লতায় ঘেরা হামহাম ঝরনা টলমলে স্বচ্ছ পানি গড়িয়ে পড়ছে পাথরের মতো শক্ত
পাহাড়ের শরীর লেপটে। নির্জন, শান্ত পাহাড়ের প্রায় দেড় শ ফুট উঁচু থেকে আছড়ে
পড়া স্রোতধারা ঘোলা হয়ে কলকল শব্দে বয়ে যাচ্ছে সমতলে। নাম জানা না-জানা
লতাপাতা-গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফলের গাছ পরম স্নেহে এই ঝরনাকে চারপাশ
থেকে আগলে রেখেছে। বুনো ঝরনার রূপ দেখে চোখ ফেরানো যায় না। সংবিৎ ফিরল
ক্যামেরার ক্লিক শুনে। ভ্রমণসঙ্গীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এই রূপ
ক্যামেরাবন্দী করতে। এই ঝরনার নাম হামহাম।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় এমন সুন্দর দর্শনীয় স্থান আমাদের কাছে এত দিন অপরিচিত ছিল—ভাবতেই অবাক লাগে।
যাত্রার ধকল কম নয়। পাহাড়ি পথ বেয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ওঠা, পিচ্ছিল পাথরের ওপর শরীরের ভারসাম্য রাখার প্রাণপণ চেষ্টা, মাথার ওপর বৈশাখের সূর্যের চোখরাঙানি—রীতিমতো এক অ্যাডভেঞ্চার। যাত্রা শুরু কলাবনপাড়া থেকে। কমলগঞ্জের চাম্পারাই চা-বাগানের কলাবনপাড়া। এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের হাঁটাপথে কুরমা বনবিট। রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি অংশ। ওখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাহাড়-টিলা-খালপথ পেরিয়ে টিপরা আদিবাসী গ্রাম তৈলংকামী। বনকাসি পাহাড়ে গভীর অরণ্যঘেরা এ গ্রাম। এখান থেকে হামহামের পথে পেরোতে হয়েছে বেশ কয়েকটি টিলা ও পাহাড়।
বনকাসি পাহাড়ের নিচে পৌঁছে চলছিল বিশ্রামের আয়োজন। পাহাড়ের ওপরে তৈলংকামী গ্রাম থেকে কয়েকজন আদিবাসী নারী ও শিশু আমাদের দেখছিল। চোখে কৌতূহল। আমাদের বিশ্রামে রেখে পথপ্রদর্শক শ্যামল পাহাড় কাটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন সেই গ্রামে। গ্রামের বাসিন্দা দ্রোন দেববর্মাকে সঙ্গে নিয়ে নামলেন। তাঁর গ্রামে যাওয়ার আমন্ত্রণটা লুফে নিলাম। সহযাত্রী একজন রসিকতা করলেন, ‘ধরা যাক, এটা আমাদের বেসক্যাম্প।’ আমাদের হাসির শব্দে গাছ থেকে উড়ে গেল কয়েকটি পাখি। চিঁ-চিঁ জুড়ে দিল কয়েকটি বানর। বোধ হয় নিজেদের এলাকার দখল ছাড়তে চায় না।
পাহাড়ের ওপরে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১০-১২টি ঘর নিয়ে আদিবাসীদের ছোট্ট গ্রাম তৈলংকামী। শণ-বাঁশে তৈরি ঘরগুলো। বারান্দা ও উঠোন লাল মাটি দিয়ে নিকানো। নকশা আঁকা, সুন্দর ও পরিপাটি। প্রতিটি ঘরের পেছনের আঙিনায় কলাগাছের ঝোপ। অবিরাম ঝিঁঝি পোকার ডাক, নানা জাতের পাখির কলরব আর বাতাসে দোল খাওয়া গাছগাছালির আওয়াজ একসঙ্গে মিশে প্রকৃতি এক অন্য রকম সুর তৈরি করে রেখেছে গ্রামটিতে। সারাক্ষণ এ সুর-মূর্ছনা সবুজ গ্রামটির বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতিনির্ভর এই গ্রামের মানুষগুলোও যেন প্রকৃতির মতোই সুন্দর। কী সহজ-সরল তাদের প্রকাশভঙ্গি! কী আন্তরিক তাদের আতিথেয়তা। নিজেদের ফলানো কলা, হাতের তৈরি পিঠা দিয়ে তারা আমাদের আপ্যায়িত করল। আর সঙ্গে দিল কুয়ার ঠান্ডা স্বচ্ছ পানি। দ্রোন দেববর্মা জানালেন, তাঁরা বনপ্রজা। অর্থাৎ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বন বিভাগ তাঁদের থাকার জায়গা দিয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা বন বিভাগকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন। তাঁদের ভাষায় পানিকে বলে ‘তৈলং’ আর ‘কামী’ শব্দের অর্থ ‘মোহনা’। অর্থাৎ তৈলংকামীর বাংলা অর্থ হলো ‘পানিমোহনা’।
এখানে আধঘণ্টা বিশ্রাম শেষে আবারও পথে পা বাড়ালাম। কিছুদূর এগোতেই একটানা নিরবধি হামহামের শব্দ কানে বাজল। ভাবলাম, এই তো এসে গেছি। কিন্তু না। কয়েকটি টিলা মাড়ানোর পর সামনে পড়ল একটা বিশাল পাহাড়। এবার দলের সবার রসিকতা, এই তো এভারেস্ট!
এবার আমাদের সামনেও এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার দুর্লভ সুযোগ। মনের মধ্যে ভীষণ অ্যাডভেঞ্চার দানা বেঁধে উঠতে লাগল। এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। শ্যামল আমাদের হাতে বাঁশের শক্ত লাঠি ধরিয়ে দিলেন। এটাতে ভর দিয়ে পাহাড়ে চড়তে হবে। নামতেও হবে এটাতে ভর দিয়েই। চূড়ায় উঠে দেখি, সামনে নিচে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে একটি স্রোতধারা।
সাবধানে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নেমে শ্যামলের পিছু পিছু এই স্রোতধারা অনুসরণ করে উজানে হাঁটতে লাগলাম। ঠান্ডা পানি। পানির নিচে পিচ্ছিল পাথর। এর ওপর দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যেন পা দুটো ঠান্ডায় একসময় স্থির হওয়ার উপক্রম। আর বুঝি পারব না। হামহাম শব্দ অনেকক্ষণ থেকেই কানে বাজছিল। কিন্তু কোথায় সে শব্দের উৎস? আর কত দূর? একসময় আমরা একটা গিরিপথের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। পথের সামনে-পেছনে খোলা। ওপরে গহিন বনের বিচিত্র গাছগাছালির আচ্ছাদন। দুই পাশে পাথর হয়ে যাওয়া পাহাড়। গিরিপথ ধরে প্রায় ২০ মিনিট এগিয়ে যেতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। এই তো সেই অপরূপ ঝরনা। এত কষ্ট সার্থক। দুচোখ ভরে দেখে নিলাম। তার জলে গা ভিজিয়ে নুতন উদ্যম ফিরে পেলাম। এখান থেকে আবার ফিরতিপথে হাঁটা।
যেভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন বা বাসে চড়ে আপনি অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সার্ভিস জিপে চড়ে চাম্পারাই চা-বাগানে পৌঁছাতে পারেন। জনপ্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। প্রতিদিন সকাল আটটার দিকে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে থেকে একটিমাত্র জিপ যায় চাম্পারাই চা-বাগানে। সার্ভিস জিপে গেলে আপনাকে আধা কিলোমিটার হেঁটে কলাবন শ্রমিক বসতিতে যেতে হবে। একই স্ট্যান্ড থেকে জিপ রিজার্ভ করেও চাম্পারাই চা-বাগানের কলাবনে যেতে পারেন। এ জন্য গুনতে হবে ৮০০-৯০০ টাকা। ফেরার চিন্তা মাথায় রেখে ভোরে রওনা দেওয়াই ভালো। হাঁটতে হবে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। সঙ্গে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ গাইড নিতে হবে। নয়তো নির্ঘাত গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে যেতে পারেন।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় এমন সুন্দর দর্শনীয় স্থান আমাদের কাছে এত দিন অপরিচিত ছিল—ভাবতেই অবাক লাগে।
যাত্রার ধকল কম নয়। পাহাড়ি পথ বেয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ওঠা, পিচ্ছিল পাথরের ওপর শরীরের ভারসাম্য রাখার প্রাণপণ চেষ্টা, মাথার ওপর বৈশাখের সূর্যের চোখরাঙানি—রীতিমতো এক অ্যাডভেঞ্চার। যাত্রা শুরু কলাবনপাড়া থেকে। কমলগঞ্জের চাম্পারাই চা-বাগানের কলাবনপাড়া। এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের হাঁটাপথে কুরমা বনবিট। রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি অংশ। ওখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাহাড়-টিলা-খালপথ পেরিয়ে টিপরা আদিবাসী গ্রাম তৈলংকামী। বনকাসি পাহাড়ে গভীর অরণ্যঘেরা এ গ্রাম। এখান থেকে হামহামের পথে পেরোতে হয়েছে বেশ কয়েকটি টিলা ও পাহাড়।
বনকাসি পাহাড়ের নিচে পৌঁছে চলছিল বিশ্রামের আয়োজন। পাহাড়ের ওপরে তৈলংকামী গ্রাম থেকে কয়েকজন আদিবাসী নারী ও শিশু আমাদের দেখছিল। চোখে কৌতূহল। আমাদের বিশ্রামে রেখে পথপ্রদর্শক শ্যামল পাহাড় কাটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন সেই গ্রামে। গ্রামের বাসিন্দা দ্রোন দেববর্মাকে সঙ্গে নিয়ে নামলেন। তাঁর গ্রামে যাওয়ার আমন্ত্রণটা লুফে নিলাম। সহযাত্রী একজন রসিকতা করলেন, ‘ধরা যাক, এটা আমাদের বেসক্যাম্প।’ আমাদের হাসির শব্দে গাছ থেকে উড়ে গেল কয়েকটি পাখি। চিঁ-চিঁ জুড়ে দিল কয়েকটি বানর। বোধ হয় নিজেদের এলাকার দখল ছাড়তে চায় না।
পাহাড়ের ওপরে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১০-১২টি ঘর নিয়ে আদিবাসীদের ছোট্ট গ্রাম তৈলংকামী। শণ-বাঁশে তৈরি ঘরগুলো। বারান্দা ও উঠোন লাল মাটি দিয়ে নিকানো। নকশা আঁকা, সুন্দর ও পরিপাটি। প্রতিটি ঘরের পেছনের আঙিনায় কলাগাছের ঝোপ। অবিরাম ঝিঁঝি পোকার ডাক, নানা জাতের পাখির কলরব আর বাতাসে দোল খাওয়া গাছগাছালির আওয়াজ একসঙ্গে মিশে প্রকৃতি এক অন্য রকম সুর তৈরি করে রেখেছে গ্রামটিতে। সারাক্ষণ এ সুর-মূর্ছনা সবুজ গ্রামটির বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতিনির্ভর এই গ্রামের মানুষগুলোও যেন প্রকৃতির মতোই সুন্দর। কী সহজ-সরল তাদের প্রকাশভঙ্গি! কী আন্তরিক তাদের আতিথেয়তা। নিজেদের ফলানো কলা, হাতের তৈরি পিঠা দিয়ে তারা আমাদের আপ্যায়িত করল। আর সঙ্গে দিল কুয়ার ঠান্ডা স্বচ্ছ পানি। দ্রোন দেববর্মা জানালেন, তাঁরা বনপ্রজা। অর্থাৎ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বন বিভাগ তাঁদের থাকার জায়গা দিয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা বন বিভাগকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন। তাঁদের ভাষায় পানিকে বলে ‘তৈলং’ আর ‘কামী’ শব্দের অর্থ ‘মোহনা’। অর্থাৎ তৈলংকামীর বাংলা অর্থ হলো ‘পানিমোহনা’।
এখানে আধঘণ্টা বিশ্রাম শেষে আবারও পথে পা বাড়ালাম। কিছুদূর এগোতেই একটানা নিরবধি হামহামের শব্দ কানে বাজল। ভাবলাম, এই তো এসে গেছি। কিন্তু না। কয়েকটি টিলা মাড়ানোর পর সামনে পড়ল একটা বিশাল পাহাড়। এবার দলের সবার রসিকতা, এই তো এভারেস্ট!
এবার আমাদের সামনেও এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার দুর্লভ সুযোগ। মনের মধ্যে ভীষণ অ্যাডভেঞ্চার দানা বেঁধে উঠতে লাগল। এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। শ্যামল আমাদের হাতে বাঁশের শক্ত লাঠি ধরিয়ে দিলেন। এটাতে ভর দিয়ে পাহাড়ে চড়তে হবে। নামতেও হবে এটাতে ভর দিয়েই। চূড়ায় উঠে দেখি, সামনে নিচে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে একটি স্রোতধারা।
সাবধানে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নেমে শ্যামলের পিছু পিছু এই স্রোতধারা অনুসরণ করে উজানে হাঁটতে লাগলাম। ঠান্ডা পানি। পানির নিচে পিচ্ছিল পাথর। এর ওপর দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যেন পা দুটো ঠান্ডায় একসময় স্থির হওয়ার উপক্রম। আর বুঝি পারব না। হামহাম শব্দ অনেকক্ষণ থেকেই কানে বাজছিল। কিন্তু কোথায় সে শব্দের উৎস? আর কত দূর? একসময় আমরা একটা গিরিপথের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। পথের সামনে-পেছনে খোলা। ওপরে গহিন বনের বিচিত্র গাছগাছালির আচ্ছাদন। দুই পাশে পাথর হয়ে যাওয়া পাহাড়। গিরিপথ ধরে প্রায় ২০ মিনিট এগিয়ে যেতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। এই তো সেই অপরূপ ঝরনা। এত কষ্ট সার্থক। দুচোখ ভরে দেখে নিলাম। তার জলে গা ভিজিয়ে নুতন উদ্যম ফিরে পেলাম। এখান থেকে আবার ফিরতিপথে হাঁটা।
যেভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন বা বাসে চড়ে আপনি অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সার্ভিস জিপে চড়ে চাম্পারাই চা-বাগানে পৌঁছাতে পারেন। জনপ্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। প্রতিদিন সকাল আটটার দিকে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে থেকে একটিমাত্র জিপ যায় চাম্পারাই চা-বাগানে। সার্ভিস জিপে গেলে আপনাকে আধা কিলোমিটার হেঁটে কলাবন শ্রমিক বসতিতে যেতে হবে। একই স্ট্যান্ড থেকে জিপ রিজার্ভ করেও চাম্পারাই চা-বাগানের কলাবনে যেতে পারেন। এ জন্য গুনতে হবে ৮০০-৯০০ টাকা। ফেরার চিন্তা মাথায় রেখে ভোরে রওনা দেওয়াই ভালো। হাঁটতে হবে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। সঙ্গে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ গাইড নিতে হবে। নয়তো নির্ঘাত গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে যেতে পারেন।
No comments:
Post a Comment