একেবারে নীচে নেমে এসেছে আর তাতে জ্বলজ্বল করেছে অগিণত তারা। এত তারা যে কোনও আকাশে থাকতে পারে তা কে জানত? সেই ছোটবেলায় পুরীতে দেখার পর এতকাল বাদে কানহায় এসে ফের সেই আকাশগঙ্গার দেখা পাওয়া গেল। আমরা মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখি অদূরে কানহার জঙ্গল থেকে ভেসে আসে ময়ূরের ডাক।
পরের দিন ভোর থেকে শুরু পার্ক রাউণ্ড। ছ’টার মধ্যে কিসলি গেটের সামনে জিপসির সারিতে আমরাও যোগ দিয়েছি। কোনও সোরগোল নেই, অযথা কথা নেই। কাউন্টার থেকে ফর্ম নিয়ে ভর্তি করে টাকা জমা দিতে হয়। তারপর সময় হলে গেট খোলে। রসিদ হাতে একজন গাইড গাড়িতে ওঠে। আজ উঠল আমাদের চেনা মানুষ অশোক ঝরিয়া। কিসলি গেট খুলল। জিপসি ঢুকল কানহার কোর এলাকায়। ধীরে ধীরে লাইন করে একটার পর একটা জিপসি। কোনও গাড়ি ঘন্টার ২০ কিলোমিটারের বেশি িস্পডে যাচ্ছে না। বিশাল মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে। ডানদিকে ইন্দ্র রোড চলে গিয়েছে। বাদিকে ডিগডোলার রাস্তা। মাঠের ওপর পুরু কার্পেটের মতো কুয়াশা ঝুলে রয়েছে। ধুসর রঙের মধ্যে মিশে গিয়েছে এক দল চিতল। আরে, বাদিকে বড় কোটরে একটা নয়, এ বার দেখি দু’দুটো স্পটেড আউলেট। ওটাই ওদের নাম। ওরা ছোট্ট ছোট্ট পেচা সাদা রঙের ওপর ছাই রঙের ফুটকি। খুব লাজুক। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে মুখ বের করে এক ঝলক দেখে নিয়েই টুক করে কোটরে ঢুকে গেল।
কানহা কিসলির সবাই বলেন, শীতকালে জন্তুজানোয়ার কিছু কম দেখা যায়। অথচ ঘুরতে ঘুরতে কত জন্তুই না চোখে পড়ল। কানহায় বারবার ফিরে যাই এই টানে যে কানহা কখনও হতাশ করে না। যেতে যেতে দেখেছি গাছের ওপর থেকে লঙ্গুর কীভাবে পাতা খাওয়ার সময় কচি কচি ডালপালা নীচে ফেলছে আর চিতলের দল গাছের তলায় জড়ো হয়ে সেই পাতা খাচ্ছে। দুই প্রাণীর মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়। খাবার সরবরাহ করা ছাড়াও গাছের ওপর থেকে লঙ্গুরেরা নজর রাখে মাংসাশী প্রাণীদের ওপর। ওদের অ্যালার্ম কল শোনামাত্র চিতলেরা সতর্ক হয়ে যায়, বেগতিক দেখলে টেনে দৌড় দেয়।
সেবার মার্চ মাসে কানহা গিয়েছি। কানহা ময়দানের একপ্রােন্ত দেখা এক পাল বন্য কুকুরের সঙ্গে। ওদের নাম ঢোলে। দিশি কুকুরের চেয়ে একটু ছোট, লালচে বাদামি গায়ের রঙ ছাই রঙের লোমশ লেজ। আমাদের জিপসি দেখে মোটেই বিচলিত নয়। গাড়ি ঘিরে ঘোরা ফেরা করছে। আর পাশের মাঠ থেকে পরিত্রাহী চিৎকার করছে রেড ওয়াটেল্ড ল্যাপউইং। মার্চ মাসে বাসা বানায় ল্যাপউইংরা। গাছে নয়, মাঠের ঘাসপালার মধ্যে। পাখির বাসা আছে আন্দাজ করে ঢোলেরা মাঠের দিকে যত এগোচ্ছে ল্যাপউইং বেচারা ততই প্রচণ্ড রেগে চিৎকার করছে আর ঢোলেদের ঠোক্কর মারতে ডাইভ বমবারের মতো নেমে আসছে। চোখের সামনে প্রকৃতির এই জীবন্ত নাটক দেখেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ল্যাপউইংয়ের জন্য উেদ্বগের অন্ত নেই। ঢোলেরা দুর্দান্ত শিকারি। বাঘও ওদের সমঝে চলে। তারা পাখির ভয়ে পালাবে এ কখনও হয়! কী যে হয় আর কী হয় না তার কতটুকু আমরা জানি। উন্নাসিক একজিকিউটিভের মতো ঢোলেরা দূরে দৃিষ্ট নিক্ষেপ করে িস্থর হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। মাথার ওপর নেমে আসা ল্যাপউইংয়ের প্রতি ভ্রূক্ষেপ নেই, ওদের ডাক যেন শুনতেই পাচ্ছে না। দু’এক মুহূর্ত কী যেন বিবেচনা করল। তারপর ধীরে ধীরে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এল। আমাদের ফূর্তি তখন দেখে কে? ওই ভয়ানক ঢোলেকে সামান্য একটা পাখি পরাস্ত করেছে! এ যেন ডেভিড আর গোলায়েথের লড়াইয়ে ডেভিডের জয়। জিপসি আবার নড়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এ যাত্রায় না হয় ল্যাপউইং জিতল, কিন্তু পরের বারও কি পারবে কিংবা তার পরের বার? আশ্বাসের মতো পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, দুঃখ করে লাভ নেই, এর নাম জঙ্গল, এখানে হার জিত দুটোই সমানভাবে ভাগ করে দেয় প্রকৃতি। আমার বড় ভয় হয়। ভয় হয় এই ভেবে যে, কেউ যদি হঠাৎ জিগ্যেস করে বসে, কী অমন আছে কানহার জঙ্গলে যে বারবার ছুটে যাচ্ছ? কী এমন দেখার আছে? গাছপালা আর জন্তুজানোয়ার এই তো? তাহলে কিন্তু আমি বেশ কাচুমাচুই হয়ে যাব। সত্যিই তো, গাছপালা আর জন্তুজানোয়ার ছাড়া কীই বা আছে? কী নেই তা অবশ্য সহজে বলে দিতে পারব। দোকানবাজার নেই, গাড়িঘোড়া নেই, টুনি বালব দিয়ে সাজানো উৎকট হোটেলের সারি নেই। পান সিগারেটের দোকান থেকে তারস্বরে ভেসে আসা কাটা লাগা, আচল ছাড়া গান নেই। এমনকি, মানুষও খুব বেশি নেই। সবার চোখে কানহার ম্যাজিক ধরা পড়বে কি না জানি না, আমার চোখে কানহার মতো এমন অত্যাশ্চর্য জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। মধ্যপ্রদেশের ওই ধূসর পাথুরে জমি আমার মন কেড়ে নিয়েছে। বিন্ধ্য পর্বতমালার কাছাকাছি যখনই গিয়েছি ঘুরেফিরে মনে হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচীন যত পাহাড় আছে তার অন্যতম হল বিন্ধ্য সাতপুড়া মায়কল পর্বতমালা। হাজার হাজার বছরের ঝড়জল বৃিষ্টতে ওই পাহাড়ের শরীরের কোনা খাজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নরম হয়েছে পেলব হয়েছে। গাছের শেকড়ের মতোই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে পাহাড়ের শেকড়। ওই সব পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টের পেয়েছি পাহাড় থেকে দৃশ্য ও অদৃশ্য বার্তা ভেসে আসে। সেই বার্তায় শব্দ নেই, ভাব আছে যা বড় আরামদায়ক। ওই পাহাড়ের দিকে তাকালে রাশি রাশি স্বিস্ত আর শািন্ততে মন ভরে যায়। এক আস্থার ইঙ্গিত পাই যা কখনওই ফুরোবে না। পাহাড় থাকবেই। আমার জেন্মর অনেক আগে থেকে যেমন পাহাড় ছিল, আমি মরে যাওয়ার অনেক পরেও ওই সব পাহাড় থেকে যাবে।যেমন থাকবে জঙ্গল। একদিকে ধূসর রুক্ষ পাথুরে জমি, অন্যদিকে ঘন সবুজ জঙ্গল। এই সোনার পাথরবাটিতে মন যদি চঞ্চল না হয় তো কিসে হবে? বাংলার মতো নরম কালো মাটি স্যাতস্যাতে হাওয়া আর কচি সবুজের বাহার এখানে নেই। রুক্ষ পাথর অসুন্দর মাটি কানহার অত জঙ্গলের মধ্যেও। তাতে কানহা আরও সুন্দর। কারো মন রাখার দায় কানহার নেই। কেয়ারি করা বাগান বোগানভেলয়ার বাহার কানহায় নেই। দরকারও নেই। কানহায় আছে মানুষের স্পর্শ এড়ানো উদাসী সন্ন্যাসীর মতো উপিস্থতি যাকে উপেক্ষা করা যায় না। কানহার জঙ্গলে একটিও মানুষ আর কোনও দিন হানা না দিলেও কানহার ক্ষতি নেই, বরং লাভ। ভারতের অন্যান্য জঙ্গলের মতো কানহাও মানুষের উৎপাতে কাহিল হতে বাধ্য। কানহা কিসলির জঙ্গল পর্যটন কেন্দ্র নয় কাজেই তা অতিথিদের মুখাপেক্ষী নয়। কানহায় গিয়ে মানুষ কানহার উপকার করে না, করে নিজের। কানহা যেন কেমন করে বুঝিয়ে দেয় পৃথিবী নামের এই বিশাল সৃিষ্টর কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ নেই, আছে অন্য কিছু। এখানে মানুষের গুরুত্ব আর পাচটা প্রাণীর চেয়ে কোনও অংশে বেশি নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কমই বরং। মানুষের আধুনিকীকরণ, কল্পনা বুিদ্ধ মেধা ছাড়াই কানহার বেশ চলে যাবে। ও সব ছাড়াই কানহা বিশাল মহান সুন্দর। ওই নিস্তব্ধ বিস্তীর্ণ জঙ্গলের মধ্যে চলতে চলতে নিজের নগণ্যতা বড় হয়ে ধরা পড়ে। একই সঙ্গে অনেক উন্নত অন্য এক সৃিষ্টশক্তি কল্পনাশক্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেই ইঙ্গিত বয়ে আনে এক আধ্যাত্মিক উপিস্থতির কথা।
আমাদের দৈনিন্দন জীবনের অভিজ্ঞতার বাইরে এমন কি আমাদের ধরা ছোয়ার বাইরের এই সব ঘটনা অনুভব করার জন্য চাই মানসিক প্রস্তুতি, আচরণগত প্রস্তুতি। সব ধ্বনি কানে শোনা যায় না; সব দৃশ্য চোখে দেখা যায় না, এই হল জঙ্গলের প্রথম পাঠ। জঙ্গল দেখার জঙ্গল বোঝার ক্ষেত্রে মনের ভূমিকা বিশাল। আমাদের সর্বদা তালাচাবি খিল নাইটল্যাচ লাগানো মনের দরজা খোলা একটা বড় কাজ। দরজা কিন্তু খুলতেই হবে। তারপর নিজেকে ভুলে একেবারে নীরবে অনুভব করতে হবে জঙ্গলকে। তবে, শুধু তবেই হয়ত জঙ্গল সাড়া দেবে। এই নিজেকে ভোলার কাজটা কঠিন। অথচ খুবই জরুরি কারণ এই যাত্রার নায়ক তো আমরা নই। এই যাত্রার নায়ক জঙ্গল স্বয়ং। অনর্গল কথাবার্তা বলে, লাফিয়ে ঝাপিয়ে, চিৎকার চেঁচামেচি করলে জঙ্গল এগিয়ে আসবে কী করে? কিসলি গেটের পাশে পুরনো বটগাছের কোটরের আউলেটের মতো জঙ্গল কিন্তু ভারী লাজুক। হইচই করলে সেই যে গুটিয়ে যাবে আর কিন্তু ধরা দেবে না।
জঙ্গলের নিয়ম মানতেই হয়, কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। মিন্দরে যেতে হলে যেমন মনকে িস্থর রাখার প্রয়োজন জঙ্গলেও অনেকটা তাই। মিন্দরের ঈশ্বর কথাবার্তা বলবেন এমন কোনও গ্যারািন্ট শ্রেষ্ঠ পুরোহিত পাণ্ডারাও দিতে পারেন না। জঙ্গলের নিয়ম মেনে মনকে মগ্ন রাখতে পারলে জঙ্গল কিন্তু নিজেকে মেলে ধরে। সেই প্রকাশ প্রকট নয় সরব নয়, কিন্ত সে যে এক অসাধারণ প্রাপ্তি তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
সিঝোরা রোড আর সাত নম্বর লিঙ্কের কাছে টাইগার শো হচ্ছে খবর পেয়ে কানহা ভিলেজ থেকে আমরা রওনা হলাম। সকালে ঘন্টা আড়াই ঘোরার পর কানহা ভিলেজে যাওয়া হয়েছিল। এক সময় ওই নামের গ্রাম ছিল ওখানে। সেই গ্রাম আর আরও ২১টা গ্রাম জঙ্গলের বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তার জায়গায় আছে ছোট অথচ সুন্দর এক মিউজিয়াম, শালগাছ ঘেরা খোলা জায়গায় রামাভাইয়ার টিনের চালের দোকান। সেখান থেকে অতি উপাদেয় ভাজি বড়া আর চা খেয়েছি কিছুক্ষণ আগে। দুঃখের বিষয় বনবিভাগ এই ভাজি আর চাকে মর্যাদা দিতে পারেনি।
অস্থায়ী ঝুপড়ির বদলে পাকা রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। তখনও চালু হয়নি, কিন্তু একদিন হবে ভেবে ভীষণ খারাপ লেগেছে। কানহার জঙ্গলের ভেতরে পাকা রেস্টুরেেন্টর কোনও প্রয়োজন নেই, এই সামান্য কথাটা বিজ্ঞজনেরা বোঝেন না।
রাস্তার ধারে জিপসি দাড়াল। এবার হাতির পিঠে গভীর জঙ্গলে। বনদেবীকে নিয়ে এসেছে বরাতু। হাতি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। হঠাৎ দেখি সামনের ঘাসের মধ্যে একদল চিতল। বাঘ দেখতে এসে শেষে চিতল!
বাঘ কোথায়, জানাও, বেতারে ফিস ফিস করে জানতে চাইল বরাতু, আমরা কিন্তু এগিয়ে চলেছি।
কোনও জবাব নেই।
বাঘ ওইখানে আছে, কানের কাছে চাপা গলায় বলে উঠল কৈলাশ, সামনের দিকে ওর হাত ছড়ানো।
তাকালাম। কোথায় বাঘ, আমি তো শুধু চিতল দেখছি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঘাসের মধ্যে থেকে মাথা তুলে তাকাল বাঘিনী। সঙ্গে সঙ্গে চিতলের দল দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বাঘিনী একবার বাদিকে একবার ডানদিকে তাকাল। তারপর আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে প্রচণ্ড এক লাফ মেরে চিতলের দলকে তাড়া করল। জঙ্গলের আলোছায়ার ভেতরে বিদ্যুতের মতো হলুদ আলোর একটা গোলা ছিটকে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে বাদিকে। হাতে ক্যামেরা নিয়ে আমি শুধু হা করে ওই দৃশ্য দেখলাম, ছবি তোলার প্রশ্নই নেই। ঘটনাটা এত হঠাৎ ঘটে গেল যে বুঝে উঠতে পারিনি বাস্তবে দেখছি, না কি সিনেমায় দেখছি। অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারিনি। সত্যি বলতে কী, এমন একটা দৃশ্য দেখার পর কথা বলাই যায় না।
এ জিনিসের ছবি তোলার জন্যে বিদেশি টেলিভিশন কোম্পানির দল মাসের পর মাস বসে থাকে, অবশেষে বলল কৈলাশ। ওর চোখ আনেন্দ চকচক করছে। আঠেরো বছর কানহার জঙ্গলে কাটানোর পরেও কানহার মায়া যে কেটে যায়নি তা ওকে দেখলে বেশ বোঝা যায়। কিন্তু ছবি তো তুলতে পারলাম না। আমার গলায় ক্ষোভের আভাস পেয়ে কৈলাস বলে উঠল, মনের ক্যামেরায় তো রয়ে গেল। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
হাতি আবার চলল, এ বার আর একটু গভীরে। শেষ পর্যন্ত মা ঠাকরুণ চিতল ধরতে পেরেছেন কি না তা তো জানতে হবে। কাজেই তার খোজে চললাম। বেশিক্ষণ যেতে হল না। গাছের তলায় দেখা পাওয়া গেল, জিভ বের করে হাফাচ্ছেন। চিতল ধরতে পারেননি বলে সামান্য হতাশ। হাতের কাছে ওঁকে পেয়ে আদেখলার মতো হুমড়ি খেয়ে আমরা পটাপট ছবি তুলছি। এক সময় আর থাকতে না পেরে মুখ ঁখিচিয়ে উঠলেন। মুখের সামনে দিয়ে খাবার পালিয়ে গেলে, বিরক্ত তো হওয়ারই কথা। অবশ্য এমন ঘটনা ঘটেই থাকে। দশ থেকে বিশবার চেষ্টা করলে তবে বাঘেরা একবার শিকার ধরতে পারে। চিতল তো বটেই, সামবার বন্য শুয়োর বারাসিংহা লঙ্গুর এমনকি সজারুও শিকার করে বাঘ।
কানহার সব শেষ বাঘসুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১২৮। বাঘের মতো এমন ম্যাজিকাল প্রাণী আর আছে কি না জানি না। বাঘ এক রাজকীয় জীব, সাহসী শক্তিধর সুন্দর সজ্জন। স্বীকার করতেই হয়, সজ্জন বিশেষণটা আমার নয়, স্বয়ং জিম করবেটের, বাঘ সম্পর্কে এই কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। মনে আছে প্রথমবার যখন বাঘ দেখেছিলাম মনে হয়েছিল ঈশ্বর মর্তে নেমে এসেছেন। সেটা ছিল নভেম্বর মাসের এক বিকেল। ঝকঝকে সোনার মতো রোদ বিস্তীর্ণ কানহার ময়দানের ওপর পড়ে ঘাসকে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই প্রথম কৈলাশ আমাদের কানহা ঘোরাচ্ছে, সঙ্গে গাইড প্রতাপ। হঠাৎ ময়দানের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওই যে বাঘ যাচ্ছে, মেল টাইগার।
তাকিয়ে দেখি হলুদ কালো ডোরা কাটা এক প্রকাণ্ড বাঘ ধীরে ধীরে কানহার ময়দান পেরোচ্ছে। পড়ন্ত বেলার রোদ ওর গায়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে এক সোনার বাঘ আগুনের ময়দানের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রোদ মাঠ আর বাঘের ওই অপূর্ব রঙ মিলে অমন দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি, জানি না আর কোনও দিন দেখব কি না। তারপর অনেকবার বাঘ দেখেছি। টাইগার শোয়ে শুধু নয়, কানহার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বাঘের দেখা পেয়েছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই প্রথম দর্শনের কথা ভুলতে পারিনি। আমরা যারা শহরে থেকে চিড়িয়াখানার বাঘ দেখে অভ্যস্ত তারা কল্পনাও করতে পারি না জঙ্গলে স্বাধীনভাবে বেড়ানো বাঘের মানে কী, তাৎপর্য কী। ওই প্রাণীকে একবার প্রকৃতির মাঝে দেখতে পেলে জীবজগৎ সম্পর্কে ধারণাই বদলে যায়। বাঘকে আরও নিবিড়ভাবে বোঝার, চেনার ইচ্ছে হয়।
সেবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। চৌথা কিলোমিটারের কাছে, কানহা রোডের ওপর শোয়ে বাঘ দেখতে গিয়েছি। শাবির আহমেদ মাহাওয়াত তার হাতি শিবাজির সঙ্গে বনকর্তাদের নিয়ে গেলেন বাঘ দেখতে। ওদের পরেই আমাদের পালা। রাস্তায় দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি তাড়াহুড়ো করে শিবাজি ফিরে আসছে, ওর পিঠে বসা ডেপুটি রেঞ্জার হাতপা নেড়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। পরক্ষণেই বুঝলাম উনি বলছেন গাড়িতে উঠে পড়ুন, বাঘ চলতে শুরু করেছে। কাছের একটা জিপসিতে লাফ মেরে উঠে পড়লাম। শিবাজি ফিরে এল। কর্তারা নেমে পড়লেন দেখে আমি গিয়ে হাতির পিঠে চড়ে বসলাম। শাবির ভাই চেনা লোক। গাছপালার আড়ালে বাঘ বসেছিল দর্শন করলাম ছবিও তুললাম। মনঃপূত হল না। হাতির পিঠ থেকে নামতে নামতেই খেয়াল হল অন্য হাতিরা সোজাসুজি ফেরার বদলে রাস্তার সমান্তরালে চলছে। মানে, এ বার বাঘ সত্যি সত্যিই চলছে।
জিপসিতে উঠে পড়ুন, বাঘ চলছে, চিরশান্ত কৈলাশের গলায় চাপা উত্তেজনা।
গাড়ি ঘুরিয়ে মোড়ের মাথায় দাড় করানো হল। সেখান থেকেই ঘন বাশঝাড়ের মধ্যে বাঘের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাঘ কি এ দিকে আসবে, না কি আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে যাবে? শ্যেনদৃিষ্ট নিক্ষেপ করে আমরা তাকিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে। হঠাৎ ঘুরে গিয়ে বাঘ একেবারে জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এল। আমাদের কয়েক হাতের মধ্যে দিয়ে, এ দিক ও দিক তাকাতে তাকাতে জিপসির পেছন দিকে যে রাস্তা, যা একটু আগে ছেড়ে এসেছি, সেই দিকে চলতে শুরু করল। রাস্তার ধারে তখন দুটো বড় বড় হাতি দাড়িয়ে। বাঘ কিছুক্ষণ এগোল। তারপর ঘুরে দাড়াল। তারপর লাফাতে লাফাতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সে যে কী অসাধারণ দৃশ্য, বুঝিয়ে বলা মুশকিল। যখন আর কয়েক হাত মাত্র ব্যবধান, বাঘ একটু কাত হয়ে বাদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ওই বিশাল হলদে কালো চমৎকার।
পরে যখনই কাউকে এই গল্প বলতে গিয়েছি, সবাই একটা কথাই জানতে চেয়েছে: ভয় করেনি? ওদের উত্তর দিতে দিতে মনে হয়েছে, হয়ত বাঘ সম্পর্কে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি উপলিব্ধ করেছি, তা প্রকাশ করা দরকার। তবে তা আজ হবে না, কারণ কানহার অন্য সদস্যদের কথাও তো বলার আছে। কানহার জঙ্গলে যে আরও অনেকের বাস।
ডিগডোলার পাহাড় থেকে নেমে সফ ময়দানে এসে পড়েছি। অন্য কোথাও পাওয়া না গেলেও সফে ওদের দেখা পাওয়া যাবেই। পৃথিবীর আর কোথাও ওরা নেই। ওরা হল হার্ড গ্রাউণ্ড বারাশিংহা। হরিণ প্রজাতির সদস্য বারাশিংহার নাম অনেকটাই আক্ষরিক। দু’দিক মিলিয়ে বারোটা শিং এদের মাথায় থাকবেই, অনেক সময় তার বেশিও থাকে। সেই শিঙের বাহার তাকিয়ে দেখার মতো। উত্তর ভারতেও বারাশিংহা পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে ওরা থাকে জলাজমিতে। একমাত্র কানহাতেই ওরা শুকনো জমিতে থাকার অভ্যাস করেছে বলে ওদের নাম হার্ড গ্রাউণ্ড বারাশিংহা। সেটা ছিল ১৯৭০ সাল। মধ্যপ্রদেশ থেকে বারাশিংহা নিিশ্চহ্ন হতে বসেছিল। সব মিলিয়ে মাত্র ৬৬টি টিকে আছে। তখন বনবিভাগ আর সংরক্ষকেরা উঠেপড়ে লাগলেন। ওঁদের সময়মতো নজর আর যেত্নর ফলে আজ কানহায় বারাশিংহার সংখ্যা অন্তত চার শো। সফ ময়দান ছাড়াও শ্রবণ তালের কাছে ওদের দেখা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় কানহা ময়দানে, বিশানপুরার মাঠেও। এ বারে যেমন, সফে তো বটেই, বিশানপুরাতে আমাদের এক দল মহিলা বারাশিংহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওদের পাকা গমের মতো বাদামি গায়ে রোদ পড়তে অদ্ভুত আলো ঠিকরে বেরচ্ছিল।
বিশানপুরা সোনঢার পেরিয়ে গাড়ি বালাঘাট জেলা ছেড়ে মণ্ডলা জেলার দিকে চলেছে। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। গাড়ি দেখে মযূর মযূরী রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকল। মাথার ওপর কে যেন শিস দিল। কালো পাখি, লম্বা ল্যাজের ডগায় দুটো ছোট ছোট চাকতি। নাম র্যাকেট টেল্ড ড্রঙ্গো। ফিঙে পরিবারের পাখি, ফিঙের মতোই ওদের ল্যাজ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। গাড়ি চলছে, এমন সময় হঠাৎ জঙ্গলের এক ধারে দেখা গেল কবরের মতো বাধানো বেদী।
লাপসি কবর, বলল কৈলাশ আর তারপরেই গল্পটাও বলল। লাপসি নামে এক আদিবাসী থাকত ওইখানে। সে বাঘ শিকার করত। কিন্তু করত এক অভিনব উপায়ে। লাপসি করত কি, তার বউকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করত। বউকে দেখে বাঘ যেই এগিয়ে আসত তখন তীর ধনুক দিয়ে বাঘকে মেরে ফেলত। সেদিনও লাপসি বউকে টোপ রেখে বাঘের জন্য আড়ালে অপেক্ষা করছে। অাজ কিন্তু বাঘ আর বউয়ের দিকে নয়, সোজা লাপসির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ওকে একেবারে মেরেই ফেলল। তারপর ওইখানেই লাপসিকে কবর দেওয়া হয়। স্থানীয় বিশ্বাস, সারা জঙ্গল ঘুরতে ঘুরতে বাঘের দেখা না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে কেউ যদি লাপসির কবরে ছোট্ট একটা পাথরও চড়িয়ে দেয়, তা হলে বাঘের দেখা পাওয়া যাবেই।
লাপসি কবর পেরিয়ে গেল, যতক্ষণ দেখা যায় ও দিকে তাকিয়ে রইলাম। চমক ভাঙাল চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাওয়া নীল পাখি। ও হল নীলকণ্ঠ। কানহার জঙ্গলে অনেক নীলকণ্ঠ আছে, যেমন আছে ড্রঙ্গো, ল্যাপউইং, িট্র পাই, ব্ল্যাক হেডেড ওরিয়ল, জাঙ্গল ব্যাবলার, হোয়াইট নেক্ড স্টর্ক… লিস্ট শেষ হতে চায় না কারণ বেশ কয়েক শো ধরনের পাখির বাস কানহার জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ওদের দেখা পাওয়া যাবেই, ওদের গানও শোনা যায়। কিন্তু এ দিকে আমাদের হাতের সময় ফুরিয়ে আসছে যে।
বাকে বাকে লঙ্গুর চিতল ময়ূর পেরোতে পেরোতে অবশেষে কানহা রোডে পড়ব, দেখি প্রাজ্ঞ েপ্রৗঢ়ের মতো সামনে দাড়িয়ে গৌর। অনেকে একে ইিণ্ডয়ান বাইসন বললেও আসলে গৌর হল গো প্রজাতির। কানহায় হাজারখানেক গৌর আছে বলে অনুমান। বিশালদেহী জীব, বাঘের গন্ধ পেলে ফোস ফোস করে আওয়াজ করে আর মাটিতে পা ঠোকে। তাই দেখে দলের সকলে সতর্ক হয়ে যায়। আপাতত জঙ্গলের মধ্যে মহাস্থবিরের মতো দাড়িয়ে পাতা চিবোচ্ছে। ওকে দেখে মনে পড়ে গেল, এক বিকেলে বাঘিরা লগ হাটের ঘরের পেছনের ঁসিড়িতে বসে মাঠের দিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ দেখি ডিগডোলার মাঠ দিয়ে একটা দুটো নয়, পর পর এক পাল গৌর চলেছে পাহাড়ের দিকে। তাদের পায়ে পায়ে ছুটছে দুটো ছোট জন্তু, অত দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ওরা বন্য কুকুর না শেয়াল। বিদেশি টেলিভিশানে এমন ছবি দেখেছি, কিন্তু একেবারে সচক্ষে এমন দৃশ্য দেখা গেলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!
কানহার ময়দানের কাছে গাড়ি চলে এসেছে। শেলার হাইডের কাছে শোনা গেল অ্যালার্ম কল শোনা গিয়েছে, বাঘ এ দিকে আসছে। গাড়ি বাক নিল মনহর নালার দিকে। সেখানে তখনও কোনও গাড়ি আসেনি। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। এমন সময় ডানদিকে, রাস্তার পাশে নালার ধারের লম্বা ঘাসের মাথা থরথর করে কেঁপে উঠল। এটা হল ওই জায়গায় বাঘ থাকার অব্যর্থ লক্ষণ। কয়েক সেকেেণ্ডর মধ্যে হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়া গেল। নালা ছেড়ে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে এল বাঘিনী। সেই পড়ন্ত রোদ, সেই সোনার ময়দান, সেই গেরুয়া রঙের ঝলমলে বাঘিনী ততক্ষণে জড়ো হওয়া অন্তত কুড়িটা জিপসির একটারও প্রতি দৃকপাত না করে, একেবারে নিজস্ব স্টাইলে রাস্তা পেরিয়ে কোইলা ভাট্টা রোডের দিকে চলে গেল।
ফিরছি আমরা। আজই শেষ রাত। কাল সকালে রওনা হব জবলপুরের দিকে। কিন্তু কানহা তো শেষ হয় না। মনের মধ্যে কানহা বাড়তে থাকে, স্বেপ্নর মতো রঙিন হয়, চুম্বকের মতো টানে। অনেক দিন পরে, শহরের চাপে চিড়েচ্যাপটা হতে হতে হঠাৎ কানহা মনে মনে ফিরে আসে, এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া, একপ্রস্থ শািন্ত সঙ্গে নিয়ে আসে। মনে হয়, রূপকথার চেয়েও অপরূপ ওই জায়গায় কি কখনও সত্যি সত্যিই গিয়েছিলাম! আর ঠিক তখনই বুঝতে পারি, বোধহয় আবার কানহায় ফেরার সময় হয়েছে।
ধীরে ধীরে পরিচিত গ্রাম দেখা দিতে লাগল। টিকরিয়া, টাটরি, মোচা, রাতা। ছোট ছোট গ্রামের বাড়িগুলো অর্ধেক সাদা অর্ধেক ঝকঝকে নীল। দোরঙা ওই ঘর দেখলেই বোঝা যায় পৌছতে আর খুব বেশিক্ষণ নেই। এই কানহার নদী পেরোল। অনেকের মতে কানহা জঙ্গলের নাম এই নদীর নাম থেকেই। সত্যি মিথ্যে জানি না। দু’দিকে এখন রীতিমতো জঙ্গল। ঘন শালপাতার সামিয়ানার ওপর গেরুয়া রোদ চমকাচ্ছে। সিরসির করে উঠল। এ হল জঙ্গলের নিয়ম। শীতকালেও রোদ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ঠাণ্ডা লাগে না। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের ঠাণ্ডা আত্মপ্রকাশ করে।
বানজার নদীর পুল পেরনোর আগেই পাশাপাশি অনেকগুলো সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। প্যানথার হোয়াইট শ্যালে তুলি কৃষ্ণা মোগলি। এমন ধূসর জায়গায় অমন বাহারি সব নাম দেখলে মুগ্ধ হওয়ার বদলে ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। মনে হতে বাধ্য এগুলো সত্যিই আছে, নাকি কারও অত্যুৎসাহিত কল্পনাশক্তির প্রকোপের ফল। আসলে ওগুলো সত্যিই আছে। কানহা কিসলির গায়ে খাটিয়া নামের গ্রামে বেসরকারি হোটেল আর রিসর্ট ওই সব বাহারি নামের মালিক।
রাস্তার দু’ধারে লোকালয়ের উপদ্রব নেই। কয়েকটা অস্থায়ী ঝুপড়ি চোখে পড়ে। এ হল খাটিয়ে গ্রামের ধাবা। অনেক সময় কাটানো গিয়েছে ওদের একটিতে, অনেক স্মৃতি, অনেক অনুভূতি রয়ে গিয়েছে। আপাতত আমাদের চোখ পড়েছে দূরে বাশের গেটে। গাড়ি থামল তার সামনে। ডানদিকে বিরাট ফলকে লেখা কানহা ন্যাশনাল পার্ক। ওই ফলক অতি নম্রভাবে ঘোষণা করে কানহার মতো উৎকৃষ্ট রাষ্ট্রীয় উদ্যান অন্য কোথাও নেই। গেটে নামধাম এনিট্র করা হল। বাশের বাধা উঠল, গাড়ি ঢুকল কানহা রাষ্ট্রীয় উদ্যানে। গেট থেকে চার কিলোমিটারের ভেতরে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের বাঘিরা লগ হাট। সেখানে পৌছতে ঘন জঙ্গল পেরোতে হয়। সেন্ধ নামছে বিশাল বিশাল শালের জঙ্গলে। গাড়ির এিঞ্জনের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। কানহা কিসলি যেতে দিনে তিনবার বাস এই রাস্তা নেয়। সকালে একবার, দুপুরে একবার আর সেন্ধবেলা একবার। এ ছাড়া, জঙ্গল দেখার বাধা সময়ে গাড়ি চলে। সেই পার্ক রাউণ্ড শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। বাস ধারেকাছে নেই। সেন্ধর জঙ্গল এই সুযোগে তার অতি মনোরম রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই পরিবেশ বড় বিচিত্র, বড়ই অদ্ভুত। হাওয়ার গন্ধ পালটে যায় এই সময়। শহুরে মানুষ সচরাচর এমন পরিবেশের মুখোমুখি হয় না। এ সময় বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে ব্যবধান ক্ষীণ হতে হতে এক সময় উধাও হয়ে যায়। নিজের সম্পকে,র্ নিজের অিস্তত্ব, নিজের চেতনা সম্পর্কে এমন সব প্রশ্ন মনে আসে যা কখনও কল্পনাও করিনি মনে আসতে পারে।
বাক পেরোল। ডানদিকে গাছের সারি পাতলা হয়েছে। অন্ধকার এখানে গাঢ়। ওখানে জলাশয় আছে। সারাদিন অনেক পাখি আসে ওখানে। আর একটু এগোলেই বাদিকে মোড় নিয়ে টিলার ওপর ওঠে গাড়ি। জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি আকাবাকা রাস্তা শেষে বাঘিরা লগ হাট। অসাধারণ এক জঙ্গলের একেবারে ভেতরে থাকার এমন সুন্দর জায়গা আর কোথায়! বাঘিরার ম্যানেজার, পুরনো বন্ধু, ঝঁাসির সজ্জন মানুষ রায় সাহেব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন সীতারাম মাসকুলে মুন্না নিতাই রায়। সামনের কয়েক দিন ওঁদের আদরযেত্ন দিন কাটবে ভেবে গভীর আরাম পেলাম।
কানহা রাষ্ট্রীয় উদ্যান মধ্যপ্রদেশের অন্যতম বড় পার্ক। ৯৪০ বর্গ কিলোমিটারের কোর বা প্রধান এলাকা। ১০০৫ বর্গ কিলোমিটারের বাফার বা আশেপাশের এলাকা। তবে শুধু আয়তনের কারণেই কানহা শ্রেষ্ঠ নয়। কানহার সৌন্দর্য আজও অটুট কারণ ওই রুদ্র রূপকে পেলব করতে মানুষের মলিন হাত উঠেপড়ে লাগেনি। প্রথম দেখায় কানহা মরুভূমির মতো কঠিন সুনশান। প্রথম দেখায় েপ্রম হয় না। কানহাকে প্রথম দেখলে অবাক লাগে, স্তিম্ভত হতে হয় আর তারপর ধীরে ধীরে অভিভূত লাগে। বিনা কারণে কানহাকে কুইন অব দ্য উইলডারনেস বলা হয় না। এখানে মোবাইল চলে না, টিভি (এখনও পর্যন্ত) চলে না, এমনকি দিনের অনেকটা সময় বিদ্যুৎ পর্যন্ত থাকে না। তবু কানহা কানহাই। চারিদিকে নিিশ্ছদ্র নীরবতা রাজত্ব করে। দৈবাৎ অর্বাচীন মানুষ গলা তুললে বহুদূর থেকে যা স্পষ্ট ভেসে আসে, আরও একবার মনে পড়ায় প্রকৃতির সভ্যতার পাশে মানুষের মতো এমন বর্বর আর নির্বোধ খুব কম জীবই আছে। এখানে সারাদিন সারারাত ল্যাপউইং ওদের ডিড ইউ ডু ইঠ ডাকে আকাশ বাতাস মুখরিত করে। ময়ূর ডাকে সময় অসময়। ডাকে চিতল সামবার চিতাবাঘ।
হাতমুখ ধুয়ে ঘরের বাইরের ঁসিড়িতে জড়ো হয়েছি আমরা পাচজন। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। গাঢ় অন্ধকার নেমেছে সামনে যেখানে জানি মাঠ আর পাহাড় আছে। মাথার ওপর চোখ পড়তে আমরা বাক্যহারা। কালো ভেলভেটের মতো আকাশ একেবারে নীচে নেমে এসেছে আর তাতে জ্বলজ্বল করেছে অগিণত তারা। এত তারা যে কোনও আকাশে থাকতে পারে তা কে জানত? সেই ছোটবেলায় পুরীতে দেখার পর এতকাল বাদে কানহায় এসে ফের সেই আকাশগঙ্গার দেখা পাওয়া গেল। আমরা মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখি অদূরে কানহার জঙ্গল থেকে ভেসে আসে ময়ূরের ডাক।
পরের দিন ভোর থেকে শুরু পার্ক রাউণ্ড। ছ’টার মধ্যে কিসলি গেটের সামনে জিপসির সারিতে আমরাও যোগ দিয়েছি। কোনও সোরগোল নেই, অযথা কথা নেই। কাউন্টার থেকে ফর্ম নিয়ে ভর্তি করে টাকা জমা দিতে হয়। তারপর সময় হলে গেট খোলে। রসিদ হাতে একজন গাইড গাড়িতে ওঠে। আজ উঠল আমাদের চেনা মানুষ অশোক ঝরিয়া। কিসলি গেট খুলল। জিপসি ঢুকল কানহার কোর এলাকায়। ধীরে ধীরে লাইন করে একটার পর একটা জিপসি। কোনও গাড়ি ঘন্টার ২০ কিলোমিটারের বেশি িস্পডে যাচ্ছে না। বিশাল মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে। ডানদিকে ইন্দ্র রোড চলে গিয়েছে। বাদিকে ডিগডোলার রাস্তা। মাঠের ওপর পুরু কার্পেটের মতো কুয়াশা ঝুলে রয়েছে। ধুসর রঙের মধ্যে মিশে গিয়েছে এক দল চিতল। আরে, বাদিকে বড় কোটরে একটা নয়, এ বার দেখি দু’দুটো স্পটেড আউলেট। ওটাই ওদের নাম। ওরা ছোট্ট ছোট্ট পেচা সাদা রঙের ওপর ছাই রঙের ফুটকি। খুব লাজুক। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে মুখ বের করে এক ঝলক দেখে নিয়েই টুক করে কোটরে ঢুকে গেল।
কানহা কিসলির সবাই বলেন, শীতকালে জন্তুজানোয়ার কিছু কম দেখা যায়। অথচ ঘুরতে ঘুরতে কত জন্তুই না চোখে পড়ল। কানহায় বারবার ফিরে যাই এই টানে যে কানহা কখনও হতাশ করে না। যেতে যেতে দেখেছি গাছের ওপর থেকে লঙ্গুর কীভাবে পাতা খাওয়ার সময় কচি কচি ডালপালা নীচে ফেলছে আর চিতলের দল গাছের তলায় জড়ো হয়ে সেই পাতা খাচ্ছে। দুই প্রাণীর মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়। খাবার সরবরাহ করা ছাড়াও গাছের ওপর থেকে লঙ্গুরেরা নজর রাখে মাংসাশী প্রাণীদের ওপর। ওদের অ্যালার্ম কল শোনামাত্র চিতলেরা সতর্ক হয়ে যায়, বেগতিক দেখলে টেনে দৌড় দেয়।
সেবার মার্চ মাসে কানহা গিয়েছি। কানহা ময়দানের একপ্রােন্ত দেখা এক পাল বন্য কুকুরের সঙ্গে। ওদের নাম ঢোলে। দিশি কুকুরের চেয়ে একটু ছোট, লালচে বাদামি গায়ের রঙ ছাই রঙের লোমশ লেজ। আমাদের জিপসি দেখে মোটেই বিচলিত নয়। গাড়ি ঘিরে ঘোরা ফেরা করছে। আর পাশের মাঠ থেকে পরিত্রাহী চিৎকার করছে রেড ওয়াটেল্ড ল্যাপউইং। মার্চ মাসে বাসা বানায় ল্যাপউইংরা। গাছে নয়, মাঠের ঘাসপালার মধ্যে। পাখির বাসা আছে আন্দাজ করে ঢোলেরা মাঠের দিকে যত এগোচ্ছে ল্যাপউইং বেচারা ততই প্রচণ্ড রেগে চিৎকার করছে আর ঢোলেদের ঠোক্কর মারতে ডাইভ বমবারের মতো নেমে আসছে। চোখের সামনে প্রকৃতির এই জীবন্ত নাটক দেখেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ল্যাপউইংয়ের জন্য উেদ্বগের অন্ত নেই। ঢোলেরা দুর্দান্ত শিকারি। বাঘও ওদের সমঝে চলে। তারা পাখির ভয়ে পালাবে এ কখনও হয়! কী যে হয় আর কী হয় না তার কতটুকু আমরা জানি। উন্নাসিক একজিকিউটিভের মতো ঢোলেরা দূরে দৃিষ্ট নিক্ষেপ করে িস্থর হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। মাথার ওপর নেমে আসা ল্যাপউইংয়ের প্রতি ভ্রূক্ষেপ নেই, ওদের ডাক যেন শুনতেই পাচ্ছে না। দু’এক মুহূর্ত কী যেন বিবেচনা করল। তারপর ধীরে ধীরে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এল। আমাদের ফূর্তি তখন দেখে কে? ওই ভয়ানক ঢোলেকে সামান্য একটা পাখি পরাস্ত করেছে! এ যেন ডেভিড আর গোলায়েথের লড়াইয়ে ডেভিডের জয়। জিপসি আবার নড়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এ যাত্রায় না হয় ল্যাপউইং জিতল, কিন্তু পরের বারও কি পারবে কিংবা তার পরের বার? আশ্বাসের মতো পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, দুঃখ করে লাভ নেই, এর নাম জঙ্গল, এখানে হার জিত দুটোই সমানভাবে ভাগ করে দেয় প্রকৃতি। আমার বড় ভয় হয়। ভয় হয় এই ভেবে যে, কেউ যদি হঠাৎ জিগ্যেস করে বসে, কী অমন আছে কানহার জঙ্গলে যে বারবার ছুটে যাচ্ছ? কী এমন দেখার আছে? গাছপালা আর জন্তুজানোয়ার এই তো? তাহলে কিন্তু আমি বেশ কাচুমাচুই হয়ে যাব। সত্যিই তো, গাছপালা আর জন্তুজানোয়ার ছাড়া কীই বা আছে? কী নেই তা অবশ্য সহজে বলে দিতে পারব। দোকানবাজার নেই, গাড়িঘোড়া নেই, টুনি বালব দিয়ে সাজানো উৎকট হোটেলের সারি নেই। পান সিগারেটের দোকান থেকে তারস্বরে ভেসে আসা কাটা লাগা, আচল ছাড়া গান নেই। এমনকি, মানুষও খুব বেশি নেই। সবার চোখে কানহার ম্যাজিক ধরা পড়বে কি না জানি না, আমার চোখে কানহার মতো এমন অত্যাশ্চর্য জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। মধ্যপ্রদেশের ওই ধূসর পাথুরে জমি আমার মন কেড়ে নিয়েছে। বিন্ধ্য পর্বতমালার কাছাকাছি যখনই গিয়েছি ঘুরেফিরে মনে হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচীন যত পাহাড় আছে তার অন্যতম হল বিন্ধ্য সাতপুড়া মায়কল পর্বতমালা। হাজার হাজার বছরের ঝড়জল বৃিষ্টতে ওই পাহাড়ের শরীরের কোনা খাজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নরম হয়েছে পেলব হয়েছে। গাছের শেকড়ের মতোই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে পাহাড়ের শেকড়। ওই সব পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টের পেয়েছি পাহাড় থেকে দৃশ্য ও অদৃশ্য বার্তা ভেসে আসে। সেই বার্তায় শব্দ নেই, ভাব আছে যা বড় আরামদায়ক। ওই পাহাড়ের দিকে তাকালে রাশি রাশি স্বিস্ত আর শািন্ততে মন ভরে যায়। এক আস্থার ইঙ্গিত পাই যা কখনওই ফুরোবে না। পাহাড় থাকবেই। আমার জেন্মর অনেক আগে থেকে যেমন পাহাড় ছিল, আমি মরে যাওয়ার অনেক পরেও ওই সব পাহাড় থেকে যাবে।যেমন থাকবে জঙ্গল। একদিকে ধূসর রুক্ষ পাথুরে জমি, অন্যদিকে ঘন সবুজ জঙ্গল। এই সোনার পাথরবাটিতে মন যদি চঞ্চল না হয় তো কিসে হবে? বাংলার মতো নরম কালো মাটি স্যাতস্যাতে হাওয়া আর কচি সবুজের বাহার এখানে নেই। রুক্ষ পাথর অসুন্দর মাটি কানহার অত জঙ্গলের মধ্যেও। তাতে কানহা আরও সুন্দর। কারো মন রাখার দায় কানহার নেই। কেয়ারি করা বাগান বোগানভেলয়ার বাহার কানহায় নেই। দরকারও নেই। কানহায় আছে মানুষের স্পর্শ এড়ানো উদাসী সন্ন্যাসীর মতো উপিস্থতি যাকে উপেক্ষা করা যায় না। কানহার জঙ্গলে একটিও মানুষ আর কোনও দিন হানা না দিলেও কানহার ক্ষতি নেই, বরং লাভ। ভারতের অন্যান্য জঙ্গলের মতো কানহাও মানুষের উৎপাতে কাহিল হতে বাধ্য। কানহা কিসলির জঙ্গল পর্যটন কেন্দ্র নয় কাজেই তা অতিথিদের মুখাপেক্ষী নয়। কানহায় গিয়ে মানুষ কানহার উপকার করে না, করে নিজের। কানহা যেন কেমন করে বুঝিয়ে দেয় পৃথিবী নামের এই বিশাল সৃিষ্টর কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ নেই, আছে অন্য কিছু। এখানে মানুষের গুরুত্ব আর পাচটা প্রাণীর চেয়ে কোনও অংশে বেশি নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কমই বরং। মানুষের আধুনিকীকরণ, কল্পনা বুিদ্ধ মেধা ছাড়াই কানহার বেশ চলে যাবে। ও সব ছাড়াই কানহা বিশাল মহান সুন্দর। ওই নিস্তব্ধ বিস্তীর্ণ জঙ্গলের মধ্যে চলতে চলতে নিজের নগণ্যতা বড় হয়ে ধরা পড়ে। একই সঙ্গে অনেক উন্নত অন্য এক সৃিষ্টশক্তি কল্পনাশক্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেই ইঙ্গিত বয়ে আনে এক আধ্যাত্মিক উপিস্থতির কথা।
আমাদের দৈনিন্দন জীবনের অভিজ্ঞতার বাইরে এমন কি আমাদের ধরা ছোয়ার বাইরের এই সব ঘটনা অনুভব করার জন্য চাই মানসিক প্রস্তুতি, আচরণগত প্রস্তুতি। সব ধ্বনি কানে শোনা যায় না; সব দৃশ্য চোখে দেখা যায় না, এই হল জঙ্গলের প্রথম পাঠ। জঙ্গল দেখার জঙ্গল বোঝার ক্ষেত্রে মনের ভূমিকা বিশাল। আমাদের সর্বদা তালাচাবি খিল নাইটল্যাচ লাগানো মনের দরজা খোলা একটা বড় কাজ। দরজা কিন্তু খুলতেই হবে। তারপর নিজেকে ভুলে একেবারে নীরবে অনুভব করতে হবে জঙ্গলকে। তবে, শুধু তবেই হয়ত জঙ্গল সাড়া দেবে। এই নিজেকে ভোলার কাজটা কঠিন। অথচ খুবই জরুরি কারণ এই যাত্রার নায়ক তো আমরা নই। এই যাত্রার নায়ক জঙ্গল স্বয়ং। অনর্গল কথাবার্তা বলে, লাফিয়ে ঝাপিয়ে, চিৎকার চেঁচামেচি করলে জঙ্গল এগিয়ে আসবে কী করে? কিসলি গেটের পাশে পুরনো বটগাছের কোটরের আউলেটের মতো জঙ্গল কিন্তু ভারী লাজুক। হইচই করলে সেই যে গুটিয়ে যাবে আর কিন্তু ধরা দেবে না।
জঙ্গলের নিয়ম মানতেই হয়, কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। মিন্দরে যেতে হলে যেমন মনকে িস্থর রাখার প্রয়োজন জঙ্গলেও অনেকটা তাই। মিন্দরের ঈশ্বর কথাবার্তা বলবেন এমন কোনও গ্যারািন্ট শ্রেষ্ঠ পুরোহিত পাণ্ডারাও দিতে পারেন না। জঙ্গলের নিয়ম মেনে মনকে মগ্ন রাখতে পারলে জঙ্গল কিন্তু নিজেকে মেলে ধরে। সেই প্রকাশ প্রকট নয় সরব নয়, কিন্ত সে যে এক অসাধারণ প্রাপ্তি তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
সিঝোরা রোড আর সাত নম্বর লিঙ্কের কাছে টাইগার শো হচ্ছে খবর পেয়ে কানহা ভিলেজ থেকে আমরা রওনা হলাম। সকালে ঘন্টা আড়াই ঘোরার পর কানহা ভিলেজে যাওয়া হয়েছিল। এক সময় ওই নামের গ্রাম ছিল ওখানে। সেই গ্রাম আর আরও ২১টা গ্রাম জঙ্গলের বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তার জায়গায় আছে ছোট অথচ সুন্দর এক মিউজিয়াম, শালগাছ ঘেরা খোলা জায়গায় রামাভাইয়ার টিনের চালের দোকান। সেখান থেকে অতি উপাদেয় ভাজি বড়া আর চা খেয়েছি কিছুক্ষণ আগে। দুঃখের বিষয় বনবিভাগ এই ভাজি আর চাকে মর্যাদা দিতে পারেনি।
অস্থায়ী ঝুপড়ির বদলে পাকা রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। তখনও চালু হয়নি, কিন্তু একদিন হবে ভেবে ভীষণ খারাপ লেগেছে। কানহার জঙ্গলের ভেতরে পাকা রেস্টুরেেন্টর কোনও প্রয়োজন নেই, এই সামান্য কথাটা বিজ্ঞজনেরা বোঝেন না।
রাস্তার ধারে জিপসি দাড়াল। এবার হাতির পিঠে গভীর জঙ্গলে। বনদেবীকে নিয়ে এসেছে বরাতু। হাতি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। হঠাৎ দেখি সামনের ঘাসের মধ্যে একদল চিতল। বাঘ দেখতে এসে শেষে চিতল!
বাঘ কোথায়, জানাও, বেতারে ফিস ফিস করে জানতে চাইল বরাতু, আমরা কিন্তু এগিয়ে চলেছি।
কোনও জবাব নেই।
বাঘ ওইখানে আছে, কানের কাছে চাপা গলায় বলে উঠল কৈলাশ, সামনের দিকে ওর হাত ছড়ানো।
তাকালাম। কোথায় বাঘ, আমি তো শুধু চিতল দেখছি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঘাসের মধ্যে থেকে মাথা তুলে তাকাল বাঘিনী। সঙ্গে সঙ্গে চিতলের দল দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বাঘিনী একবার বাদিকে একবার ডানদিকে তাকাল। তারপর আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে প্রচণ্ড এক লাফ মেরে চিতলের দলকে তাড়া করল। জঙ্গলের আলোছায়ার ভেতরে বিদ্যুতের মতো হলুদ আলোর একটা গোলা ছিটকে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে বাদিকে। হাতে ক্যামেরা নিয়ে আমি শুধু হা করে ওই দৃশ্য দেখলাম, ছবি তোলার প্রশ্নই নেই। ঘটনাটা এত হঠাৎ ঘটে গেল যে বুঝে উঠতে পারিনি বাস্তবে দেখছি, না কি সিনেমায় দেখছি। অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারিনি। সত্যি বলতে কী, এমন একটা দৃশ্য দেখার পর কথা বলাই যায় না।
এ জিনিসের ছবি তোলার জন্যে বিদেশি টেলিভিশন কোম্পানির দল মাসের পর মাস বসে থাকে, অবশেষে বলল কৈলাশ। ওর চোখ আনেন্দ চকচক করছে। আঠেরো বছর কানহার জঙ্গলে কাটানোর পরেও কানহার মায়া যে কেটে যায়নি তা ওকে দেখলে বেশ বোঝা যায়। কিন্তু ছবি তো তুলতে পারলাম না। আমার গলায় ক্ষোভের আভাস পেয়ে কৈলাস বলে উঠল, মনের ক্যামেরায় তো রয়ে গেল। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
হাতি আবার চলল, এ বার আর একটু গভীরে। শেষ পর্যন্ত মা ঠাকরুণ চিতল ধরতে পেরেছেন কি না তা তো জানতে হবে। কাজেই তার খোজে চললাম। বেশিক্ষণ যেতে হল না। গাছের তলায় দেখা পাওয়া গেল, জিভ বের করে হাফাচ্ছেন। চিতল ধরতে পারেননি বলে সামান্য হতাশ। হাতের কাছে ওঁকে পেয়ে আদেখলার মতো হুমড়ি খেয়ে আমরা পটাপট ছবি তুলছি। এক সময় আর থাকতে না পেরে মুখ ঁখিচিয়ে উঠলেন। মুখের সামনে দিয়ে খাবার পালিয়ে গেলে, বিরক্ত তো হওয়ারই কথা। অবশ্য এমন ঘটনা ঘটেই থাকে। দশ থেকে বিশবার চেষ্টা করলে তবে বাঘেরা একবার শিকার ধরতে পারে। চিতল তো বটেই, সামবার বন্য শুয়োর বারাসিংহা লঙ্গুর এমনকি সজারুও শিকার করে বাঘ।
কানহার সব শেষ বাঘসুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১২৮। বাঘের মতো এমন ম্যাজিকাল প্রাণী আর আছে কি না জানি না। বাঘ এক রাজকীয় জীব, সাহসী শক্তিধর সুন্দর সজ্জন। স্বীকার করতেই হয়, সজ্জন বিশেষণটা আমার নয়, স্বয়ং জিম করবেটের, বাঘ সম্পর্কে এই কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। মনে আছে প্রথমবার যখন বাঘ দেখেছিলাম মনে হয়েছিল ঈশ্বর মর্তে নেমে এসেছেন। সেটা ছিল নভেম্বর মাসের এক বিকেল। ঝকঝকে সোনার মতো রোদ বিস্তীর্ণ কানহার ময়দানের ওপর পড়ে ঘাসকে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই প্রথম কৈলাশ আমাদের কানহা ঘোরাচ্ছে, সঙ্গে গাইড প্রতাপ। হঠাৎ ময়দানের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওই যে বাঘ যাচ্ছে, মেল টাইগার।
তাকিয়ে দেখি হলুদ কালো ডোরা কাটা এক প্রকাণ্ড বাঘ ধীরে ধীরে কানহার ময়দান পেরোচ্ছে। পড়ন্ত বেলার রোদ ওর গায়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে এক সোনার বাঘ আগুনের ময়দানের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রোদ মাঠ আর বাঘের ওই অপূর্ব রঙ মিলে অমন দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি, জানি না আর কোনও দিন দেখব কি না। তারপর অনেকবার বাঘ দেখেছি। টাইগার শোয়ে শুধু নয়, কানহার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বাঘের দেখা পেয়েছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই প্রথম দর্শনের কথা ভুলতে পারিনি। আমরা যারা শহরে থেকে চিড়িয়াখানার বাঘ দেখে অভ্যস্ত তারা কল্পনাও করতে পারি না জঙ্গলে স্বাধীনভাবে বেড়ানো বাঘের মানে কী, তাৎপর্য কী। ওই প্রাণীকে একবার প্রকৃতির মাঝে দেখতে পেলে জীবজগৎ সম্পর্কে ধারণাই বদলে যায়। বাঘকে আরও নিবিড়ভাবে বোঝার, চেনার ইচ্ছে হয়।
সেবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। চৌথা কিলোমিটারের কাছে, কানহা রোডের ওপর শোয়ে বাঘ দেখতে গিয়েছি। শাবির আহমেদ মাহাওয়াত তার হাতি শিবাজির সঙ্গে বনকর্তাদের নিয়ে গেলেন বাঘ দেখতে। ওদের পরেই আমাদের পালা। রাস্তায় দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি তাড়াহুড়ো করে শিবাজি ফিরে আসছে, ওর পিঠে বসা ডেপুটি রেঞ্জার হাতপা নেড়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। পরক্ষণেই বুঝলাম উনি বলছেন গাড়িতে উঠে পড়ুন, বাঘ চলতে শুরু করেছে। কাছের একটা জিপসিতে লাফ মেরে উঠে পড়লাম। শিবাজি ফিরে এল। কর্তারা নেমে পড়লেন দেখে আমি গিয়ে হাতির পিঠে চড়ে বসলাম। শাবির ভাই চেনা লোক। গাছপালার আড়ালে বাঘ বসেছিল দর্শন করলাম ছবিও তুললাম। মনঃপূত হল না। হাতির পিঠ থেকে নামতে নামতেই খেয়াল হল অন্য হাতিরা সোজাসুজি ফেরার বদলে রাস্তার সমান্তরালে চলছে। মানে, এ বার বাঘ সত্যি সত্যিই চলছে।
জিপসিতে উঠে পড়ুন, বাঘ চলছে, চিরশান্ত কৈলাশের গলায় চাপা উত্তেজনা।
গাড়ি ঘুরিয়ে মোড়ের মাথায় দাড় করানো হল। সেখান থেকেই ঘন বাশঝাড়ের মধ্যে বাঘের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাঘ কি এ দিকে আসবে, না কি আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে যাবে? শ্যেনদৃিষ্ট নিক্ষেপ করে আমরা তাকিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে। হঠাৎ ঘুরে গিয়ে বাঘ একেবারে জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এল। আমাদের কয়েক হাতের মধ্যে দিয়ে, এ দিক ও দিক তাকাতে তাকাতে জিপসির পেছন দিকে যে রাস্তা, যা একটু আগে ছেড়ে এসেছি, সেই দিকে চলতে শুরু করল। রাস্তার ধারে তখন দুটো বড় বড় হাতি দাড়িয়ে। বাঘ কিছুক্ষণ এগোল। তারপর ঘুরে দাড়াল। তারপর লাফাতে লাফাতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সে যে কী অসাধারণ দৃশ্য, বুঝিয়ে বলা মুশকিল। যখন আর কয়েক হাত মাত্র ব্যবধান, বাঘ একটু কাত হয়ে বাদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ওই বিশাল হলদে কালো চমৎকার।
পরে যখনই কাউকে এই গল্প বলতে গিয়েছি, সবাই একটা কথাই জানতে চেয়েছে: ভয় করেনি? ওদের উত্তর দিতে দিতে মনে হয়েছে, হয়ত বাঘ সম্পর্কে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি উপলিব্ধ করেছি, তা প্রকাশ করা দরকার। তবে তা আজ হবে না, কারণ কানহার অন্য সদস্যদের কথাও তো বলার আছে। কানহার জঙ্গলে যে আরও অনেকের বাস।
ডিগডোলার পাহাড় থেকে নেমে সফ ময়দানে এসে পড়েছি। অন্য কোথাও পাওয়া না গেলেও সফে ওদের দেখা পাওয়া যাবেই। পৃথিবীর আর কোথাও ওরা নেই। ওরা হল হার্ড গ্রাউণ্ড বারাশিংহা। হরিণ প্রজাতির সদস্য বারাশিংহার নাম অনেকটাই আক্ষরিক। দু’দিক মিলিয়ে বারোটা শিং এদের মাথায় থাকবেই, অনেক সময় তার বেশিও থাকে। সেই শিঙের বাহার তাকিয়ে দেখার মতো। উত্তর ভারতেও বারাশিংহা পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে ওরা থাকে জলাজমিতে। একমাত্র কানহাতেই ওরা শুকনো জমিতে থাকার অভ্যাস করেছে বলে ওদের নাম হার্ড গ্রাউণ্ড বারাশিংহা। সেটা ছিল ১৯৭০ সাল। মধ্যপ্রদেশ থেকে বারাশিংহা নিিশ্চহ্ন হতে বসেছিল। সব মিলিয়ে মাত্র ৬৬টি টিকে আছে। তখন বনবিভাগ আর সংরক্ষকেরা উঠেপড়ে লাগলেন। ওঁদের সময়মতো নজর আর যেত্নর ফলে আজ কানহায় বারাশিংহার সংখ্যা অন্তত চার শো। সফ ময়দান ছাড়াও শ্রবণ তালের কাছে ওদের দেখা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় কানহা ময়দানে, বিশানপুরার মাঠেও। এ বারে যেমন, সফে তো বটেই, বিশানপুরাতে আমাদের এক দল মহিলা বারাশিংহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওদের পাকা গমের মতো বাদামি গায়ে রোদ পড়তে অদ্ভুত আলো ঠিকরে বেরচ্ছিল।
বিশানপুরা সোনঢার পেরিয়ে গাড়ি বালাঘাট জেলা ছেড়ে মণ্ডলা জেলার দিকে চলেছে। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। গাড়ি দেখে মযূর মযূরী রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকল। মাথার ওপর কে যেন শিস দিল। কালো পাখি, লম্বা ল্যাজের ডগায় দুটো ছোট ছোট চাকতি। নাম র্যাকেট টেল্ড ড্রঙ্গো। ফিঙে পরিবারের পাখি, ফিঙের মতোই ওদের ল্যাজ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। গাড়ি চলছে, এমন সময় হঠাৎ জঙ্গলের এক ধারে দেখা গেল কবরের মতো বাধানো বেদী।
লাপসি কবর, বলল কৈলাশ আর তারপরেই গল্পটাও বলল। লাপসি নামে এক আদিবাসী থাকত ওইখানে। সে বাঘ শিকার করত। কিন্তু করত এক অভিনব উপায়ে। লাপসি করত কি, তার বউকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করত। বউকে দেখে বাঘ যেই এগিয়ে আসত তখন তীর ধনুক দিয়ে বাঘকে মেরে ফেলত। সেদিনও লাপসি বউকে টোপ রেখে বাঘের জন্য আড়ালে অপেক্ষা করছে। অাজ কিন্তু বাঘ আর বউয়ের দিকে নয়, সোজা লাপসির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ওকে একেবারে মেরেই ফেলল। তারপর ওইখানেই লাপসিকে কবর দেওয়া হয়। স্থানীয় বিশ্বাস, সারা জঙ্গল ঘুরতে ঘুরতে বাঘের দেখা না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে কেউ যদি লাপসির কবরে ছোট্ট একটা পাথরও চড়িয়ে দেয়, তা হলে বাঘের দেখা পাওয়া যাবেই।
লাপসি কবর পেরিয়ে গেল, যতক্ষণ দেখা যায় ও দিকে তাকিয়ে রইলাম। চমক ভাঙাল চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাওয়া নীল পাখি। ও হল নীলকণ্ঠ। কানহার জঙ্গলে অনেক নীলকণ্ঠ আছে, যেমন আছে ড্রঙ্গো, ল্যাপউইং, িট্র পাই, ব্ল্যাক হেডেড ওরিয়ল, জাঙ্গল ব্যাবলার, হোয়াইট নেক্ড স্টর্ক… লিস্ট শেষ হতে চায় না কারণ বেশ কয়েক শো ধরনের পাখির বাস কানহার জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ওদের দেখা পাওয়া যাবেই, ওদের গানও শোনা যায়। কিন্তু এ দিকে আমাদের হাতের সময় ফুরিয়ে আসছে যে।
বাকে বাকে লঙ্গুর চিতল ময়ূর পেরোতে পেরোতে অবশেষে কানহা রোডে পড়ব, দেখি প্রাজ্ঞ েপ্রৗঢ়ের মতো সামনে দাড়িয়ে গৌর। অনেকে একে ইিণ্ডয়ান বাইসন বললেও আসলে গৌর হল গো প্রজাতির। কানহায় হাজারখানেক গৌর আছে বলে অনুমান। বিশালদেহী জীব, বাঘের গন্ধ পেলে ফোস ফোস করে আওয়াজ করে আর মাটিতে পা ঠোকে। তাই দেখে দলের সকলে সতর্ক হয়ে যায়। আপাতত জঙ্গলের মধ্যে মহাস্থবিরের মতো দাড়িয়ে পাতা চিবোচ্ছে। ওকে দেখে মনে পড়ে গেল, এক বিকেলে বাঘিরা লগ হাটের ঘরের পেছনের ঁসিড়িতে বসে মাঠের দিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ দেখি ডিগডোলার মাঠ দিয়ে একটা দুটো নয়, পর পর এক পাল গৌর চলেছে পাহাড়ের দিকে। তাদের পায়ে পায়ে ছুটছে দুটো ছোট জন্তু, অত দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ওরা বন্য কুকুর না শেয়াল। বিদেশি টেলিভিশানে এমন ছবি দেখেছি, কিন্তু একেবারে সচক্ষে এমন দৃশ্য দেখা গেলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!
কানহার ময়দানের কাছে গাড়ি চলে এসেছে। শেলার হাইডের কাছে শোনা গেল অ্যালার্ম কল শোনা গিয়েছে, বাঘ এ দিকে আসছে। গাড়ি বাক নিল মনহর নালার দিকে। সেখানে তখনও কোনও গাড়ি আসেনি। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। এমন সময় ডানদিকে, রাস্তার পাশে নালার ধারের লম্বা ঘাসের মাথা থরথর করে কেঁপে উঠল। এটা হল ওই জায়গায় বাঘ থাকার অব্যর্থ লক্ষণ। কয়েক সেকেেণ্ডর মধ্যে হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়া গেল। নালা ছেড়ে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে এল বাঘিনী। সেই পড়ন্ত রোদ, সেই সোনার ময়দান, সেই গেরুয়া রঙের ঝলমলে বাঘিনী ততক্ষণে জড়ো হওয়া অন্তত কুড়িটা জিপসির একটারও প্রতি দৃকপাত না করে, একেবারে নিজস্ব স্টাইলে রাস্তা পেরিয়ে কোইলা ভাট্টা রোডের দিকে চলে গেল।
ফিরছি আমরা। আজই শেষ রাত। কাল সকালে রওনা হব জবলপুরের দিকে। কিন্তু কানহা তো শেষ হয় না। মনের মধ্যে কানহা বাড়তে থাকে, স্বেপ্নর মতো রঙিন হয়, চুম্বকের মতো টানে। অনেক দিন পরে, শহরের চাপে চিড়েচ্যাপটা হতে হতে হঠাৎ কানহা মনে মনে ফিরে আসে, এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া, একপ্রস্থ শািন্ত সঙ্গে নিয়ে আসে। মনে হয়, রূপকথার চেয়েও অপরূপ ওই জায়গায় কি কখনও সত্যি সত্যিই গিয়েছিলাম! আর ঠিক তখনই বুঝতে পারি, বোধহয় আবার কানহায় ফেরার সময় হয়েছে।
No comments:
Post a Comment