পৃথিবীর অনেক বৃহৎ নগরীর নিজস্ব একটা ‘সিম্বল’ বা প্রতীক কিংবা বলা যেতে
পারে, ‘আইকন’ থাকে। যেমন-লন্ডনের বিগ বেন ঘড়ি, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার,
সিডনির অপেরা হাউস, বেইজিংয়ের গ্রেট ওয়াল ইত্যাদি। তেমনিভাবে জাতিসংঘের সদর
দপ্তরটি যুক্তরাষ্ট্রের যে শহরে অবস্থিত, সেই নিউইয়র্কের ‘আইকন’ হচ্ছে
একটি ‘ছোট্ট’ ব্রোঞ্জের মূর্তি, যেটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্ট্যাচু অব
লিবার্টি’। বাংলা ভাষায় একে বলা যেতে পারে স্বাধীনতার ‘শিলামূর্তি’।
তা ছোট্ট বললাম এ কারণে যে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের পতাকা সুশোভিত জাতিসংঘের বিরাটকায় সদর দপ্তর ভবন, যেটি স্বমহিমাতেই নিউইয়র্কের আইকন হিসেবে স্ট্যাচুটির স্থলাভিষিক্ত হতে পারত, কিন্তু পারেনি, সেটির তুলনায় স্ট্যাচুটি অবয়বে ছোট্টই বটে। তা ছাড়া নাইন-ইলেভেনের আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ১১০ তলা থেকে যখন অদূরবর্তী স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে দেখেছিলাম, তখন সত্যি বলতে কি, ছোট্টই মনে হয়েছিল।
তবে আমি ছোট্ট বললেই কিন্তু এটি ছোট্ট হয়ে গেল না। স্ট্যাচুটির উচ্চতা ১৫১ ফুট এবং যে পাথরের বেদির ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত, সেটিসুদ্ধ মোট উচ্চতা হচ্ছে ৩০৫ ফুট। আর নিউইয়র্ক পোতাশ্রয়ে অবস্থিত ১২ একর আয়তনের লিবার্টি নামের যে ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে এটি স্থাপিত, সেটি নিউইয়র্ক স্টেটের অংশবিশেষ হলেও অবস্থানের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী স্টেট নিউজার্সির অধিকতর নিকটবর্তী।
সে যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রান্সের জনগণ কর্তৃক ভালোবাসা ও সহমর্মিতার নিদর্শনস্বরূপ স্ট্যাচুটি ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দেওয়া হয়। তা প্রথমে ছোট স্কেলে এটির যে মডেল তৈরি করা হয়, সেটিও বর্তমানে প্যারিসের লুক্সেমবার্গ পার্কে রক্ষিত আছে। আটাত্তরে ফ্রান্সে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে সেটি দেখারও সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
ফরাসি স্থপতি ফ্রেডরিক বার্থলজি স্ট্যাচুটির নির্মাতা, আর তাঁকে অন্তঃস্থ কাঠামো নির্মাণে সাহায্য করেছেন আইফেল টাওয়ার-খ্যাত গুস্তাভ আইফেল। প্রাচীন রোমের পৌরাণিক কাহিনীতে দাসপ্রথা ও অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে মুক্তিদানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম ছিল লিবারটা, যার মুখের আদলের অনুকরণেই মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে; যদিও অনেকে নাকি মূর্তিটির ভাবলেশহীন চেহারার সঙ্গে স্থপতির মায়ের চেহারার সাদৃশ্য খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।
আর মূর্তিটির দিকে খুব মনোযোগসহকারে তাকালে লক্ষ করা যায় যে এটি যেন পা দিয়ে কিছু মাড়িয়ে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, এটি হচ্ছে অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তি পাওয়ার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বাস্তবে কতটুকু ঘটেছে, সেটি অবশ্য আলাদা ব্যাপার। অধিকন্তু মূর্তিটির মাথায় যে সাতটি গজাল লক্ষিত হয়, সেগুলো নাকি প্রতিনিধিত্ব করে সাত সমুদ্র ও সাত মহাদেশের। আর দেবীর ডান হাতের মশালের মানে হচ্ছে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ তথা আলোকসম্পাত, আর বাঁ হাতে রক্ষিত ক্ষুদ্র ফলক দ্বারা নাকি বোঝানো হচ্ছে ‘জ্ঞান’ এবং এটিতে রোমান অক্ষরে লেখা আছে আমেরিকান জাতির জন্ম দিবস ৪ জুলাই ১৭৭৬।
গত বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে নিকটাত্মীয়সহযোগে সস্ত্রীক স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শন করতে না গেলে এতসব জানা হতো না। এর আগে দুবার যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যাওয়া হয়নি। কেননা সময়টি ছিল শীতকাল, আর শীতকালে লিবার্টি দ্বীপের ফেরি জাহাজ বন্ধ থাকে। এবার স্প্রিং তথা বসন্তকাল হলেও কী হবে, ঠান্ডা কনকনে বাতাসের তীব্র গতির দরুন হাড় কাঁপন শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কি!
নিউইয়র্কের যে প্রান্ত অর্থাৎ ম্যানহাটনের যে স্থান থেকে ফেরির যাত্রা শুরু, সেটি ‘জিরো গ্রাউন্ড’ অর্থাৎ নাইন-ইলেভেনের আগে যে জায়গায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার্স সগৌরবে বিরাজ করছিল, সেটির একেবারে কাছে।
ক্রিস্টিনা এসেছেন মিশিগান থেকে স্বামী-পুত্রসহ। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই শুনে খুব খুশি হলেন, স্বামী ও বালক পুত্রকে ডেকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শাড়ির প্রশংসা করতেও ভুললেন না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ আমি বলি কি-মার্কিনিরা স্বদেশে সুন্দর, বাঙালিরা পরবাসে।
দিনের শুরুটা হয়েছিল আকাশে মেঘের ঘনঘটা দিয়ে; মনে করিয়ে দিচ্ছিল ছেলেবেলায় পড়া কবিতার লাইনঃ ‘বাদলা দিনে আজকে আমার পাগলি মেতেছে/ছিন্ন কাঁথা রৌদ্র-শশীর সভায় পেতেছে।’ মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম। কী আশ্চর্য! সময় একটু গড়াতেই সূর্যমামা সেই যে উঁকি দিলেন, বাকিটা সময় আর মেঘের চাদরে গা ঢাকা দিলেন না। অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে রৌদ্রস্মাত আবহাওয়ায় শুধু কাছে থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টিই দেখা হলো না, পুরো লিবার্টি দ্বীপটিও ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। স্মারক আলোকচিত্রও তোলা হলো, বেলা থাকতেই বহাল তবিয়তে প্রত্যাবর্তন করা গেল।
আমাদের অর্থাৎ পর্যটকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চারপাশে অগণিত গাঙচিলকে উড়তে-বসতে দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ওপার বাংলার অধুনা জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের একটি গানের অংশবিশেষ, ‘আমি কখনো ভাসিনি নীলে/কখনো রাখিনি চোখ ডানামেলা গাঙচিলে···’। আর স্যুভেনির শপ থেকে স্ট্যাচুর ছোট্ট প্রতিরূপ কেনার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র পুস্তিকাও কিনে সেটি পাঠ করে জানা গেল-স্ট্যাচু অব লিবার্টি এমন প্রকৌশলে তৈরি যে বাতাস ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে প্রবাহিত হলে মূর্তিটি তিন ইঞ্চি ও মশাল পাঁচ ইঞ্চি দোল খায়। কী অপূর্ব মানুষের বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী শক্তি!
তা ছোট্ট বললাম এ কারণে যে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের পতাকা সুশোভিত জাতিসংঘের বিরাটকায় সদর দপ্তর ভবন, যেটি স্বমহিমাতেই নিউইয়র্কের আইকন হিসেবে স্ট্যাচুটির স্থলাভিষিক্ত হতে পারত, কিন্তু পারেনি, সেটির তুলনায় স্ট্যাচুটি অবয়বে ছোট্টই বটে। তা ছাড়া নাইন-ইলেভেনের আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ১১০ তলা থেকে যখন অদূরবর্তী স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে দেখেছিলাম, তখন সত্যি বলতে কি, ছোট্টই মনে হয়েছিল।
তবে আমি ছোট্ট বললেই কিন্তু এটি ছোট্ট হয়ে গেল না। স্ট্যাচুটির উচ্চতা ১৫১ ফুট এবং যে পাথরের বেদির ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত, সেটিসুদ্ধ মোট উচ্চতা হচ্ছে ৩০৫ ফুট। আর নিউইয়র্ক পোতাশ্রয়ে অবস্থিত ১২ একর আয়তনের লিবার্টি নামের যে ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে এটি স্থাপিত, সেটি নিউইয়র্ক স্টেটের অংশবিশেষ হলেও অবস্থানের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী স্টেট নিউজার্সির অধিকতর নিকটবর্তী।
সে যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রান্সের জনগণ কর্তৃক ভালোবাসা ও সহমর্মিতার নিদর্শনস্বরূপ স্ট্যাচুটি ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দেওয়া হয়। তা প্রথমে ছোট স্কেলে এটির যে মডেল তৈরি করা হয়, সেটিও বর্তমানে প্যারিসের লুক্সেমবার্গ পার্কে রক্ষিত আছে। আটাত্তরে ফ্রান্সে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে সেটি দেখারও সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
ফরাসি স্থপতি ফ্রেডরিক বার্থলজি স্ট্যাচুটির নির্মাতা, আর তাঁকে অন্তঃস্থ কাঠামো নির্মাণে সাহায্য করেছেন আইফেল টাওয়ার-খ্যাত গুস্তাভ আইফেল। প্রাচীন রোমের পৌরাণিক কাহিনীতে দাসপ্রথা ও অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে মুক্তিদানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম ছিল লিবারটা, যার মুখের আদলের অনুকরণেই মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে; যদিও অনেকে নাকি মূর্তিটির ভাবলেশহীন চেহারার সঙ্গে স্থপতির মায়ের চেহারার সাদৃশ্য খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।
আর মূর্তিটির দিকে খুব মনোযোগসহকারে তাকালে লক্ষ করা যায় যে এটি যেন পা দিয়ে কিছু মাড়িয়ে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, এটি হচ্ছে অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তি পাওয়ার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বাস্তবে কতটুকু ঘটেছে, সেটি অবশ্য আলাদা ব্যাপার। অধিকন্তু মূর্তিটির মাথায় যে সাতটি গজাল লক্ষিত হয়, সেগুলো নাকি প্রতিনিধিত্ব করে সাত সমুদ্র ও সাত মহাদেশের। আর দেবীর ডান হাতের মশালের মানে হচ্ছে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ তথা আলোকসম্পাত, আর বাঁ হাতে রক্ষিত ক্ষুদ্র ফলক দ্বারা নাকি বোঝানো হচ্ছে ‘জ্ঞান’ এবং এটিতে রোমান অক্ষরে লেখা আছে আমেরিকান জাতির জন্ম দিবস ৪ জুলাই ১৭৭৬।
গত বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে নিকটাত্মীয়সহযোগে সস্ত্রীক স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শন করতে না গেলে এতসব জানা হতো না। এর আগে দুবার যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যাওয়া হয়নি। কেননা সময়টি ছিল শীতকাল, আর শীতকালে লিবার্টি দ্বীপের ফেরি জাহাজ বন্ধ থাকে। এবার স্প্রিং তথা বসন্তকাল হলেও কী হবে, ঠান্ডা কনকনে বাতাসের তীব্র গতির দরুন হাড় কাঁপন শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কি!
নিউইয়র্কের যে প্রান্ত অর্থাৎ ম্যানহাটনের যে স্থান থেকে ফেরির যাত্রা শুরু, সেটি ‘জিরো গ্রাউন্ড’ অর্থাৎ নাইন-ইলেভেনের আগে যে জায়গায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার্স সগৌরবে বিরাজ করছিল, সেটির একেবারে কাছে।
ক্রিস্টিনা এসেছেন মিশিগান থেকে স্বামী-পুত্রসহ। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই শুনে খুব খুশি হলেন, স্বামী ও বালক পুত্রকে ডেকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শাড়ির প্রশংসা করতেও ভুললেন না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ আমি বলি কি-মার্কিনিরা স্বদেশে সুন্দর, বাঙালিরা পরবাসে।
দিনের শুরুটা হয়েছিল আকাশে মেঘের ঘনঘটা দিয়ে; মনে করিয়ে দিচ্ছিল ছেলেবেলায় পড়া কবিতার লাইনঃ ‘বাদলা দিনে আজকে আমার পাগলি মেতেছে/ছিন্ন কাঁথা রৌদ্র-শশীর সভায় পেতেছে।’ মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম। কী আশ্চর্য! সময় একটু গড়াতেই সূর্যমামা সেই যে উঁকি দিলেন, বাকিটা সময় আর মেঘের চাদরে গা ঢাকা দিলেন না। অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে রৌদ্রস্মাত আবহাওয়ায় শুধু কাছে থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টিই দেখা হলো না, পুরো লিবার্টি দ্বীপটিও ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। স্মারক আলোকচিত্রও তোলা হলো, বেলা থাকতেই বহাল তবিয়তে প্রত্যাবর্তন করা গেল।
আমাদের অর্থাৎ পর্যটকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চারপাশে অগণিত গাঙচিলকে উড়তে-বসতে দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ওপার বাংলার অধুনা জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের একটি গানের অংশবিশেষ, ‘আমি কখনো ভাসিনি নীলে/কখনো রাখিনি চোখ ডানামেলা গাঙচিলে···’। আর স্যুভেনির শপ থেকে স্ট্যাচুর ছোট্ট প্রতিরূপ কেনার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র পুস্তিকাও কিনে সেটি পাঠ করে জানা গেল-স্ট্যাচু অব লিবার্টি এমন প্রকৌশলে তৈরি যে বাতাস ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে প্রবাহিত হলে মূর্তিটি তিন ইঞ্চি ও মশাল পাঁচ ইঞ্চি দোল খায়। কী অপূর্ব মানুষের বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী শক্তি!
No comments:
Post a Comment