আপাত অচেনা মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শিলং
বাঙালির নস্টালজিয়ায় অনন্য। হাল আমলে শহরের আধুনিক চেহারা নজর কাড়ে।
আশেপাশে অনেক মনকাড়া জায়গা। ছোট্ট অবসর কাটাতে ইউমিয়াম লেকের তীরে স্বর্গীয়
দৃশ্যাবলীর মাঝে নির্জনবাস। শিলং ও তার কাছাকাছি স্পটের হরেক টুকরো ছবির
মালা গেথেছেন লেখক।
চেরাপুিঞ্জর আমেজ নিয়ে চললাম বরাপানির দিকে। কলকাতার পাচ বঙ্গসন্তানের প্রথম উত্তর-পূর্ব ভারত দর্শনের িদ্বতীয় গন্তব্যস্থল।
শিলংয়ের অনতিদূরে ইউমিয়াম হ্রদ। এরই অন্য নাম বরাপানি। কথা ছিল পৃথিবী বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ চালর্স কোরিয়ার ডিজাইন করা রিসর্টে দিন দুয়েক থাকার। যাত্রাপথে যেহেতু মেঘালয়ের রাজধানী শিলং পড়বে তাই ঠিক হল সেখানেই মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেওয়া হবে।
ফের সিমেন্ট কারখানার চিমনি, তালা ঝোলানো সেল্স অফিস দেখতে দেখতে বোলেরো চেরাপুিঞ্জ থেকে শিলং-এর পথ ধরল।
৩৬ ঘন্টা আগের যে রাস্তা অন্ধকারের মোড়কে প্রায় দুঃস্বেপ্নর আকার নিয়েছিল সেই রাস্তাই শিলং ফেরার পথে এ বার তার রং-রূপ বর্ণ-গন্ধ মেলে ধরল আমাদের সামনে। রাস্তার এক পাশে খাদ, দূরে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম। পাহাড়ি শিশুদের খেলা। কাকতাড়ুয়া। যা দেখে মিঠি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তার ধারণাতেই আসছিল না বইয়ের পাতার ছবি থেকে কী ভাবে পাহাড়ি উপত্যকায় নেমে এল কাকতাড়ুয়ার দল!
হলিউডের ছবির মত দৃশ্যাবলি। দিগন্তঘেরা পাহাড়শ্রেণি। মাঝখানে উপত্যকা। শীত আসি আসি করছে মধ্য অেক্টাবরের বেলায়। তাই রোদ্দুরটাও কেমন মোলায়েম। এমন পিকচার পোস্টকার্ড-এ কী শুধু গাড়ি চড়ে চলে যাওয়া যায় নীরব দর্শক হয়ে? নেমে পড়লাম। যত দূর চোখ যায় উপত্যকার বুক চিরে একে বেকে চলে যাওয়া রাস্তায় ছোট খেলনার মত গাড়ির সারি। ঢেউ খেলানো উপত্যকায় মাঝে মধ্যেই বড় বড় লম্বা পাথর রাখা। অদ্ভুত লেগেছিল প্রথমে। পরে জানতে পারলাম িপ্রয়জনের স্মৃতির উেদ্দশ্যে রাখা এই পাথরখণ্ডকে ‘কিমন’ বলে। নির্জন সেই উপত্যকায় ছবির মত দৃশ্যে কেমন যেন মন কেমন করা বারবেলা সেটি। সময় যেন থমকে দাড়িয়ে রয়েছে প্রস্তরখণ্ড হয়ে।
এক সময় দেখলাম পাহাড়ি বাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সাভানার মত হলুদ ঘাসজমি। তার মধ্যেই পথ চিনে গাড়ি ছুটছিল। হঠাৎ মনে হল, এত দৌড়চ্ছি কেন আমরা? কীসের টানে? কেন ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে এলাম এখানে? কারণ একটাই। অন্য এক পৃথিবী দেখব বলে! আর সেই পৃথিবীই যখন তার প্যালেট খুলে ছবি আকছে তখন কোথায় হন্তদন্ত হয়ে চলেছি? গাড়ি থেমে গেল। রাস্তায় কদাচিৎ চলা যানবাহনের শব্দ ছাড়া ছিল শুধু হাওয়ার শব্দ। হাওয়ায় দোলা হলদেটে ঘাস, নীল আকাশ, পেজা তুলোর মত সাদা মেঘ, দিগেন্ত ঘিরে থাকা পাহাড় শ্রেণি রয়ে গেল মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য।
মহানবমী যে চলছে তা মনে পড়ল শিলংয়ের পুলিশ বাজারে গিয়ে। শহরের ব্যস্ততম এলাকা পুলিশ বাজার এক্কেবারে মিনি ধর্মতলা। বাস, ট্যািক্স, গাড়ির ভিড়ে ভিড়াক্কার।
দলে দলে মানুষ নতুন পোশাক পরে বেরিয়েছেন। অবস্থা এমনই যে পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া ভার। যে কোনও উৎসবের বা সপ্তাহ শেষের সন্ধ্যায় পার্ক িষ্ট্রটের রেেস্তারার বাইরে দাড়ানো অপেক্ষমান জনতা অতি পরিচিত দৃশ্য। সেই দৃশ্যেরই হুবহু প্রতিলিপি দেখলাম মহানবমীর পুলিশ বাজারে। যে রেেস্তারাতেই যাই, ঠাই নেই, ঠাই নেই। কয়েক ঘন্টার যাত্রা শেষে পেটে তখন ছুচো ডন দিচ্ছে। শেষে রাস্তার পাশে মাঝারি গোছের চিনা খাবারের দোকানেই অর্ডার দেওয়া হল। খাবার আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই কাচের দেওয়ালের ওপাশে মহানবমীর দুপুরের শিলংকে দেখতে মনোযোগী হলাম।
উত্তর পূর্ব ভারতের রাণী হিসেবে এই শহর পরিচিত। দেখলাম তার সঙ্গে মানানসই হয়ে উঠেছেন মহানবমীর দর্শনার্থীরা। পুজোর সময় কলকাতার ফ্যাশন েস্টটমেন্ট দেখতে বিেশ্বর নানা প্রান্ত থেকে বাঙালিরা ছুটে আসেন। আমার মনে হয় তারা শিলং-এও আসতে পারেন। ঠাওর করে দেখলাম টমি হিলফিগার, বেনেটন, রিবক, নাইকি, অ্যাডিডাস-কোনও নামি দামি ব্র্যাণ্ড বাদ নেই সেই জনেস্রাতে। পাশাপাশি পাহাড়ি ঐতিহ্যের সাজও নজরে পড়ছিল। হলফ করে বলতে পারি, বিখ্যাত ব্র্যােণ্ডর মধ্যে সেই সাজ শিলংয়ের ফ্যাশন কালচারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ঠিক যেন পূব পিশ্চমের ফ্যাশন মিশেল। মিশেল ছিল ভাষাতেও। জনেস্রাত থেকে যেমন ভেসে আসছিল টুকরো টুকরো বাংলা শব্দ, তেমনই খাসি, গারো শব্দও ছুয়ে যাচ্ছিল কর্ণকুহর।
চাইনিজ খেয়ে রওনা দিলাম বরাপানির দিকে, যার পোষাকি নাম ইউমিয়াম লেক। কিন্তু রাস্তায় তখন মানুষের ঢল। ৪৮ ঘন্টার ফারাকে চরম নির্জনতা থেকে যানজটে আটকে যাওয়া। কয়েক ঘন্টা আগেও মোবাইলের কোনও নেটওয়ার্ক ছিল না। শব্দ বলতে ছিল ঁঝিঁঝির ডাক। আর এখন গাড়িতে চারটে মোবাইলই অনবরত বেজে চলেছে। সারথিরটা ধরলে পাচটা। বিভিন্ন গাড়ি আর কয়েক হাজার মানুষের সমবেত শব্দজাল ঘিরে ধরেছিল আমাদের। সেই যানজট কাটিয়ে লরির ধুলো খেতে খেতে ইউমিয়াম লেক রিসর্টে পৌছনো।
রিসর্ট ঝকঝকে তকতকে। যেমন পাচতারা মার্কা রিসর্ট হয় আর কি! তবে খেতে বসে মনে হয়েছিল বাইরের ঝকঝকে ভাবের সবটা বোধহয় রান্নায় ধরা পড়েনি। পরিবেশনেও রয়ে গিয়েছে কেমন গা ছাড়া ভাব। রিসর্টের দোতলায়, ঘরের বারান্দায় এসে চোখ ভরে গেল অন্য স্বাদে।
পরদিন সকালে ঘুমের আমেজ কাটিয়ে আলাপ হল রিসর্টের অন্য এক বাসিন্দার সঙ্গে। পেলাম এক নতুন বন্ধু। সে এক অসম তনয়া। পড়ে গুয়াহাটির এক কলেজে। পুজোর ছুটিতে মা বাবার সঙ্গে একদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে বরাপানি। এখন সাত সকালেই বাড়ির সবার সঙ্গে চলেছে শিলচর। সেখানে দিদা তার আদরের নাতনিকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন যে! নাতনিও উদগ্রীব তার দিদাকে দেখার জন্য। কিন্তু জিন্স পরে একটু চিন্তাও হচ্ছে। দিদা যে পিশ্চমি পোশাক একেবারেই পছন্দ করেন না।
শুনেছিলাম রিসর্টের সামনেই লেক। কিন্তু দেখতে পেলাম না। কারণ সেটি ঢাকা পড়ে গিয়েছে তীরের বনানীতে। হ্রদ দেখতে না পেয়ে যখন হতাশ, ঠিক তখনই নাম না জানা পাখির দল ডেকে উঠল। উচু একটা গাছের মাথায় ডাকতে ডাকতে তারা জড়ো হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ একসঙ্গে উড়ে গেল অন্য গাছে। নীচের দিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল নানান রঙের প্রজাপতি।
আর না! হাল্কা রোদ গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু দূর যাওয়ার পরই গাছের ফাক দিয়ে হ্রদের জল দেখা গেল। ছোট ছোট ঢেউ এসে পাড়ে ধাক্কা খাচ্ছে। আশপাশের পাহাড়ে সকালের রোদ পড়েছে। সেই রোদে কেমন মায়াবি লাগছে খাসি পাহাড় শ্রেণিকে। হ্রদের মধ্যে দ্বীপ। দূর থেকে বেশ বোঝা গেল সেই দ্বীপও সকালের রোদ্দুরে আলস্য কাটিয়ে জেগে উঠছে
লেকের পাড়েই আলাপ হল চার বন্ধুর সঙ্গে। এসেছে শিলং থেকে। সবাই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া। দিব্যি আগুন জ্বালিয়ে রান্না চড়িয়েছে। কেউ কুটনো কুটছে। কেউ দেখছে আচটা ঠিক মত হল কি না। সবুজ জলের ধারে বসা এক তরুণ আপন মনে গিটারে সুর তুলছে। চুপ করে দাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম সুরটা। পারলাম না। কারণ ঠিক তখনই গিটারের শব্দ থেমে গেল। পাহাড়ি তরুণের নজর পড়েছে অনাহুত দর্শকের দিকে। লাজুক মুখে সে গিটার সরিয়ে রাখল। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর অবশ্যি একটু পরে ফের সুর ধরল। কিন্তু দু’ বার শুনেও সুরটা বুঝলাম না।
লেকে লঞ্চ ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে মেঘালয় সরকারের ‘মোটর বাসে’। লেঞ্চর ই অন্য নাম। মিনিট কুড়ির ভ্রমণ। সেখানেই দেখলাম জলের রঙের কত রূপ। পাড়ের ঘন জঙ্গলের ছায়ায় জলের রঙ হয়েছে গাঢ় সবুজ। আর মধ্যিখানে যেখানে কোনও ছায়ারই সম্ভাবনা নেই, সেখানে প্রকৃতির ভাণ্ডারে কোনও রঙও রাখা হয়নি। পাইলট মাঝে মধ্যেই জানাচ্ছিলেন হ্রদের কোথায় জলের কত গভীরতা। কিন্তু সেই গভীরতার চেয়েও আমার মন টানল হ্রদের মধ্যিখানে এক দ্বীপ। ইতস্তত গাছ রয়েছে সেখানে। ছোট টিলার ওপর রয়েছে ঘর। কল্পনা করতে চেষ্টা করছিলাম নির্জন সেই দ্বীপবাসীদের এবং মনে পড়ে গেল আরও একটা দ্বীপের কথা।
আন্দামান সাগরের বুকে জঙ্গলে ভরা ছোট্ট দ্বীপ। লঞ্চ থেকে দেখা। দ্বীপের সামনে খানিকটা তটভূমি। তারপরই জঙ্গল। দ্বীপের একদিকে খাড়াই টিলা। সমুদ্র যেন হঠাৎ কোনও আক্রোশে তার ওপর বারংবার ঝাপিয়ে পড়ছে। কলকাতায় ফিরে এসেও এই ছবি বার বার মনে ফিরে আসত।
লেক থেকে ঘুরে এসে অখণ্ড অবসর। তাই রিসর্টের নরম গাসের ওপর শুরু হল ফটো সেশন। মোবাইল, ক্যামেরা, হ্যািণ্ডক্যাম কিছুই বাদ গেল না ঘন্টা দুয়েকের সেই কসরতে। রইল সন্ধ্যাবেলা বাঙালির শুভবিজয়াও।
পরদিন সকালে আমাদের ইউমিয়াম লেক রিসর্ট ছাড়ার কথা। কিন্তু বিজয়াদশমীর সন্ধ্যাবেলাতেই বোঝা গেল শিলংয়ে আদতে যেখানে ওঠা হবে বলে ঠিক হয়েছিল তা বেঠিক হয়ে গেছে। ফলে প্রবল উদ্যমে কাকলি তার সেলফোন থেকে শিলংয়ে হোটেল বুকিংয়ে নেমে পড়ল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর তা হয়েও গেল। হোটেল পোলো টাওয়ার্স অামাদের জন্য দরজা খুলে দিল। তাই একাদশীর সকালে বরাপানি ছেড়ে রওনা দিলাম সেই দিকেই। অবশ্য রিসর্ট কতৃর্পক্ষের সঙ্গে একটা ছোটখাটো বাগযুেদ্ধর পর। অযথা কিছু ব্যয় ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টাই ছিল এর মূলে।
এ বার বাহন মারুতি ভার্সা। শিলংয়ে পৌছে অবশ্য খুব বেশিক্ষণ হোটেলের ঘরে থাকা হয়নি। নতুন সারথি বললেন, চলুন বেলা থাকতে থাকতে শিলং পিক্, এলিফ্যান্ট ফল্স আর গির্জা দেখে আসা যাক। শিলং যে রবীন্দ্র রচনার অন্যতম পীঠস্থান তা আগেই জানা ছিল। কিন্তু কবি শিলং-এ এসে কোথায় ছিলেন তা ছিল অজানা। হোটেল থেকে জানলাম, কবি এখানে দু’দফায় এসেছিলেন। ১৯১৯ আর ১৯২৩-এ। রিলবংয়ের দুটি বাড়ি সেই ঘটনার সাক্ষী। দু’দিন বাদে আমাদের গুয়াহাটি ফেরার পালা। ঠিক হল শিলং ছাড়ার আগে ওই দুটি বাড়ি অবশ্যই দেখে যাব।
ভার্সা ছুটল শিলং পিকের দিকে। শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ১৯৬৫ মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে যাকে বলে ‘পাখির চোখ’-এ মেঘালয়ের রাজধানীকে দেখা। দেশের আর পাচটা শিখরের মতো এখানেও দেখলাম ছবি তোলার ধুম। যে যেখানে পারছে হাসি মুখে ক্যামেরার সামনে দাড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ নিচে শিলং শহরের ছবি ‘জুম’ করে তুলতে ব্যস্ত। আশেপাশের দোকানে চলছে টুপি, হাতের কাজের ব্যস্ত বিক্রি। একমাত্র ব্যস্ত ছিল না বোধহয় মিঠি। সে তখন মনের আনেন্দ চিপ্স খাচ্ছে।
এরপর এলিফ্যান্ট ফল্স। মূল এবং সহযোগী জলপ্রপাত। বেশ কিছুটা নেমে যেতে হয়। যার পক্ষে পুরোটা নামা সম্ভব নয়, তিনি মাঝপথেও িবশ্রাম নিতে পারেন। গেলাম গির্জাতেও। হোটেলে ফেরার আগে পুলিশ বাজারের ভিড়ে গা ভাসানো হল। পুলিশ বাজারের চাইনিV হোটেলের দোতলার রেেস্তারায় খেতে খেতে নজরে আসছিল মানুষের ঢল। আলো ঝলমল সেই সন্ধ্যা দেখতে দেখতে ভুল হচ্ছিল, কলকাতায় নেই তো?
পরদিন যাওয়া হল ১৮ হোলের বিখ্যাত শিলং গল্ফ কোর্স দেখতে। অেক্টাবরে দেশের তাবড় গলফার ‘গ্লেন ইগলস অফ দি ইস্ট’-এ এসে জড়ো হন প্রতিযোগিতায়। ইতিহাস বলছে গলফ খেলার জন্য িব্রটিশ আইসিএস অফিসাররা ১৮৯৮ সালে ৯ হোলের এক গল্ফ কোর্স তৈরি করেন। ১৯২৪ সালে এসে সেটাই বেড়ে হয় ১৮ হোলের কোর্স। ছবির মতো কোর্সটা আদতে শিলংয়েরই এক টুকরো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেড় হাজার মিটার উচুতে এই শহরের এভিনিউতে হাটলেই যে মন ভাল হয়ে যায়, তা গাড়িতে বসেই বেশ বুঝতে পারছিলাম।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, ১৮৬৪ সালে শিলং গ্রামে িব্রটিশরা শহর পত্তন করেন। বর্তমানে ২ লক্ষ ৬০ হাজার বাসিন্দার এই শহর, ১৯৭২ সালে, মেঘালয়ের জন্মলগ্নের আগে পর্যন্ত অসমের রাজধানী ছিল। স্থানীয় কাগজে দেখলাম ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে উপজাতিদের সঙ্গে শিলং নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের বিরোধের কথা। শিলং ও তার আশেপাশের এলাকা এক উপজাতির কাছ থেকে লিজে নিয়েছিল তদানীন্তন িব্রটিশ সরকার। সেই লিজের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন সেই উপজাতির মানুষ তাদের জমি ফেরত চাইছেন। সরকারের তো মাথায় হাত! পুরো শিলংটাই তো চলে যাবে জমি ফেরত দিতে গেলে। ফলে মামলা মোকদ্দমা, রাস্তায় নামা।
গুয়াহাটি যাওয়ার পথে রিলবংয়ে রবি ঠাকুরের দুটি বাড়িও দেখা হল। আশ্চর্য ব্যাপার যে প্রতিবেশীদের অনেকেই এই বাড়ির সম্পর্কে জানেন না। মেঘালয় বিধানসভার পাশেই পুরনো কাঠের বাড়ি। কলকাতা থেকে আসছি শুনে মাঝবয়সী কেয়ারটেকার সাগ্রহে দরজা খুলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে এই বাড়িতে কয়েক মাসের জন্য ছিলেন। কবির মনে ‘শেষের কবিতা’র জন্ম হতে শুরু করে তখনই।
এখন বাড়ির ভেতরে রবীন্দ্রনাথের আকা ছবির কিছু প্রতিলিপি দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে মাত্র। মেঝেতে জড়ো করা রয়েছে আরও কয়েকজন শিল্পীর কাজ। কেয়ারটেকার যা জানালেন তার মর্মার্থ হল, এই বাড়ি পড়ে ছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। এখন পুলিশের দফতর হয়েছে। মেঘালয় সরকারও উদ্যোগী হয়ে কবির স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছেন। এখন চেষ্টা চলছে হাল ফেরানোর।
িদ্বতীয় বাড়িটির অবশ্য হাল ফেরানোর কোনও দরকার নেই। ছবির মতো সুন্দর বাড়ি এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। ১৯২৩ সালে এখানে বসেই কবি ‘রক্তকরবী’ আর ‘শিলংয়ের চিঠি’ লেখেন। এই বাড়িতে ঢোকা সোজা হয়নি। বিশাল গেট। তাও বন্ধ। প্রথম বাড়ির কেয়ারটেকার নিজে এসে ডাকাডাকি করলেন। উত্তরে প্রথমে এল এক বিশাল অ্যালসেশিয়ান। তারপর বাড়ির পরিচারক। তিনি অ্যালসেশিয়ানকে বেধে গেট খুললেন। গেটের পাশেই ফলক। কবির স্মৃতিধন্য হওয়ার কথা সেখানেই লেখা। বাড়ির মধ্যে অবশ্য ঢোকা যায়নি। কারণ বাড়ির মালিক কলকাতায়। তাই বাড়ির বাইরেটা ঘুরেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছিল। বন্ধ ঘরের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করেছিলাম কবির রচনাকালকে।
এবারের যাত্রা শেষ হয়েছিল পরের দিন গুয়াহাটি বিমানবন্দরে। গুয়াহাটির হোটেল থেকে কামাখ্যা মিন্দরে নিয়ে গিয়েছিলেন এক নতুন সারথি, সিরাজ। তার কয়েকটা কথা মন ছুয়ে গিয়েছিল। কাঠ বাঙাল ভাষায় বলছিলেন, ‘‘দ্যাহেন, আপনারা এহানে দেখতে আহেন বটে, কিন্তু মন দিয়া দ্যাহেন না। মন পড়ে থাহে বাড়ির দিকা। আমি বলি কি, এই ক’দিন না হয় ভুইলাই গেলেন সংসারের কহা। এত রঙ ছড়াইয়া বইস্যা আসে মা প্রকৃতি, তারই রঙ লাগান না। মন ভাল হইবই-ই হইব।’’
মন ভাল হয়েছিল। বারংবার বারণ করা সেত্ত্বও তিনি ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দরের গেট পর্যন্ত এসেছিলেন। বিদায়ের সময় হাতজোড় করে বললেন, ‘‘আবার আইবেন।’’ এত সমাদর এই যাত্রায় কেউ আমাদের করেননি।
চেরাপুিঞ্জর আমেজ নিয়ে চললাম বরাপানির দিকে। কলকাতার পাচ বঙ্গসন্তানের প্রথম উত্তর-পূর্ব ভারত দর্শনের িদ্বতীয় গন্তব্যস্থল।
শিলংয়ের অনতিদূরে ইউমিয়াম হ্রদ। এরই অন্য নাম বরাপানি। কথা ছিল পৃথিবী বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ চালর্স কোরিয়ার ডিজাইন করা রিসর্টে দিন দুয়েক থাকার। যাত্রাপথে যেহেতু মেঘালয়ের রাজধানী শিলং পড়বে তাই ঠিক হল সেখানেই মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেওয়া হবে।
ফের সিমেন্ট কারখানার চিমনি, তালা ঝোলানো সেল্স অফিস দেখতে দেখতে বোলেরো চেরাপুিঞ্জ থেকে শিলং-এর পথ ধরল।
৩৬ ঘন্টা আগের যে রাস্তা অন্ধকারের মোড়কে প্রায় দুঃস্বেপ্নর আকার নিয়েছিল সেই রাস্তাই শিলং ফেরার পথে এ বার তার রং-রূপ বর্ণ-গন্ধ মেলে ধরল আমাদের সামনে। রাস্তার এক পাশে খাদ, দূরে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম। পাহাড়ি শিশুদের খেলা। কাকতাড়ুয়া। যা দেখে মিঠি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তার ধারণাতেই আসছিল না বইয়ের পাতার ছবি থেকে কী ভাবে পাহাড়ি উপত্যকায় নেমে এল কাকতাড়ুয়ার দল!
হলিউডের ছবির মত দৃশ্যাবলি। দিগন্তঘেরা পাহাড়শ্রেণি। মাঝখানে উপত্যকা। শীত আসি আসি করছে মধ্য অেক্টাবরের বেলায়। তাই রোদ্দুরটাও কেমন মোলায়েম। এমন পিকচার পোস্টকার্ড-এ কী শুধু গাড়ি চড়ে চলে যাওয়া যায় নীরব দর্শক হয়ে? নেমে পড়লাম। যত দূর চোখ যায় উপত্যকার বুক চিরে একে বেকে চলে যাওয়া রাস্তায় ছোট খেলনার মত গাড়ির সারি। ঢেউ খেলানো উপত্যকায় মাঝে মধ্যেই বড় বড় লম্বা পাথর রাখা। অদ্ভুত লেগেছিল প্রথমে। পরে জানতে পারলাম িপ্রয়জনের স্মৃতির উেদ্দশ্যে রাখা এই পাথরখণ্ডকে ‘কিমন’ বলে। নির্জন সেই উপত্যকায় ছবির মত দৃশ্যে কেমন যেন মন কেমন করা বারবেলা সেটি। সময় যেন থমকে দাড়িয়ে রয়েছে প্রস্তরখণ্ড হয়ে।
এক সময় দেখলাম পাহাড়ি বাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সাভানার মত হলুদ ঘাসজমি। তার মধ্যেই পথ চিনে গাড়ি ছুটছিল। হঠাৎ মনে হল, এত দৌড়চ্ছি কেন আমরা? কীসের টানে? কেন ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে এলাম এখানে? কারণ একটাই। অন্য এক পৃথিবী দেখব বলে! আর সেই পৃথিবীই যখন তার প্যালেট খুলে ছবি আকছে তখন কোথায় হন্তদন্ত হয়ে চলেছি? গাড়ি থেমে গেল। রাস্তায় কদাচিৎ চলা যানবাহনের শব্দ ছাড়া ছিল শুধু হাওয়ার শব্দ। হাওয়ায় দোলা হলদেটে ঘাস, নীল আকাশ, পেজা তুলোর মত সাদা মেঘ, দিগেন্ত ঘিরে থাকা পাহাড় শ্রেণি রয়ে গেল মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য।
মহানবমী যে চলছে তা মনে পড়ল শিলংয়ের পুলিশ বাজারে গিয়ে। শহরের ব্যস্ততম এলাকা পুলিশ বাজার এক্কেবারে মিনি ধর্মতলা। বাস, ট্যািক্স, গাড়ির ভিড়ে ভিড়াক্কার।
দলে দলে মানুষ নতুন পোশাক পরে বেরিয়েছেন। অবস্থা এমনই যে পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া ভার। যে কোনও উৎসবের বা সপ্তাহ শেষের সন্ধ্যায় পার্ক িষ্ট্রটের রেেস্তারার বাইরে দাড়ানো অপেক্ষমান জনতা অতি পরিচিত দৃশ্য। সেই দৃশ্যেরই হুবহু প্রতিলিপি দেখলাম মহানবমীর পুলিশ বাজারে। যে রেেস্তারাতেই যাই, ঠাই নেই, ঠাই নেই। কয়েক ঘন্টার যাত্রা শেষে পেটে তখন ছুচো ডন দিচ্ছে। শেষে রাস্তার পাশে মাঝারি গোছের চিনা খাবারের দোকানেই অর্ডার দেওয়া হল। খাবার আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই কাচের দেওয়ালের ওপাশে মহানবমীর দুপুরের শিলংকে দেখতে মনোযোগী হলাম।
উত্তর পূর্ব ভারতের রাণী হিসেবে এই শহর পরিচিত। দেখলাম তার সঙ্গে মানানসই হয়ে উঠেছেন মহানবমীর দর্শনার্থীরা। পুজোর সময় কলকাতার ফ্যাশন েস্টটমেন্ট দেখতে বিেশ্বর নানা প্রান্ত থেকে বাঙালিরা ছুটে আসেন। আমার মনে হয় তারা শিলং-এও আসতে পারেন। ঠাওর করে দেখলাম টমি হিলফিগার, বেনেটন, রিবক, নাইকি, অ্যাডিডাস-কোনও নামি দামি ব্র্যাণ্ড বাদ নেই সেই জনেস্রাতে। পাশাপাশি পাহাড়ি ঐতিহ্যের সাজও নজরে পড়ছিল। হলফ করে বলতে পারি, বিখ্যাত ব্র্যােণ্ডর মধ্যে সেই সাজ শিলংয়ের ফ্যাশন কালচারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ঠিক যেন পূব পিশ্চমের ফ্যাশন মিশেল। মিশেল ছিল ভাষাতেও। জনেস্রাত থেকে যেমন ভেসে আসছিল টুকরো টুকরো বাংলা শব্দ, তেমনই খাসি, গারো শব্দও ছুয়ে যাচ্ছিল কর্ণকুহর।
চাইনিজ খেয়ে রওনা দিলাম বরাপানির দিকে, যার পোষাকি নাম ইউমিয়াম লেক। কিন্তু রাস্তায় তখন মানুষের ঢল। ৪৮ ঘন্টার ফারাকে চরম নির্জনতা থেকে যানজটে আটকে যাওয়া। কয়েক ঘন্টা আগেও মোবাইলের কোনও নেটওয়ার্ক ছিল না। শব্দ বলতে ছিল ঁঝিঁঝির ডাক। আর এখন গাড়িতে চারটে মোবাইলই অনবরত বেজে চলেছে। সারথিরটা ধরলে পাচটা। বিভিন্ন গাড়ি আর কয়েক হাজার মানুষের সমবেত শব্দজাল ঘিরে ধরেছিল আমাদের। সেই যানজট কাটিয়ে লরির ধুলো খেতে খেতে ইউমিয়াম লেক রিসর্টে পৌছনো।
রিসর্ট ঝকঝকে তকতকে। যেমন পাচতারা মার্কা রিসর্ট হয় আর কি! তবে খেতে বসে মনে হয়েছিল বাইরের ঝকঝকে ভাবের সবটা বোধহয় রান্নায় ধরা পড়েনি। পরিবেশনেও রয়ে গিয়েছে কেমন গা ছাড়া ভাব। রিসর্টের দোতলায়, ঘরের বারান্দায় এসে চোখ ভরে গেল অন্য স্বাদে।
পরদিন সকালে ঘুমের আমেজ কাটিয়ে আলাপ হল রিসর্টের অন্য এক বাসিন্দার সঙ্গে। পেলাম এক নতুন বন্ধু। সে এক অসম তনয়া। পড়ে গুয়াহাটির এক কলেজে। পুজোর ছুটিতে মা বাবার সঙ্গে একদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে বরাপানি। এখন সাত সকালেই বাড়ির সবার সঙ্গে চলেছে শিলচর। সেখানে দিদা তার আদরের নাতনিকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন যে! নাতনিও উদগ্রীব তার দিদাকে দেখার জন্য। কিন্তু জিন্স পরে একটু চিন্তাও হচ্ছে। দিদা যে পিশ্চমি পোশাক একেবারেই পছন্দ করেন না।
শুনেছিলাম রিসর্টের সামনেই লেক। কিন্তু দেখতে পেলাম না। কারণ সেটি ঢাকা পড়ে গিয়েছে তীরের বনানীতে। হ্রদ দেখতে না পেয়ে যখন হতাশ, ঠিক তখনই নাম না জানা পাখির দল ডেকে উঠল। উচু একটা গাছের মাথায় ডাকতে ডাকতে তারা জড়ো হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ একসঙ্গে উড়ে গেল অন্য গাছে। নীচের দিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল নানান রঙের প্রজাপতি।
আর না! হাল্কা রোদ গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু দূর যাওয়ার পরই গাছের ফাক দিয়ে হ্রদের জল দেখা গেল। ছোট ছোট ঢেউ এসে পাড়ে ধাক্কা খাচ্ছে। আশপাশের পাহাড়ে সকালের রোদ পড়েছে। সেই রোদে কেমন মায়াবি লাগছে খাসি পাহাড় শ্রেণিকে। হ্রদের মধ্যে দ্বীপ। দূর থেকে বেশ বোঝা গেল সেই দ্বীপও সকালের রোদ্দুরে আলস্য কাটিয়ে জেগে উঠছে
লেকের পাড়েই আলাপ হল চার বন্ধুর সঙ্গে। এসেছে শিলং থেকে। সবাই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া। দিব্যি আগুন জ্বালিয়ে রান্না চড়িয়েছে। কেউ কুটনো কুটছে। কেউ দেখছে আচটা ঠিক মত হল কি না। সবুজ জলের ধারে বসা এক তরুণ আপন মনে গিটারে সুর তুলছে। চুপ করে দাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম সুরটা। পারলাম না। কারণ ঠিক তখনই গিটারের শব্দ থেমে গেল। পাহাড়ি তরুণের নজর পড়েছে অনাহুত দর্শকের দিকে। লাজুক মুখে সে গিটার সরিয়ে রাখল। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর অবশ্যি একটু পরে ফের সুর ধরল। কিন্তু দু’ বার শুনেও সুরটা বুঝলাম না।
লেকে লঞ্চ ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে মেঘালয় সরকারের ‘মোটর বাসে’। লেঞ্চর ই অন্য নাম। মিনিট কুড়ির ভ্রমণ। সেখানেই দেখলাম জলের রঙের কত রূপ। পাড়ের ঘন জঙ্গলের ছায়ায় জলের রঙ হয়েছে গাঢ় সবুজ। আর মধ্যিখানে যেখানে কোনও ছায়ারই সম্ভাবনা নেই, সেখানে প্রকৃতির ভাণ্ডারে কোনও রঙও রাখা হয়নি। পাইলট মাঝে মধ্যেই জানাচ্ছিলেন হ্রদের কোথায় জলের কত গভীরতা। কিন্তু সেই গভীরতার চেয়েও আমার মন টানল হ্রদের মধ্যিখানে এক দ্বীপ। ইতস্তত গাছ রয়েছে সেখানে। ছোট টিলার ওপর রয়েছে ঘর। কল্পনা করতে চেষ্টা করছিলাম নির্জন সেই দ্বীপবাসীদের এবং মনে পড়ে গেল আরও একটা দ্বীপের কথা।
আন্দামান সাগরের বুকে জঙ্গলে ভরা ছোট্ট দ্বীপ। লঞ্চ থেকে দেখা। দ্বীপের সামনে খানিকটা তটভূমি। তারপরই জঙ্গল। দ্বীপের একদিকে খাড়াই টিলা। সমুদ্র যেন হঠাৎ কোনও আক্রোশে তার ওপর বারংবার ঝাপিয়ে পড়ছে। কলকাতায় ফিরে এসেও এই ছবি বার বার মনে ফিরে আসত।
লেক থেকে ঘুরে এসে অখণ্ড অবসর। তাই রিসর্টের নরম গাসের ওপর শুরু হল ফটো সেশন। মোবাইল, ক্যামেরা, হ্যািণ্ডক্যাম কিছুই বাদ গেল না ঘন্টা দুয়েকের সেই কসরতে। রইল সন্ধ্যাবেলা বাঙালির শুভবিজয়াও।
পরদিন সকালে আমাদের ইউমিয়াম লেক রিসর্ট ছাড়ার কথা। কিন্তু বিজয়াদশমীর সন্ধ্যাবেলাতেই বোঝা গেল শিলংয়ে আদতে যেখানে ওঠা হবে বলে ঠিক হয়েছিল তা বেঠিক হয়ে গেছে। ফলে প্রবল উদ্যমে কাকলি তার সেলফোন থেকে শিলংয়ে হোটেল বুকিংয়ে নেমে পড়ল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর তা হয়েও গেল। হোটেল পোলো টাওয়ার্স অামাদের জন্য দরজা খুলে দিল। তাই একাদশীর সকালে বরাপানি ছেড়ে রওনা দিলাম সেই দিকেই। অবশ্য রিসর্ট কতৃর্পক্ষের সঙ্গে একটা ছোটখাটো বাগযুেদ্ধর পর। অযথা কিছু ব্যয় ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টাই ছিল এর মূলে।
এ বার বাহন মারুতি ভার্সা। শিলংয়ে পৌছে অবশ্য খুব বেশিক্ষণ হোটেলের ঘরে থাকা হয়নি। নতুন সারথি বললেন, চলুন বেলা থাকতে থাকতে শিলং পিক্, এলিফ্যান্ট ফল্স আর গির্জা দেখে আসা যাক। শিলং যে রবীন্দ্র রচনার অন্যতম পীঠস্থান তা আগেই জানা ছিল। কিন্তু কবি শিলং-এ এসে কোথায় ছিলেন তা ছিল অজানা। হোটেল থেকে জানলাম, কবি এখানে দু’দফায় এসেছিলেন। ১৯১৯ আর ১৯২৩-এ। রিলবংয়ের দুটি বাড়ি সেই ঘটনার সাক্ষী। দু’দিন বাদে আমাদের গুয়াহাটি ফেরার পালা। ঠিক হল শিলং ছাড়ার আগে ওই দুটি বাড়ি অবশ্যই দেখে যাব।
ভার্সা ছুটল শিলং পিকের দিকে। শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ১৯৬৫ মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে যাকে বলে ‘পাখির চোখ’-এ মেঘালয়ের রাজধানীকে দেখা। দেশের আর পাচটা শিখরের মতো এখানেও দেখলাম ছবি তোলার ধুম। যে যেখানে পারছে হাসি মুখে ক্যামেরার সামনে দাড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ নিচে শিলং শহরের ছবি ‘জুম’ করে তুলতে ব্যস্ত। আশেপাশের দোকানে চলছে টুপি, হাতের কাজের ব্যস্ত বিক্রি। একমাত্র ব্যস্ত ছিল না বোধহয় মিঠি। সে তখন মনের আনেন্দ চিপ্স খাচ্ছে।
এরপর এলিফ্যান্ট ফল্স। মূল এবং সহযোগী জলপ্রপাত। বেশ কিছুটা নেমে যেতে হয়। যার পক্ষে পুরোটা নামা সম্ভব নয়, তিনি মাঝপথেও িবশ্রাম নিতে পারেন। গেলাম গির্জাতেও। হোটেলে ফেরার আগে পুলিশ বাজারের ভিড়ে গা ভাসানো হল। পুলিশ বাজারের চাইনিV হোটেলের দোতলার রেেস্তারায় খেতে খেতে নজরে আসছিল মানুষের ঢল। আলো ঝলমল সেই সন্ধ্যা দেখতে দেখতে ভুল হচ্ছিল, কলকাতায় নেই তো?
পরদিন যাওয়া হল ১৮ হোলের বিখ্যাত শিলং গল্ফ কোর্স দেখতে। অেক্টাবরে দেশের তাবড় গলফার ‘গ্লেন ইগলস অফ দি ইস্ট’-এ এসে জড়ো হন প্রতিযোগিতায়। ইতিহাস বলছে গলফ খেলার জন্য িব্রটিশ আইসিএস অফিসাররা ১৮৯৮ সালে ৯ হোলের এক গল্ফ কোর্স তৈরি করেন। ১৯২৪ সালে এসে সেটাই বেড়ে হয় ১৮ হোলের কোর্স। ছবির মতো কোর্সটা আদতে শিলংয়েরই এক টুকরো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেড় হাজার মিটার উচুতে এই শহরের এভিনিউতে হাটলেই যে মন ভাল হয়ে যায়, তা গাড়িতে বসেই বেশ বুঝতে পারছিলাম।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, ১৮৬৪ সালে শিলং গ্রামে িব্রটিশরা শহর পত্তন করেন। বর্তমানে ২ লক্ষ ৬০ হাজার বাসিন্দার এই শহর, ১৯৭২ সালে, মেঘালয়ের জন্মলগ্নের আগে পর্যন্ত অসমের রাজধানী ছিল। স্থানীয় কাগজে দেখলাম ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে উপজাতিদের সঙ্গে শিলং নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের বিরোধের কথা। শিলং ও তার আশেপাশের এলাকা এক উপজাতির কাছ থেকে লিজে নিয়েছিল তদানীন্তন িব্রটিশ সরকার। সেই লিজের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন সেই উপজাতির মানুষ তাদের জমি ফেরত চাইছেন। সরকারের তো মাথায় হাত! পুরো শিলংটাই তো চলে যাবে জমি ফেরত দিতে গেলে। ফলে মামলা মোকদ্দমা, রাস্তায় নামা।
গুয়াহাটি যাওয়ার পথে রিলবংয়ে রবি ঠাকুরের দুটি বাড়িও দেখা হল। আশ্চর্য ব্যাপার যে প্রতিবেশীদের অনেকেই এই বাড়ির সম্পর্কে জানেন না। মেঘালয় বিধানসভার পাশেই পুরনো কাঠের বাড়ি। কলকাতা থেকে আসছি শুনে মাঝবয়সী কেয়ারটেকার সাগ্রহে দরজা খুলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে এই বাড়িতে কয়েক মাসের জন্য ছিলেন। কবির মনে ‘শেষের কবিতা’র জন্ম হতে শুরু করে তখনই।
এখন বাড়ির ভেতরে রবীন্দ্রনাথের আকা ছবির কিছু প্রতিলিপি দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে মাত্র। মেঝেতে জড়ো করা রয়েছে আরও কয়েকজন শিল্পীর কাজ। কেয়ারটেকার যা জানালেন তার মর্মার্থ হল, এই বাড়ি পড়ে ছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। এখন পুলিশের দফতর হয়েছে। মেঘালয় সরকারও উদ্যোগী হয়ে কবির স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছেন। এখন চেষ্টা চলছে হাল ফেরানোর।
িদ্বতীয় বাড়িটির অবশ্য হাল ফেরানোর কোনও দরকার নেই। ছবির মতো সুন্দর বাড়ি এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। ১৯২৩ সালে এখানে বসেই কবি ‘রক্তকরবী’ আর ‘শিলংয়ের চিঠি’ লেখেন। এই বাড়িতে ঢোকা সোজা হয়নি। বিশাল গেট। তাও বন্ধ। প্রথম বাড়ির কেয়ারটেকার নিজে এসে ডাকাডাকি করলেন। উত্তরে প্রথমে এল এক বিশাল অ্যালসেশিয়ান। তারপর বাড়ির পরিচারক। তিনি অ্যালসেশিয়ানকে বেধে গেট খুললেন। গেটের পাশেই ফলক। কবির স্মৃতিধন্য হওয়ার কথা সেখানেই লেখা। বাড়ির মধ্যে অবশ্য ঢোকা যায়নি। কারণ বাড়ির মালিক কলকাতায়। তাই বাড়ির বাইরেটা ঘুরেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছিল। বন্ধ ঘরের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করেছিলাম কবির রচনাকালকে।
এবারের যাত্রা শেষ হয়েছিল পরের দিন গুয়াহাটি বিমানবন্দরে। গুয়াহাটির হোটেল থেকে কামাখ্যা মিন্দরে নিয়ে গিয়েছিলেন এক নতুন সারথি, সিরাজ। তার কয়েকটা কথা মন ছুয়ে গিয়েছিল। কাঠ বাঙাল ভাষায় বলছিলেন, ‘‘দ্যাহেন, আপনারা এহানে দেখতে আহেন বটে, কিন্তু মন দিয়া দ্যাহেন না। মন পড়ে থাহে বাড়ির দিকা। আমি বলি কি, এই ক’দিন না হয় ভুইলাই গেলেন সংসারের কহা। এত রঙ ছড়াইয়া বইস্যা আসে মা প্রকৃতি, তারই রঙ লাগান না। মন ভাল হইবই-ই হইব।’’
মন ভাল হয়েছিল। বারংবার বারণ করা সেত্ত্বও তিনি ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দরের গেট পর্যন্ত এসেছিলেন। বিদায়ের সময় হাতজোড় করে বললেন, ‘‘আবার আইবেন।’’ এত সমাদর এই যাত্রায় কেউ আমাদের করেননি।
No comments:
Post a Comment