আফ্রিকা মহাদেশের জনবহুলতম শহর কায়রোর প্রসিদ্ধি তার ঐতিহাসিক
বাতাবরণে। কিন্তু কৌলীন্য ছাপিয়েও উদ্ভাসিত হয় তার দ্বৈত সত্তা।
প্রাচীনেত্বর ধুলো ঝেড়ে আধুনিক বৈভবে গা ভাসাতে চায় মিশরের রাজধানী। আবার
খান-এল-খালিল বাজারের সরু গলিতে কৌশারি আর কাবাবের সুঘ্রাণে ভর করে, সুফি
গানের মূর্চ্ছনায় ফিরে আসে প্রাচ্যের অকৃত্রিম আমেজ। বহুরূপী নগরীর নানান
রূপে মুগ্ধ হয়েছেন লেখক।
বিমা সংক্রান্ত কনফারেন্সে চার দিনের মিশর সফর। বেশ ব্যাজার মুখ আমাদের সকলের। অর্থাৎ প্রায় পচিশ জনের সাংবাদিক দলের প্রত্যেকের। কারণ কায়রো আর নীল নদের হাতছানির আস্বাদ তখন একটু হলেও পেয়েছি আমরা সকলেই। শিক্ষার তুলনায় না-দেখা ইতিহাসই টানছে তখন। কিন্তু উপায় নেই। যে কারণে এই ফারাওদের দেশে আসা, আগে তো সেই কনফারেন্স।
মিশরের রাজধানী কায়রোর প্রসিদ্ধি তার ঐতিহাসিক কৌলীন্যের জন্য। ‘কায়রো’ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘আল-কাহিরা’ থেকে, যার অর্থ ‘বিজয়ী’। সরকারি নথিপত্রেও শহরের নাম ‘আল-কাহিরা’। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে জনবহুল কায়রোর বাসিন্দাদের বলা হয় ‘মাসরাওয়েয়া’। প্রায় ৭.৭ কোটি মানুষের ঠাঁই এই শহরে। ফাতিমিদ খলিফাদের হাতে কায়রোর গোড়াপত্তন হলেও, কালের স্রোত বেয়ে মামলুক, অটোম্যান তুর্কি, এমনকী সম্রাট নেপোলিয়নও এই শহর শাসন করেছেন। মিশরের এক শাসক মহম্মদ আলি, কায়রোকে তাঁর রাজ্যের রাজধানী করেন। ১৮০৫ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত। এর পর শাসন ভার চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। অবশেষে ১৯২২ সালে স্বাধীনতা লাভ করে মিশর।
কনফারেন্স শেষে কায়রো ঘুরে যা দেখলাম, প্রত্যাশা ছাড়িয়ে তা পুষিয়ে দিল ইতিহাসই।
নীল নদের তীরে এই শহরের প্রধানত দু’টি বিভাজন— প্রাচীন ও আধুনিক। প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন নিয়ে ‘ওল্ড কায়রো’তে আছড়ে পড়ে প্রাত্যহিক ভিন দেশি পর্যটক। কিন্তু শহরের অভিজাত আধুনিক অঞ্চল সাজানো চোখ ধাধানো নব্য যুগের স্থাপত্যশৈলীতে।
শহরের একপাশে রয়েছে ভিক্টোরিয়ান ভিলা, সুন্দর রাস্তা, ঝকঝকে দোকান। আবার শহরের অন্য প্রান্তে হতশ্রী সব বাড়ি। কোনও বাড়ির বাইরেটাই রং করা হয়নি। স্থানীয় একজন জানালেন যে, কর দেওয়ার ভয়ে রঙের পোচ দেন না গৃহকর্তা। মজাই লাগল শুনে। এ যেন দু’টি ভিন্ন শহর।
আমাদের হোটেল নাইল হিলটন এই সাজানো শহরেরই অংশে। এক সন্ধ্যায় হাটা পথেই পৌছে গেলাম স্থানীয় খাবারের রেস্তোরায়। ফুল মুদাম্মাস, কৌশারি, জেবনা মাকলেয়া, বামিয়া ও বাকলাভা। সবই নিরামিষ খাবার। তবে প্রচুর পরিমাণে রসুন থাকে। সবচেয়ে জনিপ্রয় খাবার এখানে কৌশারি। খুব কম দামে সম্পূর্ণ ‘ডিশ’ বলতে যা বোঝায়। ডাল, মটরশুটি, চাল দিয়ে তৈরি হয়। এ ছাড়াও, রয়েছে নানা রকমের কাবাব।
কায়রো দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি বাজার খান-এল-খালিলি না যাওয়া হয়। অসংখ্য গলির সংমিশ্রণে এই বাজার। সব ক’টা গলি প্রায় এক মনে হয়।
রাস্তার দু’পাশে কয়েক ধাপ নামলেই বাজারের মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়। পাথরের মূর্তি, পিরামিড, স্ফিংস, প্যাপিরাস পেন্টিং, গয়না, শাল, হুকা— সবই পাওয়া যায়। আর দর কষাকষিও চলে সমান ভাবে। তাই একবার দেখেই কিনে নেওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দাম বেশি মনে করে যেই এক পা এগিয়েছি, অমনি পেছন থেকে ডাক। এ বার কেনার মতো। অদ্ভুত মিল আমাদের গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজারের সঙ্গে! তবে গড়িয়াহাটের হকারদের সঙ্গে দর কষাকষি করে অভ্যস্তদের জন্যও বেশ কঠিন হতে পারে এখানে বাজার করা।
এক জন দোকানদার অবশ্য আমাকে একটু ছাড় দিলেন। অমিতাভ বচ্চনের দেশের লোক বলে সস্তায় প্যাপিরাস পেন্টিং পেলাম।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক ঘোরাঘুরির পর যখন সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তখন স্বভাবতই মনে হল একটু চা পেলে ভাল হত। বাজার চত্বরে ঢোকার পরেই লক্ষ করেছিলাম যে প্রায় প্রতি গলিতেই রয়েছে চায়ের দোকান। কোনও অসুবিধাই হল না। বসে পড়লাম একটি দোকানে। চা-কে এখানে শাই বলে। তবে চা পাতার সঙ্গে মেশানো থাকে পুদিনা পাতা। এর সঙ্গে ‘কিছু-মিছু’ বলতে বাকলাভা বা পাউরুটি। খেতে মন্দ নয়। তবে চায়ের কাপে চায়ের গন্ধই মানায়। অন্তত আমার মতে।
আছে আরও একটি ক্লান্তি তাড়ানোর উপায়। হুকা। বিভিন্ন সুগন্ধী তামাক দিয়ে হুকা টানার ব্যবস্থা। নানা রঙের কাচ দিয়ে তৈরি হুকাগুলি খুব ‘এথনিক’ দেখতে। ঘর সাজানোর আইটেম হিসেবেও বেশ আকর্ষণীয় বস্তু। বিভিন্ন ধরনের ফল-ফুলের সুগন্ধী দেওয়া তামাক। লোভ সংবরণ করার কোনও রকম বাসনাই হল না। কলকাতার বেশ কিছু ‘ক্যাফে কফি ডে (সি সি ডি)’ তে এই ব্যবস্থা আছে। আছে ‘শিসা’ নামে ডিেস্কাথেকেও। কিন্তু কখনও সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তাই পরদেশেই মিটিয়ে নিলাম হুকা টানার শখ। তবে হুকা টানা খুব সহজ নয়। ধোয়া ছাড়াটা আরও গণ্ডগোলের। আমি তো ধোয়া ছাড়া আর গিলে ফেলার মাঝামাঝি একটা জায়গায় আটকে গিয়ে বাকি সকলের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলাম।
কায়রোর সঙ্গে কলকাতার আরও একটা মিল রয়েছে। তা হল ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার রীতি। এখানে সিগনালের আলো নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায় বলে মনে হল না। হুড়োহুড়ি করে রাস্তা পার হওয়া বা প্রায় অন্ধের মতো আরেকটি গাড়িকে ধাক্কা মারতে যাওয়ার আগে কোনও রকমে ব্রেক কষা, সবই খুব চেনা লাগল। সন্ধ্যায় অফিস ছুটির পর জ্যাম হওয়াও বেশ স্বাভাবিক মনে হল। শহরে বহু মহিলাই ‘ওয়ার্কিং উওম্যান’। এবং সবাই মাথা ঢেকে রাখলেও, পোশাক পরেন পাশ্চাত্য কায়দায়। আর সন্ধ্যার পরে নীল নদের ধার ধরেই আড্ডা, বেড়ানো ও সময় কাটানোর ভিড়।
চারটে দিন কী ভাবে কেটে গেল বুঝতে পারিনি। তবে ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়া সেই মিশর, পিরামিড, স্ফিংস বাস্তবে দেখা, জীবনে একটি বিশেষ অধ্যায় যোগ করে দিল।
বিমা সংক্রান্ত কনফারেন্সে চার দিনের মিশর সফর। বেশ ব্যাজার মুখ আমাদের সকলের। অর্থাৎ প্রায় পচিশ জনের সাংবাদিক দলের প্রত্যেকের। কারণ কায়রো আর নীল নদের হাতছানির আস্বাদ তখন একটু হলেও পেয়েছি আমরা সকলেই। শিক্ষার তুলনায় না-দেখা ইতিহাসই টানছে তখন। কিন্তু উপায় নেই। যে কারণে এই ফারাওদের দেশে আসা, আগে তো সেই কনফারেন্স।
মিশরের রাজধানী কায়রোর প্রসিদ্ধি তার ঐতিহাসিক কৌলীন্যের জন্য। ‘কায়রো’ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘আল-কাহিরা’ থেকে, যার অর্থ ‘বিজয়ী’। সরকারি নথিপত্রেও শহরের নাম ‘আল-কাহিরা’। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে জনবহুল কায়রোর বাসিন্দাদের বলা হয় ‘মাসরাওয়েয়া’। প্রায় ৭.৭ কোটি মানুষের ঠাঁই এই শহরে। ফাতিমিদ খলিফাদের হাতে কায়রোর গোড়াপত্তন হলেও, কালের স্রোত বেয়ে মামলুক, অটোম্যান তুর্কি, এমনকী সম্রাট নেপোলিয়নও এই শহর শাসন করেছেন। মিশরের এক শাসক মহম্মদ আলি, কায়রোকে তাঁর রাজ্যের রাজধানী করেন। ১৮০৫ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত। এর পর শাসন ভার চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। অবশেষে ১৯২২ সালে স্বাধীনতা লাভ করে মিশর।
কনফারেন্স শেষে কায়রো ঘুরে যা দেখলাম, প্রত্যাশা ছাড়িয়ে তা পুষিয়ে দিল ইতিহাসই।
নীল নদের তীরে এই শহরের প্রধানত দু’টি বিভাজন— প্রাচীন ও আধুনিক। প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন নিয়ে ‘ওল্ড কায়রো’তে আছড়ে পড়ে প্রাত্যহিক ভিন দেশি পর্যটক। কিন্তু শহরের অভিজাত আধুনিক অঞ্চল সাজানো চোখ ধাধানো নব্য যুগের স্থাপত্যশৈলীতে।
শহরের একপাশে রয়েছে ভিক্টোরিয়ান ভিলা, সুন্দর রাস্তা, ঝকঝকে দোকান। আবার শহরের অন্য প্রান্তে হতশ্রী সব বাড়ি। কোনও বাড়ির বাইরেটাই রং করা হয়নি। স্থানীয় একজন জানালেন যে, কর দেওয়ার ভয়ে রঙের পোচ দেন না গৃহকর্তা। মজাই লাগল শুনে। এ যেন দু’টি ভিন্ন শহর।
আমাদের হোটেল নাইল হিলটন এই সাজানো শহরেরই অংশে। এক সন্ধ্যায় হাটা পথেই পৌছে গেলাম স্থানীয় খাবারের রেস্তোরায়। ফুল মুদাম্মাস, কৌশারি, জেবনা মাকলেয়া, বামিয়া ও বাকলাভা। সবই নিরামিষ খাবার। তবে প্রচুর পরিমাণে রসুন থাকে। সবচেয়ে জনিপ্রয় খাবার এখানে কৌশারি। খুব কম দামে সম্পূর্ণ ‘ডিশ’ বলতে যা বোঝায়। ডাল, মটরশুটি, চাল দিয়ে তৈরি হয়। এ ছাড়াও, রয়েছে নানা রকমের কাবাব।
কায়রো দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি বাজার খান-এল-খালিলি না যাওয়া হয়। অসংখ্য গলির সংমিশ্রণে এই বাজার। সব ক’টা গলি প্রায় এক মনে হয়।
রাস্তার দু’পাশে কয়েক ধাপ নামলেই বাজারের মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়। পাথরের মূর্তি, পিরামিড, স্ফিংস, প্যাপিরাস পেন্টিং, গয়না, শাল, হুকা— সবই পাওয়া যায়। আর দর কষাকষিও চলে সমান ভাবে। তাই একবার দেখেই কিনে নেওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দাম বেশি মনে করে যেই এক পা এগিয়েছি, অমনি পেছন থেকে ডাক। এ বার কেনার মতো। অদ্ভুত মিল আমাদের গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজারের সঙ্গে! তবে গড়িয়াহাটের হকারদের সঙ্গে দর কষাকষি করে অভ্যস্তদের জন্যও বেশ কঠিন হতে পারে এখানে বাজার করা।
এক জন দোকানদার অবশ্য আমাকে একটু ছাড় দিলেন। অমিতাভ বচ্চনের দেশের লোক বলে সস্তায় প্যাপিরাস পেন্টিং পেলাম।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক ঘোরাঘুরির পর যখন সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তখন স্বভাবতই মনে হল একটু চা পেলে ভাল হত। বাজার চত্বরে ঢোকার পরেই লক্ষ করেছিলাম যে প্রায় প্রতি গলিতেই রয়েছে চায়ের দোকান। কোনও অসুবিধাই হল না। বসে পড়লাম একটি দোকানে। চা-কে এখানে শাই বলে। তবে চা পাতার সঙ্গে মেশানো থাকে পুদিনা পাতা। এর সঙ্গে ‘কিছু-মিছু’ বলতে বাকলাভা বা পাউরুটি। খেতে মন্দ নয়। তবে চায়ের কাপে চায়ের গন্ধই মানায়। অন্তত আমার মতে।
আছে আরও একটি ক্লান্তি তাড়ানোর উপায়। হুকা। বিভিন্ন সুগন্ধী তামাক দিয়ে হুকা টানার ব্যবস্থা। নানা রঙের কাচ দিয়ে তৈরি হুকাগুলি খুব ‘এথনিক’ দেখতে। ঘর সাজানোর আইটেম হিসেবেও বেশ আকর্ষণীয় বস্তু। বিভিন্ন ধরনের ফল-ফুলের সুগন্ধী দেওয়া তামাক। লোভ সংবরণ করার কোনও রকম বাসনাই হল না। কলকাতার বেশ কিছু ‘ক্যাফে কফি ডে (সি সি ডি)’ তে এই ব্যবস্থা আছে। আছে ‘শিসা’ নামে ডিেস্কাথেকেও। কিন্তু কখনও সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তাই পরদেশেই মিটিয়ে নিলাম হুকা টানার শখ। তবে হুকা টানা খুব সহজ নয়। ধোয়া ছাড়াটা আরও গণ্ডগোলের। আমি তো ধোয়া ছাড়া আর গিলে ফেলার মাঝামাঝি একটা জায়গায় আটকে গিয়ে বাকি সকলের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলাম।
কায়রোর সঙ্গে কলকাতার আরও একটা মিল রয়েছে। তা হল ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার রীতি। এখানে সিগনালের আলো নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায় বলে মনে হল না। হুড়োহুড়ি করে রাস্তা পার হওয়া বা প্রায় অন্ধের মতো আরেকটি গাড়িকে ধাক্কা মারতে যাওয়ার আগে কোনও রকমে ব্রেক কষা, সবই খুব চেনা লাগল। সন্ধ্যায় অফিস ছুটির পর জ্যাম হওয়াও বেশ স্বাভাবিক মনে হল। শহরে বহু মহিলাই ‘ওয়ার্কিং উওম্যান’। এবং সবাই মাথা ঢেকে রাখলেও, পোশাক পরেন পাশ্চাত্য কায়দায়। আর সন্ধ্যার পরে নীল নদের ধার ধরেই আড্ডা, বেড়ানো ও সময় কাটানোর ভিড়।
চারটে দিন কী ভাবে কেটে গেল বুঝতে পারিনি। তবে ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়া সেই মিশর, পিরামিড, স্ফিংস বাস্তবে দেখা, জীবনে একটি বিশেষ অধ্যায় যোগ করে দিল।
No comments:
Post a Comment