গ্রিসের এথেন্সজুড়ে রয়েছে অনেক স্কয়ার।
স্কয়ারগুলোর মধ্যমণি বলা যায় সিনথাগমাকে। স্কয়ারের ওপরে পার্লামেন্ট ভবন, নিচে পাতাল ট্রেন, স্কয়ারের আশপাশেই বিভিন্ন রুটের বাস, তাই লোকসমাগম সর্বক্ষণ। স্কয়ারের ভেতর বিশাল জায়গাজুড়ে গাছের ছায়ায় বেঞ্চ পাতা। ক্লান্ত পথচারীদের ক্ষণিক অবসর নেওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। পার্লামেন্ট ভবনের ধার দিয়েই প্রশস্ত রাস্তা। রাস্তা পার হয়ে প্রশস্ত শ্বেতপাথরের বেদিগুলোর পরই স্কয়ার।
সিনথাগমা স্কয়ারের বাংলা প্রতিশব্দ ‘সংবিধান চত্বর’।
স্কয়ারের ওপর বর্তমান পার্লামেন্ট ভবনটি ছিল তৎকালীন রাজপ্রাসাদ।
সিনথাগমা স্কয়ারের পাশেই হোটেল ‘গ্রান্ডে ব্রেটগনে’। ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৬২ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভবনটিকে সামরিক দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ভবনেই একসময় এসেছিলেন হিটলার, হিমলার, গোয়েরিং, জেনারেল রোমেল প্রমুখ। এসেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং এ ভবনেই এক টন ডিনামাইট বিস্কোরণ ঘটিয়ে চার্চিলকে হত্যার এক পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
সারা দিন ঘোরাফেরা করে শেষে সিনথাগমার শ্বেতপাথরের বেদিতে বসেছিলাম।
বসেছিলেন আরও অনেকে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, দিনের প্রচণ্ড গরমের পর ঝিরঝির বাতাস বইছে। স্কয়ারের ভেতর বিজলিবাতিগুলো জ্বলে উঠলেও চারদিক একটু আলো-আঁধারি। একটি মেয়ে এসে পাশের বেদিতে বসল। পরনে সংক্ষিপ্ত স্কার্ট। পায়ে প্রাচীন গ্রিসের ঘরানার পেঁচানো সেন্ডেল, যেন গ্রিক ভাস্কর্য। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলাম মধ্যবয়সী একজন মাথা নিচু করে বেদিতে বসে আছেন। চারদিক আনন্দ কোলাহলের মধ্যেও কী যেন এক বিষণ্নতায় ভরা মুখ। চোখাচোখি হতেই উঠে এসে পাশে বসে বললেন, ‘আপনি কি বাঙালি?’ এভাবেই অজিতের সঙ্গে পরিচয়। ১৯ বছর ধরে আছেন এথেন্সে, আজও স্থায়ী চাকরি হয়নি। যৌবনের প্রারম্ভেই বিক্রমপুর থেকে চলে এসেছিলেন এখানে; আছেন এভাবেই। এভাবেই হয়তো জীবন কেটে যাবে। দেশে মায়ের কথা মনে হয়। দেশে যাওয়া হয়নি, তবে হয়তো যাবেন। বললাম, ‘এখানে কি প্রায়ই আসেন?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলেন, ‘আমাকে আসতেই হয়।’ দীর্ঘশ্বাসটি জানিয়ে দিল কী এক অজানা আকর্ষণ সিনথাগমা স্কয়ার তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
এই চত্বরেই অজিতের পরিচয় হয়েছিল সিনথিয়ার সঙ্গে।
অজিত তখন সবে বিক্রমপুর থেকে এসেছেন; যা দেখছেন, তা-ই ভালো লাগছে। চারদিক কত ছিমছাম, কত জৌলুশ। বিক্রমপুরের মতো নয়। তবে দেশের জন্য একটু মন খারাপ হতো। মায়ের কথা মনে হতো। বাবা নেই, মা একেবারে একা। একটি বোন আছে, তারও বিয়ে হয়ে গেছে। এই মন খারাপ করা সময়েই দেখা হয়েছিল সিনথিয়ার সঙ্গে। সিনথিয়া চাকরি করতেন বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, সেলস কাউন্টারে। সিনথাগমা স্কয়ার দিয়েই তাঁকে যাতায়াত করতে হতো। রোজই তাঁকে স্টোর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন। ওই পথটুকুতেই অনেক কথা হতো, বর্তমান-ভবিষ্যৎ। অজিত কাজ করতেন একটি হোটেলে। এভাবেই সিনথিয়ার সঙ্গে প্রেম। তারপর বিয়ে। বিয়েতে ধুমধাম না হলেও মনটা ভরে ছিল ভালোবাসায়। বিয়ের পর দুজনই চাকরি ছেড়ে জমানো টাকা আর ব্যাংক থেকে কিছু টাকা নিয়ে হোটেল খুলে বসেন। প্রথম প্রথম ভালোই যাচ্ছিল ব্যবসা। তার পরই কেমন করে যেন ধস নামে। এর মধ্যেই বিজিত এসে গেছে। বিজিত উভয়ের ভালোবাসার ফসল। ব্যবসার ধস যেন ধীরে ধীরে মনেও ধস নামায়। সিনথিয়াও যেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। তারপর একদিন এই সিনথাগমার পাতাল ট্রেন ধরে ছেলেকে নিয়ে সিনথিয়া চলে যান অন্য এক শহরে। সেই থেকে অজিত একা। এভাবেই চলে গেছে ১২টি বছর। সিনথিয়া আর ছেলের খবর অজিত জানেন না, তবে শুনেছেন ছেলে বড় হয়েছে। হয়তো কোনো সময় আত্মজের সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারে। সিনথাগমা স্কয়ার শুধু হিটলার, হিমলার, রোমেল, চার্চিলের পদচারণায় প্রকম্পিত নয়, অজিতদের দীর্ঘশ্বাসেও আবর্তিত। প্রশ্ন করেছিলাম, সিনথিয়া আর বিজিতের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সম্ভাবনা নেই, তবে কত লোকই তো এই স্কয়ার দিয়ে যায়-আসে, হয়তো দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে। তবে আজ অজিতের মনটা একটু বেশি খারাপ, আজ বিজিতের জন্মদিন। কেমন আছে ছেলেটা কে জানে! ভালোবাসা দিয়ে হয়তো সবকিছুই জয় করা যায় না, কোনো না কোনো সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশীয় আচার-আচরণ সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। অজিত আর সিনথিয়াকেও করেছিল।
যে কয়দিন এথেন্সে ছিলাম, সিনথাগমা স্কয়ারে গিয়েছি আরও অনেকবার। কারণ ওই স্কয়ার দিয়েই আমাকে যাতায়াত করতে হতো। শ্বেতপাথরের বেদিতে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা; কিন্তু অজিতের আর দেখা পাইনি। প্রবাসী অজিতেরা এভাবেই হারিয়ে যায়।
স্কয়ারগুলোর মধ্যমণি বলা যায় সিনথাগমাকে। স্কয়ারের ওপরে পার্লামেন্ট ভবন, নিচে পাতাল ট্রেন, স্কয়ারের আশপাশেই বিভিন্ন রুটের বাস, তাই লোকসমাগম সর্বক্ষণ। স্কয়ারের ভেতর বিশাল জায়গাজুড়ে গাছের ছায়ায় বেঞ্চ পাতা। ক্লান্ত পথচারীদের ক্ষণিক অবসর নেওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। পার্লামেন্ট ভবনের ধার দিয়েই প্রশস্ত রাস্তা। রাস্তা পার হয়ে প্রশস্ত শ্বেতপাথরের বেদিগুলোর পরই স্কয়ার।
সিনথাগমা স্কয়ারের বাংলা প্রতিশব্দ ‘সংবিধান চত্বর’।
স্কয়ারের ওপর বর্তমান পার্লামেন্ট ভবনটি ছিল তৎকালীন রাজপ্রাসাদ।
সিনথাগমা স্কয়ারের পাশেই হোটেল ‘গ্রান্ডে ব্রেটগনে’। ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৬২ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভবনটিকে সামরিক দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ভবনেই একসময় এসেছিলেন হিটলার, হিমলার, গোয়েরিং, জেনারেল রোমেল প্রমুখ। এসেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং এ ভবনেই এক টন ডিনামাইট বিস্কোরণ ঘটিয়ে চার্চিলকে হত্যার এক পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
সারা দিন ঘোরাফেরা করে শেষে সিনথাগমার শ্বেতপাথরের বেদিতে বসেছিলাম।
বসেছিলেন আরও অনেকে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, দিনের প্রচণ্ড গরমের পর ঝিরঝির বাতাস বইছে। স্কয়ারের ভেতর বিজলিবাতিগুলো জ্বলে উঠলেও চারদিক একটু আলো-আঁধারি। একটি মেয়ে এসে পাশের বেদিতে বসল। পরনে সংক্ষিপ্ত স্কার্ট। পায়ে প্রাচীন গ্রিসের ঘরানার পেঁচানো সেন্ডেল, যেন গ্রিক ভাস্কর্য। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলাম মধ্যবয়সী একজন মাথা নিচু করে বেদিতে বসে আছেন। চারদিক আনন্দ কোলাহলের মধ্যেও কী যেন এক বিষণ্নতায় ভরা মুখ। চোখাচোখি হতেই উঠে এসে পাশে বসে বললেন, ‘আপনি কি বাঙালি?’ এভাবেই অজিতের সঙ্গে পরিচয়। ১৯ বছর ধরে আছেন এথেন্সে, আজও স্থায়ী চাকরি হয়নি। যৌবনের প্রারম্ভেই বিক্রমপুর থেকে চলে এসেছিলেন এখানে; আছেন এভাবেই। এভাবেই হয়তো জীবন কেটে যাবে। দেশে মায়ের কথা মনে হয়। দেশে যাওয়া হয়নি, তবে হয়তো যাবেন। বললাম, ‘এখানে কি প্রায়ই আসেন?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলেন, ‘আমাকে আসতেই হয়।’ দীর্ঘশ্বাসটি জানিয়ে দিল কী এক অজানা আকর্ষণ সিনথাগমা স্কয়ার তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
এই চত্বরেই অজিতের পরিচয় হয়েছিল সিনথিয়ার সঙ্গে।
অজিত তখন সবে বিক্রমপুর থেকে এসেছেন; যা দেখছেন, তা-ই ভালো লাগছে। চারদিক কত ছিমছাম, কত জৌলুশ। বিক্রমপুরের মতো নয়। তবে দেশের জন্য একটু মন খারাপ হতো। মায়ের কথা মনে হতো। বাবা নেই, মা একেবারে একা। একটি বোন আছে, তারও বিয়ে হয়ে গেছে। এই মন খারাপ করা সময়েই দেখা হয়েছিল সিনথিয়ার সঙ্গে। সিনথিয়া চাকরি করতেন বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, সেলস কাউন্টারে। সিনথাগমা স্কয়ার দিয়েই তাঁকে যাতায়াত করতে হতো। রোজই তাঁকে স্টোর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন। ওই পথটুকুতেই অনেক কথা হতো, বর্তমান-ভবিষ্যৎ। অজিত কাজ করতেন একটি হোটেলে। এভাবেই সিনথিয়ার সঙ্গে প্রেম। তারপর বিয়ে। বিয়েতে ধুমধাম না হলেও মনটা ভরে ছিল ভালোবাসায়। বিয়ের পর দুজনই চাকরি ছেড়ে জমানো টাকা আর ব্যাংক থেকে কিছু টাকা নিয়ে হোটেল খুলে বসেন। প্রথম প্রথম ভালোই যাচ্ছিল ব্যবসা। তার পরই কেমন করে যেন ধস নামে। এর মধ্যেই বিজিত এসে গেছে। বিজিত উভয়ের ভালোবাসার ফসল। ব্যবসার ধস যেন ধীরে ধীরে মনেও ধস নামায়। সিনথিয়াও যেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। তারপর একদিন এই সিনথাগমার পাতাল ট্রেন ধরে ছেলেকে নিয়ে সিনথিয়া চলে যান অন্য এক শহরে। সেই থেকে অজিত একা। এভাবেই চলে গেছে ১২টি বছর। সিনথিয়া আর ছেলের খবর অজিত জানেন না, তবে শুনেছেন ছেলে বড় হয়েছে। হয়তো কোনো সময় আত্মজের সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারে। সিনথাগমা স্কয়ার শুধু হিটলার, হিমলার, রোমেল, চার্চিলের পদচারণায় প্রকম্পিত নয়, অজিতদের দীর্ঘশ্বাসেও আবর্তিত। প্রশ্ন করেছিলাম, সিনথিয়া আর বিজিতের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সম্ভাবনা নেই, তবে কত লোকই তো এই স্কয়ার দিয়ে যায়-আসে, হয়তো দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে। তবে আজ অজিতের মনটা একটু বেশি খারাপ, আজ বিজিতের জন্মদিন। কেমন আছে ছেলেটা কে জানে! ভালোবাসা দিয়ে হয়তো সবকিছুই জয় করা যায় না, কোনো না কোনো সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশীয় আচার-আচরণ সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। অজিত আর সিনথিয়াকেও করেছিল।
যে কয়দিন এথেন্সে ছিলাম, সিনথাগমা স্কয়ারে গিয়েছি আরও অনেকবার। কারণ ওই স্কয়ার দিয়েই আমাকে যাতায়াত করতে হতো। শ্বেতপাথরের বেদিতে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা; কিন্তু অজিতের আর দেখা পাইনি। প্রবাসী অজিতেরা এভাবেই হারিয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment