Monday, July 14, 2014

বর্ষায় বলধা গার্ডেনে

আষাঢ়ের শুরুতে একটু মন খারাপই হয়েছিল। বর্ষার রূপে কি মরচে পড়ল? বর্ষণ কই? কয়েক দিন যেতেই প্রবল প্রতিপত্তিতে উপস্থিত বৃষ্টি। পূর্ণরূপে নামল বর্ষা। কিন্তু ঢাকায় তাকে দেখব কোথায়? এখানে যে বৃষ্টি মানেই যানজট, পানি জমে যাওয়া, মানুষের দুর্ভোগ। তবে জায়গা একটা আছে, সেখানে যেতে পারেন আপনিও, একা বা দল বেঁধে। পুরান ঢাকার ওয়ারীতে বলধা গার্ডেনে
এক শুক্রবার বেরিয়ে পড়লাম মোটরসাইকেল নিয়ে। ঝুমবৃষ্টিতে রেইনকোটই ভরসা। বন্ধু মুশতাক কাদরী ও মুস্তফা আমীনও সঙ্গী হতে চাইলেন। ফুল খুব ভালোবাসেন দুজনই।
সাইকি
বলধা গার্ডেন আমার খুব পরিচিত। কতবার আমি এখানে এসেছি, তা গুনে শেষ করতে পারব না। ১৯০৯ সালে রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ বলধা গার্ডেন তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে ৬৭২ প্রজাতির গাছ নিয়ে সম্পূর্ণ হয় বলধা গার্ডেন। এর দুটি অংশ—একটি সাইকি, অন্যটি সিবিলি। সেদিন সাইকি ভাগে ঢুকেই পেলাম মুশতাক কাদরী আর মুস্তফা আমীনদের। মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছেন। গড়াগড়ি খাচ্ছে ছাতা। আশপাশে শাপলা, পদ্মভরা চৌবাচ্চা। তাতে বৃষ্টির পানি পড়ার একটানা শব্দ। গাছগুলো যেন হয়ে উঠেছে আরও সবুজ। চোখে নেশা লেগে যায় সবুজের। এখানে সারা বছরই নীল শাপলা ফোটে, তবে বর্ষায় একটু বেশি। আজ একসঙ্গে চারটি নীল শাপলার দেখা পেলাম। এখান থেকে বের হতে হতে পথে ফণীমনসা ছায়াতরুর পাশে গ্লোবলতার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখানেই অফিসরুমের কাছাকাছি একটি ক্যাকটাসগাছে ফুল ফুটেছে। গাছটি শত বছরের পুরোনো। অবশ্য বলধার প্রায় সব গাছই এমন। এগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এভাবেই একদিন গাছগুলো হয়তো হারিয়ে যাবে। তখন তাদের দেখা মিলবে শুধু বইয়ের পাতায়।
সাইকি ভাগের পেছনে হংসলতায় ফুল এসেছে আর ঢোলসমুদ্র তার সমস্ত স্নিগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাকটাস গ্যালারির দিকটায় চলে এলাম এবার। ক্যাকটাস গ্যালারির সামনে হুসনেলতা। এখানেই অপরাজিতা নীল ও সাদা দুই রঙের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়। দেখা হয় ব্লিডিংহার্টের সঙ্গে। রাজ অশোকগাছে এখন ফুল নেই। ব্রুনফেলসিয়া আমেরিকানায় ফুল ফুটে আছে। ব্রুনফেলসিয়া রমনা উদ্যানেও প্রচুর। সেটির ফুল নীল, বাসি হলে সাদা হয়। বলধায় এরা ঘিয়ে রঙের, বাসি হলে সাদা হয়। আমেরিকানার মাথার ওপর করমচাগাছে করমচা ধরে আছে। আমরা করমচাগাছের পাশে ভূতনাগিনীর সান্নিধ্য নিয়ে প্যাপিরাস, উলটচণ্ডাল, পান্থপাদপ, অর্কিড আর আমাজন লিলির বিশাল পাতা দেখে সাইকি ভাগ থেকে চলে আসি সিবিলি ভাগে।
সিবিলি
ঝুমবৃষ্টি এখন ঝিরি ঝিরি হয়ে এসেছে প্রায়। ভেজার সঙ্গে চলছে আমাদের আড্ডাও। কতখানি মমতা আর ভালোবাসা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বাগান, তা ভাবছিলাম। শুধু টাকার প্রাচুর্য থাকলেই চলবে না, মনেও ধনী হতে হবে।
এর মধ্যে সাইকি থেকে চলে এলাম সিবিলিতে। এখানেই আছে বিখ্যাত জয় হাউস, এটি এককক্ষবিশিষ্ট দোতলা ঘর। এখানে বসেই কবিগুরু তাঁর বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি রচনা করেন। আমাদের মনেও যেন কাব্যের রং ধরল। মুস্তফা আমীন ভাইকে অনুরোধ জানানো হলো কবিতাটি আবৃত্তি করার। এখানে আছে সূর্যঘড়ি এবং অনিন্দ্যসুন্দর শংখনাদ পুকুরসহ বহু দুর্লভ বৃক্ষরাজি।
আমরা হেঁটে একেবারে পেছনের দিকে চলে আসি। এখানে একসময় প্রাচীন মহুয়াগাছটি ছিল। এর পাশেই মৃত সুগারপামগাছটির অবস্থান। এখানে আমাদের দেখা হয় বেশ কয়েক প্রজাতির গার্ডেনিয়ার সঙ্গে এবং ডুকডুকি, চালতা, টর্চফ্লাওয়ার, কর্ডিয়াসেবাস্টিন, নাগলিঙ্গম, অশোক, জুহুরিচাঁপা, সহজচাঁপা, ক্যানাঙ্গা, মরুগোলাপ ও গুস্তাভিয়ার। এখন ক্যামেলিয়ার মৌসুম নয়। আমরা ক্যামেলিয়া পাইনি কিন্তু ক্যামেলিয়া হাউস ঘুরে দেখেছি। দেখেছি বেহুলাবট ও কৃষ্ণবট। কৃষ্ণবট বলধা গার্ডেন ছাড়া আমাদের দেশের আর কোথাও নেই। আসলে বলধায় এমন অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছ আর ফুলের কথা বলে শেষ করার নয়।
ছিলাম ঘণ্টা দুয়েক। কিন্তু তাতে বলধার সবকিছু দেখে শেষ করার নয়। সারা দিনের জন্য যেতে পারলেই ভালো। ফুলে ফুলে চোখ জুড়িয়ে নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।
কীভাবে যাবেন
বলধা গার্ডেন পুরান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত। রিকশা, অটোরিকশা বা নিজস্ব বাহনে বলধায় চলে যেতে পারেন। বাসে গেলে গুলিস্তান বা ফার্মগেট হয়ে রাজধানী সুপার মার্কেটের কাছে নেমে হেঁটে বলধায় চলে যান। নিজস্ব বাহন হলে সরাসরি বলধা গার্ডেনের ফটকে চলে যেতে পারবেন। গাড়ি রাখার কোনো সমস্যা নেই।
সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বলধা খোলা পাবেন। সাইকি ভাগে প্রবেশের আগে অনুমতি লাগবে। সিবিলিতে যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। প্রবেশ ফি জনপ্রতি পাঁচ টাকা। কষ্ট করে পুরান ঢাকায় যখন যাবেনই—খ্রিষ্টান কবরস্থান, বাহাদুরশাহ পার্ক, বিউটি বোর্ডিংসহ আহসান মঞ্জিল ও রূপলাল হাউস দেখে আসতে পারেন। আর খেয়ে আসতে পারেন আদি ঢাকাই খাবার!

No comments:

Post a Comment