Wednesday, July 16, 2014

রাজারও ওপরে চিত্রকূট

চিত্রকূট ধাম কারবি স্টেশনে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ পৌছনোর বদলে, চম্বল এক্সেপ্রস যখন অবশেষে পৌছল তখন বেলা সাড়ে তিনটে। অক্টোবর মাস। শুকনো হাওয়া, রোদ ঝলমল। চওড়া প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছে মানুষ। তার মধ্যে দিয়ে একেবেকে বাইরে এসে দেখি স্টেশনের লাগোয়া এক মাঠ। পার্কিং লট হতে পারত, কিন্তু নয়। কেন না, সেখানে বাস ট্যািক্স অটো এমন কি একটা সাইকেল রিকশা পর্যন্ত নেই। এই স্টেশন পর্যটকদের সুযোগ সুবিধের কথা মনে রাখে না। সুতরাং সেখানে কোনও কিছু পাওয়ার আশা মুলতূবি রেখে লটবহর নিয়ে স্টেশনের চৌহিদ্দর বাইরে, রাস্তায় এসে দাড়ালাম। বড়বাজার মনে এল। বাস স্ট্যাণ্ডের কথা জিগ্যেস করতে সহৃদয় দোকানি জানালেন তার চেয়ে বরং অটো নেওয়া ভাল হবে। প্রথম কয়েক মিনিট হাটার চেষ্টা করে পরিত্যাগ করতে হল। মানুষ সাইকেল অটো গরু সমাগমে এই রাস্তা হাটার উপযুক্ত নয়। সুতরাং সাইকেল রিকশায় চড়া হল।
আধঘন্টা বাদে অটো স্ট্যােণ্ড হাজির হয়ে দেখি তখনও অনিশ্চিত লাগছে। অটোওয়ালা বললেন, মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেলে যেতে ১৫০ টাকা পড়বে। আতকে উঠে প্রতিবাদ করতে যাব, বললেন, আসলে ওটা তো মধ্যপ্রদেশে, এই গাড়ি তো সেখানে যাবে না। অন্য গাড়ি ধরতে হবে। তার মানে এটা? উত্তরপ্রদেশ, জানালেন অটোচালক। চিত্রকূট ধাম কার্বি যে উত্তরপ্রদেশে, জানতাম না।
কাছাকাছি বা পাশাপাশি দুটো শহরের উদাহরণ অনেক। কিন্তু দুই প্রদেশ জুড়ে একই শহরের নমুনা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। উত্তরপ্রদেশের বান্দা আর মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার মধ্যে ভাগাভাগি করে রয়েছে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই তীর্থস্থান, চিত্রকূট। এই সেই চিত্রকূট যার উল্লেখ পাওয়া যায় রামায়ণে। কৈকেয়ী আর মন্থরার ষড়যেন্ত্রর ফলে রামচন্দ্রকে ১৪ বছরের বনবাসে পাঠালেন রাজা দশরথ। রামচন্দ্র সেই বনবাসের সিংহভাগ কাটান চিত্রকূট পাহাড়ে। এ জায়গা, প্রকৃতির সৌন্দর্যের পীঠস্থানও বটে। উত্তর বিন্ধ্যর সবুজ সৌন্দর্যের কোনও কার্পণ্য নেই এখানে। শুধু তাই নয়, আধ্যাত্মিক স্থল হিসেবেও চিত্রকূট শীর্ষস্থানের অধিকারী। বড় পুরনো শহর। কিন্তু আর পাচটা প্রাচীন শহরের মতো ঘিঞ্জি জনবসতিতে ছেয়ে যায়নি। সামান্য ঢালু রাস্তা শহরের মধ্যে দিয়ে গেলেও তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে পারেনি।
বিকেলের সূর্য ঢলে পড়ছে। ছায়া লম্বা হচ্ছে। আমরা বেরলাম মন্দাকিনী দেখতে। পান্থ নিবাস থেকে বেরিয়ে পায়ে হাটা ছোট্ট পুল পেরতেই মধ্যপ্রদেশ থেকে উত্তরপ্রদেশে ঢুকলাম। দোকানের সারি তো নয়, এ যেন স্থায়ী মেলা। পাথর আর পেতলের পুজোর সামগ্রী থেকে শুরু করে হরেক জিনিস এই সব দোকানে। রূপ আর বর্ণের বৈচিত্র দেখে মনে হয় এখানে যেন কোনও উৎসব হচ্ছে। দোকানের সারির মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা চলে গিয়েছে নদীর একেবারে ধার পর্যন্ত। চওড়া চাতালের পরেই বয়ে যাচ্ছে মন্দাকিনীর চকচকে কালো জল। বাদিকে, নদীর ধার ধরে যতদূর চোখ যায়, বাধানো রাস্তার মতো চওড়া ঘাট। তার একদিকে সারি দেওয়া দোকান অন্য দিকে মন্দাকিনীর জল। গোটা এলাকা দিনের আলোর মতো ঝকঝক করছে। ধুপ ধুনো আর ফুলের হাল্কা গন্ধ চার দিকে।
এই হল রামঘাট। এখানে প্রত্যেক সেন্ধবেলা আরতি হয় নদীর একেবারে ধারে। আরতির জায়গা কোথায় জিগ্যেস করতে করতে সেই দিকে এগোচ্ছি। এক সময় এসে পড়লাম এক ঝাক আলোর নীচে বাধানো বেদীর সামনে। বেদীর ওপর পাথরের এক মূর্তি। এই সৌধের নাম তুলসী চবুতরা। ওই মূর্তি সন্ত তুলসীদাসের। ওই পাথরের বেদীর ওপরে বসে তুলসীদাস রাম চরিতমানস সৃষ্টি করেছিলেন। তুলসী চবুতরার পাশেই সন্ধ্যারতির আয়োজন। সিঁড়ির ওপর কিছুটা ফাকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। দেখতে দেখতে জায়গাগুলো ভরে গেল। তিলধারণের আর জায়গা নেই। তবু লোক আসছে। মনে মনে টেনশান হচ্ছে। এটা পিশ্চমবাংলা হলে এতক্ষণে ঠেলাঠেলি, গুতোগুতি শুরু হয়ে গিয়েছে, কিছু বচসাও। সামান্য হলেও অপ্রীতিকর কিছু একটা হবে বলে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কোথায় কী! যে যেমন জায়গা পেল বসল, যারা পেল না দাড়িয়ে দাড়িয়ে আরতি দেখার চেষ্টা করল। কোনও ক্ষোভ, বিরক্তি বা রাগের আভাস পেলাম না। আমরা যারা সর্বদা আসেপাশের মানুষের দাত নখ বেরতে দেখে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
পেতলের প্রদীপদানে আলো জ্বালানোর তৈয়ারি চলছে। ইতিমধ্যে, কাঠের ট্রে আর ডালি হাতে সামনে দিয়ে ঘুরতে শুরু করেছে ছোট মেয়েরা। তাদের ডালিতে রয়েছে শালপাতার ছোট ছোট রেকাবিতে ফুল আর দীপ। আরতির পর এই পাত্র মন্দাকিনীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা। তাতে পুণ্য কত হয় জানা যায় না, কিন্তু রাতের নদীর কালো জলের ওপর ওই আলোর সারির যে শোভা, তার তো তুলনা না থাকারই কথা। সামনে এল ছোট্ট বিমলা। দিনের বেলা স্কুলে যায়, ক্লাস সিক্সে পড়ে, সন্ধ্যের কিছুটা সময় ফুল আর আলো বিক্রি করে। দু’ টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে শালপাতার পাত্র কিনে বসে রইলাম।

ঘন্টা বেজে উঠল। ধুপ ধুনোর ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠে নদীর ও পারের অন্ধকারের দিকে ভেসে গেল। ওই বড় এক’শ আটটা প্রদীপের দানি প্রধান পুরোহিতের হাতে উঠল। সেই প্রদীপের আলোয় রোজকার মতো আজও চমকে উঠছে মন্দাকিনীর জল। তারপর আরতি শুরু হল মন্দাকিনীর। এ তো পুজো নয়। এ যে এক পরম স্নিগ্ধ উৎসব। েস্তাত্র শেষ হতে ভজন শুরু হল। নদীর ঢেউ বেয়ে তখনও ঘন্টার শব্দ চলেছে দূরে, বহু দূরে। সেই ঢেউয়ের মাথায় একে একে ভেসে চলেছে প্রদীপের বিন্দু।
আরতি শেষে সিঁড়ির ভিড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। তখনও ভজন হচ্ছে। আমরা উঠে রামঘাটের অনেকগুলো বাধানো বেঞ্চির একটাতে বসলাম। ঠাণ্ডা এমন কিছু বেশি নয়। সামনে আলো আর রাংতায় সাজানো ছাউনি দেওয়া বড় বড় নৌকো আনাগোনা করছে। এই সব নৌকো করে লোকে নদী থেকে সন্ধ্যারতি দেখে, নদীতে বিহারও করে। আরতি শেষে অনেক নৌকো ঘাটে ফিরেছে। কিছু এখনও মাঝনদীতে। পেছনে দোকানের সারি থেকে ভক্তিমূলক গান ভেসে আসছে। রামঘাটের পরিবেশ তা সেত্ত্বও শান্তিপূর্ণ। হই হট্টগোলের চিহ্ন নেই। নেই ফিরিওয়ালার উৎপাত কিংবা দোকানিদের কানবিদীর্ণ করা হাক ডাক। সমগ্র মধ্যপ্রদেশের মতো এখানেও কান পাতলে শোনা যায়, কিছুটা নির্বিবাদী আর কিছুটা উদাস এক সুর।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংখ্যা কমছে। এ জায়গা ছেড়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করে না। উপায় নেই। কাল সারাদিন এই ধামের নানা পীঠস্থান ঘুরে দেখার কথা। চিত্রকূটের প্রাকৃতিক শোভা ছিল মূল আকর্ষণ, তারই সূত্র ধরে পবিত্র জায়গাগুলো ঘোরার পরিকল্পনা। আশা ছিল, রামঘাটের মতো এখানকার অন্য জায়গাগুলোও নিরিবিলি আর পরিচ্ছন্ন হবে। বাস্তবে দেখা গেল শেষ পর্যন্ত সেই আশা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে আর মনে হল না। পরমশক্তির কাছে মানুষের নিঃশর্ত সমর্পণের প্রভাব শুধু বায়বীয় থাকে না। তাকে যেন হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। বিশ্বাস থাকা না থাকার সঙ্গে সেই প্রভাব যুক্ত নয়। সেই প্রভাবের সামনে বাহ্য জগতের মলিনতা গৌন হয়ে যায়। তখন অপরিচ্ছন্নতা, কোলাহল সব অতিক্রম করে মন অন্য কিছুর সন্ধানে বিিস্মত হতে থাকে। এমন আভাস সচরাচর তো পাওয়া যায় না।
ভোর হতে গাড়ি হাজির। প্রথমেই চললাম স্ফটিক শীলার দিকে। যাওয়ার পথটি বড়ই মনোরম। এ অঞ্চল লোকালয় থেকে দূরে। উত্তর বিন্ধ্য পর্বতমালার সামান্য পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারে ঘন সবুজ গাছের সমারোহ, জঙ্গল। সামনে দু’চারটে ভারী গাড়ি চলেছে। মহিলা পুরুষ বোঝাই। তাদের চোখেমুখে উৎসাহ, নিঃশর্ত ভক্তিভাব। এই সারল্য মনকে ছুয়ে যেতে বাধ্য। এরা সাধারণ তীর্থযাত্রী। মনে পড়ে গেল পান্থ নিবাসের ম্যানেজারের কথা। তিনি বলছিলান, চিত্রকূট আসলে গরিব মানুষের বারানসি। যারা বেনারস গিয়ে উঠতে পারে না, তারা চিত্রকূট আসে। দেশের সাধারণ মানুষ তারা। বিশ্বনাথের দর্শন না পেয়ে রামচেন্দ্রর প্রতিই তারা মনোনিবেশ করেছেন।
চিত্রকূট পাহাড়েই যে রামচন্দ্র বারো বছর কাটিয়েছিলেন, সে কথা পদে পদে মনে পড়ে। এখানকার পাথরের গায়ে রাম সীতার স্পর্শ, রামায়ণের গল্প। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মন্দাকিনী। ঢেউয়ের স্রোতে কাকে মাথা নিচু করে খুজছে গাছের ডাল? নদীর গা ঘেষে ছাউনি দেওয়া খোলা ঘর। এরই নাম স্ফটিক শীলা। ভেতরে পাথর ঘিরে বসে অনেক মহিলা পুরুষ পুরোহিতের কথা শুনছেন। পাথরের মধ্যে বিশাল এক পায়ের ছাপ, স্পষ্ট না হলেও হাল্কাভাবে দেখা যাচ্ছে। এই নাকি সীতার পায়ের ছাপ। ঠিক এই জায়গায় ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত, কাকের রূপে সীতার কাপড় টেনে ধরেছিলেন। তার ফলে পায়ের ছাপ এত বড় হবে কেন স্পষ্ট হল না।
চোখ আর মন এই বিশাল পায়ের চাপ দেখে ধেন্দ পড়ে। দ্বেন্দ্বর সূচনার আভাস পেয়ে মনকে রক্ষা করতে পাথর ছেড়ে দূরে তাকায় চোখ, সেই দিকে, যেখানে মন প্রতিবাদ করার মতো কিছু খুজে পাবে না। লোকে বলে ঠিক এইকানে বসে রাম আর সীতে মন্দাকিনীর সৌন্দর্য উপভোগ করেতন। আমাদের মতো গুটি কয়েক পর্যটক আর তীর্থযাত্রী ছাড়া এ জায়গা মোটামুটি জনমানুষহীন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। পাথরের ওপর বসে সেই সৌন্দর্যে ডুব দিতে পারলে অনেক শািন্ত সঞ্চয় করা যায়। কিন্তু সে সময় কোথায়! স্ফটিক শীলার মতো আর এক পীঠ সতী অনসূয়া। পাহাড়ের কোলে এই জায়গায় আধুনিক মিন্দর গড়ে তুলে জায়গাটার সৌন্দর্য একেবারেই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। মিন্দরের ভেতরে যে কয়েকটি মূর্তি রাখা হয়েছে তাদের কুরূপে মন রীতিমতো বিব্রত হয়ে যায়। পত্রপাঠ মিন্দর ছেড়ে চলে আসতে হয়, তারপর সে দিকে পেছন ফিরে সামনে তাকালে দেখা যায় পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে চলেছে।
সিঁ
সিঁ
মন্দাকিনী ছেড়ে এ বার গোদাবরীর পথে। গাছে ঘেরা রাস্তা এখানে নয়। কিছু অসমান মাঠ, ইতস্তত পাথর, আর কিছু গাছের পর লম্বা রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামল। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে গুপ্ত গোদাবরী। প্রখর রোদ। মনে হচ্ছে না অক্টোবরের শেষ। চওড়া রাস্তার দু’ধারে কিছু দোকান। ভিড় তেমন নেই। রাস্তার শেষে পাথর বাধানো পুকুর। সামনে সোজা ওপরে উঠে গিয়েছে সিঁড়ি, গুপ্ত গোদাবরীর গুহার দিকে। রামঘাট থেকে ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণের এই গুহা থেকে গোদাবরী নদী আত্মপ্রকাশ করে নীচের এক গুহায় পৌছয়ে। কিন্তু তার পরেই সে আবার উধাও হয়ে যায়। এই গুহার ছাদ থেকে এক খণ্ড পাথর ঝুলতে দেখা যায়। গল্প হল, সীতা যখন স্নান করছেন, তখন ময়ঙ্ক নামে এক রাক্ষস তার কাপড় চুরি করতে গিয়েছিল। সেই না দেখে লক্ষ্মণ তাকে তৎক্ষণাত পাথর করে দেয়। গুপ্ত গোদাবরীর গুহার ছাদ থেকে নেমে আসা সেই পাথরই হল ময়ঙ্ক।

েশ্বতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এ বার গুহার ভেতরে সরু পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। কয়েক ধাপ পরে এক বড়সড় গুহা। এই গুহায় রামচন্দ্র সভা করতেন। অন্ধকার স্যাতস্যাতে হলে কী হয়, এখানে আলোর অভাব নেই, নেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার। গল্প যেখানে বাস্তবের সীমানায় পৌছায় সেখানকার এক আলাদা মাধুর্য থাকে। তখন কাহিনির সত্যাসত্য বিচার অবান্তর। তখন কল্পনা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কল্পজগতের চিরবিস্ময় তার বিচিত্র রূপের ডালি উজাড় করে মানসচোখের সামনে। তখন মাটি কাদা চামচিকে গন্ধ কোনওটাই আর মনে থাকে না। ভাবতে ভাল লাগে মাঝের ওই ঢিবি আসলে ছিল রামচেন্দ্রর সিংহাসন, যেখানে বসে তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলতেন, আলোচনা করতেন।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলাম চোখ ধাধানো রোদে। আরও কয়েক ধাপ পাশে পাহাড়ের গায়ে গুহার মধ্যে জলের ধারা। সেই জল ধীরে ধীরে হাটুর কাছে উঠে আসে। এই হল গুপ্ত গোদাবরীর গুহা। একেবেকে চলেছে নদী। পাথরের খাজে খাজে বিজলি বাতির ব্যবস্থা থাকায় জল ধরে এগোতে অসুবিধে হয় না। এত আলো সেত্ত্বও গুহার চিরন্তণ রহস্যের একাংশও ক্ষুণ্ণ হয়নি। এ জল কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়, তার সঠিক হদিশ কারও জানা নেই। জলে ক্ষয়ে গিয়ে পাথরের গায়ে পরাবাস্তব নকশা শুধু অজানার রহস্যকে আরও গাঢ় করে।
মন্দাকিনী নদীর ধারে ফিরতে হল। এসে পড়েছি জানকী কুণ্ডে। বড় রাস্তা থেকে এক চিলতে গলির মতো সরু খাড়া সিঁড়ি নেমে গিয়েছে একেবারে মন্দাকিনীর ধার পর্যন্ত। এই নিশ্চিন্ত নিরালায় জানকী স্নান করতেন, বলে লোকে। এখানেও সবুজে ঘেরা নদীর ধার।
জল বয়ে যাচ্ছে একটু বেশি তেজে। চিত্রকূটের আর সব জায়গার মতো এখানকার সিঁড়ি বসে থাকার, এখানকার পরিবেশ মনের মধ্যে টেনে নেওয়ার। আকাশের নীল এখানে এসে পড়ে জলের নীলে, তার অপরিসীম সৌন্দর্য আরও একবার মনে পড়ায় ঈশ্বরের আর এক নাম সুন্দর। সামনে কিছু দূরে দেখা যায় পাহাড়, নাম হনুমান ধারা। সোনার লঙ্কাতে আগুন জ্বালিয়েরোষানলে দগ্ধ হনুমান তখন ভারত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তার সেই অবস্থা নিরিক্ষণ করে রামচন্দ্র তীর দিয়ে পাথরের মধ্যে থেকে শীতল জলের ধারার ব্যবস্থা করেন। সেই ঠাণ্ডা জলে স্নান করে শািন্ত পায় হনুমান। পাহাড়ের গায়ে সেই জল প্রবাহের নাম আজও হনুমান ধারা। তিন’শর বেশি সিঁড়ি বেয়ে ওপরের হনুমান ধারায় উঠতে হয়। সরু গলির মধ্যে দিয়ে একেবেকে রাস্তা চলে গিয়েছে। দু’পাশে দোকান, বসতি। পাহাড়ের একেবারে নীচে, সারি দেওয়া দোকান আর এক প্রাচীন বটগাছের নীচে গাড়ি রেখে পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু হল। উচু উচু ধাপের সিঁড়ি শ্বেতপাথরে মোড়া নয় দেখে ভাল লাগল। গুপ্ত গোদাবরীর েশ্বতপাথরের সিঁড়ি গোটা এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ মোটামুটি ধ্বংস করে দিতে পেরেছে। সে তুলনায় এখানকার পরিবেশ স্বাভাবিক আছে।
পাহাড়ের মাঝামাঝি চিত্রকূটের বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখা যায়। অসাধারণ সে দৃশ্য। কিছু সবুজ। কিছু হলুদ মাঠ, কিছু লালচে চাষের জমি। যতদূর চোখ যায়, এই রঙিন বৈচিত্র। সে দিকে তাকিয়েই সময় কাটানো হবে, স্থির হল। সামনে দিয়ে লোক সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, নামছে। আমরা এক বুড়ি ভিখারিনীর পেছনে সিমেেন্টর বেিঞ্চতে বসে সামনের দৃশ্য দেখতে দেখতে জীবনের জটিলতাকে কীভাবে সরল করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকি। নয়ত চুপচাপ বসে নিজের সঙ্গে অনেক দিনের মুলতুবি রাখা বোঝাপড়াটুকু সেরে নিই।

No comments:

Post a Comment