দিগন্তবিস্তৃত সবুজ, এক পাশে হাকালুকি হাওরের হাতছানি মাধবকুণ্ড
জলপ্রপাতের কথা জানি। কিন্তু মাধবছড়া! না, এটা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার কাছ থেকেই প্রথম স্থানটি সম্পর্কে জানা। তারপর
একদিন ভরদুপুরে মাধবছড়ার পথে বেরিয়ে পড়া। মৌলভীবাজার-চান্দগ্রাম সড়কের
বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলি থেকে মাধবকুণ্ডে যাওয়ার যে পথ, সেই পথেই মাধবছড়া।
মাধবকুণ্ডে যাওয়ার আগে একটি বাঁক আছে। সেই বাঁক থেকে সোজা পূর্বমুখী এগিয়ে
গ্রামীণ পথ ধরে যেতে যেতে যেখানে পথ বলে দিল এবার থামো, সেখান থেকেই আসলে
মাধবছড়ার শুরু।
কাছেপিঠে তেমন কাউকে না পেয়ে অনেকটা অনুমাননির্ভর একটি পাহাড়ি ছড়ায় নামলাম। ছড়ায় ক্ষীণ জলধারা বইছে। পায়ে ছোট ছোট পাথরের খোঁচা সত্ত্বেও ঠান্ডা পানির ছোঁয়া ভালোই লাগে। তবে ছড়ায় বেশি দূর যেতে হয় না—এই পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটলেই চলে। তারপর পাহাড়ি পথ। আর থমকে দাঁড়ানোর দরকার নেই। পথই পাহাড়ের চূড়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়। দুই পাশে গাছপালা, অনেক ধরনের বুনো গাছ। বুনো ফুল। লতাপাতা। মাঝেমধ্যে দু-একটা পাখির ডাক। পাহাড়ের পথেই দেখা বড়লেখার পরনগর গ্রামের আবু তাহেরের (৫৫) সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আগে এখানে বন ছিল। বনের মধ্যে অল্প অল্প বাঁশ। বনে বাঘ দেখা যেত। ভয়ে আসতাম না।’
তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবছড়া পাহাড়ে একসময় বিশাল জঙ্গল ছিল। বনজ বিভিন্ন জাতের চেনা-অচেনা গাছপালা ও মুলি বাঁশের ঝাড় ছিল। বাঘ, হাতি, ভালুক, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য পশু এখানে অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছে। সমতলভূমি থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উচ্চতায় সেখানে মানুষের বিচরণ ছিল কম। এখন সেখানে প্রাকৃতিক গাছ, লতাপাতা ধ্বংস করে করা হয়েছে সামাজিক বনায়ন। লাগানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব নয় এমন একাশিয়া বা আকাশমণি জাতের গাছ। যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মে বনজ গাছপালার পুনরুৎপাদন হওয়ার কথা, সেখানে এত উঁচুতে সামাজিক বনায়ন কেন, বোঝা গেল না। বড়লেখার মাঠ গুদাম এলাকার মো. আবদুস শহীদ (৪০) বললেন, ‘এই পাহাড়ে লতাগুল্ম আর বাঁশবন ছিল। হরিণ, বনমোরগ, শূকর, হাতি দেখা যেত। সামাজিক বনায়নের পর বন্য প্রাণী কম দেখা যায়। বন পরিষ্কার করায় লুকানোর জায়গা নেই। থাকবে কোথায়? তবে বছরে একবার বৈশাখ মাসে গাছপালায় নতুন পাতা গজালে খাওয়ার জন্য ওপার (ভারতীয় বন এলাকা) থেকে হাতির দল আসে।’ কেমন শিহরণ লাগে। যদি হঠাৎ সামনে পথ আগলে দাঁড়ায় বুনো হাতির দল! কিংবা বুনো শূকর! আবার চমক দিয়ে রঙিন পালক নাচিয়ে ডেকে উঠতে পারে হঠাৎ কোনো বনমোরগ। হয়তো বা ঝাঁকবেঁধে ছুটতে পারে পাতার ফাঁকে!
যতই ওপরে উঠতে থাকি, যেন চোখ খুলতে থাকে। যেন নিজেকে ছাড়িয়ে আরও ওপরে, আরও কোনো চূড়ার দিকে যাত্রা। দুই পাশে ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিপোকা, অচেনা পাখির ডাক। রংবেরঙের প্রজাপতির ওড়াউড়ি। চলার পথ অনেকটাই ঢালু মতো, আবার কিছু কিছু জায়গা খাড়া। তবু উঠতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। একসময় চূড়ায় উঠলে চড়াই-উতরাই পথের কষ্ট আর মনেই থাকে না। পাহাড়ের ওপর আকাশমণি বা একাশিয়ার গাছ বেড়ে উঠছে। তবু ছায়ানিবিড় একটা পরিবেশ। শুনেছি, এই গাছ ১৪-১৫ বছরের হলে কেটে ফেলা হবে। আবার বনায়ন হবে। এতে হয়তো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টাকার জোগান আসবে। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এ রকমই বলেন পরিবেশসচেতন লোকজন। এই গাছে তো আর সব পাখি বসবে না, সব পাখি বাসা বাঁধবে না, গান গাইবে না। ঝোপ-জঙ্গল নেই তো বুনো পশুর দল থাকবে কোথায়? দেখা গেল বেশ কিছু পেঁপেগাছ। ব্রিটিশ আমলে খনন করা একটি পরিত্যক্ত তেলকূপের ইটের স্থাপনার অংশ লতাপাতার ফাঁকে জেগে আছে। পাহাড়চূড়া থেকে যেদিকেই চোখ যায় দিগন্তজোড়া সবুজ। অনেক দূরে হাকালুকি হাওরের আভাস। কেমন ধু-ধু সবুজের বিস্তার। মাধবছড়ায় জলপ্রপাত নেই। তাতে কী! চোখ মেলে কেবল চারপাশ দেখুন। চমকে উঠবেন, ঘন সবুজের প্রাচুর্য দেখে। মাধবছড়া আর মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাশাপাশিই। তবু আলাদা মাধুর্যের পাঠ। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত দেখে একবার মাধবছড়ায় ঘুরে আসা যায় যেমন, তেমনি মাধবছড়ার নিরিবিলিতেই দিনের আলোর পুরো সময়টি কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবে সন্ধ্যার আগেভাগেই পাহাড় ছেড়ে নেমে এলে ভালো।
যাবেন যেভাবে
মাধবছড়ায় যাওয়া যায় মাধবকুণ্ডের পথেই। মাধবকুণ্ডে যাওয়ার আগে মাধবছড়ার পথ। পথই টেনে নিয়ে যাবে। এখানে থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশিক্ষণ থাকলে সঙ্গে হালকা খাবার, পানি—এসব নিয়ে গেলে ভালো। বনে হাঁটার উপযোগী জুতা পরবেন। বৃষ্টির সময় সঙ্গে ছাতা থাকাও দরকার। আর মাধবকুণ্ডে যাওয়ার রাস্তা মৌলভীবাজার-চান্দগ্রাম সড়কের কাঁঠালতলি থেকে। এখানে আসা যেতে পারে সড়কপথে বাস বা ব্যক্তিগত গাড়িতে। নতুবা ট্রেনে করে কুলাউড়া জংশন। তারপর অন্য কোনো যানবাহনে।
কাছেপিঠে তেমন কাউকে না পেয়ে অনেকটা অনুমাননির্ভর একটি পাহাড়ি ছড়ায় নামলাম। ছড়ায় ক্ষীণ জলধারা বইছে। পায়ে ছোট ছোট পাথরের খোঁচা সত্ত্বেও ঠান্ডা পানির ছোঁয়া ভালোই লাগে। তবে ছড়ায় বেশি দূর যেতে হয় না—এই পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটলেই চলে। তারপর পাহাড়ি পথ। আর থমকে দাঁড়ানোর দরকার নেই। পথই পাহাড়ের চূড়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়। দুই পাশে গাছপালা, অনেক ধরনের বুনো গাছ। বুনো ফুল। লতাপাতা। মাঝেমধ্যে দু-একটা পাখির ডাক। পাহাড়ের পথেই দেখা বড়লেখার পরনগর গ্রামের আবু তাহেরের (৫৫) সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আগে এখানে বন ছিল। বনের মধ্যে অল্প অল্প বাঁশ। বনে বাঘ দেখা যেত। ভয়ে আসতাম না।’
তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবছড়া পাহাড়ে একসময় বিশাল জঙ্গল ছিল। বনজ বিভিন্ন জাতের চেনা-অচেনা গাছপালা ও মুলি বাঁশের ঝাড় ছিল। বাঘ, হাতি, ভালুক, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য পশু এখানে অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছে। সমতলভূমি থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উচ্চতায় সেখানে মানুষের বিচরণ ছিল কম। এখন সেখানে প্রাকৃতিক গাছ, লতাপাতা ধ্বংস করে করা হয়েছে সামাজিক বনায়ন। লাগানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব নয় এমন একাশিয়া বা আকাশমণি জাতের গাছ। যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মে বনজ গাছপালার পুনরুৎপাদন হওয়ার কথা, সেখানে এত উঁচুতে সামাজিক বনায়ন কেন, বোঝা গেল না। বড়লেখার মাঠ গুদাম এলাকার মো. আবদুস শহীদ (৪০) বললেন, ‘এই পাহাড়ে লতাগুল্ম আর বাঁশবন ছিল। হরিণ, বনমোরগ, শূকর, হাতি দেখা যেত। সামাজিক বনায়নের পর বন্য প্রাণী কম দেখা যায়। বন পরিষ্কার করায় লুকানোর জায়গা নেই। থাকবে কোথায়? তবে বছরে একবার বৈশাখ মাসে গাছপালায় নতুন পাতা গজালে খাওয়ার জন্য ওপার (ভারতীয় বন এলাকা) থেকে হাতির দল আসে।’ কেমন শিহরণ লাগে। যদি হঠাৎ সামনে পথ আগলে দাঁড়ায় বুনো হাতির দল! কিংবা বুনো শূকর! আবার চমক দিয়ে রঙিন পালক নাচিয়ে ডেকে উঠতে পারে হঠাৎ কোনো বনমোরগ। হয়তো বা ঝাঁকবেঁধে ছুটতে পারে পাতার ফাঁকে!
যতই ওপরে উঠতে থাকি, যেন চোখ খুলতে থাকে। যেন নিজেকে ছাড়িয়ে আরও ওপরে, আরও কোনো চূড়ার দিকে যাত্রা। দুই পাশে ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিপোকা, অচেনা পাখির ডাক। রংবেরঙের প্রজাপতির ওড়াউড়ি। চলার পথ অনেকটাই ঢালু মতো, আবার কিছু কিছু জায়গা খাড়া। তবু উঠতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। একসময় চূড়ায় উঠলে চড়াই-উতরাই পথের কষ্ট আর মনেই থাকে না। পাহাড়ের ওপর আকাশমণি বা একাশিয়ার গাছ বেড়ে উঠছে। তবু ছায়ানিবিড় একটা পরিবেশ। শুনেছি, এই গাছ ১৪-১৫ বছরের হলে কেটে ফেলা হবে। আবার বনায়ন হবে। এতে হয়তো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টাকার জোগান আসবে। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এ রকমই বলেন পরিবেশসচেতন লোকজন। এই গাছে তো আর সব পাখি বসবে না, সব পাখি বাসা বাঁধবে না, গান গাইবে না। ঝোপ-জঙ্গল নেই তো বুনো পশুর দল থাকবে কোথায়? দেখা গেল বেশ কিছু পেঁপেগাছ। ব্রিটিশ আমলে খনন করা একটি পরিত্যক্ত তেলকূপের ইটের স্থাপনার অংশ লতাপাতার ফাঁকে জেগে আছে। পাহাড়চূড়া থেকে যেদিকেই চোখ যায় দিগন্তজোড়া সবুজ। অনেক দূরে হাকালুকি হাওরের আভাস। কেমন ধু-ধু সবুজের বিস্তার। মাধবছড়ায় জলপ্রপাত নেই। তাতে কী! চোখ মেলে কেবল চারপাশ দেখুন। চমকে উঠবেন, ঘন সবুজের প্রাচুর্য দেখে। মাধবছড়া আর মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাশাপাশিই। তবু আলাদা মাধুর্যের পাঠ। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত দেখে একবার মাধবছড়ায় ঘুরে আসা যায় যেমন, তেমনি মাধবছড়ার নিরিবিলিতেই দিনের আলোর পুরো সময়টি কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবে সন্ধ্যার আগেভাগেই পাহাড় ছেড়ে নেমে এলে ভালো।
যাবেন যেভাবে
মাধবছড়ায় যাওয়া যায় মাধবকুণ্ডের পথেই। মাধবকুণ্ডে যাওয়ার আগে মাধবছড়ার পথ। পথই টেনে নিয়ে যাবে। এখানে থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশিক্ষণ থাকলে সঙ্গে হালকা খাবার, পানি—এসব নিয়ে গেলে ভালো। বনে হাঁটার উপযোগী জুতা পরবেন। বৃষ্টির সময় সঙ্গে ছাতা থাকাও দরকার। আর মাধবকুণ্ডে যাওয়ার রাস্তা মৌলভীবাজার-চান্দগ্রাম সড়কের কাঁঠালতলি থেকে। এখানে আসা যেতে পারে সড়কপথে বাস বা ব্যক্তিগত গাড়িতে। নতুবা ট্রেনে করে কুলাউড়া জংশন। তারপর অন্য কোনো যানবাহনে।
No comments:
Post a Comment