চোখের সামনে জলপ্রপাত নাফাখুম গত ৬ আগস্ট, বিকেল। বান্দরবান শহরে
আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমিতে দেখা হলো প্রথম আলোর বান্দারবান প্রতিনিধি
বুদ্ধজ্যোতি চাকমার সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগেই আমরা ফিরেছি এক অভিযান শেষ করে।
বুদ্ধজ্যোতি বললেন, ‘যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা হলে আপনাদের যেতে দিতাম
না। বর্ষার এ সময়টা ওইখানে মাঝেমধ্যেই তিন-চারজন “খরচা” হয়ে যায়।’ তাঁর
সঙ্গে আসা প্রথম আলো বন্ধুসভার কয়েকজন বন্ধুও সায় দিলেন।
অভিযান শেষ, তার পরও ‘খরচা’ শব্দটার অর্থ বুঝে আমাদের বিশেষ করে আমার মধ্যে ভয় শুরু হলো। তবে নিজেকে অভয় দিলাম এই বলে যে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছি লাইফটাইম একটা এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে।
দারুণ এই অভিজ্ঞতা যে গন্তব্যে, সেটি নাফাখুম জলপ্রপাত। রেমাক্রি জলপ্রপাত নামেও এটা অনেকের কাছে পরিচিত। জলপ্রপাতটা দেখে সবারই মনে হয়েছে, বাংলাদেশেও এমন জায়গা আছে!
নাফাখুম কিছুটা দুর্গম। বিশেষ করে, বৃষ্টিবাদলার দিনগুলোয়। তাই তো একেবারে জলপ্রপাত ঘুরে আসা সমতল ভূমির মানুষের সংখ্যাও কম। আমাদের ছোটখাটো দলের সবারই ইচ্ছে ছিল, বান্দরবানে কোনো ঝরনা বা জলপ্রপাত দেখে আসা। যেখানে যেতে আবার ট্রেকিংও যেন করতে হয়। দলটি এক অর্থে বেশ বিস্ময়কর, আবার আরেকভাবে চিন্তা করলে, দলটিতে দারুণ ভারসাম্য রয়েছে। দলে একদিকে আছেন বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম, যিনি আমাদের গন্তব্য নাফাখুম জলপ্রপাত ঠিক করেছেন। অপরদিকে আমার মতো ৮৬ কেজি ওজনের মানুষ। মাঝখানে প্রথম আলোর সিমু নাসের, জাবেদ সুলতান পিয়াস আর সিমু নাসেরের স্ত্রী চারুকলার ছাত্রী সিফাত আজিম। একদিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠা মুসা, অন্যদিকে পাহাড়ে অনভিজ্ঞ বা কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞ লোকজন—এমন ভারসাম্য কি আর সহজে মেলে?
থানচি হয়ে তিন্দু
গত ৪ আগস্ট সকালেই বাসে বান্দরবান শহর। বাস থেকে আমাদের নামিয়ে নিলেন গাইড মংখাই। ৯-১০ বছর আগে যখন মুসার পর্বতারোহণ শুরু বান্দরবানের পাহাড়-পর্বত দিয়ে, তখন থেকেই মুসার বিভিন্ন অভিযানের সঙ্গী তিনি। গত মাসের নাফাখুম অভিযানে মংখাই আমাদের সঙ্গী। মংখাইয়ের সঙ্গে কথা বলে মুসা আগেই রুট ঠিক করেছেন। তাঁর পরামর্শে আর প্রবল উৎসাহে আমাদের প্রস্তুতিও ব্যাপক। মশা যাতে না কামড়ায় সে জন্য মলম অডোমাস, বর্ষাতি, ছাতা, পর্যাপ্ত টয়লেট টিস্যু, হাফ বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, পিচ্ছিল পথে হাঁটার উপযোগী স্যান্ডেল, টুকটাক ওষুধ, বারান্দাওয়ালা টুপি, টি-শার্ট, তিনদিকে সেলাই করা বিছানার চাদর (ঘুমানোর জন্য), টর্চলাইট, হেডল্যাম্প, এমনকি ক্যামেরার জন্য বর্ষাতি—লটবহর কম নয়। সব নিয়ে চড়া হয় ভাড়া করা নিশান পেট্রলগাড়িতে। চালক আনন্দ নিয়ে যাবেন থানচি পর্যন্ত। বান্দরবান থেকে ৭৯ কিলোমিটার। শুরু হলো গাড়ির চড়াই-উতরাই পেরোনো। পাহাড়ি পথের ধারে মিশ্র ফল বাগান, আদিবাসীদের চলাচল সবই মুগ্ধ করে। একে একে আমরা পার হই মিলনছড়া, নীলগিরি, চিম্বুক, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তা ‘পিক ৬৯’, বাঘাইছড়া। মাঝেমধ্যে আমরা থামি, ছবিটবি তুলি; আবার চলতে থাকি আনন্দের জিম্মায়। পাহাড়ের একটা জায়গায় অনেক দূরে বঙ্গোপসাগরও দেখা যায়। ক্যামেরার টেলিলেন্সে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওটা সমুদ্রই। ঘণ্টাতিনেক পরে গাড়ি পৌঁছায় থানচির এপারে শঙ্খ নদীর পাড়ে। পাহাড়িদের কাছে এ নদীর নাম সাঙ্গু। এই সাঙ্গু বেয়েই আমাদের উঠতে হবে রেমাক্রি বাজার অবধি। উঠতে হবে এ কারণে, শঙ্খ নদী নেমেছে পাহাড় বেয়ে। আমাদের গন্তব্য যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী, তাই নদী বেয়ে ওঠা ছাড়া উপায় কী!
ইঞ্জিনচালিত চিকনচাকন একটা নৌকা ভাড়া করে ফেললেন মংখাই। শঙ্খ নদীর ওপারে থানচি বাজারে যেতে হবে আগে। দুপুরের খাবার ছাড়াও বিডিআর ক্যাম্প থেকে অনুমতি নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা আছে। বাজারে আদিবাসী একটা পান্থশালায় মুরগি আর সবজি দিয়ে খাওয়া হলো। পাহাড়ি রান্নায় অনভ্যস্ত হওয়ায় মুরগিটা জমল না, জমল সবজি। মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট বিজয়ী, তিনি এখন তারকা। বিডিআরের কয়েকজন সদস্য তাঁর সঙ্গে এভারেস্ট নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। আমাদের বলা হলো, এ সময়টা দুর্ঘটনা ঘটে। তবে গত কয়েক দিন জোরালো বৃষ্টি হয়নি। তাই পাহাড়ি ঢল নামেনি। ঢল নামলে এ পথে যাওয়ার জন্য বিডিআরের অনুমতি মেলে না। জানা গেল ঘণ্টাখানেক আগে বিডিআরের অতিথি হয়ে আসা একটি দলও রওনা হয়ে গেছে। তবে অনুমতির আগে সবার ঢাকার ঠিকানা ও আত্মীয়ের ফোন নম্বর লিখে দিতে হলো। নৌকায় ওঠার আগে দূর পাহাড়ে দেখা গেল বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বারিধারা থানচিতেও। থেমে গেল অল্পক্ষণেই। নৌকায় শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
সাঙ্গু খরস্রোতা, পাথুরে। নৌকা কিছুক্ষণ চলতেই দুই পাশে অপূর্ব সৌন্দর্যের সব পাহাড়। নদীতে এসে পড়ছে ছোট ছোট ঝরনাধারা। জুম চাষের পাহাড়গুলো যেন হালকা সবুজের মোলায়েম মখমল। এখানে সেখানে আদিবাসী বাড়ি। নদীর বাঁকগুলোয় ছোট-বড় পাথরের স্তূপ আর প্রবল স্রোত। দুবার নামতেও হলো নৌকা থেকে। মাঝি আর তাঁর সঙ্গীরা ইঞ্জিন চালিয়ে, লগি ঠেলে ওসব বাঁকে নৌকা পার করলেন। এ নৌকায় সঙ্গী হয়েছে আদিবাসী পিতা-পুত্র। ছেলেটি শিশু, বয়স হবে আট-নয়। জানা গেল তার পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছে, ব্যান্ডেজও রয়েছে। কিন্তু ভয়াল বাঁকগুলোতেও শিশুটি নৌকার পাটাতনে আধশোয়া, নির্বিকার তার ভঙ্গি। বোঝাই গেল প্রকৃতির সঙ্গে এভাবে জুুঝতে জুঝতেই বড় হবে শিশুটি। যেমন হয়েছেন তার পূর্বপুরুষেরা।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নৌকা পৌঁছাল তিন্দু বাজারের ঘাটে। নেমেই উঁচু পাহাড়ে সোনালি আকাশ চোখে পড়ল। নদীর ঘাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেশ উঁচুতে তিন্দুবাজার। কাঠের একটা ছোট দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো। মশার কামড় থেকে বাঁচতে শরীরের খোলা অংশে মাখা হলো অডোমাস।
তিন্দু থানচি উপজেলার একটা ইউনিয়ন। চেয়ারম্যান শাইয়ানের সঙ্গে কথা হয় তাঁর দোকানে। সৌরবিদ্যুৎ আছে বাজারে। তারই টিমটিমে আলো থাকে রাতে। মোবাইল ফোনের মধ্যে শুধু টেলিটকের নেটওয়ার্ক রয়েছে। কোনো টিভি চ্যানেল, বেতার বা সংবাদপত্র এখানে নেই। ফলে খবর জানা যায় শুধু মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলে। তবে বাজারে সাবান, শ্যাম্পু, প্যাকেটের গুঁড়া মসলা ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যই পাওয়া যায়।
রাতের খাওয়াটা হলো বেশ। মুরগির ঝোল, ভাত আর বাঁশের ঝোল। কেউ তো এমনিতে কোনো দিন বাঁশ খেতে চায় না, কিন্তু খাওয়ার সময় দেখা গেল দলের সবাই শুধু বাঁশই খেতে চাইছে। রাত নয়টার মধ্যে পুরো বাজার নীরব। বন্ধ হয়ে গেছে চেয়ারম্যানের টেলিভিশনটাও। এটাতে কোনো চ্যানেল নয়, ডিভিডি চালিয়ে দেখা হয়। উঁচু পাহাড় থেকে আকাশটা মনে হলো কাছেই। দলের সবাই বাজারে মাঝখানে ফেলে রাখা বাঁশের ওপর শুয়ে-বসে দেখতে থাকি অজস্র তারাভরা আকাশ। রাত বাড়তে থাকে, আকাশের তারা আরও উজ্জ্বল হতে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে আমাদের মুগ্ধতা।
রেমাক্রির পথে
ভোর ছয়টাতেই ঘুম ভেঙে যায় সবার। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে আবারও নৌযাত্রা। এবারের নৌপথ নাকি আরও কঠিন। কিছুক্ষণ পর তা বোঝাও গেল। জায়গাটার নাম কেয়াপেজা। বড় বড় পাথর। বড় তিন-চারটা পাথর আছে নদীর মাঝখানে, সেসব পাথরে তাঁবু খাটিয়ে থাকাও যায়। থেকেছেনও বৈমানিক এনাম তালুকদার আর অভিযাত্রী, আলোকচিত্রী রোনাল্ড হালদার। ফেসবুকে সেই তাঁবুবাসের ছবিও আছে। বিডিআরের লোকজন এই পাথরের কথা বলেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। কেয়াপেজা পার হওয়ার খানিকটা পর নদী আরও বিরূপ। আমরা নেমে গেলাম নৌকা থেকে। শুরু হলো মানুষ, যন্ত্র বনাম প্রকৃতির লড়াই। অবশেষে পার হলো নৌকা, জয় মানুষেরই।
দুই পাশে প্রকৃতি অসীম আর উদার। জুমের সবুজ মখমলে মাঝেমধ্যে কালো কালো দাগ চোখে পড়ে। মনে হয় যেন ঘা। আসলে তা-ই। পাহাড়ের গায়ে থাকা বড় বড় গাছ কাটার চিহ্ন ওইগুলো। মনটা খারাপ হয়ে যায়। যেমন খারাপ লেগেছিল বান্দরবান থেকে থানচি বাজার আসার পথে দূর পাহাড়ের মাঝে ইটভাটার চিমনি দেখে।
আড়াই ঘণ্টার নৌকাযাত্রা শেষে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছে যাই রেমাক্রি বাজারে। এটাও থানচির একটা ইউনিয়ন। থাকার জায়গা বের করি। ঠিক হয় বাজারে থাকব। এ বাজারেও সৌরবিদ্যুৎ, তবে মোবাইল ফোন নেই। থাকার জন্য এবার একতলা ঘর। মেঝেটা কাঠের। আমাদের লটবহর রেখে সাড়ে ১০টায় শুরু হয় মূল অভিযান—নাফাখুম জলপ্রপাত। আমাদের দলে যুক্ত হয় আদিবাসী এক কিশোর, যে নাফাখুমের পথটা চেনে।
ঝিরি বেয়ে নাফাখুমের পথে
গাড়ি ও নৌকার পালা শেষ রেমাক্রি বাজারেই। এবার ট্রেকিং মানে হাঁটাপথ। রেমাক্রি বাজারে সাঙ্গু বাঁক নিয়েছে। এই বাঁকে এসে পড়েছে রেমাক্রি খাল। খালের শুরুটা নাফাখুম জলপ্রপাতে। মাঝেমধ্যে অনেক ঝরনার পানি যোগ হয়েছে খালে। এই খাল মানে ঝিরি ধরেই হাঁটা আমাদের। শুরুতেই তিনটা পাহাড় ডিঙাতে হবে। অন্যদের তেমন কিছু না, একটা পাহাড় ডিঙাতেই আমার অবস্থা খারাপ। বসেই পড়ি এক জায়গায়। এগিয়ে আসেন মুসা। নানা কথা বলেন, উজ্জীবিত করেন। দলের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করি। তিন পাহাড় পেরোতে ৪৫ মিনিট। এবার ঝিরি ধরে এগোনো। পাথুরে খালের দুই পাড় হাঁটার জন্য বন্ধুর। তবে শীতল, প্রায় স্বচ্ছ পানি আর নির্ভেজাল প্রকৃতির কারণে শরীর ও মন সতেজ হয়ে ওঠে। ঝিরির দুই পাড় বেশির ভাগ পাথুরে ও সরু। কোথাও কোথাও পিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে আবার হাঁটু বা কোমরসমান স্রোত ঠেলে এপার-ওপার করতে হয়। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আদিবাসীদের শেষ পাড়াটাও আমরা পেরিয়ে এলাম। মাঝেমধ্যে জুম চাষের পাহাড়ে বা ঝিরির পানিতে স্নানরত এক-দুজন আদিবাসী ছাড়া কোনো মানুষও চোখে পড়ে না। রেমাক্রি খালে এসে মিশেছে ছোট-বড় অনেক ঝরনা। শীতল সেই ঝরনাগুলোর পানি শীতল এবং সুপেয়। ঝরনা আর ঝিরির পানিতে ভিজে শরীর সতেজ হচ্ছে, আবার আমরা হাঁটছি। এভাবে একটা জায়গায় পৌঁছালাম আমরা। যেখানে খাল আর হেঁটে পার হওয়া যাবে না। আমি আর সিফাত সাঁতার জানি না। কী হবে?
ঝিরির পাশে এক জুমচাষি কাজ করছিলেন। তাঁর হাতের দা নিয়ে আমাদের কিশোর গাইড তিনটা কলাগাছ কেটে আনল। কলাগাছের আঁশ দিয়েই বাঁধা হলো সেগুলো। সামনে বাঁশের একটা কঞ্চি গাঁথা হলো। আমি সেটা ধরে থাকব, মুসা ও দুই গাইড সাঁতরে ঠেলে খাল পার করবেন। প্রথমে আমি, পরে সিফাত—পার হলাম এভাবে। এরপর পথ আরও জটিল। কাঁদা, পাথরের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝোপঝাড়। আরও প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর শোনা গেলে পানির শব্দ। দেখা মিলল শুভ্র জলরাশির—নাফাখুম জলপ্রপাত।
প্রায় ১৫-২০ ফুট ওপর থেকে পানি পড়ছে নিচের রেমাক্রি খালে। তীব্র স্রোত তৈরি করে চলে যাচ্ছে সাঙ্গু নদীর দিকে। জলপ্রপাতের প্রস্থ ৪০ ফুটের কম না। দুদিকে বড় পাথরের দেয়াল। এমন জলপ্রপাত বাংলাদেশে, বিশ্বাসই যেন হতে চায় না। জলপ্রপাতের নিচে পাথুরে গুহাও আছে। সেই গুহা চলে গেছে পাহাড়ের অনেকটা ভেতরে। জলপ্রপাতের শুভ্র জলরাশির মধ্যে হঠাৎ নীল একটা আকৃতি চোখে পড়ল। দেখা গেল একজন আদিবাসী মারমা বাঁশের আগায় জাল বেঁধে মাছ ধরছেন। ওপর থেকে পানি পড়ার সময় সব মাছ লাফ দেয়। লাফ দিয়ে জালে এসে ধরা দেয় এসব মাছ।
বিষয়টা সরেজমিন বোঝার জন্য মুসা আর সিমু নাসের পাথুরে পাড় থেকে জলপ্রপাতের জলধারায় ডাইভ দেন। স্রোত তাঁদের আট থেকে ১০ ফুট ঠেলে নিয়ে যায়। একটা পাথর আঁকড়ে ধরে তাঁরা উঠে যান ওপারে। তারপর পাথুরে পাহাড় ধরে ধরে জলপ্রপাতের ভেতরে গুহার মুখে যান তাঁরা। এই গুহা নিয়ে নানান কিংবদন্তি আছে। গুহায় নাকি বিরাট কিছু মাছ আছে, সেগুলো ধরতে যারা গুহায় ঢোকে, তারা আর ফিরে আসে না।
দেড় ঘণ্টার মতো আমরা নাফাখুম দেখলাম, মুগ্ধ হলাম। আবার হাঁটতে হবে আট কিলোমিটার বন্ধুর পথ। দিনের আলো থাকতেই পৌঁছাতে হবে রেমাক্রি বাজারে। আদিবাসী মৎস্য শিকারির কাছ থেকে বেশ কিছু নলাজাতীয় মাছ কিনে শুরু হলো ফিরতি যাত্রা। রাতে খাওয়া হয় এই মাছ ভাজা আর পরদিন সকালে এই মাছের কাবাব।
ফেরার সময় বিরতিহীন হাঁটা। ঝিরঝির বৃষ্টি থাকলেও কোথাও থামা হয়নি। সন্ধ্যা নেমে এল আর আমরা ঝিরি থেকে উঠে গেলাম পাহাড়িপাড়ায়। নাফাখুমে শীতকালেও পানি থাকে, তবে পরিমাণে কম। শীতকালে যাওয়া-আসার পথের ঝুঁকিটাও অনেক কম।
গত ৬ আগস্ট সকালে আবার নৌকাযাত্রা। ফিরতি পথ মানে নেমে যাওয়া থানচির পথে। যে পথে যেতে সময় লেগেছিল ছয় ঘণ্টা, ফিরতে লাগল দেড় ঘণ্টা। সাঙ্গুর বাঁকগুলোয় ওঠার চেয়ে যে নামা আরও বিপজ্জনক, তা বোঝাও গেল। বিশেষ করে কেয়াপেজা জায়গাটা। নানা রকম পাথর এড়িয়ে যে নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে মাঝিরা নৌকা চালালেন, তা দেখার মতো।
দুই পাশের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা ফিরে এলাম থানচি। জেনে এলাম নাফাখুমের যে পানি, তার উৎস আরও দুই দিনের পথ। সেখানেও আছে জলপ্রপাত। এর চেয়েও বেশি উঁচু প্রায় ১০০ ফুট ওপর থেকে পড়ে বিপুল জলরাশি। তাজিনডং পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। বান্দরবানে রোমাঞ্চকর এ রকম দারুণ সুন্দর জায়গাগুলো নিয়ে আমরা তো গর্ব করতেই পারি, বেরিয়ে যেতে পারি অভিযানে।
যেভাবে যাবেন
বাসে ঢাকা থেকে বান্দরবান, ভাড়া ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। চান্দের গাড়ি বা ভাড়া করা ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়িতে থানচি। চান্দের গাড়ির ভাড়া জনপ্রতি ২০০ আর গাড়ি ভাড়া করলে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। থানচি থেকে রেমাক্রি নৌকায় যাওয়া-আসা, ভাড়া চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
থাকা: থানচি, তিন্দু বা রেমাক্রি বাজারে কাঠের ঘরে থাকা যাবে। থাকার জন্য টাকা লাগবে না, তবে খাওয়ার জন্য প্রতি বেলায় জনপ্রতি লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এ ছাড়া গাইডের সহযোগিতায় আদিবাসী গ্রামেও থাকা যেতে পারে।
অভিযান শেষ, তার পরও ‘খরচা’ শব্দটার অর্থ বুঝে আমাদের বিশেষ করে আমার মধ্যে ভয় শুরু হলো। তবে নিজেকে অভয় দিলাম এই বলে যে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছি লাইফটাইম একটা এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে।
দারুণ এই অভিজ্ঞতা যে গন্তব্যে, সেটি নাফাখুম জলপ্রপাত। রেমাক্রি জলপ্রপাত নামেও এটা অনেকের কাছে পরিচিত। জলপ্রপাতটা দেখে সবারই মনে হয়েছে, বাংলাদেশেও এমন জায়গা আছে!
নাফাখুম কিছুটা দুর্গম। বিশেষ করে, বৃষ্টিবাদলার দিনগুলোয়। তাই তো একেবারে জলপ্রপাত ঘুরে আসা সমতল ভূমির মানুষের সংখ্যাও কম। আমাদের ছোটখাটো দলের সবারই ইচ্ছে ছিল, বান্দরবানে কোনো ঝরনা বা জলপ্রপাত দেখে আসা। যেখানে যেতে আবার ট্রেকিংও যেন করতে হয়। দলটি এক অর্থে বেশ বিস্ময়কর, আবার আরেকভাবে চিন্তা করলে, দলটিতে দারুণ ভারসাম্য রয়েছে। দলে একদিকে আছেন বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম, যিনি আমাদের গন্তব্য নাফাখুম জলপ্রপাত ঠিক করেছেন। অপরদিকে আমার মতো ৮৬ কেজি ওজনের মানুষ। মাঝখানে প্রথম আলোর সিমু নাসের, জাবেদ সুলতান পিয়াস আর সিমু নাসেরের স্ত্রী চারুকলার ছাত্রী সিফাত আজিম। একদিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠা মুসা, অন্যদিকে পাহাড়ে অনভিজ্ঞ বা কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞ লোকজন—এমন ভারসাম্য কি আর সহজে মেলে?
থানচি হয়ে তিন্দু
গত ৪ আগস্ট সকালেই বাসে বান্দরবান শহর। বাস থেকে আমাদের নামিয়ে নিলেন গাইড মংখাই। ৯-১০ বছর আগে যখন মুসার পর্বতারোহণ শুরু বান্দরবানের পাহাড়-পর্বত দিয়ে, তখন থেকেই মুসার বিভিন্ন অভিযানের সঙ্গী তিনি। গত মাসের নাফাখুম অভিযানে মংখাই আমাদের সঙ্গী। মংখাইয়ের সঙ্গে কথা বলে মুসা আগেই রুট ঠিক করেছেন। তাঁর পরামর্শে আর প্রবল উৎসাহে আমাদের প্রস্তুতিও ব্যাপক। মশা যাতে না কামড়ায় সে জন্য মলম অডোমাস, বর্ষাতি, ছাতা, পর্যাপ্ত টয়লেট টিস্যু, হাফ বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, পিচ্ছিল পথে হাঁটার উপযোগী স্যান্ডেল, টুকটাক ওষুধ, বারান্দাওয়ালা টুপি, টি-শার্ট, তিনদিকে সেলাই করা বিছানার চাদর (ঘুমানোর জন্য), টর্চলাইট, হেডল্যাম্প, এমনকি ক্যামেরার জন্য বর্ষাতি—লটবহর কম নয়। সব নিয়ে চড়া হয় ভাড়া করা নিশান পেট্রলগাড়িতে। চালক আনন্দ নিয়ে যাবেন থানচি পর্যন্ত। বান্দরবান থেকে ৭৯ কিলোমিটার। শুরু হলো গাড়ির চড়াই-উতরাই পেরোনো। পাহাড়ি পথের ধারে মিশ্র ফল বাগান, আদিবাসীদের চলাচল সবই মুগ্ধ করে। একে একে আমরা পার হই মিলনছড়া, নীলগিরি, চিম্বুক, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তা ‘পিক ৬৯’, বাঘাইছড়া। মাঝেমধ্যে আমরা থামি, ছবিটবি তুলি; আবার চলতে থাকি আনন্দের জিম্মায়। পাহাড়ের একটা জায়গায় অনেক দূরে বঙ্গোপসাগরও দেখা যায়। ক্যামেরার টেলিলেন্সে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওটা সমুদ্রই। ঘণ্টাতিনেক পরে গাড়ি পৌঁছায় থানচির এপারে শঙ্খ নদীর পাড়ে। পাহাড়িদের কাছে এ নদীর নাম সাঙ্গু। এই সাঙ্গু বেয়েই আমাদের উঠতে হবে রেমাক্রি বাজার অবধি। উঠতে হবে এ কারণে, শঙ্খ নদী নেমেছে পাহাড় বেয়ে। আমাদের গন্তব্য যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী, তাই নদী বেয়ে ওঠা ছাড়া উপায় কী!
ইঞ্জিনচালিত চিকনচাকন একটা নৌকা ভাড়া করে ফেললেন মংখাই। শঙ্খ নদীর ওপারে থানচি বাজারে যেতে হবে আগে। দুপুরের খাবার ছাড়াও বিডিআর ক্যাম্প থেকে অনুমতি নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা আছে। বাজারে আদিবাসী একটা পান্থশালায় মুরগি আর সবজি দিয়ে খাওয়া হলো। পাহাড়ি রান্নায় অনভ্যস্ত হওয়ায় মুরগিটা জমল না, জমল সবজি। মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট বিজয়ী, তিনি এখন তারকা। বিডিআরের কয়েকজন সদস্য তাঁর সঙ্গে এভারেস্ট নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। আমাদের বলা হলো, এ সময়টা দুর্ঘটনা ঘটে। তবে গত কয়েক দিন জোরালো বৃষ্টি হয়নি। তাই পাহাড়ি ঢল নামেনি। ঢল নামলে এ পথে যাওয়ার জন্য বিডিআরের অনুমতি মেলে না। জানা গেল ঘণ্টাখানেক আগে বিডিআরের অতিথি হয়ে আসা একটি দলও রওনা হয়ে গেছে। তবে অনুমতির আগে সবার ঢাকার ঠিকানা ও আত্মীয়ের ফোন নম্বর লিখে দিতে হলো। নৌকায় ওঠার আগে দূর পাহাড়ে দেখা গেল বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বারিধারা থানচিতেও। থেমে গেল অল্পক্ষণেই। নৌকায় শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
সাঙ্গু খরস্রোতা, পাথুরে। নৌকা কিছুক্ষণ চলতেই দুই পাশে অপূর্ব সৌন্দর্যের সব পাহাড়। নদীতে এসে পড়ছে ছোট ছোট ঝরনাধারা। জুম চাষের পাহাড়গুলো যেন হালকা সবুজের মোলায়েম মখমল। এখানে সেখানে আদিবাসী বাড়ি। নদীর বাঁকগুলোয় ছোট-বড় পাথরের স্তূপ আর প্রবল স্রোত। দুবার নামতেও হলো নৌকা থেকে। মাঝি আর তাঁর সঙ্গীরা ইঞ্জিন চালিয়ে, লগি ঠেলে ওসব বাঁকে নৌকা পার করলেন। এ নৌকায় সঙ্গী হয়েছে আদিবাসী পিতা-পুত্র। ছেলেটি শিশু, বয়স হবে আট-নয়। জানা গেল তার পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছে, ব্যান্ডেজও রয়েছে। কিন্তু ভয়াল বাঁকগুলোতেও শিশুটি নৌকার পাটাতনে আধশোয়া, নির্বিকার তার ভঙ্গি। বোঝাই গেল প্রকৃতির সঙ্গে এভাবে জুুঝতে জুঝতেই বড় হবে শিশুটি। যেমন হয়েছেন তার পূর্বপুরুষেরা।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নৌকা পৌঁছাল তিন্দু বাজারের ঘাটে। নেমেই উঁচু পাহাড়ে সোনালি আকাশ চোখে পড়ল। নদীর ঘাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেশ উঁচুতে তিন্দুবাজার। কাঠের একটা ছোট দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো। মশার কামড় থেকে বাঁচতে শরীরের খোলা অংশে মাখা হলো অডোমাস।
তিন্দু থানচি উপজেলার একটা ইউনিয়ন। চেয়ারম্যান শাইয়ানের সঙ্গে কথা হয় তাঁর দোকানে। সৌরবিদ্যুৎ আছে বাজারে। তারই টিমটিমে আলো থাকে রাতে। মোবাইল ফোনের মধ্যে শুধু টেলিটকের নেটওয়ার্ক রয়েছে। কোনো টিভি চ্যানেল, বেতার বা সংবাদপত্র এখানে নেই। ফলে খবর জানা যায় শুধু মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলে। তবে বাজারে সাবান, শ্যাম্পু, প্যাকেটের গুঁড়া মসলা ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যই পাওয়া যায়।
রাতের খাওয়াটা হলো বেশ। মুরগির ঝোল, ভাত আর বাঁশের ঝোল। কেউ তো এমনিতে কোনো দিন বাঁশ খেতে চায় না, কিন্তু খাওয়ার সময় দেখা গেল দলের সবাই শুধু বাঁশই খেতে চাইছে। রাত নয়টার মধ্যে পুরো বাজার নীরব। বন্ধ হয়ে গেছে চেয়ারম্যানের টেলিভিশনটাও। এটাতে কোনো চ্যানেল নয়, ডিভিডি চালিয়ে দেখা হয়। উঁচু পাহাড় থেকে আকাশটা মনে হলো কাছেই। দলের সবাই বাজারে মাঝখানে ফেলে রাখা বাঁশের ওপর শুয়ে-বসে দেখতে থাকি অজস্র তারাভরা আকাশ। রাত বাড়তে থাকে, আকাশের তারা আরও উজ্জ্বল হতে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে আমাদের মুগ্ধতা।
রেমাক্রির পথে
ভোর ছয়টাতেই ঘুম ভেঙে যায় সবার। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে আবারও নৌযাত্রা। এবারের নৌপথ নাকি আরও কঠিন। কিছুক্ষণ পর তা বোঝাও গেল। জায়গাটার নাম কেয়াপেজা। বড় বড় পাথর। বড় তিন-চারটা পাথর আছে নদীর মাঝখানে, সেসব পাথরে তাঁবু খাটিয়ে থাকাও যায়। থেকেছেনও বৈমানিক এনাম তালুকদার আর অভিযাত্রী, আলোকচিত্রী রোনাল্ড হালদার। ফেসবুকে সেই তাঁবুবাসের ছবিও আছে। বিডিআরের লোকজন এই পাথরের কথা বলেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। কেয়াপেজা পার হওয়ার খানিকটা পর নদী আরও বিরূপ। আমরা নেমে গেলাম নৌকা থেকে। শুরু হলো মানুষ, যন্ত্র বনাম প্রকৃতির লড়াই। অবশেষে পার হলো নৌকা, জয় মানুষেরই।
দুই পাশে প্রকৃতি অসীম আর উদার। জুমের সবুজ মখমলে মাঝেমধ্যে কালো কালো দাগ চোখে পড়ে। মনে হয় যেন ঘা। আসলে তা-ই। পাহাড়ের গায়ে থাকা বড় বড় গাছ কাটার চিহ্ন ওইগুলো। মনটা খারাপ হয়ে যায়। যেমন খারাপ লেগেছিল বান্দরবান থেকে থানচি বাজার আসার পথে দূর পাহাড়ের মাঝে ইটভাটার চিমনি দেখে।
আড়াই ঘণ্টার নৌকাযাত্রা শেষে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছে যাই রেমাক্রি বাজারে। এটাও থানচির একটা ইউনিয়ন। থাকার জায়গা বের করি। ঠিক হয় বাজারে থাকব। এ বাজারেও সৌরবিদ্যুৎ, তবে মোবাইল ফোন নেই। থাকার জন্য এবার একতলা ঘর। মেঝেটা কাঠের। আমাদের লটবহর রেখে সাড়ে ১০টায় শুরু হয় মূল অভিযান—নাফাখুম জলপ্রপাত। আমাদের দলে যুক্ত হয় আদিবাসী এক কিশোর, যে নাফাখুমের পথটা চেনে।
ঝিরি বেয়ে নাফাখুমের পথে
গাড়ি ও নৌকার পালা শেষ রেমাক্রি বাজারেই। এবার ট্রেকিং মানে হাঁটাপথ। রেমাক্রি বাজারে সাঙ্গু বাঁক নিয়েছে। এই বাঁকে এসে পড়েছে রেমাক্রি খাল। খালের শুরুটা নাফাখুম জলপ্রপাতে। মাঝেমধ্যে অনেক ঝরনার পানি যোগ হয়েছে খালে। এই খাল মানে ঝিরি ধরেই হাঁটা আমাদের। শুরুতেই তিনটা পাহাড় ডিঙাতে হবে। অন্যদের তেমন কিছু না, একটা পাহাড় ডিঙাতেই আমার অবস্থা খারাপ। বসেই পড়ি এক জায়গায়। এগিয়ে আসেন মুসা। নানা কথা বলেন, উজ্জীবিত করেন। দলের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করি। তিন পাহাড় পেরোতে ৪৫ মিনিট। এবার ঝিরি ধরে এগোনো। পাথুরে খালের দুই পাড় হাঁটার জন্য বন্ধুর। তবে শীতল, প্রায় স্বচ্ছ পানি আর নির্ভেজাল প্রকৃতির কারণে শরীর ও মন সতেজ হয়ে ওঠে। ঝিরির দুই পাড় বেশির ভাগ পাথুরে ও সরু। কোথাও কোথাও পিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে আবার হাঁটু বা কোমরসমান স্রোত ঠেলে এপার-ওপার করতে হয়। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আদিবাসীদের শেষ পাড়াটাও আমরা পেরিয়ে এলাম। মাঝেমধ্যে জুম চাষের পাহাড়ে বা ঝিরির পানিতে স্নানরত এক-দুজন আদিবাসী ছাড়া কোনো মানুষও চোখে পড়ে না। রেমাক্রি খালে এসে মিশেছে ছোট-বড় অনেক ঝরনা। শীতল সেই ঝরনাগুলোর পানি শীতল এবং সুপেয়। ঝরনা আর ঝিরির পানিতে ভিজে শরীর সতেজ হচ্ছে, আবার আমরা হাঁটছি। এভাবে একটা জায়গায় পৌঁছালাম আমরা। যেখানে খাল আর হেঁটে পার হওয়া যাবে না। আমি আর সিফাত সাঁতার জানি না। কী হবে?
ঝিরির পাশে এক জুমচাষি কাজ করছিলেন। তাঁর হাতের দা নিয়ে আমাদের কিশোর গাইড তিনটা কলাগাছ কেটে আনল। কলাগাছের আঁশ দিয়েই বাঁধা হলো সেগুলো। সামনে বাঁশের একটা কঞ্চি গাঁথা হলো। আমি সেটা ধরে থাকব, মুসা ও দুই গাইড সাঁতরে ঠেলে খাল পার করবেন। প্রথমে আমি, পরে সিফাত—পার হলাম এভাবে। এরপর পথ আরও জটিল। কাঁদা, পাথরের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝোপঝাড়। আরও প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর শোনা গেলে পানির শব্দ। দেখা মিলল শুভ্র জলরাশির—নাফাখুম জলপ্রপাত।
প্রায় ১৫-২০ ফুট ওপর থেকে পানি পড়ছে নিচের রেমাক্রি খালে। তীব্র স্রোত তৈরি করে চলে যাচ্ছে সাঙ্গু নদীর দিকে। জলপ্রপাতের প্রস্থ ৪০ ফুটের কম না। দুদিকে বড় পাথরের দেয়াল। এমন জলপ্রপাত বাংলাদেশে, বিশ্বাসই যেন হতে চায় না। জলপ্রপাতের নিচে পাথুরে গুহাও আছে। সেই গুহা চলে গেছে পাহাড়ের অনেকটা ভেতরে। জলপ্রপাতের শুভ্র জলরাশির মধ্যে হঠাৎ নীল একটা আকৃতি চোখে পড়ল। দেখা গেল একজন আদিবাসী মারমা বাঁশের আগায় জাল বেঁধে মাছ ধরছেন। ওপর থেকে পানি পড়ার সময় সব মাছ লাফ দেয়। লাফ দিয়ে জালে এসে ধরা দেয় এসব মাছ।
বিষয়টা সরেজমিন বোঝার জন্য মুসা আর সিমু নাসের পাথুরে পাড় থেকে জলপ্রপাতের জলধারায় ডাইভ দেন। স্রোত তাঁদের আট থেকে ১০ ফুট ঠেলে নিয়ে যায়। একটা পাথর আঁকড়ে ধরে তাঁরা উঠে যান ওপারে। তারপর পাথুরে পাহাড় ধরে ধরে জলপ্রপাতের ভেতরে গুহার মুখে যান তাঁরা। এই গুহা নিয়ে নানান কিংবদন্তি আছে। গুহায় নাকি বিরাট কিছু মাছ আছে, সেগুলো ধরতে যারা গুহায় ঢোকে, তারা আর ফিরে আসে না।
দেড় ঘণ্টার মতো আমরা নাফাখুম দেখলাম, মুগ্ধ হলাম। আবার হাঁটতে হবে আট কিলোমিটার বন্ধুর পথ। দিনের আলো থাকতেই পৌঁছাতে হবে রেমাক্রি বাজারে। আদিবাসী মৎস্য শিকারির কাছ থেকে বেশ কিছু নলাজাতীয় মাছ কিনে শুরু হলো ফিরতি যাত্রা। রাতে খাওয়া হয় এই মাছ ভাজা আর পরদিন সকালে এই মাছের কাবাব।
ফেরার সময় বিরতিহীন হাঁটা। ঝিরঝির বৃষ্টি থাকলেও কোথাও থামা হয়নি। সন্ধ্যা নেমে এল আর আমরা ঝিরি থেকে উঠে গেলাম পাহাড়িপাড়ায়। নাফাখুমে শীতকালেও পানি থাকে, তবে পরিমাণে কম। শীতকালে যাওয়া-আসার পথের ঝুঁকিটাও অনেক কম।
গত ৬ আগস্ট সকালে আবার নৌকাযাত্রা। ফিরতি পথ মানে নেমে যাওয়া থানচির পথে। যে পথে যেতে সময় লেগেছিল ছয় ঘণ্টা, ফিরতে লাগল দেড় ঘণ্টা। সাঙ্গুর বাঁকগুলোয় ওঠার চেয়ে যে নামা আরও বিপজ্জনক, তা বোঝাও গেল। বিশেষ করে কেয়াপেজা জায়গাটা। নানা রকম পাথর এড়িয়ে যে নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে মাঝিরা নৌকা চালালেন, তা দেখার মতো।
দুই পাশের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা ফিরে এলাম থানচি। জেনে এলাম নাফাখুমের যে পানি, তার উৎস আরও দুই দিনের পথ। সেখানেও আছে জলপ্রপাত। এর চেয়েও বেশি উঁচু প্রায় ১০০ ফুট ওপর থেকে পড়ে বিপুল জলরাশি। তাজিনডং পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। বান্দরবানে রোমাঞ্চকর এ রকম দারুণ সুন্দর জায়গাগুলো নিয়ে আমরা তো গর্ব করতেই পারি, বেরিয়ে যেতে পারি অভিযানে।
যেভাবে যাবেন
বাসে ঢাকা থেকে বান্দরবান, ভাড়া ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। চান্দের গাড়ি বা ভাড়া করা ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়িতে থানচি। চান্দের গাড়ির ভাড়া জনপ্রতি ২০০ আর গাড়ি ভাড়া করলে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। থানচি থেকে রেমাক্রি নৌকায় যাওয়া-আসা, ভাড়া চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
থাকা: থানচি, তিন্দু বা রেমাক্রি বাজারে কাঠের ঘরে থাকা যাবে। থাকার জন্য টাকা লাগবে না, তবে খাওয়ার জন্য প্রতি বেলায় জনপ্রতি লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এ ছাড়া গাইডের সহযোগিতায় আদিবাসী গ্রামেও থাকা যেতে পারে।
No comments:
Post a Comment