শতাব্দী এক্সেপ্রস দুর্দান্ত স্পিডে চলেছে ভোপালের দিকে। সাতপুড়া পর্বতমালা
ছেড়ে এসেছি কিছুক্ষণ হল। নর্মদা পেরিয়ে এখন বিন্ধ্যাচলে পৌছেছি। পৃথিবীর
প্রাচীনতম পাহাড়ের গা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। অনেকে বলে বিন্ধ্যাচলের তুলনায়
সাতপুড়া অনেক সবুজ। অগস্ট মাসে দুই পাহাড়ের মধ্যে কোনও তফাত চোখে পড়েনি।
বর্ষার শেষে বিন্ধ্যা সাতপুড়ার মতোই ঘন সবুজে রঙিন। পর পর কয়েকটা টানেল
পেরল। তার মানে বিন্ধ্যা শেষ হতে চলেছে। ভোপাল আর বেশি দূর নয়। যেই না টের
পেলাম অমনি আমার উত্তেজনা বাড়তে শুরু করল। ম্যাপট্যাপ ঘেটে মনে হয়েছিল
ট্রেন থেকেই সেই পরম আশ্চর্য জিনিস দেখতে পাওয়ার কথা। তখন থেকেই উত্তেজিত
লাগছে। এখন যত এগিয়ে আসছে সেই উত্তেজনা হতাশার আশঙ্কায় পরিণত হচ্ছে। মনে
মনে সন্দেহ হচ্ছে, সত্যিই দেখা যাবে তো? প্রশ্ন করতেই দরদী সহযাত্রী
স্নেহভরে বলে উঠলেন, হা, মিলেগা না! ট্রেনের জানলার বাইরে চোখ লাগিয়ে বসে
আছি, অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ওরা চট করে পালিয়ে না যায়। নিবিড় জঙ্গলে ঢাকা
পাহাড়ি এলাকা। হঠাৎ সবুজ উপত্যকার মাঝখানে দেখা পেলাম। পাহাড়ের ওপর বহু
যুগের আবহাওয়ার ঝাপটায় কালো হয়ে যাওয়া পাশাপাশি দাড়িয়ে পাথরের ঢিবি।
ভীমবৈঠকার প্রথম দর্শন।
‘‘ও-ই হ্যায় ভীমবৈঠকা,’’ বললেন সহযাত্রী। আনন্দ আর উত্তেজনায় আমার চোখে জল এসে গিয়েছে। দশ হাজার কুড়ি হাজার তিরিশ হাজার বছর আগে এই গুহায় থাকত আদিমানুষ। ওই সব গুহার দেয়ালে ছবি একে রেখে গিয়েছে, রেখে গিয়েছে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ। সেই গুহাচিত্র এখনও আছে, এখনও তা দেখতে পাওয়া যায়। নৃতেত্ত্বর নিরস ডেটাব্যাংক থেকে আদিমানুষ নেমে এসেছে ধরাছোয়ার মধ্যে, আঙুলের ডগায়। এমন আশ্চর্য ঘটনা আধুনিক মানুষের জীবনে সচরাচর ঘটে না। দৈবাৎ ঘটে গেলে অভিভূত না হয়ে উপায় কী! যতক্ষণ দেখা যায় ভীমবৈঠকার দিকে তাকিয়ে আছি। এক সময় দেখলাম ট্রেনের জানলার বাইরে থেকে ভীমবৈঠকা আেস্ত আেস্ত সরে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে দৃিষ্টর আড়ালে। মনটা হু হু করে উঠল। অজানা উদ্বেগে মন ভরে উঠল। ভীমবৈঠকা চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ। ভীমবৈঠকাকে হারিয়ে ফেলার উদ্বেগ। যারা হারিয়েছে, তারাই হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা বোঝে। আমার সেই যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। এমন সময় ভুল ভাঙে। কুড়ি তিরিশ চিল্লশ হাজার বছর ধরে আদিমানব তার অস্তিত্ব নিয়ে ওই গুহায় রয়ে গিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ এসেছে, আবার চলেও গিয়েছে। ভীমবৈঠকা থেকে গিয়েছে, থেকে গিয়েছে আদিমানুষের অস্তিত্বের চিহ্ন। আমাকে নিয়ে শতাব্দী এক্সেপ্রস চলে গেলেও ভীমবৈঠকার গুহা ঠিক ওইভাবেই ওইখানে থাকবে। থাকবে আর হয়তো অপেক্ষা করবে ফের কবে আধুনিক মানুষ এসে দাড়াবে গুহার সামনে।
ভীমবৈঠকার কাহিনী শুরুই অপেক্ষা দিয়ে। আদিমানুষের অস্তিত্ব চিহ্ন নিয়ে ভীমবৈঠকা অপেক্ষা করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। যে ইংরেজরা আমাদের অজন্তা এলোরার গুহা খুজে দিয়েছে। খুজে দিয়েছে খাজুরাহোর মন্দির, সেই সাহেবরাও ভীমবৈঠকার সন্ধান পায়নি। ভীমবৈঠকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভারতের বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ ভি এস ওয়াকাংকারের। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি চম্বলের বেহড়ে কয়েকটি গুহা আবিষ্কারের পর ওয়াকাংকার উজ্জৈন হয়ে নাগপুর ফিরছেলেন। ট্রেনের জানলা দিয়ে পাহাড়ের মাথায় গুহার ঢিবি দেখে কী মনে করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সেগুন আর তেন্দুর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ওয়াকাংকর এসে দাড়ান আদিমানুষের সংসারের দোরগোড়ায়। সেই থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত পরিশ্রমের ফলে আবিষ্কার ও নথিভুক্ত করেন সাতশোর মতো গুহা আর সেগুলোর মধ্যের গুহাচিত্র। ২০০৩ সাল ডিসেম্বর মাস। প্যারিসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (ইউনেস্কো) ওয়াল্ডর্ হেরিটেজ কমিটির ২৭তম বৈঠকে ভীমবৈঠকাকে ওয়াল্ডর্ হেরিটেজের তালিকাভুক্ত করা হয়। শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেল ভীমবৈঠকা।
মাস আষ্টেক পরের কথা। ভোপালে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল পলাশে বসে অধীর হয়ে উঠেছি ভীমবৈঠকা দেখার জন্যে। পরে দিন সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম ভীমবৈঠকার উেদ্দশে। ভোপাল থেকে দক্ষিণে হোসাঙ্গাবাদ যাওয়ার রাস্তা। অগস্ট মাস। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশেও শরতকাল এসেছে। আদিমানুষের মনেও কি শরতকাল এমন মধুর প্রভাব ফেলত? ৪৬ কিলোমিটারের মাথায় গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে বাদিকে বেকল। একটু এগোতেই লেভেল ক্রসিং। এই লাইন ধরেই শতাব্দী এক্সেপ্রস আমাদের ভোপাল পৌছে দিয়েছিল। চারদিকে ধূ ধূ মাঠ। দূরের পাহাড় কখনও পাথুরে কখনও গাছে ঢাকা। লোকজন নেই বললেই হয়। শুধু মধ্যপ্রদেশ কিংবা ভারত নয়, গোটা বিশ্বের মনুষ্য সভ্যতার আদি কাহিনীর এই পীঠস্থান বড়ই নিঃসঙ্গ বড়ই অনাড়ম্বর। আধুনিক ভারতের বাসিন্দা হয়ে আমাদের মন আজ মোড়ক সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। অনাড়ম্বর জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি জাগে না। ভীমবৈঠকার আসেপাশের ওই জনশুন্য জৌলুসহীন চেহারা দেখে আমাদের মনে সেন্দহ হয়, সত্যি সত্যি কিছু আছে তো, নাকি সবটাই পাবলিসিটি গিমিক। মধ্যপ্রদেশ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আরও একবার আমাদের ভুল ভাঙায়।
গাড়ি পার্ক করে নামতেই সামনে এসে দাড়ালেন গাইড বি এল পাওয়ার। ভীমবৈঠকার অলিগলি ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব ওঁর। রাস্তা চলে গিয়েছে গাছের মাঝখান দিয়ে। আমরা এগোলাম। অনেক চেষ্টা করেও অভিভূত না হয়ে পারছি না। পায়ের তলায় হাজার হাজার বছরের পুরনো ধুলোবালি। মাঝেমাঝে লোহার রড ছাড়া আধুনিকতার কোনও ছোয়া এখানে নেই। সময় থেমে রয়েছে। এমন কি এখানকার পাথরের গায়েও আদিকাল তার ঘন রেখা টেনে দিয়েছে বলে মনে হয়। কে জানে, হয়তো এই রাস্তা দিয়ে আদিমানুষ শিকার করে ফিরত। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে কিংবা কোনও বর্ষার অলস দুপুরে কাঠি আর খড়কের তুলি নিয়ে গুহার দেওয়ালে ছবি আকত। পাশে বসে সঙ্গিনী কিংবা ছোটরা কৌতূহল প্রকাশ করেছে কি? হাতে হাতে তুলি রঙ এগিয়ে দিয়েছে কি? না কি, আবার সেই বদখেয়াল মাথায় চেপেছে ভেবে, উদাসীন হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছে।
পাথরের বিশাল গুহার ভেতরে আমরা দাড়িয়েছি। উচু সিলিং। সামনে খোলা চত্বর থেকে আলো এসে পড়ছে। ভীমবৈঠকার নামকরণ সম্পর্কে বললেন পাওয়ারজি। মহাভারতের দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের নাম থেকেই এই জায়গার নামকরণ। বনবাসের সময় জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে পাণ্ডবরা এই গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, এমন একটা ধারণা এই নামের মূলে রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ভীমের বাটিকা বা বাগান থেকে এই নাম। অন্য একটি মত অনুসারে ভীমের বসার জায়গা বা ভীম বৈঠকি থেকে ভীমবৈঠকা। এর পর আদিমানুষের গল্প বললেন পাওয়ারজি। কী ভাবে তারা বনে জঙ্গলে জন্তু শিকার করেছে, কী ভাবে শেকড়বাকড় ফল কুড়িয়ে জীবনযাপন করেছে। আদিমানুষ কেমন করে প্রথম আগুন আবিষ্কার করে। তারপর প্রথমে পাথরের আর পরে লোহার অস্ত্র তৈরি করতে শেখে।
‘‘এইখানে দেখুন,’’ বলে আমাদের কাছে ডেকে নিলেন পাওয়ারজি। তার পেছনে বালি রঙের পাথরের থাম উঠে গিয়েছে। আমরা তাকালাম ভীমবৈঠকার প্রথম গুহাচিত্রের দিকে। হলদে পাথরের ওপর লালরঙের জন্তু জানোয়ারের ছবি। বোঝা যায় হরিণ বাঘ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাড়িয়ে আছি। পাওয়রজি আমাদের এক রকম জোর করে নিয়ে গেলেন। একাবেকা পথ ধরে আরও অনেক গুহায়, সেখানে আরও অনেক অনেক ছবি দেখাতে।
আদিমানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আর কতটুকু! বই বা টেলিভিশনের তথ্যচিত্র, কিংবা কিছু বিদেশি সিনেমা বা ব্যঙ্গচিত্র। এর বাইরে আদিমানুষের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। পরিচিত গণ্ডির অনেক বাইরে, কিছুটা অবাস্তব কিছুটা অনুন্নত একদল প্রাণী বলেই মনে করেছি আদিমানুষকে। হঠাৎ ভীমবৈঠকার এত কাছাকাছি এসে পড়ায় খেয়াল হল আদিমানব সম্পর্কে আমাদের মনের ভাসাভাসা ধারণা অবয়ব পাচ্ছে। মানতে বাধ্য হই ওরা মানুষই ছিল। হয়তো একেবারে আমাদের মতন নয়, তবে অনেকটাই আমাদের মতো। অচেতন মনে আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিল ওরা ভাষাহীন মূক বধির বোধবুিদ্ধহীন জন্তুর মতো। সেই ধারণাতেও ধাক্কা লাগে। আমরা গ্যাস ইলেকিট্রসিটি আগুন হাড়ি কড়াই বলপয়েন্ট কলমের মধ্যে জেন্মছি। ওরা বেচেছে আগুন আবিষ্কার করে, পদে পদে মাথা খাটিয়ে বাচার পদ্ধতি বের করতে করতে। একেবারে হাবাগোবা হলে ওরা বাচল কী করে? নিজেদের অস্তিত্বের চিহ্ন এতকাল ধরে টিকিয়ে রাখল কী করে? কী করেই বা ছবি আকল? আদিমানবের প্রতি অজ্ঞাত অবজ্ঞাভাব ধীরে ধীরে শ্রদ্ধায় পরিণত হয়, ওদের সম্পর্কে কৌতূহল বাড়ে।
সেই সঙ্গে আরও একটা উপলিব্ধ হয়। পৃথিবীর আদি বাসিন্দাদের স্বকীয়তা আর সৃিষ্টশীলতাই আধুনিক মানুষের সৃজনশীলতার অন্যতম উপাদান। এ কথা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাচীনের চেয়েও প্রাচীনের সঙ্গে একটা সংযোগ ঘটে। আমরা ওদের উত্তরসূরি, ওদের থেকেই আমাদের উৎপত্তি, ওদের অস্তিত্বের ফলেই আমাদের অস্তিত্ব, এই উপলিব্ধ বড়ই বিস্ময়কর। আমি বিশাল চলমান ঐতিহাসিকতা- পুরাতাত্বিকতার এক অংশ; ছোট হলেও সেই ব্যাপকতার অংশ হিসেবে নিজেকে অনুভব করি। পারিবারিক পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষের বিবর্তন আর সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় আমার পরিচয়ের সন্ধান পাই। ছোটখাটো ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী আমির সঙ্গে এই বিপুলেত্বর একাংশ আমির অনেক তফাত। ক্ষুদ্র তুচ্ছ নগণ্য এই আমিকে বিশালের অংশ হিসেবে অনুভব করার অভিজ্ঞতা শুধু বিস্ময়করই নয়, আধ্যাত্মিকও। সুতরাং যে এই অতি আশ্চর্র্য সুযোগ করে দিল তাকে দেখার জন্যে মন স্বাভাবিকভাবে অধৈর্য হয়ে ওঠে।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পরিপাটি রাস্তা ধরে আমরা যাচ্ছি। রাস্তার পাশে ঝোপ থেকে কয়েকটা পাতা তুলে ফেললেন পাওয়ারজি। চটকে নিয়ে আমাদের হাতে তালুতে লাগিয়ে দিলেন। তালুর ঠিক মাঝখানে টুকটুকে লাল রঙের দাগ পড়ল। এই লালের সঙ্গে এইমাত্র দেখে আসা ছবির লাল একেবারে মিলে যায়। সেই দাগ উঠতে পাচ ছ’দিন সময় লেগেছিল। তাহলে কি আদিমানব ছবি আকার সময় এই পাতা ব্যবহার করত? এই পাতা আর অন্য রঙও। তাতে গাছের আঠা, জন্তু জানোয়ারের মেদ এই সব মিশিয়ে পাকা রঙ বানাত, জানালেন পাওয়ারজি।
বিন্ধ্যার শেষে এই অঞ্চল আদিমানুষের থাকার পক্ষে ছিল একেবারে আদর্শ। কাছেই ঘন জঙ্গলে বন্য জন্তু ফলপাকুড়ের অভাব নেই। মানে, খাওয়ার জন্য বেশি দূর যেতে হত না। একাধিক জলের সূত্র থাকায় জলেরও অভাব ছিল না। আর ছিল প্রকৃতির প্রকোপ থেকে রক্ষা করার মতো গুহা, বা আশ্রয়। সুতরাং এখানে যে আদিমানুষ বহুকাল ধরে বসবাস করেছে তা খুব আশ্চর্যের নয়। প্রথমে তার আগুন ছিল না।
চকমকি পাথর ঘষে হঠাৎ একদিন সে আগুন আবিষ্কার করে। সেখানেই অ্যাডভেঞ্চার শেষ হয়নি। প্রস্তর যুগের মানুষ পাথরের ফলার খোজ পায় একদিন। লম্বা লাঠির ডগায় পাথরের ধারালো ফলক লাগিয়ে আদিমানুষ তেরি করে শিকার করার উন্নত হাতিয়ার। ভীমবৈঠকার মাটিতে ছোট ছোট ধারালো পাথরের কুচি পড়ে থাকতে দেখা যায়, যদিও কাছের বারখেড়াতে এই পাথর বেশি করে পাওয়া যায় বলে জানা গিয়েছে। আমাদের হাতে পাথরের টুকরো দিয়ে পাওয়ারজি বললেন, সাবধান, হাত কেটে যেতে পারে কিন্তু। সাবধানে কাগজে মুড়ে রেখে দিলাম সাদা পাথরের টুকরো, সেটা এখন আমার কলকাতার বাড়ির ড্রেসিং টেবিলে শোভা পাচ্ছে।
এবার আমরা দাঁড়িয়েছি নিচু এক গুহার সামনে। প্রকাণ্ড পাথরের দেয়াল গোল হয়ে নীচের দিকে ঢুকে যাওয়ায় একটা পাথরের তাক তৈরি হয়েছে। সেই তাকের তলার দিকে সাদা রং দিয়ে আকা অসংখ্য জন্তু জানোয়ারের ছবি। গরু মোষ তো রয়েইছে, একটু খেয়াল করলে চিতল বারাসিংহাও দেখতে পাওয়া যায়। পাথরের গায়ে ভিড় জমিয়েছে কত রকমের পশু। ভ্যাটিকানের সিসটিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে মিকেলাঞ্জেলোর জিনিয়াস প্রত্যক্ষ করলে যেমন হতভম্ব লাগে, ভীমবৈঠকার গুহায় এই চিড়িয়াখানা দেখে তার চেয়ে কিছু কম হতবাক লাগে না। অথচ, ছবিগুলো যেখানে আছে সেখানে পৌছতে হলে প্রায় চিত হয়ে শুয়ে ছবি আকতে হত। সামান্য ছবি আকার জন্যে আদিমানুষ কি এত কষ্ট করেছে? কী মনে করে ছবি একেছে সে? হয়তো পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বন্য জন্তুদের চরে বেড়াতে দেখে সেই দৃশ্য মনে ধরেছিল, ঘরে ফিরে সেটাই পাথরে ধরে রেখেছিল আদিমানব।
ভীমবৈঠকার গুহাচিত্র থেকে আদিমানুষের জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে জীবনযাপন করত ওরা। তার পর শিকার করা শুরু হল প্রাণধারণের তাগিদে। তবে সব ছবিই যে আদিমানুষের জীবন কাহিনীর চিত্র এমন নাও হতে পারে। পাহাড়ের ওপর থেকে ওরা অনায়াসে দেখতে পেত নীচের উপত্যকায় কী কী ঘটছে। অনেক সময় গুহার গায়ে সেই গল্পও একে রেখেছে ওরা। সেক্ষেত্রে বলতে হয় আদিমানুষ অনেক যুদ্ধ দেখেছে। ছবি থেকে বেশ বোঝা যায়, এক দল ঘোড়ার পিঠে চড়ে আক্রমণ করতে আসছে, অন্য দল মোষ জাতীয় জন্তুর পিঠে বসে লড়াই করছে। ছবিগুলো কখনও লাল, কখনও সাদা আবার কখনও লাল সাদা দুটো রঙ দিয়ে আকা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় হলদে আর নীল রঙও ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এই শেষের ছবিগুলো খুব স্পষ্ট নয়। পাওয়ারজি দেখালেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে এক পরত ছবির ওপর নতুন করে ছবি আকা হয়েছে। আদিমানুষ যখন শিকার করত না কিংবা ছবি আকত না তখন তারা কী করত? এই প্রেশ্নর উত্তর গুহাচিত্র থেকেই পাওয়া যায়। এক দেওয়ালে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একজন ঢোল বাজাচ্ছে আর তার সামনে হাত ধরাধরি করে অনেকে মিলে নাচছে। এখনও আদিবাসিরা যে ভাবে নাচে, ঠিক সেই ভাবে।
তা সেত্ত্বও আদিবাসীরা ভীমবৈঠকাকে ভাল চোখে দেখে না। ভীমবৈঠকা থেকে বারখেড়া যাওয়ার পথে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো গ্রাম দেখা যায়। সবুজের ওপর লাল টালির ঘর। আর নয়তো রাস্তার ধার ঘেষে জমিতে ভুট্টা চাষ করছে। ছোট্ট ক্ষেত পেরোলেই ওদের ঘর। প্রজেন্মর পর প্রজন্ম ধরে ওরা এইখানেই রয়েছে। চাষবাস করলেও আদিমানুষের মত এরাও জীবনযাপনের জন্যে জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে; প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছে, আর এই কারণেই ভীমবৈঠকা ওয়াল্ডর্ হেরিটেজ তালিকা ভুক্ত হয়েছে। আদিবাসিদের ধারণা ভীমবৈঠকার ছবি যারা একেছে তারা কেউ স্থানীয় লোক ছিল না। বাইরে থেকে লোক এসে ছবিগুলো একে দিয়ে গিয়েছে। এখন আমরা জানি এ কথা সত্যি নয়। কিছুকাল হল ভীমবৈঠকার মাটির নীচে মানুষের কবর পাওয়া যায়। আপাতত আদিমানুষের সাত ফুট লম্বা একটা কঙ্কাল কলকাতার জাতীয় জাদুঘরে রাখা রয়েছে।
কখনও মাটির একেবারে কাছে, কখনও অনেক ওপরে, আদিমানব এইভাবেই নানা জায়গায় ছবি একে রেখে গিয়েছে। কত সময় পেরিয়েছে। ছবির আঙ্গিকে পরিবর্তন আমার মতো আনাড়িরও চোখে পড়ে। রোগা কাঠি হাত পায়ের বদলে ঘোড়ার ওপর যারা বসে আছে তাদের মাথার পাগড়ি থুতনির দাড়ি সব পরিষ্কার বোঝা যায়। তার পর এক সময় সাধুবাবার আবির্ভাব ঘটেছে। সে কথাও ছবিতে লেখা আছে। চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলতে িদ্বধা নেই ভীমবৈঠকার শিল্পীরা নিঃসেন্দহে পৃথিবীর প্রথম সারির শিল্পী। চোখমুখ দেখা যাচ্ছে না, অথচ পাথরের ওপর মানুষের অনুভূতি, আক্রমণের গতি এই সব স্পষ্ট ধরা পড়েছে। দেখতে দেখতে ঘোর লেগে গিয়েছে। চটকা ভাঙল পাওয়ারজির কথায়।
‘‘গুহাচিত্র এখানেই শেষ, তবে ও পাশে মন্দির আছে, চলে যাওয়ার আগে দেখে যাবেন।’’ আমরা চললাম মিন্দরের খোজে। গুহার চত্বর থেকে খুব দূরে নয়। অদ্ভুত পরিবেশ। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। মাঝেমাঝে বিরাট এক একটা পাথর উচু হয়ে দাড়িয়ে। ঝড়জল আর হাওয়ার উৎপাতে ক্ষয়ে বিচিত্র কারুকাজের মতো দেখাচ্ছে। বেশি দূর যেতে হল না। সামনেই পাওয়া গেল বৈেষ্ণাদেবীর মন্দির। প্রাচীন মূর্তি ভেঙে গিয়েছে। সে গাছতলায় আশ্রয় পেয়েছে। এখন মিন্দরের মধ্যে নতুন বিগ্রহ। পাশের গুহার মধ্যে পুরোহিত মশাইয়ের বাস। আশেপাশে কোনও বসতি নেই। ওঁদের দাবি, সেই পাণ্ডবদের সময় থেকেই এই মন্দির রয়েছে। আমরা তর্কের মধ্যে গেলাম না। আদিমানবের যে কীর্তি দেখে এসেছি তাতে গতানুগতিক যুক্তিবোধ অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে। অর্ধেক মন যেন মেনে নিতে রাজিই আছে ভীমবৈঠকার ওই মন্দির পাণ্ডবদের আমলেরই। প্রগৈতিহাসের অলিগলিতে নিজেদের পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার আগে ফেরাই বাঞ্ছনীয় মনে করলাম। শরতের সূর্য তখনও ঢলে পড়েনি। আমরা আদিমানুষের অবিস্মরণীয় আর রহস্যময় জগৎ ছেড়ে নিতান্তই গড়পড়তা পৃথিবীতে ফেরার ব্যবস্থা করতে শুরু করলাম।
‘‘ও-ই হ্যায় ভীমবৈঠকা,’’ বললেন সহযাত্রী। আনন্দ আর উত্তেজনায় আমার চোখে জল এসে গিয়েছে। দশ হাজার কুড়ি হাজার তিরিশ হাজার বছর আগে এই গুহায় থাকত আদিমানুষ। ওই সব গুহার দেয়ালে ছবি একে রেখে গিয়েছে, রেখে গিয়েছে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ। সেই গুহাচিত্র এখনও আছে, এখনও তা দেখতে পাওয়া যায়। নৃতেত্ত্বর নিরস ডেটাব্যাংক থেকে আদিমানুষ নেমে এসেছে ধরাছোয়ার মধ্যে, আঙুলের ডগায়। এমন আশ্চর্য ঘটনা আধুনিক মানুষের জীবনে সচরাচর ঘটে না। দৈবাৎ ঘটে গেলে অভিভূত না হয়ে উপায় কী! যতক্ষণ দেখা যায় ভীমবৈঠকার দিকে তাকিয়ে আছি। এক সময় দেখলাম ট্রেনের জানলার বাইরে থেকে ভীমবৈঠকা আেস্ত আেস্ত সরে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে দৃিষ্টর আড়ালে। মনটা হু হু করে উঠল। অজানা উদ্বেগে মন ভরে উঠল। ভীমবৈঠকা চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ। ভীমবৈঠকাকে হারিয়ে ফেলার উদ্বেগ। যারা হারিয়েছে, তারাই হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা বোঝে। আমার সেই যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। এমন সময় ভুল ভাঙে। কুড়ি তিরিশ চিল্লশ হাজার বছর ধরে আদিমানব তার অস্তিত্ব নিয়ে ওই গুহায় রয়ে গিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ এসেছে, আবার চলেও গিয়েছে। ভীমবৈঠকা থেকে গিয়েছে, থেকে গিয়েছে আদিমানুষের অস্তিত্বের চিহ্ন। আমাকে নিয়ে শতাব্দী এক্সেপ্রস চলে গেলেও ভীমবৈঠকার গুহা ঠিক ওইভাবেই ওইখানে থাকবে। থাকবে আর হয়তো অপেক্ষা করবে ফের কবে আধুনিক মানুষ এসে দাড়াবে গুহার সামনে।
ভীমবৈঠকার কাহিনী শুরুই অপেক্ষা দিয়ে। আদিমানুষের অস্তিত্ব চিহ্ন নিয়ে ভীমবৈঠকা অপেক্ষা করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। যে ইংরেজরা আমাদের অজন্তা এলোরার গুহা খুজে দিয়েছে। খুজে দিয়েছে খাজুরাহোর মন্দির, সেই সাহেবরাও ভীমবৈঠকার সন্ধান পায়নি। ভীমবৈঠকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভারতের বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ ভি এস ওয়াকাংকারের। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি চম্বলের বেহড়ে কয়েকটি গুহা আবিষ্কারের পর ওয়াকাংকার উজ্জৈন হয়ে নাগপুর ফিরছেলেন। ট্রেনের জানলা দিয়ে পাহাড়ের মাথায় গুহার ঢিবি দেখে কী মনে করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সেগুন আর তেন্দুর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ওয়াকাংকর এসে দাড়ান আদিমানুষের সংসারের দোরগোড়ায়। সেই থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত পরিশ্রমের ফলে আবিষ্কার ও নথিভুক্ত করেন সাতশোর মতো গুহা আর সেগুলোর মধ্যের গুহাচিত্র। ২০০৩ সাল ডিসেম্বর মাস। প্যারিসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (ইউনেস্কো) ওয়াল্ডর্ হেরিটেজ কমিটির ২৭তম বৈঠকে ভীমবৈঠকাকে ওয়াল্ডর্ হেরিটেজের তালিকাভুক্ত করা হয়। শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেল ভীমবৈঠকা।
মাস আষ্টেক পরের কথা। ভোপালে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল পলাশে বসে অধীর হয়ে উঠেছি ভীমবৈঠকা দেখার জন্যে। পরে দিন সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম ভীমবৈঠকার উেদ্দশে। ভোপাল থেকে দক্ষিণে হোসাঙ্গাবাদ যাওয়ার রাস্তা। অগস্ট মাস। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশেও শরতকাল এসেছে। আদিমানুষের মনেও কি শরতকাল এমন মধুর প্রভাব ফেলত? ৪৬ কিলোমিটারের মাথায় গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে বাদিকে বেকল। একটু এগোতেই লেভেল ক্রসিং। এই লাইন ধরেই শতাব্দী এক্সেপ্রস আমাদের ভোপাল পৌছে দিয়েছিল। চারদিকে ধূ ধূ মাঠ। দূরের পাহাড় কখনও পাথুরে কখনও গাছে ঢাকা। লোকজন নেই বললেই হয়। শুধু মধ্যপ্রদেশ কিংবা ভারত নয়, গোটা বিশ্বের মনুষ্য সভ্যতার আদি কাহিনীর এই পীঠস্থান বড়ই নিঃসঙ্গ বড়ই অনাড়ম্বর। আধুনিক ভারতের বাসিন্দা হয়ে আমাদের মন আজ মোড়ক সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। অনাড়ম্বর জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি জাগে না। ভীমবৈঠকার আসেপাশের ওই জনশুন্য জৌলুসহীন চেহারা দেখে আমাদের মনে সেন্দহ হয়, সত্যি সত্যি কিছু আছে তো, নাকি সবটাই পাবলিসিটি গিমিক। মধ্যপ্রদেশ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আরও একবার আমাদের ভুল ভাঙায়।
গাড়ি পার্ক করে নামতেই সামনে এসে দাড়ালেন গাইড বি এল পাওয়ার। ভীমবৈঠকার অলিগলি ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব ওঁর। রাস্তা চলে গিয়েছে গাছের মাঝখান দিয়ে। আমরা এগোলাম। অনেক চেষ্টা করেও অভিভূত না হয়ে পারছি না। পায়ের তলায় হাজার হাজার বছরের পুরনো ধুলোবালি। মাঝেমাঝে লোহার রড ছাড়া আধুনিকতার কোনও ছোয়া এখানে নেই। সময় থেমে রয়েছে। এমন কি এখানকার পাথরের গায়েও আদিকাল তার ঘন রেখা টেনে দিয়েছে বলে মনে হয়। কে জানে, হয়তো এই রাস্তা দিয়ে আদিমানুষ শিকার করে ফিরত। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে কিংবা কোনও বর্ষার অলস দুপুরে কাঠি আর খড়কের তুলি নিয়ে গুহার দেওয়ালে ছবি আকত। পাশে বসে সঙ্গিনী কিংবা ছোটরা কৌতূহল প্রকাশ করেছে কি? হাতে হাতে তুলি রঙ এগিয়ে দিয়েছে কি? না কি, আবার সেই বদখেয়াল মাথায় চেপেছে ভেবে, উদাসীন হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছে।
পাথরের বিশাল গুহার ভেতরে আমরা দাড়িয়েছি। উচু সিলিং। সামনে খোলা চত্বর থেকে আলো এসে পড়ছে। ভীমবৈঠকার নামকরণ সম্পর্কে বললেন পাওয়ারজি। মহাভারতের দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের নাম থেকেই এই জায়গার নামকরণ। বনবাসের সময় জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে পাণ্ডবরা এই গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, এমন একটা ধারণা এই নামের মূলে রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ভীমের বাটিকা বা বাগান থেকে এই নাম। অন্য একটি মত অনুসারে ভীমের বসার জায়গা বা ভীম বৈঠকি থেকে ভীমবৈঠকা। এর পর আদিমানুষের গল্প বললেন পাওয়ারজি। কী ভাবে তারা বনে জঙ্গলে জন্তু শিকার করেছে, কী ভাবে শেকড়বাকড় ফল কুড়িয়ে জীবনযাপন করেছে। আদিমানুষ কেমন করে প্রথম আগুন আবিষ্কার করে। তারপর প্রথমে পাথরের আর পরে লোহার অস্ত্র তৈরি করতে শেখে।
‘‘এইখানে দেখুন,’’ বলে আমাদের কাছে ডেকে নিলেন পাওয়ারজি। তার পেছনে বালি রঙের পাথরের থাম উঠে গিয়েছে। আমরা তাকালাম ভীমবৈঠকার প্রথম গুহাচিত্রের দিকে। হলদে পাথরের ওপর লালরঙের জন্তু জানোয়ারের ছবি। বোঝা যায় হরিণ বাঘ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাড়িয়ে আছি। পাওয়রজি আমাদের এক রকম জোর করে নিয়ে গেলেন। একাবেকা পথ ধরে আরও অনেক গুহায়, সেখানে আরও অনেক অনেক ছবি দেখাতে।
আদিমানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আর কতটুকু! বই বা টেলিভিশনের তথ্যচিত্র, কিংবা কিছু বিদেশি সিনেমা বা ব্যঙ্গচিত্র। এর বাইরে আদিমানুষের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। পরিচিত গণ্ডির অনেক বাইরে, কিছুটা অবাস্তব কিছুটা অনুন্নত একদল প্রাণী বলেই মনে করেছি আদিমানুষকে। হঠাৎ ভীমবৈঠকার এত কাছাকাছি এসে পড়ায় খেয়াল হল আদিমানব সম্পর্কে আমাদের মনের ভাসাভাসা ধারণা অবয়ব পাচ্ছে। মানতে বাধ্য হই ওরা মানুষই ছিল। হয়তো একেবারে আমাদের মতন নয়, তবে অনেকটাই আমাদের মতো। অচেতন মনে আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিল ওরা ভাষাহীন মূক বধির বোধবুিদ্ধহীন জন্তুর মতো। সেই ধারণাতেও ধাক্কা লাগে। আমরা গ্যাস ইলেকিট্রসিটি আগুন হাড়ি কড়াই বলপয়েন্ট কলমের মধ্যে জেন্মছি। ওরা বেচেছে আগুন আবিষ্কার করে, পদে পদে মাথা খাটিয়ে বাচার পদ্ধতি বের করতে করতে। একেবারে হাবাগোবা হলে ওরা বাচল কী করে? নিজেদের অস্তিত্বের চিহ্ন এতকাল ধরে টিকিয়ে রাখল কী করে? কী করেই বা ছবি আকল? আদিমানবের প্রতি অজ্ঞাত অবজ্ঞাভাব ধীরে ধীরে শ্রদ্ধায় পরিণত হয়, ওদের সম্পর্কে কৌতূহল বাড়ে।
সেই সঙ্গে আরও একটা উপলিব্ধ হয়। পৃথিবীর আদি বাসিন্দাদের স্বকীয়তা আর সৃিষ্টশীলতাই আধুনিক মানুষের সৃজনশীলতার অন্যতম উপাদান। এ কথা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাচীনের চেয়েও প্রাচীনের সঙ্গে একটা সংযোগ ঘটে। আমরা ওদের উত্তরসূরি, ওদের থেকেই আমাদের উৎপত্তি, ওদের অস্তিত্বের ফলেই আমাদের অস্তিত্ব, এই উপলিব্ধ বড়ই বিস্ময়কর। আমি বিশাল চলমান ঐতিহাসিকতা- পুরাতাত্বিকতার এক অংশ; ছোট হলেও সেই ব্যাপকতার অংশ হিসেবে নিজেকে অনুভব করি। পারিবারিক পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষের বিবর্তন আর সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় আমার পরিচয়ের সন্ধান পাই। ছোটখাটো ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী আমির সঙ্গে এই বিপুলেত্বর একাংশ আমির অনেক তফাত। ক্ষুদ্র তুচ্ছ নগণ্য এই আমিকে বিশালের অংশ হিসেবে অনুভব করার অভিজ্ঞতা শুধু বিস্ময়করই নয়, আধ্যাত্মিকও। সুতরাং যে এই অতি আশ্চর্র্য সুযোগ করে দিল তাকে দেখার জন্যে মন স্বাভাবিকভাবে অধৈর্য হয়ে ওঠে।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পরিপাটি রাস্তা ধরে আমরা যাচ্ছি। রাস্তার পাশে ঝোপ থেকে কয়েকটা পাতা তুলে ফেললেন পাওয়ারজি। চটকে নিয়ে আমাদের হাতে তালুতে লাগিয়ে দিলেন। তালুর ঠিক মাঝখানে টুকটুকে লাল রঙের দাগ পড়ল। এই লালের সঙ্গে এইমাত্র দেখে আসা ছবির লাল একেবারে মিলে যায়। সেই দাগ উঠতে পাচ ছ’দিন সময় লেগেছিল। তাহলে কি আদিমানব ছবি আকার সময় এই পাতা ব্যবহার করত? এই পাতা আর অন্য রঙও। তাতে গাছের আঠা, জন্তু জানোয়ারের মেদ এই সব মিশিয়ে পাকা রঙ বানাত, জানালেন পাওয়ারজি।
বিন্ধ্যার শেষে এই অঞ্চল আদিমানুষের থাকার পক্ষে ছিল একেবারে আদর্শ। কাছেই ঘন জঙ্গলে বন্য জন্তু ফলপাকুড়ের অভাব নেই। মানে, খাওয়ার জন্য বেশি দূর যেতে হত না। একাধিক জলের সূত্র থাকায় জলেরও অভাব ছিল না। আর ছিল প্রকৃতির প্রকোপ থেকে রক্ষা করার মতো গুহা, বা আশ্রয়। সুতরাং এখানে যে আদিমানুষ বহুকাল ধরে বসবাস করেছে তা খুব আশ্চর্যের নয়। প্রথমে তার আগুন ছিল না।
চকমকি পাথর ঘষে হঠাৎ একদিন সে আগুন আবিষ্কার করে। সেখানেই অ্যাডভেঞ্চার শেষ হয়নি। প্রস্তর যুগের মানুষ পাথরের ফলার খোজ পায় একদিন। লম্বা লাঠির ডগায় পাথরের ধারালো ফলক লাগিয়ে আদিমানুষ তেরি করে শিকার করার উন্নত হাতিয়ার। ভীমবৈঠকার মাটিতে ছোট ছোট ধারালো পাথরের কুচি পড়ে থাকতে দেখা যায়, যদিও কাছের বারখেড়াতে এই পাথর বেশি করে পাওয়া যায় বলে জানা গিয়েছে। আমাদের হাতে পাথরের টুকরো দিয়ে পাওয়ারজি বললেন, সাবধান, হাত কেটে যেতে পারে কিন্তু। সাবধানে কাগজে মুড়ে রেখে দিলাম সাদা পাথরের টুকরো, সেটা এখন আমার কলকাতার বাড়ির ড্রেসিং টেবিলে শোভা পাচ্ছে।
এবার আমরা দাঁড়িয়েছি নিচু এক গুহার সামনে। প্রকাণ্ড পাথরের দেয়াল গোল হয়ে নীচের দিকে ঢুকে যাওয়ায় একটা পাথরের তাক তৈরি হয়েছে। সেই তাকের তলার দিকে সাদা রং দিয়ে আকা অসংখ্য জন্তু জানোয়ারের ছবি। গরু মোষ তো রয়েইছে, একটু খেয়াল করলে চিতল বারাসিংহাও দেখতে পাওয়া যায়। পাথরের গায়ে ভিড় জমিয়েছে কত রকমের পশু। ভ্যাটিকানের সিসটিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে মিকেলাঞ্জেলোর জিনিয়াস প্রত্যক্ষ করলে যেমন হতভম্ব লাগে, ভীমবৈঠকার গুহায় এই চিড়িয়াখানা দেখে তার চেয়ে কিছু কম হতবাক লাগে না। অথচ, ছবিগুলো যেখানে আছে সেখানে পৌছতে হলে প্রায় চিত হয়ে শুয়ে ছবি আকতে হত। সামান্য ছবি আকার জন্যে আদিমানুষ কি এত কষ্ট করেছে? কী মনে করে ছবি একেছে সে? হয়তো পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বন্য জন্তুদের চরে বেড়াতে দেখে সেই দৃশ্য মনে ধরেছিল, ঘরে ফিরে সেটাই পাথরে ধরে রেখেছিল আদিমানব।
ভীমবৈঠকার গুহাচিত্র থেকে আদিমানুষের জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে জীবনযাপন করত ওরা। তার পর শিকার করা শুরু হল প্রাণধারণের তাগিদে। তবে সব ছবিই যে আদিমানুষের জীবন কাহিনীর চিত্র এমন নাও হতে পারে। পাহাড়ের ওপর থেকে ওরা অনায়াসে দেখতে পেত নীচের উপত্যকায় কী কী ঘটছে। অনেক সময় গুহার গায়ে সেই গল্পও একে রেখেছে ওরা। সেক্ষেত্রে বলতে হয় আদিমানুষ অনেক যুদ্ধ দেখেছে। ছবি থেকে বেশ বোঝা যায়, এক দল ঘোড়ার পিঠে চড়ে আক্রমণ করতে আসছে, অন্য দল মোষ জাতীয় জন্তুর পিঠে বসে লড়াই করছে। ছবিগুলো কখনও লাল, কখনও সাদা আবার কখনও লাল সাদা দুটো রঙ দিয়ে আকা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় হলদে আর নীল রঙও ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এই শেষের ছবিগুলো খুব স্পষ্ট নয়। পাওয়ারজি দেখালেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে এক পরত ছবির ওপর নতুন করে ছবি আকা হয়েছে। আদিমানুষ যখন শিকার করত না কিংবা ছবি আকত না তখন তারা কী করত? এই প্রেশ্নর উত্তর গুহাচিত্র থেকেই পাওয়া যায়। এক দেওয়ালে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একজন ঢোল বাজাচ্ছে আর তার সামনে হাত ধরাধরি করে অনেকে মিলে নাচছে। এখনও আদিবাসিরা যে ভাবে নাচে, ঠিক সেই ভাবে।
তা সেত্ত্বও আদিবাসীরা ভীমবৈঠকাকে ভাল চোখে দেখে না। ভীমবৈঠকা থেকে বারখেড়া যাওয়ার পথে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো গ্রাম দেখা যায়। সবুজের ওপর লাল টালির ঘর। আর নয়তো রাস্তার ধার ঘেষে জমিতে ভুট্টা চাষ করছে। ছোট্ট ক্ষেত পেরোলেই ওদের ঘর। প্রজেন্মর পর প্রজন্ম ধরে ওরা এইখানেই রয়েছে। চাষবাস করলেও আদিমানুষের মত এরাও জীবনযাপনের জন্যে জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে; প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছে, আর এই কারণেই ভীমবৈঠকা ওয়াল্ডর্ হেরিটেজ তালিকা ভুক্ত হয়েছে। আদিবাসিদের ধারণা ভীমবৈঠকার ছবি যারা একেছে তারা কেউ স্থানীয় লোক ছিল না। বাইরে থেকে লোক এসে ছবিগুলো একে দিয়ে গিয়েছে। এখন আমরা জানি এ কথা সত্যি নয়। কিছুকাল হল ভীমবৈঠকার মাটির নীচে মানুষের কবর পাওয়া যায়। আপাতত আদিমানুষের সাত ফুট লম্বা একটা কঙ্কাল কলকাতার জাতীয় জাদুঘরে রাখা রয়েছে।
কখনও মাটির একেবারে কাছে, কখনও অনেক ওপরে, আদিমানব এইভাবেই নানা জায়গায় ছবি একে রেখে গিয়েছে। কত সময় পেরিয়েছে। ছবির আঙ্গিকে পরিবর্তন আমার মতো আনাড়িরও চোখে পড়ে। রোগা কাঠি হাত পায়ের বদলে ঘোড়ার ওপর যারা বসে আছে তাদের মাথার পাগড়ি থুতনির দাড়ি সব পরিষ্কার বোঝা যায়। তার পর এক সময় সাধুবাবার আবির্ভাব ঘটেছে। সে কথাও ছবিতে লেখা আছে। চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলতে িদ্বধা নেই ভীমবৈঠকার শিল্পীরা নিঃসেন্দহে পৃথিবীর প্রথম সারির শিল্পী। চোখমুখ দেখা যাচ্ছে না, অথচ পাথরের ওপর মানুষের অনুভূতি, আক্রমণের গতি এই সব স্পষ্ট ধরা পড়েছে। দেখতে দেখতে ঘোর লেগে গিয়েছে। চটকা ভাঙল পাওয়ারজির কথায়।
‘‘গুহাচিত্র এখানেই শেষ, তবে ও পাশে মন্দির আছে, চলে যাওয়ার আগে দেখে যাবেন।’’ আমরা চললাম মিন্দরের খোজে। গুহার চত্বর থেকে খুব দূরে নয়। অদ্ভুত পরিবেশ। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। মাঝেমাঝে বিরাট এক একটা পাথর উচু হয়ে দাড়িয়ে। ঝড়জল আর হাওয়ার উৎপাতে ক্ষয়ে বিচিত্র কারুকাজের মতো দেখাচ্ছে। বেশি দূর যেতে হল না। সামনেই পাওয়া গেল বৈেষ্ণাদেবীর মন্দির। প্রাচীন মূর্তি ভেঙে গিয়েছে। সে গাছতলায় আশ্রয় পেয়েছে। এখন মিন্দরের মধ্যে নতুন বিগ্রহ। পাশের গুহার মধ্যে পুরোহিত মশাইয়ের বাস। আশেপাশে কোনও বসতি নেই। ওঁদের দাবি, সেই পাণ্ডবদের সময় থেকেই এই মন্দির রয়েছে। আমরা তর্কের মধ্যে গেলাম না। আদিমানবের যে কীর্তি দেখে এসেছি তাতে গতানুগতিক যুক্তিবোধ অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে। অর্ধেক মন যেন মেনে নিতে রাজিই আছে ভীমবৈঠকার ওই মন্দির পাণ্ডবদের আমলেরই। প্রগৈতিহাসের অলিগলিতে নিজেদের পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার আগে ফেরাই বাঞ্ছনীয় মনে করলাম। শরতের সূর্য তখনও ঢলে পড়েনি। আমরা আদিমানুষের অবিস্মরণীয় আর রহস্যময় জগৎ ছেড়ে নিতান্তই গড়পড়তা পৃথিবীতে ফেরার ব্যবস্থা করতে শুরু করলাম।
No comments:
Post a Comment