পাহাড়ের চূড়ায় বরফ দেখার সাধ বাঙালির অনেকদিনের। বরফ দেখার ও বরফ নিয়ে খেলা
করার সখ, অনেকটা সিনেমায় যেমন দেখা যায় আর কী। আর সেই সখ মেটাতে বাঙালি
শীতটা একটু কমতেই হাজির মানালিতে। এপ্রিলের শুরুতেও বরফ থাকায় হিমাচল
প্রদেশের কুলু উপত্যকার মানালি অনেক বাঙালিকেই সপরিবারে টেনে আনতে পেরেছে।
অন্য পাচটি পর্যটন কেেন্দ্রর মতোই মানালিও নেহাতই একটি হোটেল-শহর। বিয়াস
নদীর দু’পার বরাবর শহর ছড়িয়ে পড়ছে প্রধানত পর্যটকদের উপর নির্ভর করে। তাই,
শহর বলতে নদীর দু’ধারের ছোটবড় হোটেল ও রেস্তরা, কিছু কুলু-শাল ও উলের
জামাকাপড়ের দোকান, ট্যুরিস্টদের ঘোরাঘুরির জন্য বাস ও ট্যাক্সির ভিড়।
পাহাড়ের কোলে এই ছোট্ট শহরটি এমনিতে যথেষ্ট নোংরা, শহরের যত আবর্জনা খোলা
নর্দমা উপছে সোজা বিয়াসে গিয়ে পড়ছে। শহরের রাস্তাঘাটও আহামরি কিছু নয়।
কিন্তু সে সবই মানালি শহরের মধ্যে। এখন শহর ছাড়িয়ে নদীর অন্য পারে একাধিক
বড় হোটেল-ক্লাব তৈরি হয়েছে, সেখানে থাকলে শহরের নোংরা গায়ে লাগে না। আর
একবার মানালি থেকে বাইরে বেরোলেই ভ্রমণপিপাসু বাঙালির পয়সা উশুল। মাইলের পর
মাইল আপেল বাগিচা, এপ্রিলে অবশ্য আপেল নেই, শুধুমাত্র ফুল ধরেছে গাছে।
কিন্তু চারপাশের সবুজের মধ্যে পাতাহীন আপেল গাছ সারি সারি হালকা বেগুনি বা
সাদা রঙের ফুলে ঢেকে দাড়িয়ে। আর মাথা তুললেই চারদিকের ছোটবড় সব পাহাড়ের
মাথা বরফে সাদা। এ বছর হিমাচলে বরফ পড়েছিল অনেক বেশি, স্থানীয় লোকজনের
হিসাবে মার্চের ১০-১১ তারিখেও মানালি শহরের রাস্তাঘাট বরফে ঢাকা ছিল। অনেক
পর্যটককেই হোটেল থেকে বেরিয়ে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত বরফের মধ্যে পায়ে হেঁটে
বাজারে গিয়ে তবে গাড়িতে উঠতে হয়েছিল। তবে এপ্রিলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার,
কিন্তু প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে, আর দেখতে দেখতে পাহাড়ের মাথা আরও সাদা হয়ে
যাচ্ছে।
বরফ নিয়ে খেলার সাধ মেটাতে হোটেলে বসে থাকলে চলবে না। তাই বৃষ্টি থেমে রোদ উঠতেই রোটাং পাসের পথে যেতে হল। মানালি থেকে রোটাং পাসের দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। কিন্তু মাত্র ১২ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই বরফে সে রাস্তা বন্ধ। সেনাবাহিনীর বর্ডার রোড ইঞ্জিনিয়ারদের তরফে রোড ব্লক করে রাস্তা বন্ধ রাখার নির্দেশ। হাজার খানেক গাড়িতে ও পর্যটকে রাস্তায় পা ফেলার উপায় নেই। চারদিক বরফে ঢাকা। রাস্তায় মানালি ছাড়ার পরেই সার সার দোকান থেকে বরফে বেড়ানোর জন্য ওভারকোট, বুট, গ্লাভস, এমনকি িস্ক পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে সবাই তৈরি বরফে পা রাখার জন্য। স্থানীয় ছেলেরা গাইড হিসাবে কাজ করছে, তারা মাসিমা মেসোমশাই, দাদা বৌদিদের হাত ধরে হাটি হাটি পা পা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বরফের মধ্যে। তারপরে স্কি নিয়ে মকশো করতে গিয়ে শুরু হল আছাড় খাওয়ার পর্ব। তবুও উৎসাহ কমে না। ছোট বেলা থেকেই হিিন্দ-ইংরেজি সিনেমায় নায়ক নায়িকাদের অবলীলাক্রমে স্কি করতে দেখেছে সে (এবং জড়াজড়ি করে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য মনে গেথে রয়েছে)। এখন ভাড়া করা দেশিবিদেশি ওভারকোটে নিজেকে তখন নতুন করে আবিষ্কার করছে সে বরফের মধ্যে। ফলে, কয়েকটা আছাড়ও তার কাছে তখন উপরি পাওনা মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকটা নাটকীয়ভাবেই আক্ষরিক অর্থে বরফ পড়তে শুরু করল। বিদেশি সাহিত্যে বরফ পড়ার অনেক বিবরণই পড়া, তার সঙ্গে সিনেমাতে দেখা দৃশ্য মিলিয়ে যে ধার করা অভিজ্ঞতা ছিল, এবার তার সঙ্গে মিশল সত্যিকারের বরফ পড়ার অভিজ্ঞতা। মাথায়, ওভারকোটের গায়ে ছোট ছোট বরফের কুচি এসে পড়ছে, কয়েকটি কুচি জামার মধ্যেও ঢুকে পড়ছে। তুষারপাতের এই অনাবিল অভিজ্ঞতায় চারপাশের আরও পুরুষ ও মহিলার মুখে যে অদ্ভুত হাসি ফুটে রয়েছে, তা দেখে বাঙালি বুঝতে পারল নিজের মুখেও একইরকম বোকা হাসি লেগে রয়েছে।
বরফ নিয়ে নাড়াচাড়া করার এই অভিজ্ঞতা অবশ্য কিছুটা বিস্বাদ হয়ে যেতে বাধ্য সেখানে পর্যটকদের আচরণের কারণেই। সুস্থ সবল পর্যটকরা চাকা লাগানো কাঠের গাড়িতে বাবুর মতো বসে, আর তাদের টেনে পাহাড়ে তুলে বরফ দেখাচ্ছে স্থানীয় মানুষ। অন্তত ১০ হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের পথে ওভাবে টানতে গিয়ে মানুষগুলো যে ভাবে শ্বাস নেওয়ার জন্য হাফাচ্ছিল, তা দেখার পরে পর্যটক হিসাবে নিজেদের ভূমিকায় লজ্জা ও গ্লানিবোধ এড়ানোর উপায় নেই।
তবে এ নিয়ে বেশিক্ষণ আবেগে কাতর হওয়া সম্ভবত আমাদের ধাতে নেই। বিশেষ করে কড়কড়ে টাকা গুণে কলকাতা থেকে সপরিবারে এতদূর এসে এখন কড়াগণ্ডায় তা উশুল করতে ব্যস্ত। তাই ও সব মন খারাপ করা দৃশ্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে আপাতত ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য স্থানীয় উপকরণের দিকে তার নজর। বরফের মধ্যেই দিব্যি একটা ঘরের মতো বানিয়ে সেখানে রঙ দিয়ে ‘হানিমুন’ লেখা, তাতে পিঠ দিয়ে নবদম্পতিরা বসে ছবি তুলতে ব্যস্ত, প্রতিটি ছবি ১০ টাকা। ছবি না তুললেও অনেকেরই নজর সেদিকে।
বাকিদের ভিড় চা কফি চিপসের অস্থায়ী দোকানের সামনে। গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারদের সূত্রে খবর, এখনও কমবেশি বরফ পড়ায় রাস্তা সাফ করা শুরু করা যাচ্ছে না। রোটাং পাস খুলতে জুনের মাঝামাঝি হয়ে যাবে। বরফের রাজ্য থেকে ফিরে নিচে নামার পথটি বিয়াসের জন্যই উৎসর্গীকৃত। বিয়াস খুবই প্রাণবন্ত। নদীর জল ছুতে অবশ্য একটু কষ্ট করে নিচে নামতে হয়। কিন্তু তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
উত্তর ভারতের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রের মতোই মানালিও তার নিজস্ব মন্দিরসম্পদ থেকে বিঞ্চত নয়। বশিষ্ঠ মুনির মন্দির, সঙ্গে গরম জলের ঝর্ণা। কিন্তু মিন্দরের স্থাপত্য বা পরিবেশ কোনওটাই মন টানে না। বরং পাহাড়ের মাথায় দেবদারু ও পাইন বনের মধ্যে হিড়িম্বা মন্দির একেবারে ব্যতিক্রম। কয়েকশ বছরের পুরনো ওই মন্দির আগাগোড়া কাঠের তৈরি। তার মধ্যে হিড়িম্বার মূর্তি। প্রাঙ্গণের একধারে ঘটোৎকচও ছোট্ট একটা মন্দিরে বসে আছে। গোটা পরিবেশ, সেই সঙ্গে মিন্দরের গায়ে কাঠের কাজ, সব মিলিয়ে চমৎকার। রাস্তায় কোথাও সম্ভবত মনুর মিন্দরের সাইনবোর্ডও চোখে পড়েছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই। দেখতে যাওয়া হয়নি।
মানালি এসে নাগর যাওয়া হবে না, এটা হতেই পারে না। মানালি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে নাগর। সেখানে আগেকার নাগর রাজার আমলের একটি ছোট্ট কাস্ল, এখন রাজ্য পর্যটন দফতরের হোটেলে রূপান্তরিত। পাহাড়ের গায়ে চারদিক খোলা পরিবেশে ওই কাঠের প্রাসাদে চারদিক টানা বারান্দায় বসে বিয়াস ও বরফে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে মধ্যাহ্নভোজনের অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। আর সেখান থেকে বেরিয়ে ওই পাহাড়েই আরও উপরে উঠলে রোয়েরিখের মিউজিয়াম। নিকোলাস রোয়েরিখ, তার ছেলে স্বোয়েদস্লাভ ও পুত্রবধূ ঠাকুরপরিবারের কন্যা দেবিকারানী, তাদের প্রাসাদোপম বাড়ি ও বাগান এখন ট্রাস্ট দেখাশোনা করছে। রোয়েরিখদের বেশিরভাগ পেইন্টিই এ দেশে নেই, কিছু নিউ ইয়র্কে, কিছু রাশিয়ায়। তবুও যে কয়েকটি পেইন্টিং সেখানে আছে, তা দেখতে পাওয়াটাও কম প্রাপ্তি নয়। বিশেষ করে স্বোয়েদস্লাভের আকা দেবিকারানীর দুটি বড় পোট্রেট আর নিকোলাসের আকা হিমালয়ের নিসর্গদৃশ্য। নিকোলাস রোয়েরিখ আমৃত্যু সেখানেই বাস করেন ও ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। বাগানের মধ্যেই বিয়াসের ধারে একটি সমতল জায়গায় তার অগ্নিসংস্কার হয়েছিল। সেখানে একটি বিরাট শিলাখণ্ড রেখে জায়গাটি চিহ্নিত করা রয়েছে। মিউজিয়ামে এখনও এক রুশ গবেষক কাজ করছেন। তবে গবেষকরা যেটুকু আসেন সবই বিদেশ থেকে।
পাহাড়, বরফ ও নদী থাকবে আর হিন্দি সিনেমা থাকবে না, তা হয় না। মানালির কোণায় কোণায় বোম্বাই সিনেমার শুটিংয়ের কহানি স্থানীয় মানুষের গর্বের ধন। নাগরে প্রাসাদ ঘুরে দেখার সময় উপযাচক হয়ে এক কর্মী দেখিয়ে দেবেন— ওইখানে িপ্রতি জিন্টা বাসন ধুয়েছিলেন, আপনারা …সিনেমাটা দেখেননি, নাগরেই তো শুটিং হয়েছিল! আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেলে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে অন্য পর্যটকের কাছে ছুটবেন তিনি। মানালির কোন হোটেলে শাহরুখ খান উঠেছিল, আবার কোথায় বিয়াসের ধারে হৃতিক রোশনরা ধূম-২ শু্যট করতে এসেছে, বরফের পাহাড় ও বিয়াসের সঙ্গে বাড়তি পাওনা আদায়ে তাই সব পর্যটকের ভিড়। যদিও বাইনাকুলারে দেখা গেল, নায়ক নায়িকা নয়, পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার ফুট রোপ লাগিয়ে যত সব একষ্ট্রারা ঝুলছে।
দু’দিন আগেই চোখে পড়ল, কলকাতার এক ইংরেজি পত্রিকায় একজন মানালির হোটেলের রান্নার খুব প্রশংসা করেছেন। সে জন্যই এ নিয়ে দু-চার কথা বলতে ইচ্ছে করল। মানালির ছোট-বড় বিভিন্ন ধরণের হোটেল রেস্তরায় খাওয়ার অভিজ্ঞতা বাঙালির পক্ষে মোটেই সুখকর হয়নি। তিব্বতি রেস্তরাগুলি বাদ দিলে বাকি সব রেস্তরার কোনও জাত নেই। সাইনবোর্ডে সবাই বাঙালি, গুজরাতি, পঞ্জাবি, তামিল রসনার উপযোগী রান্না করেন বলে দাবি করলেও স্বাদে গন্ধে সব একাকার। মনে হবে, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে নিখাদ ভারতীয় কোনও রান্না আবিষ্কারের চেষ্টায় রয়েছে মানালির হোটেলগুলি। উগ্র প্রকৃতিপ্রেমিক বা ভ্রমণপিপাসু না হলে একদিনের বেশি ওই খাবার গলা দিয়ে নামানো কঠিন।
বরফ নিয়ে খেলার সাধ মেটাতে হোটেলে বসে থাকলে চলবে না। তাই বৃষ্টি থেমে রোদ উঠতেই রোটাং পাসের পথে যেতে হল। মানালি থেকে রোটাং পাসের দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। কিন্তু মাত্র ১২ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই বরফে সে রাস্তা বন্ধ। সেনাবাহিনীর বর্ডার রোড ইঞ্জিনিয়ারদের তরফে রোড ব্লক করে রাস্তা বন্ধ রাখার নির্দেশ। হাজার খানেক গাড়িতে ও পর্যটকে রাস্তায় পা ফেলার উপায় নেই। চারদিক বরফে ঢাকা। রাস্তায় মানালি ছাড়ার পরেই সার সার দোকান থেকে বরফে বেড়ানোর জন্য ওভারকোট, বুট, গ্লাভস, এমনকি িস্ক পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে সবাই তৈরি বরফে পা রাখার জন্য। স্থানীয় ছেলেরা গাইড হিসাবে কাজ করছে, তারা মাসিমা মেসোমশাই, দাদা বৌদিদের হাত ধরে হাটি হাটি পা পা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বরফের মধ্যে। তারপরে স্কি নিয়ে মকশো করতে গিয়ে শুরু হল আছাড় খাওয়ার পর্ব। তবুও উৎসাহ কমে না। ছোট বেলা থেকেই হিিন্দ-ইংরেজি সিনেমায় নায়ক নায়িকাদের অবলীলাক্রমে স্কি করতে দেখেছে সে (এবং জড়াজড়ি করে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য মনে গেথে রয়েছে)। এখন ভাড়া করা দেশিবিদেশি ওভারকোটে নিজেকে তখন নতুন করে আবিষ্কার করছে সে বরফের মধ্যে। ফলে, কয়েকটা আছাড়ও তার কাছে তখন উপরি পাওনা মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকটা নাটকীয়ভাবেই আক্ষরিক অর্থে বরফ পড়তে শুরু করল। বিদেশি সাহিত্যে বরফ পড়ার অনেক বিবরণই পড়া, তার সঙ্গে সিনেমাতে দেখা দৃশ্য মিলিয়ে যে ধার করা অভিজ্ঞতা ছিল, এবার তার সঙ্গে মিশল সত্যিকারের বরফ পড়ার অভিজ্ঞতা। মাথায়, ওভারকোটের গায়ে ছোট ছোট বরফের কুচি এসে পড়ছে, কয়েকটি কুচি জামার মধ্যেও ঢুকে পড়ছে। তুষারপাতের এই অনাবিল অভিজ্ঞতায় চারপাশের আরও পুরুষ ও মহিলার মুখে যে অদ্ভুত হাসি ফুটে রয়েছে, তা দেখে বাঙালি বুঝতে পারল নিজের মুখেও একইরকম বোকা হাসি লেগে রয়েছে।
বরফ নিয়ে নাড়াচাড়া করার এই অভিজ্ঞতা অবশ্য কিছুটা বিস্বাদ হয়ে যেতে বাধ্য সেখানে পর্যটকদের আচরণের কারণেই। সুস্থ সবল পর্যটকরা চাকা লাগানো কাঠের গাড়িতে বাবুর মতো বসে, আর তাদের টেনে পাহাড়ে তুলে বরফ দেখাচ্ছে স্থানীয় মানুষ। অন্তত ১০ হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের পথে ওভাবে টানতে গিয়ে মানুষগুলো যে ভাবে শ্বাস নেওয়ার জন্য হাফাচ্ছিল, তা দেখার পরে পর্যটক হিসাবে নিজেদের ভূমিকায় লজ্জা ও গ্লানিবোধ এড়ানোর উপায় নেই।
তবে এ নিয়ে বেশিক্ষণ আবেগে কাতর হওয়া সম্ভবত আমাদের ধাতে নেই। বিশেষ করে কড়কড়ে টাকা গুণে কলকাতা থেকে সপরিবারে এতদূর এসে এখন কড়াগণ্ডায় তা উশুল করতে ব্যস্ত। তাই ও সব মন খারাপ করা দৃশ্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে আপাতত ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য স্থানীয় উপকরণের দিকে তার নজর। বরফের মধ্যেই দিব্যি একটা ঘরের মতো বানিয়ে সেখানে রঙ দিয়ে ‘হানিমুন’ লেখা, তাতে পিঠ দিয়ে নবদম্পতিরা বসে ছবি তুলতে ব্যস্ত, প্রতিটি ছবি ১০ টাকা। ছবি না তুললেও অনেকেরই নজর সেদিকে।
বাকিদের ভিড় চা কফি চিপসের অস্থায়ী দোকানের সামনে। গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারদের সূত্রে খবর, এখনও কমবেশি বরফ পড়ায় রাস্তা সাফ করা শুরু করা যাচ্ছে না। রোটাং পাস খুলতে জুনের মাঝামাঝি হয়ে যাবে। বরফের রাজ্য থেকে ফিরে নিচে নামার পথটি বিয়াসের জন্যই উৎসর্গীকৃত। বিয়াস খুবই প্রাণবন্ত। নদীর জল ছুতে অবশ্য একটু কষ্ট করে নিচে নামতে হয়। কিন্তু তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
উত্তর ভারতের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রের মতোই মানালিও তার নিজস্ব মন্দিরসম্পদ থেকে বিঞ্চত নয়। বশিষ্ঠ মুনির মন্দির, সঙ্গে গরম জলের ঝর্ণা। কিন্তু মিন্দরের স্থাপত্য বা পরিবেশ কোনওটাই মন টানে না। বরং পাহাড়ের মাথায় দেবদারু ও পাইন বনের মধ্যে হিড়িম্বা মন্দির একেবারে ব্যতিক্রম। কয়েকশ বছরের পুরনো ওই মন্দির আগাগোড়া কাঠের তৈরি। তার মধ্যে হিড়িম্বার মূর্তি। প্রাঙ্গণের একধারে ঘটোৎকচও ছোট্ট একটা মন্দিরে বসে আছে। গোটা পরিবেশ, সেই সঙ্গে মিন্দরের গায়ে কাঠের কাজ, সব মিলিয়ে চমৎকার। রাস্তায় কোথাও সম্ভবত মনুর মিন্দরের সাইনবোর্ডও চোখে পড়েছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই। দেখতে যাওয়া হয়নি।
মানালি এসে নাগর যাওয়া হবে না, এটা হতেই পারে না। মানালি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে নাগর। সেখানে আগেকার নাগর রাজার আমলের একটি ছোট্ট কাস্ল, এখন রাজ্য পর্যটন দফতরের হোটেলে রূপান্তরিত। পাহাড়ের গায়ে চারদিক খোলা পরিবেশে ওই কাঠের প্রাসাদে চারদিক টানা বারান্দায় বসে বিয়াস ও বরফে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে মধ্যাহ্নভোজনের অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। আর সেখান থেকে বেরিয়ে ওই পাহাড়েই আরও উপরে উঠলে রোয়েরিখের মিউজিয়াম। নিকোলাস রোয়েরিখ, তার ছেলে স্বোয়েদস্লাভ ও পুত্রবধূ ঠাকুরপরিবারের কন্যা দেবিকারানী, তাদের প্রাসাদোপম বাড়ি ও বাগান এখন ট্রাস্ট দেখাশোনা করছে। রোয়েরিখদের বেশিরভাগ পেইন্টিই এ দেশে নেই, কিছু নিউ ইয়র্কে, কিছু রাশিয়ায়। তবুও যে কয়েকটি পেইন্টিং সেখানে আছে, তা দেখতে পাওয়াটাও কম প্রাপ্তি নয়। বিশেষ করে স্বোয়েদস্লাভের আকা দেবিকারানীর দুটি বড় পোট্রেট আর নিকোলাসের আকা হিমালয়ের নিসর্গদৃশ্য। নিকোলাস রোয়েরিখ আমৃত্যু সেখানেই বাস করেন ও ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। বাগানের মধ্যেই বিয়াসের ধারে একটি সমতল জায়গায় তার অগ্নিসংস্কার হয়েছিল। সেখানে একটি বিরাট শিলাখণ্ড রেখে জায়গাটি চিহ্নিত করা রয়েছে। মিউজিয়ামে এখনও এক রুশ গবেষক কাজ করছেন। তবে গবেষকরা যেটুকু আসেন সবই বিদেশ থেকে।
পাহাড়, বরফ ও নদী থাকবে আর হিন্দি সিনেমা থাকবে না, তা হয় না। মানালির কোণায় কোণায় বোম্বাই সিনেমার শুটিংয়ের কহানি স্থানীয় মানুষের গর্বের ধন। নাগরে প্রাসাদ ঘুরে দেখার সময় উপযাচক হয়ে এক কর্মী দেখিয়ে দেবেন— ওইখানে িপ্রতি জিন্টা বাসন ধুয়েছিলেন, আপনারা …সিনেমাটা দেখেননি, নাগরেই তো শুটিং হয়েছিল! আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেলে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে অন্য পর্যটকের কাছে ছুটবেন তিনি। মানালির কোন হোটেলে শাহরুখ খান উঠেছিল, আবার কোথায় বিয়াসের ধারে হৃতিক রোশনরা ধূম-২ শু্যট করতে এসেছে, বরফের পাহাড় ও বিয়াসের সঙ্গে বাড়তি পাওনা আদায়ে তাই সব পর্যটকের ভিড়। যদিও বাইনাকুলারে দেখা গেল, নায়ক নায়িকা নয়, পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার ফুট রোপ লাগিয়ে যত সব একষ্ট্রারা ঝুলছে।
দু’দিন আগেই চোখে পড়ল, কলকাতার এক ইংরেজি পত্রিকায় একজন মানালির হোটেলের রান্নার খুব প্রশংসা করেছেন। সে জন্যই এ নিয়ে দু-চার কথা বলতে ইচ্ছে করল। মানালির ছোট-বড় বিভিন্ন ধরণের হোটেল রেস্তরায় খাওয়ার অভিজ্ঞতা বাঙালির পক্ষে মোটেই সুখকর হয়নি। তিব্বতি রেস্তরাগুলি বাদ দিলে বাকি সব রেস্তরার কোনও জাত নেই। সাইনবোর্ডে সবাই বাঙালি, গুজরাতি, পঞ্জাবি, তামিল রসনার উপযোগী রান্না করেন বলে দাবি করলেও স্বাদে গন্ধে সব একাকার। মনে হবে, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে নিখাদ ভারতীয় কোনও রান্না আবিষ্কারের চেষ্টায় রয়েছে মানালির হোটেলগুলি। উগ্র প্রকৃতিপ্রেমিক বা ভ্রমণপিপাসু না হলে একদিনের বেশি ওই খাবার গলা দিয়ে নামানো কঠিন।
No comments:
Post a Comment