গাড়ি চলে না। চলে না রে। কানসাটে পৌঁছে আমাদের গাড়ি থেমে যায়। গাড়ির জানালা খুলে গলা বাড়াই। সামনে কী হয়েছে ভাই? লোকটা জবাব দেয়, আম।
আমরা লক্ষ করি। সামনে আম। পেছনে আম। ডানে বামে সর্বত্র আমের গাড়ি।
বাইসাইকেলের দুই পাশে বিশাল ঝুড়ি ভরা আম। ভ্যানে আম। ট্রাকে আম। বাসে আম। আম আর আম।
শিবগঞ্জের কানসাটে বিশাল আমের বাজার। আমরা জ্যামে পড়েছি। এ জ্যাম শুধুই আমের কারণে। যানজট নয়। একে আমজট বলা যায়।
আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দুজন মান্যবর ব্যক্তি বললেন, ঢাকা শহরে দেখা যায়, বিশাল আমের মেলা। ব্যানার টাঙিয়ে আম বিক্রি হচ্ছে। ব্যানারে লেখা, রাজশাহীর আমের মেলা। এত মিথ্যে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হচ্ছে আমের রাজধানী। আমের সাম্রাজ্য। লেখা উচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম।
পরের দিন সকাল ১০টায় আমরা আমের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করি। শহর থেকে দুই কিলোমিটার পরই শুরু হয় এই সাম্রাজ্য। আমরা আমাদের দুই চোখে বিস্ময় নিয়ে দেখছি আমগাছ। ডাল ভরে ঝুলে আছে নানা জাতের আম। আমের ভারে কোনো কোনো ডালকে বাঁশ দিয়ে ঠেকনা দেওয়া হয়েছে। যাতে ভেঙে না পড়ে।
মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। রাস্তার দুই পাশে আমগাছ ছাড়া বিশেষ কোনো গাছই চোখে পড়ছে না। কোনো কোনো গাছ দেখে মনে হচ্ছে গাছে পাতার চেয়ে আমই বেশি। গাছগুলোর মধ্যে আম ফলানোর প্রতিযোগিতা যেন। কোন গাছ কত বেশি আম ফলাতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে কানসাট আমের বাজার। প্রতিদিন বসে, আমের মৌসুমে। আমাদের মাইক্রোবাস ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে রাস্তার দুই ধারে আমের গাছ দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল’। ভরা মৌসুমে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে এলে মুকুল না বলে হয়তো আমের কথাই বলতেন।
এক কিলোমিটারজুড়ে আম জ্যাম।
বাজারে আম নিয়ে এসেছে ভ্যানচালক ডালিম। ডালিম নিয়ে এসেছে আম। বাহ্ চমৎকার। ধরা যাক, দু-একটি ইঁদুর এবার (হুট করে মাথায় জীবনানন্দ দাশ এল)
বাড়ি কোথায়?
শিয়ালমারা।
বলে কি! তাহলে তো ইঁদুর নয়, শিয়াল ধরতে হবে।
নিজের গাছের আম?
ডালিম হাসে। যেন পাকা ডালিম ফেটে গেছে। পান খাওয়া দাঁত। জানায়, বাগান থেকে সে মালিকের আম বাজারে পৌঁছে দেয়। আট-দশ কিলোমিটার দূর থেকে বাজারে পৌঁছে দিলে ৩০০ টাকা মজুরি। জালিগাছা থেকে এসেছে আলম। তার সাইকেলের দুই দিকে ঝুলিয়ে এনেছে প্রায় সাড়ে চার মণ আম। সাইকেল ঠেলে এনেছে প্রায় ১০ কিলোমিটার। মালিকের আম। মজুরি ৩০০ টাকা। এ রকম হাজার আলম। হাজার ডালিমের দেখা পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
আমাদের সফরসঙ্গী জুবায়ের কবিরকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে কখন ক্যামেরা নিয়ে নেমে গেছে টেরই পাইনি। গাড়িতে মোহিত কামাল মোবাইলে তাঁর স্ত্রীকে বলছেন, ‘বুঝেছ, আম দেখে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ না এলে আমবাগান যে কী বুঝতেই পারতাম না।’ আনোয়ার হোসেন দিলু ভাইও ছবির পর ছবি তুলছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা হয়েও চোখে তাঁর ঘোর লেগেছে আমাদের মতোই।
প্রায় ৪০ হাজার লোক নাকি আমের কাজের সঙ্গে জড়িত। কেউ আম গাছ থেকে পাড়ে, কেউ ভ্যানে, কেউ সাইকেলে, কেউ মাথায় করে নিয়ে বাজারে যায়। কেউ আমগাছের পরিচর্যা করে, কেউ আমের ঝুড়ি বানায়, আবার কেউ আম ওজন দেওয়ার কাজ করে।
প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা আমজট থেকে মুক্তি পাই। সিদ্ধান্ত হয়, ফেরার সময় অন্য পথে শহরে ফিরব। কারণ, সময় যত বাড়বে, আমজটও তত বাড়বে।
শিবগঞ্জে আছি। সোনা মসজিদ না দেখলে কি হয়?
ছুটে যাই সেখানে। চোখ রাখি সোনা মসজিদে।
নামফলকে লেখা ছোট্ট সোনা মসজিদ। আমি বলি, ‘বড়টা কই’? ‘ওটা মালদহ, ভারতে পড়েছে’। আমার খুব মন খারাপ হয়। বড়টা ভারতে পড়বে কেন?
এর আগেও আমার বেশ কয়েকবার মন খারাপ হয়েছে। নেত্রকোনায় বিরিশিরি গেছি। দূরে পাহাড় দেখে জানতে চেয়েছি। ‘এটা কোথায়?’ উত্তর এসেছে, ‘ওটা ইন্ডিয়ায় পড়েছে।’ এর কোনো মানে হয়!
প্রথম আলোর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন, আমাদের দিলু ভাই বলেন, ‘খাবেন?’
তখন দুপুর। পেট চো চো করছে।
বলি, ‘কী’?
‘হাঁসের মাংস, গরম ভাত?’
‘কোথায়?’
‘সোনারগাঁয়েও খেতে পারেন। শেরাটনেও খেতে পারেন।’
‘মানে?’
মানে বোঝার জন্য তাঁর পেছন পেছন হাঁটি।
সোনা মসজিদের কাছে দুটি ছোট খাবার হোটেল। একটির নাম সোনারগাঁও হোটেল, আরেকটি শেরাটন।
আমরা ছুটি ভোলাহাট উপজেলার দিকে।
দুই চোখ ভরে আমের সাম্রাজ্য দেখতে দেখতে ছুটে বেড়াই। গাছ। ছোট গাছ। মাঝারি গাছ। এক শ-দেড় শ বছরের পুরোনো গাছ। কোনো কোনোটা বটগাছের মতো। অনেক নতুন বাগান হচ্ছে। ধান বা সবজির খেত না করে আমের চাষ শুরু করেছে কেউ কেউ।
দুপুরের পরপর ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশনে পৌঁছাই। এটি বিশাল আমের আড়ত।
যেখানে ৪৮ কেজিতে এক মণ ধরা হয়।
‘কেন?’
আমের ব্যবসায়ী কোরবান জানান, ‘এটা এখানকার প্রথা। এখনো পরিবর্তন হয়নি। আটচল্লিশেই চলছে।’
ভোলাহাটে চোখে পড়ে ছোট্ট একটি আমের বাজার।
বলি, ‘বাজার এত ছোট ক্যানে?’
কোরবান বলেন, ‘এটা হচ্ছে গাছপাকা আমের বাজার। গাছ থেকে পাকা আম পড়ে যায়। এটা সেই আমের বাজার।’
দুটি তথ্য দিই। যে তথ্য ভাবায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে মানুষসমান উচ্চতার হাজার হাজার আমগাছ। হাত বাড়ালেই আম। কিন্তু কেউ কারও গাছের আম ছিঁড়ে নেয় না।
গত রাতে ছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারে। খুব ভোরে উঠেছি। প্রায় ২০০ প্রজাতির আমগাছ সেখানে। ১০-১২ জন মহিলা আম কুড়াচ্ছেন।
হাতে চটের ব্যাগ।
জানতে চাই, ‘কয়টা আম পেলেন?’
‘তিন কেজি হবে।’
আমার নাগরিক মন বলে, কুড়ানোর দরকার কী? ছিঁড়ে নিলেই তো হয়!
কিন্তু ওরা ছিঁড়ে না।
আরও একটি তথ্য। ঝড়ে যদি কাঁচা আম পড়ে যায়, তাহলে যে কেউ সে আম গাছতলা থেকে তুলে নিতে পারে। গাছের মালিক কিছু বলে না। তা সে পাঁচ মণই হোক বা ১০ মণ।
আবার নাগরিক মন আমাকে খোঁচায়। তাহলে তো ঝড় হলে চাঁপাই আসতে হবে। আম কুড়াতে। ছিঃ কী ভাবছি। ঝড়ে আম পড়লে তো আমচাষিদের ক্ষতির সীমা নেই।
আমাদের গাড়ি ছুটে বেড়ায় চাঁপাই সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট উপজেলায়।
সব ধরনের আম্রকাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রায় সবারই চোখেমুখে আনন্দের ছটা। যেন চলছে আমের উৎসব।
মুসলিমপুরের তরিকুলকে বলি, এ তো দেখছি ঈদের আনন্দের মতো। তরিকুল বলেন, ঈদের আনন্দের মতো না। তবে তার চেয়ে কোনো অংশে কমও না।
আমরা ক্ষুধার্ত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে না পৌঁছা পর্যন্ত খাবার সুযোগ হচ্ছে না।
দিলু ভাই বলেন, শহরে না পৌঁছানো পর্যন্ত একটি আম ফিডার খেয়ে নিন।
আমি একটি নরম আম পেছনের দিকে ছিদ্র করে বাচ্চাদের মতো চুষতে থাকি। দারুণ।
‘কী আম এটা।’
দিলু ভাই উত্তর দেন,
‘রানী পসনদ।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের এই মৌসুমটাকে এত পছন্দ করে ফেলি যে তা সব পছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে যায়।
আমরা লক্ষ করি। সামনে আম। পেছনে আম। ডানে বামে সর্বত্র আমের গাড়ি।
বাইসাইকেলের দুই পাশে বিশাল ঝুড়ি ভরা আম। ভ্যানে আম। ট্রাকে আম। বাসে আম। আম আর আম।
শিবগঞ্জের কানসাটে বিশাল আমের বাজার। আমরা জ্যামে পড়েছি। এ জ্যাম শুধুই আমের কারণে। যানজট নয়। একে আমজট বলা যায়।
আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দুজন মান্যবর ব্যক্তি বললেন, ঢাকা শহরে দেখা যায়, বিশাল আমের মেলা। ব্যানার টাঙিয়ে আম বিক্রি হচ্ছে। ব্যানারে লেখা, রাজশাহীর আমের মেলা। এত মিথ্যে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হচ্ছে আমের রাজধানী। আমের সাম্রাজ্য। লেখা উচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম।
পরের দিন সকাল ১০টায় আমরা আমের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করি। শহর থেকে দুই কিলোমিটার পরই শুরু হয় এই সাম্রাজ্য। আমরা আমাদের দুই চোখে বিস্ময় নিয়ে দেখছি আমগাছ। ডাল ভরে ঝুলে আছে নানা জাতের আম। আমের ভারে কোনো কোনো ডালকে বাঁশ দিয়ে ঠেকনা দেওয়া হয়েছে। যাতে ভেঙে না পড়ে।
মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। রাস্তার দুই পাশে আমগাছ ছাড়া বিশেষ কোনো গাছই চোখে পড়ছে না। কোনো কোনো গাছ দেখে মনে হচ্ছে গাছে পাতার চেয়ে আমই বেশি। গাছগুলোর মধ্যে আম ফলানোর প্রতিযোগিতা যেন। কোন গাছ কত বেশি আম ফলাতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে কানসাট আমের বাজার। প্রতিদিন বসে, আমের মৌসুমে। আমাদের মাইক্রোবাস ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে রাস্তার দুই ধারে আমের গাছ দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল’। ভরা মৌসুমে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে এলে মুকুল না বলে হয়তো আমের কথাই বলতেন।
এক কিলোমিটারজুড়ে আম জ্যাম।
বাজারে আম নিয়ে এসেছে ভ্যানচালক ডালিম। ডালিম নিয়ে এসেছে আম। বাহ্ চমৎকার। ধরা যাক, দু-একটি ইঁদুর এবার (হুট করে মাথায় জীবনানন্দ দাশ এল)
বাড়ি কোথায়?
শিয়ালমারা।
বলে কি! তাহলে তো ইঁদুর নয়, শিয়াল ধরতে হবে।
নিজের গাছের আম?
ডালিম হাসে। যেন পাকা ডালিম ফেটে গেছে। পান খাওয়া দাঁত। জানায়, বাগান থেকে সে মালিকের আম বাজারে পৌঁছে দেয়। আট-দশ কিলোমিটার দূর থেকে বাজারে পৌঁছে দিলে ৩০০ টাকা মজুরি। জালিগাছা থেকে এসেছে আলম। তার সাইকেলের দুই দিকে ঝুলিয়ে এনেছে প্রায় সাড়ে চার মণ আম। সাইকেল ঠেলে এনেছে প্রায় ১০ কিলোমিটার। মালিকের আম। মজুরি ৩০০ টাকা। এ রকম হাজার আলম। হাজার ডালিমের দেখা পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
আমাদের সফরসঙ্গী জুবায়ের কবিরকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে কখন ক্যামেরা নিয়ে নেমে গেছে টেরই পাইনি। গাড়িতে মোহিত কামাল মোবাইলে তাঁর স্ত্রীকে বলছেন, ‘বুঝেছ, আম দেখে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ না এলে আমবাগান যে কী বুঝতেই পারতাম না।’ আনোয়ার হোসেন দিলু ভাইও ছবির পর ছবি তুলছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা হয়েও চোখে তাঁর ঘোর লেগেছে আমাদের মতোই।
প্রায় ৪০ হাজার লোক নাকি আমের কাজের সঙ্গে জড়িত। কেউ আম গাছ থেকে পাড়ে, কেউ ভ্যানে, কেউ সাইকেলে, কেউ মাথায় করে নিয়ে বাজারে যায়। কেউ আমগাছের পরিচর্যা করে, কেউ আমের ঝুড়ি বানায়, আবার কেউ আম ওজন দেওয়ার কাজ করে।
প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা আমজট থেকে মুক্তি পাই। সিদ্ধান্ত হয়, ফেরার সময় অন্য পথে শহরে ফিরব। কারণ, সময় যত বাড়বে, আমজটও তত বাড়বে।
শিবগঞ্জে আছি। সোনা মসজিদ না দেখলে কি হয়?
ছুটে যাই সেখানে। চোখ রাখি সোনা মসজিদে।
নামফলকে লেখা ছোট্ট সোনা মসজিদ। আমি বলি, ‘বড়টা কই’? ‘ওটা মালদহ, ভারতে পড়েছে’। আমার খুব মন খারাপ হয়। বড়টা ভারতে পড়বে কেন?
এর আগেও আমার বেশ কয়েকবার মন খারাপ হয়েছে। নেত্রকোনায় বিরিশিরি গেছি। দূরে পাহাড় দেখে জানতে চেয়েছি। ‘এটা কোথায়?’ উত্তর এসেছে, ‘ওটা ইন্ডিয়ায় পড়েছে।’ এর কোনো মানে হয়!
প্রথম আলোর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন, আমাদের দিলু ভাই বলেন, ‘খাবেন?’
তখন দুপুর। পেট চো চো করছে।
বলি, ‘কী’?
‘হাঁসের মাংস, গরম ভাত?’
‘কোথায়?’
‘সোনারগাঁয়েও খেতে পারেন। শেরাটনেও খেতে পারেন।’
‘মানে?’
মানে বোঝার জন্য তাঁর পেছন পেছন হাঁটি।
সোনা মসজিদের কাছে দুটি ছোট খাবার হোটেল। একটির নাম সোনারগাঁও হোটেল, আরেকটি শেরাটন।
আমরা ছুটি ভোলাহাট উপজেলার দিকে।
দুই চোখ ভরে আমের সাম্রাজ্য দেখতে দেখতে ছুটে বেড়াই। গাছ। ছোট গাছ। মাঝারি গাছ। এক শ-দেড় শ বছরের পুরোনো গাছ। কোনো কোনোটা বটগাছের মতো। অনেক নতুন বাগান হচ্ছে। ধান বা সবজির খেত না করে আমের চাষ শুরু করেছে কেউ কেউ।
দুপুরের পরপর ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশনে পৌঁছাই। এটি বিশাল আমের আড়ত।
যেখানে ৪৮ কেজিতে এক মণ ধরা হয়।
‘কেন?’
আমের ব্যবসায়ী কোরবান জানান, ‘এটা এখানকার প্রথা। এখনো পরিবর্তন হয়নি। আটচল্লিশেই চলছে।’
ভোলাহাটে চোখে পড়ে ছোট্ট একটি আমের বাজার।
বলি, ‘বাজার এত ছোট ক্যানে?’
কোরবান বলেন, ‘এটা হচ্ছে গাছপাকা আমের বাজার। গাছ থেকে পাকা আম পড়ে যায়। এটা সেই আমের বাজার।’
দুটি তথ্য দিই। যে তথ্য ভাবায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে মানুষসমান উচ্চতার হাজার হাজার আমগাছ। হাত বাড়ালেই আম। কিন্তু কেউ কারও গাছের আম ছিঁড়ে নেয় না।
গত রাতে ছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারে। খুব ভোরে উঠেছি। প্রায় ২০০ প্রজাতির আমগাছ সেখানে। ১০-১২ জন মহিলা আম কুড়াচ্ছেন।
হাতে চটের ব্যাগ।
জানতে চাই, ‘কয়টা আম পেলেন?’
‘তিন কেজি হবে।’
আমার নাগরিক মন বলে, কুড়ানোর দরকার কী? ছিঁড়ে নিলেই তো হয়!
কিন্তু ওরা ছিঁড়ে না।
আরও একটি তথ্য। ঝড়ে যদি কাঁচা আম পড়ে যায়, তাহলে যে কেউ সে আম গাছতলা থেকে তুলে নিতে পারে। গাছের মালিক কিছু বলে না। তা সে পাঁচ মণই হোক বা ১০ মণ।
আবার নাগরিক মন আমাকে খোঁচায়। তাহলে তো ঝড় হলে চাঁপাই আসতে হবে। আম কুড়াতে। ছিঃ কী ভাবছি। ঝড়ে আম পড়লে তো আমচাষিদের ক্ষতির সীমা নেই।
আমাদের গাড়ি ছুটে বেড়ায় চাঁপাই সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট উপজেলায়।
সব ধরনের আম্রকাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রায় সবারই চোখেমুখে আনন্দের ছটা। যেন চলছে আমের উৎসব।
মুসলিমপুরের তরিকুলকে বলি, এ তো দেখছি ঈদের আনন্দের মতো। তরিকুল বলেন, ঈদের আনন্দের মতো না। তবে তার চেয়ে কোনো অংশে কমও না।
আমরা ক্ষুধার্ত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে না পৌঁছা পর্যন্ত খাবার সুযোগ হচ্ছে না।
দিলু ভাই বলেন, শহরে না পৌঁছানো পর্যন্ত একটি আম ফিডার খেয়ে নিন।
আমি একটি নরম আম পেছনের দিকে ছিদ্র করে বাচ্চাদের মতো চুষতে থাকি। দারুণ।
‘কী আম এটা।’
দিলু ভাই উত্তর দেন,
‘রানী পসনদ।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের এই মৌসুমটাকে এত পছন্দ করে ফেলি যে তা সব পছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে যায়।
No comments:
Post a Comment