রাবাং রাবাং…’’, একটানা হাক পাড়ছে নোরবু। চোখ ঘুরছে ভিনদেশি ট্যুরিস্টর
ঝাকের ওপর। সকালের নরম রোদ দূরের বরফ চুড়ো ছুয়ে নামচি বাজার জিপ
স্ট্যােণ্ডর চারপাশে সোনািল আভা ছড়াচ্ছে। নোরবু তামাং। দক্ষিণ সিকিমের জেলা
সদর নামচি বাজারের জিপ চালক। ট্যুরিেস্টর দল নিয়ে রাবাংলা অবধি ওর জিপ
যাতায়াত করে দিনে তিন চার বার। কখনও আবার রাবাংলা ছাড়িয়ে কিউজিং, গ্যাংটক
এমন কি পেলিং পর্যন্তও চলে যায় সে জুতসই যাত্রী আর ভাড়া পেলে।
বাক্সপ্যাটরা নিয়ে আমরা এখন নোরবুর খেদ্দর। যাচ্ছি রাবাংলা। শিলিগুড়ি থেকে সকালের বাস ধরে তিস্তাবাজার, মেিল্ল হয়ে ৫৫০০ ফিট উচু নামচি পৌছেছি গত দুপুরে। হোটেল সুস্বাগতম বাস স্ট্যােণ্ডর কাছেই। মালপত্তর রেখে খাওয়াদাওয়া সেরে যেটুকু সময় পেলাম তাতে দুটো নার্সারি দেখে উঠলাম সাম্দ্রুপ্ত্সে পাহাড়ে। সাম্দ্রুপ্ত্সে মানে ইচ্ছে পূরণের পাহাড়। পাহাড়ের ওপর দেখলাম ১৩৫ ফিট উচু গুরু পদ্মসম্ভবের বিরাট মূর্ত্তি। তাংখা আর দাশি দিয়ে সাজানো পাহাড় স্থানীয় বৌদ্ধদের বিশ্বাসে অতি পবিত্র।
নামচি থেকে সকাল সাড়ে আটটায় জিপ ছাড়ল। ২৬ কিলোমিটার দূরের রাবাংলা পৌছতে চড়তে হবে ২৫০০ ফিট। চড়াই ভাঙতে পাহাড়কে বেড় দিয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা উঠেছে। সেকেণ্ড গিয়ারে গোঙানি ছেড়ে আেস্ত আেস্ত গাড়ি চলেছে। এক পাশে পাহাড়ের ওপর বড় বড় পাইন, দেবদারু, ফার আর ধুপি গাছের জঙ্গল। পাথুরে দেওয়ালে লম্বা ঘাসের ফাকে ফুটে আছে ডেইজির গোছা, কসমস, ফার্র্ন আর বুনো ষ্ট্রবেির। রাস্তার আর এক দিকে গভীর খাদ। সূর্যের আলো তার খানিকটায় পড়লেও বেিশর ভাগটাই ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কোথাও আবার পাহাড়ের গা বেয়ে ঝাপিয়ে নামছে প্রথম বর্ষার জলে প্রাণ পাওয়া দুরন্ত ঝরনা। তার ছিটকে আসা জলের ফোটা ঝাপটা মারে চোখেমুখে। ঝরনা ধারার পাশে ফুটে থাকা পাহাড়ি লিলির ওপর ঘোরে রঙিন প্রজাপতি।
দেখতে দেখতে ড্যানথাম ছাড়িয়ে এসে গেলাম রাবাংলার বাজার। এখানেই গাড়ি প্রায় ফাকা হয়ে গেল। আমরা নামলাম কয়েক গজ দূরে হোটেল মনোকামনায়। কলকাতা থেকে আগাম বুকিং করা ছিল। মালিক শ্রী কিশোরকুমার ঘোষ গরম কফি দিয়ে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা পেলাম টানা বারান্দার এক পাশে ডাবল বেডরুম সঙ্গে এট্যাচ্ড টয়লেট। ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম ঝকঝকে আকাশে মাথা তুলে দাড়িয়ে একের পর এক বরফ চুড়ো। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া আর কাউকেই চিনি না। শহরের এক পাশ থেকে উঠেছে মৈনাম পাহাড়। তার শরীর ঢাকা ঘন জঙ্গলের ওভারকোটে আর এই মূহুর্তে তার মাথায় চাপানো সাদা কুয়াশার টুপি।
দক্ষিণ সিকিমের ছোট্ট শহর রাবাংলার উচ্চতা ৮০০০ ফিট। এতই ছোট যে পুরোপুরি শহর বলতেও বাধে। তিস্তা বাজার থেকে গেজিং যাওয়ার পথে কিউজিং রোডের ওপর এই হিলেস্টশন দেখে চট করে হলিউডের সিনেমায় ওয়াইল্ড ওয়েেস্টর কোনও কাউবয় ঘাটির কথা মনে পড়ে। বসতি বলতে হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল, মোমো- থুক্পার ক’টা গুমটি, ছোট এক বাজার, পাওয়ার প্লােন্টর কিছু কটেজ আর স্যুভেনির শপ। খুব অল্প সংখ্যক কয়েকটা গৃহস্থ বাড়িও আছে এখানে।
কিশোরদা মজলিশি লোক। খাওয়ার টেবিলের আড্ডায় গেল্প আর তথ্যে আলাপ করিয়ে দিলেন রাবাংলার সাথে। কলকাতার হাফ ধরা গরম থেকে এসে আমরা শীতে কাপছি দেখে হেসে বললেন, জানুয়ারীতে এখানে ছোট পাহাড়গুলোও বরফে ঢেকে যায়। সেই সময় রুম হিটার আর ফায়ারেপ্লস ছাড়া টেকা মুশকিল।
‘‘তবে ব্যক্তিগত পছেন্দর কথা বলতে হলে জানাই, এখানে বর্ষাই আমার িপ্রয় ঋতু। সবুজের মেলা দেখতে এই সময়টাই ভাল। নদীনালাও প্রাণ পায় তখন,’’ বলেই তিনি তাড়া লাগিয়ে আমাদের তুলে দেন সোনম লেপচার ল্যাণ্ডরোভারে টেমি চা বাগানের পথে। রাবাংলা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের টেমি চা বাগান সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে সিকিমের সেরা চা বাগান। এই বাগানের চায়ের ভাল কদরও আছে। ৩০ মিনিটে পৌছে গেলাম। ততক্ষণে চা পাতা তোলা শেষ করে কামিন মেয়েরা পিঠের লম্বা টুকরি ভরে চা কারখানার দিকে হাটা শুরু করেছে। তাদের কারও পেটের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে বাধা মোটা চাদরে ঘুমিয়ে ছোট্ট শিশু। প্রচণ্ড পরিশ্রমী এই মেয়েদের মুখে হাসি লেগেই আছে। সারি বেধে হাটতে হাটতে তারা গান গাইছে: চেংবা হুই চেংবা, ঢাম্পুলে আজা ক্যায়া ভন্ছা….। টেমি থেকে ফেরার পথে ড্যানথামে টি েব্রক। এখান থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে মরা আগ্নেয়গিরি টেনডং পাহাড়। টেনডং স্যাংচুয়ারীর ভেতর দিয়ে যাওয়ার রাস্তা। শুনলাম ওপর থেকে গোটা সিংগালিলা পাহাড় শ্রেণী ছাড়াও শিলিগুড়ি শহর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। মৃত আগ্নেয়গিরির মুখে বছরে একবার পাহাড়িরা জড় হন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পুজো দেওয়ার জন্য।
সেন্ধবেলা জাকালো শীতে হোটেল লাউেঞ্জ বসল মোমো আর গেল্পর আসর। আড্ডার মধ্যমণি আমাদের গাড়ির চালক সোনম। ঝাল মাংসের টুকরো জিভে আগুন েজ্বলে দিচ্ছে, সঙ্গে সোনমের স্টকের যাবতীয় ভূতের ‘সত্য কাহিনী’। এমন সময় সে হঠাৎ মৈনাম পাহাড়ের কথা পাড়ে। মৈনামের চুড়ো থেকে নাকি অসাধারণ সূর্যোদয় দেখা যায়। ‘‘তবে পাহাড়ি পথে হাটতে হবে রাতে। ভয় পেয়ে যাবেন নিঝুম রাতে জঙ্গলে চলতে।’’ তার কথায় রোমােঞ্চর আভাস পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। ঠিক হল কাল রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ব মৈনামের রাস্তায়।
পর দিন সকালে গেলাম তিব্বতী শরনার্থীদের বিস্ত। এখানে দেখলাম তিব্বতী হস্তশিেল্পর অনেক জিনিস। ছাম নাচের আদলে গড়া মুখোস, বেতের নানা ধরনের ঝুড়ি, বাশের চোঙের ওপর রং করা তিব্বতী নক্সা আর সুন্দর কার্পেট। কার্পেট বুনছে তিব্বতী মেয়েরা আর তা কেচে শুকিয়ে পাট করে রাখার দায়িত্ব ছেলেদের। এই কাজে চাই অনেক যত্ন আর নিষ্ঠা। বিভিন্ন ধরনের কার্পেট পাওয়া যায় এখানে আর তাদের দামও নানা রকম। মজা লাগল দেখে, তাত ঘরের এক কোণে চারপাশের বিরাট ব্যস্ততার মাঝে বেতের ঝুড়িতে নিিশ্চেন্ত ঘুমোচ্ছে এক তিব্বতী শিশু। বয়েস তার খুব জোর ৪ মাস।
তিব্বতী বিস্ত ছেড়ে এবার ২৬ কিলোমিটার দূরের রালং গোম্ফা। পুরনো আর নতুন, দুটো গোম্ফাই দেখলাম। ফাকা পুরনো দেবালয়ের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে মন খারাপ হল। আবার নতুন মন্যািষ্ট্রর জাকজমক দেখে তাক লেগে গেল। গোম্ফার সামনে পৌছে দেখি তখন বোধিসেত্ত্বর আরাধনা হচ্ছে। শেষ হলে এক জন অল্প বয়সী লামা আমাদের গোম্ফা ঘুরিয়ে দেখালেন। তার ব্যাখ্যা থেকে জানতে পারলাম গোম্ফার অন্দরমহলের অনেক কিছু।
গোম্ফার চত্বর পরিষ্কার তকতকে। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ শুনতে পেলাম টুং টাং হাল্কা ঘন্টার আওয়াজ। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম মন্যািষ্ট্রর কার্নিশের কোণায় ঝুলছে একটা পেতলের চিনে উইণ্ডচাইম্। হিমেল হাওয়ার হাল্কা ছোয়ায় তৈরী হচ্ছে অপূব্বর্ সুর।
গোম্ফা থেকে চললাম উষ্ণ প্রস্রবণ দেখতে। রালং গোম্ফার পাশ থেকে নীচে নেমে গেছে রাস্তা। পৌছতে ২০ মিনিট লাগল। রঙ্গিত নদীর উপত্যকার সৌন্দর্য অসাধারণ। চারপাশের পাহাড় থেকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে চাষের জমি যা এ অঞ্চলের পাহাড়ের বৈশিষ্ট। উপত্যকার মাঝে বোল্ডার রাজ্যের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে ঝাপিয়ে জল ছিটিয়ে বয়ে চলেছে রঙ্গিত। মূল নদীর ধারার কাছেই গরম জলের কুণ্ড। এখন জনবিরল হলেও শুনলাম ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে ভিড় জমে। রাত কাটানোর জন্য কটেজ ভাড়া পাওয়া যায় সেই সময়। স্থানীয় মানুষেরা দোকান দেন শাকসিব্জ আর নানা রকম ডেয়ারি েপ্রাডােক্টর।
রাত দেড়টায় ঘরের দরজায় টোকা পড়ায় খুলে দেখি সোনমের হাসিমুখ। সঙ্গে কিশোরদা আর এক সিকিমি ছেলে, তার নাম বললো রাজেন। কিশোরদা কফির ফ্লাস্ক আর টিফিন কেরিয়ার হাতে দিয়ে দিলেন। আর সোনমের কথায় মোজার ভেতর পুরে নিতে হল দোক্তা পাতা যা আমাদের জোকের হাত থেকে বাচাবে। জঙ্গলের রাস্তায় এদের আক্রমণ ভয়ঙ্কর। কাল সেন্ধয় ঝড় বৃিষ্ট হয়েছে অবশ্য এখন আকাশ পরিষ্কার। শহরের শেষ বাড়িটা পেরোনোর সময় দুটো লোমশ কুকুর তেড়ে এল বটে কিন্তু কামড়াল না দেখে নিিশ্চন্ত হলাম।
১০,৮০০ ফিট উচু মৈনাম চুড়ো রাবাংলা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। পথ ঘুরে ঘুরে উঠেছে ওক, পাইন, ম্যাগনোলিয়া আর রডোডেনড্রন গাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এই পাহাড় বৌদ্ধ লামাদের সাধনার জায়গা বলে প্রসিদ্ধ। আর, বিপন্ন প্রজাতির রেড পাণ্ডাও পাওয়া যায় এই মৈনাম ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে। শীতে পাহাড়চুড়ো বরফে ঢেকে গেলে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়।
রাবাংলা ছাড়িয়ে কিছুটা ফাকা জমি পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। ঝোলা থেকে ন্যাকড়া বের করে গাছের ভাঙা ডালে বেধে সোনম চটপট চারটে মশাল তৈরী করে ফেলল। রাস্তায় বুনো জন্তুর হাত থেকে রেহাই পেতে এই ব্যবস্থা। শুনলাম যেতে যেতে হিমালয়ের কালো ভালুকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতেই পারে।
গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে কাল সেন্ধর বৃিষ্টর জল ঝরে পড়ছে। রাজেন সাবধান করে দেয়, জলের সঙ্গে জোকও খসে পড়তে পারে। চমকে উঠে হাত ঘুরিয়ে তল্লাসি চালাই শরীরের না ঢাকা অংশে। মশালের আলোর বৃত্তের বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ ঝোপের পেছনে দেখি এক জোড়া লাল চোখ। ঘাবড়ে গিয়ে সোনমকে ডাকতে ও হেসে মশাল তুলে দেখায়, বুনো খরগোস।
দু’ ঘন্টা টানা হেঁটে বিশ্রাম নিতে বসলাম একটা বড় পাথরের ওপর। কফির গ্লাস শেষ করে একটু এগিয়ে দেখি রাস্তা বন্ধ। কাল বিকেলের ঝড়ে দুটো গাছ ভেঙে পড়ে এই বিপদ। এবার সোনমের বুিদ্ধতে চোরবাটো বা পাহাড়ি শর্টকাট দিয়ে সেই জায়গাটা পেরোতে হল। এই রাস্তায় ঝুকি একটু বেশি হলেও অন্য উপায় ছিল না। রাস্তা ছেড়ে সোজা পাহাড়ের খাড়া দেওয়াল চড়তে হল লতাপাতা আর গাছের শেকড় ধরে। অনভ্যাসের ফলে হাতের তালু ছড়ে গেল। তবু শেষটা যে ভাল ভাবে সে জায়গাটা পেরতে পারলাম তার জন্য আমরা সোনমের কাছে কৃতজ্ঞ। চড়াই শেষ হলে অল্প ঢালু ঘাসজমিতে এসে পৌছলাম। এখানে বন বিভাগের কাঠের ওয়াচটাওয়ার। টাওয়ার থেকে পাহাড় চুড়ো আরও এক কিলোমিটার। আকাশ ফিকে হচ্ছে দেখে আমরা জোরে পা চালাতে লাগলাম। কুড়ি মিনিট পরে মৈনামের মাথায় পৌছে সব পরিশ্রম সার্থক মনে হল। হাল্কা গোলাপি আকাশে ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে সারি সারি বরফের চুড়ো। সিনিয়লচু, পািণ্ডম, জোপুনো, কাব্রু আর কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে এখন গোলাপি ছেড়ে লালচে রং ধরেছে। তারপর আরও লাল, গাঢ় কমলা, ফিকে কমলা, সোনালি আর শেষে ঝকমকে রূপোলি রঙে ফুটে উঠল তারা। অকল্পনীয় এই সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখে আমাদের সব ক্লািন্ত চলে গেল। পাহাড় থেকে নীচের খাদের ওপর ক্যািণ্ডফ্লসের মত ছোট ছোট টুকরো ছেড়া মেঘ। তাদের ফাক অনেক নীচে ঘুমিয়ে আছে রাবাংলা শহর।
এবার নামার পালা। সকালের আলোয় কাল রাতের জঙ্গল তার সব রহস্যময়তা হারিয়েছে। জংলী রাস্তা ভয় পাওয়ায় না, উেল্ট মেলে ধরে তার যত গুপ্তধন। কম বয়সী রাজেন পরিচয় করিয়ে দেয় হিমালয়ের এই অঞ্চলের অদ্ভুত দেখতে ফুল, েস্নক ফ্লাওয়ার, আর কিছু িপ্রমূলা প্রজাতির ফুলের সঙ্গে। বিশাল গাছের গোড়ায় দেখতে পেলাম ৫/৬ রকমের মাশরুম। পাহাড় থেকে নামতে প্রায় অেদ্ধর্ক সময় লাগল। সোনম আর রাজেনকে বিদায় জানিয়ে হোটেল পৌছলাম সকাল ন’টায়। এবার গোছগাছ সারতে হবে। দশটায় হোটেলের জিপ নিয়ে রওনা হব শিলিগুড়ি।
বাক্সপ্যাটরা নিয়ে আমরা এখন নোরবুর খেদ্দর। যাচ্ছি রাবাংলা। শিলিগুড়ি থেকে সকালের বাস ধরে তিস্তাবাজার, মেিল্ল হয়ে ৫৫০০ ফিট উচু নামচি পৌছেছি গত দুপুরে। হোটেল সুস্বাগতম বাস স্ট্যােণ্ডর কাছেই। মালপত্তর রেখে খাওয়াদাওয়া সেরে যেটুকু সময় পেলাম তাতে দুটো নার্সারি দেখে উঠলাম সাম্দ্রুপ্ত্সে পাহাড়ে। সাম্দ্রুপ্ত্সে মানে ইচ্ছে পূরণের পাহাড়। পাহাড়ের ওপর দেখলাম ১৩৫ ফিট উচু গুরু পদ্মসম্ভবের বিরাট মূর্ত্তি। তাংখা আর দাশি দিয়ে সাজানো পাহাড় স্থানীয় বৌদ্ধদের বিশ্বাসে অতি পবিত্র।
নামচি থেকে সকাল সাড়ে আটটায় জিপ ছাড়ল। ২৬ কিলোমিটার দূরের রাবাংলা পৌছতে চড়তে হবে ২৫০০ ফিট। চড়াই ভাঙতে পাহাড়কে বেড় দিয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা উঠেছে। সেকেণ্ড গিয়ারে গোঙানি ছেড়ে আেস্ত আেস্ত গাড়ি চলেছে। এক পাশে পাহাড়ের ওপর বড় বড় পাইন, দেবদারু, ফার আর ধুপি গাছের জঙ্গল। পাথুরে দেওয়ালে লম্বা ঘাসের ফাকে ফুটে আছে ডেইজির গোছা, কসমস, ফার্র্ন আর বুনো ষ্ট্রবেির। রাস্তার আর এক দিকে গভীর খাদ। সূর্যের আলো তার খানিকটায় পড়লেও বেিশর ভাগটাই ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কোথাও আবার পাহাড়ের গা বেয়ে ঝাপিয়ে নামছে প্রথম বর্ষার জলে প্রাণ পাওয়া দুরন্ত ঝরনা। তার ছিটকে আসা জলের ফোটা ঝাপটা মারে চোখেমুখে। ঝরনা ধারার পাশে ফুটে থাকা পাহাড়ি লিলির ওপর ঘোরে রঙিন প্রজাপতি।
দেখতে দেখতে ড্যানথাম ছাড়িয়ে এসে গেলাম রাবাংলার বাজার। এখানেই গাড়ি প্রায় ফাকা হয়ে গেল। আমরা নামলাম কয়েক গজ দূরে হোটেল মনোকামনায়। কলকাতা থেকে আগাম বুকিং করা ছিল। মালিক শ্রী কিশোরকুমার ঘোষ গরম কফি দিয়ে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা পেলাম টানা বারান্দার এক পাশে ডাবল বেডরুম সঙ্গে এট্যাচ্ড টয়লেট। ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম ঝকঝকে আকাশে মাথা তুলে দাড়িয়ে একের পর এক বরফ চুড়ো। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া আর কাউকেই চিনি না। শহরের এক পাশ থেকে উঠেছে মৈনাম পাহাড়। তার শরীর ঢাকা ঘন জঙ্গলের ওভারকোটে আর এই মূহুর্তে তার মাথায় চাপানো সাদা কুয়াশার টুপি।
দক্ষিণ সিকিমের ছোট্ট শহর রাবাংলার উচ্চতা ৮০০০ ফিট। এতই ছোট যে পুরোপুরি শহর বলতেও বাধে। তিস্তা বাজার থেকে গেজিং যাওয়ার পথে কিউজিং রোডের ওপর এই হিলেস্টশন দেখে চট করে হলিউডের সিনেমায় ওয়াইল্ড ওয়েেস্টর কোনও কাউবয় ঘাটির কথা মনে পড়ে। বসতি বলতে হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল, মোমো- থুক্পার ক’টা গুমটি, ছোট এক বাজার, পাওয়ার প্লােন্টর কিছু কটেজ আর স্যুভেনির শপ। খুব অল্প সংখ্যক কয়েকটা গৃহস্থ বাড়িও আছে এখানে।
কিশোরদা মজলিশি লোক। খাওয়ার টেবিলের আড্ডায় গেল্প আর তথ্যে আলাপ করিয়ে দিলেন রাবাংলার সাথে। কলকাতার হাফ ধরা গরম থেকে এসে আমরা শীতে কাপছি দেখে হেসে বললেন, জানুয়ারীতে এখানে ছোট পাহাড়গুলোও বরফে ঢেকে যায়। সেই সময় রুম হিটার আর ফায়ারেপ্লস ছাড়া টেকা মুশকিল।
‘‘তবে ব্যক্তিগত পছেন্দর কথা বলতে হলে জানাই, এখানে বর্ষাই আমার িপ্রয় ঋতু। সবুজের মেলা দেখতে এই সময়টাই ভাল। নদীনালাও প্রাণ পায় তখন,’’ বলেই তিনি তাড়া লাগিয়ে আমাদের তুলে দেন সোনম লেপচার ল্যাণ্ডরোভারে টেমি চা বাগানের পথে। রাবাংলা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের টেমি চা বাগান সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে সিকিমের সেরা চা বাগান। এই বাগানের চায়ের ভাল কদরও আছে। ৩০ মিনিটে পৌছে গেলাম। ততক্ষণে চা পাতা তোলা শেষ করে কামিন মেয়েরা পিঠের লম্বা টুকরি ভরে চা কারখানার দিকে হাটা শুরু করেছে। তাদের কারও পেটের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে বাধা মোটা চাদরে ঘুমিয়ে ছোট্ট শিশু। প্রচণ্ড পরিশ্রমী এই মেয়েদের মুখে হাসি লেগেই আছে। সারি বেধে হাটতে হাটতে তারা গান গাইছে: চেংবা হুই চেংবা, ঢাম্পুলে আজা ক্যায়া ভন্ছা….। টেমি থেকে ফেরার পথে ড্যানথামে টি েব্রক। এখান থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে মরা আগ্নেয়গিরি টেনডং পাহাড়। টেনডং স্যাংচুয়ারীর ভেতর দিয়ে যাওয়ার রাস্তা। শুনলাম ওপর থেকে গোটা সিংগালিলা পাহাড় শ্রেণী ছাড়াও শিলিগুড়ি শহর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। মৃত আগ্নেয়গিরির মুখে বছরে একবার পাহাড়িরা জড় হন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পুজো দেওয়ার জন্য।
সেন্ধবেলা জাকালো শীতে হোটেল লাউেঞ্জ বসল মোমো আর গেল্পর আসর। আড্ডার মধ্যমণি আমাদের গাড়ির চালক সোনম। ঝাল মাংসের টুকরো জিভে আগুন েজ্বলে দিচ্ছে, সঙ্গে সোনমের স্টকের যাবতীয় ভূতের ‘সত্য কাহিনী’। এমন সময় সে হঠাৎ মৈনাম পাহাড়ের কথা পাড়ে। মৈনামের চুড়ো থেকে নাকি অসাধারণ সূর্যোদয় দেখা যায়। ‘‘তবে পাহাড়ি পথে হাটতে হবে রাতে। ভয় পেয়ে যাবেন নিঝুম রাতে জঙ্গলে চলতে।’’ তার কথায় রোমােঞ্চর আভাস পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। ঠিক হল কাল রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ব মৈনামের রাস্তায়।
পর দিন সকালে গেলাম তিব্বতী শরনার্থীদের বিস্ত। এখানে দেখলাম তিব্বতী হস্তশিেল্পর অনেক জিনিস। ছাম নাচের আদলে গড়া মুখোস, বেতের নানা ধরনের ঝুড়ি, বাশের চোঙের ওপর রং করা তিব্বতী নক্সা আর সুন্দর কার্পেট। কার্পেট বুনছে তিব্বতী মেয়েরা আর তা কেচে শুকিয়ে পাট করে রাখার দায়িত্ব ছেলেদের। এই কাজে চাই অনেক যত্ন আর নিষ্ঠা। বিভিন্ন ধরনের কার্পেট পাওয়া যায় এখানে আর তাদের দামও নানা রকম। মজা লাগল দেখে, তাত ঘরের এক কোণে চারপাশের বিরাট ব্যস্ততার মাঝে বেতের ঝুড়িতে নিিশ্চেন্ত ঘুমোচ্ছে এক তিব্বতী শিশু। বয়েস তার খুব জোর ৪ মাস।
তিব্বতী বিস্ত ছেড়ে এবার ২৬ কিলোমিটার দূরের রালং গোম্ফা। পুরনো আর নতুন, দুটো গোম্ফাই দেখলাম। ফাকা পুরনো দেবালয়ের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে মন খারাপ হল। আবার নতুন মন্যািষ্ট্রর জাকজমক দেখে তাক লেগে গেল। গোম্ফার সামনে পৌছে দেখি তখন বোধিসেত্ত্বর আরাধনা হচ্ছে। শেষ হলে এক জন অল্প বয়সী লামা আমাদের গোম্ফা ঘুরিয়ে দেখালেন। তার ব্যাখ্যা থেকে জানতে পারলাম গোম্ফার অন্দরমহলের অনেক কিছু।
গোম্ফার চত্বর পরিষ্কার তকতকে। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ শুনতে পেলাম টুং টাং হাল্কা ঘন্টার আওয়াজ। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম মন্যািষ্ট্রর কার্নিশের কোণায় ঝুলছে একটা পেতলের চিনে উইণ্ডচাইম্। হিমেল হাওয়ার হাল্কা ছোয়ায় তৈরী হচ্ছে অপূব্বর্ সুর।
গোম্ফা থেকে চললাম উষ্ণ প্রস্রবণ দেখতে। রালং গোম্ফার পাশ থেকে নীচে নেমে গেছে রাস্তা। পৌছতে ২০ মিনিট লাগল। রঙ্গিত নদীর উপত্যকার সৌন্দর্য অসাধারণ। চারপাশের পাহাড় থেকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে চাষের জমি যা এ অঞ্চলের পাহাড়ের বৈশিষ্ট। উপত্যকার মাঝে বোল্ডার রাজ্যের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে ঝাপিয়ে জল ছিটিয়ে বয়ে চলেছে রঙ্গিত। মূল নদীর ধারার কাছেই গরম জলের কুণ্ড। এখন জনবিরল হলেও শুনলাম ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে ভিড় জমে। রাত কাটানোর জন্য কটেজ ভাড়া পাওয়া যায় সেই সময়। স্থানীয় মানুষেরা দোকান দেন শাকসিব্জ আর নানা রকম ডেয়ারি েপ্রাডােক্টর।
রাত দেড়টায় ঘরের দরজায় টোকা পড়ায় খুলে দেখি সোনমের হাসিমুখ। সঙ্গে কিশোরদা আর এক সিকিমি ছেলে, তার নাম বললো রাজেন। কিশোরদা কফির ফ্লাস্ক আর টিফিন কেরিয়ার হাতে দিয়ে দিলেন। আর সোনমের কথায় মোজার ভেতর পুরে নিতে হল দোক্তা পাতা যা আমাদের জোকের হাত থেকে বাচাবে। জঙ্গলের রাস্তায় এদের আক্রমণ ভয়ঙ্কর। কাল সেন্ধয় ঝড় বৃিষ্ট হয়েছে অবশ্য এখন আকাশ পরিষ্কার। শহরের শেষ বাড়িটা পেরোনোর সময় দুটো লোমশ কুকুর তেড়ে এল বটে কিন্তু কামড়াল না দেখে নিিশ্চন্ত হলাম।
১০,৮০০ ফিট উচু মৈনাম চুড়ো রাবাংলা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। পথ ঘুরে ঘুরে উঠেছে ওক, পাইন, ম্যাগনোলিয়া আর রডোডেনড্রন গাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এই পাহাড় বৌদ্ধ লামাদের সাধনার জায়গা বলে প্রসিদ্ধ। আর, বিপন্ন প্রজাতির রেড পাণ্ডাও পাওয়া যায় এই মৈনাম ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে। শীতে পাহাড়চুড়ো বরফে ঢেকে গেলে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়।
রাবাংলা ছাড়িয়ে কিছুটা ফাকা জমি পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। ঝোলা থেকে ন্যাকড়া বের করে গাছের ভাঙা ডালে বেধে সোনম চটপট চারটে মশাল তৈরী করে ফেলল। রাস্তায় বুনো জন্তুর হাত থেকে রেহাই পেতে এই ব্যবস্থা। শুনলাম যেতে যেতে হিমালয়ের কালো ভালুকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতেই পারে।
গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে কাল সেন্ধর বৃিষ্টর জল ঝরে পড়ছে। রাজেন সাবধান করে দেয়, জলের সঙ্গে জোকও খসে পড়তে পারে। চমকে উঠে হাত ঘুরিয়ে তল্লাসি চালাই শরীরের না ঢাকা অংশে। মশালের আলোর বৃত্তের বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ ঝোপের পেছনে দেখি এক জোড়া লাল চোখ। ঘাবড়ে গিয়ে সোনমকে ডাকতে ও হেসে মশাল তুলে দেখায়, বুনো খরগোস।
দু’ ঘন্টা টানা হেঁটে বিশ্রাম নিতে বসলাম একটা বড় পাথরের ওপর। কফির গ্লাস শেষ করে একটু এগিয়ে দেখি রাস্তা বন্ধ। কাল বিকেলের ঝড়ে দুটো গাছ ভেঙে পড়ে এই বিপদ। এবার সোনমের বুিদ্ধতে চোরবাটো বা পাহাড়ি শর্টকাট দিয়ে সেই জায়গাটা পেরোতে হল। এই রাস্তায় ঝুকি একটু বেশি হলেও অন্য উপায় ছিল না। রাস্তা ছেড়ে সোজা পাহাড়ের খাড়া দেওয়াল চড়তে হল লতাপাতা আর গাছের শেকড় ধরে। অনভ্যাসের ফলে হাতের তালু ছড়ে গেল। তবু শেষটা যে ভাল ভাবে সে জায়গাটা পেরতে পারলাম তার জন্য আমরা সোনমের কাছে কৃতজ্ঞ। চড়াই শেষ হলে অল্প ঢালু ঘাসজমিতে এসে পৌছলাম। এখানে বন বিভাগের কাঠের ওয়াচটাওয়ার। টাওয়ার থেকে পাহাড় চুড়ো আরও এক কিলোমিটার। আকাশ ফিকে হচ্ছে দেখে আমরা জোরে পা চালাতে লাগলাম। কুড়ি মিনিট পরে মৈনামের মাথায় পৌছে সব পরিশ্রম সার্থক মনে হল। হাল্কা গোলাপি আকাশে ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে সারি সারি বরফের চুড়ো। সিনিয়লচু, পািণ্ডম, জোপুনো, কাব্রু আর কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে এখন গোলাপি ছেড়ে লালচে রং ধরেছে। তারপর আরও লাল, গাঢ় কমলা, ফিকে কমলা, সোনালি আর শেষে ঝকমকে রূপোলি রঙে ফুটে উঠল তারা। অকল্পনীয় এই সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখে আমাদের সব ক্লািন্ত চলে গেল। পাহাড় থেকে নীচের খাদের ওপর ক্যািণ্ডফ্লসের মত ছোট ছোট টুকরো ছেড়া মেঘ। তাদের ফাক অনেক নীচে ঘুমিয়ে আছে রাবাংলা শহর।
এবার নামার পালা। সকালের আলোয় কাল রাতের জঙ্গল তার সব রহস্যময়তা হারিয়েছে। জংলী রাস্তা ভয় পাওয়ায় না, উেল্ট মেলে ধরে তার যত গুপ্তধন। কম বয়সী রাজেন পরিচয় করিয়ে দেয় হিমালয়ের এই অঞ্চলের অদ্ভুত দেখতে ফুল, েস্নক ফ্লাওয়ার, আর কিছু িপ্রমূলা প্রজাতির ফুলের সঙ্গে। বিশাল গাছের গোড়ায় দেখতে পেলাম ৫/৬ রকমের মাশরুম। পাহাড় থেকে নামতে প্রায় অেদ্ধর্ক সময় লাগল। সোনম আর রাজেনকে বিদায় জানিয়ে হোটেল পৌছলাম সকাল ন’টায়। এবার গোছগাছ সারতে হবে। দশটায় হোটেলের জিপ নিয়ে রওনা হব শিলিগুড়ি।
No comments:
Post a Comment