সুইজারল্যাণ্ড। এখানে এসে নাকি প্রকৃতির নেশায় ঘোর লেগে যায়। সেই নেশায়
আমেজ বাড়ায় বরফ ঢাকা পাহাড়। নীল জলের সরোবর। সুইস চকোলেট আর সেখানকার
ষোড়শীর চাহনি। কলকাতা ছাড়ার আগে বন্ধু পই পই করে বলে দিয়েছিল, ‘‘যেখানেই
যাস না কেন, একবার ইন্টারলাকেনটা ঘুরে নিস।’’ তাই ইন্টারলাকেন যাওয়ার লোভে
একা একাই বেরিয়ে পড়লেন লেখক।
দলছুট হয়ে গেলাম।
লুজার্ন-এ রয়ে গেল গোটা দল। আমি ক্যামেরা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে।
সুইজারল্যান্ড । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনে এসেছি দেশটার কথা। শুনে এসেছি এখানে এসে নাকি প্রকৃতির নেশায় ঘোর লেগে যায়। সেই নেশায় আমেজ বাড়ায় বরফ-ঢাকা পাহাড়। নীল জলের সরোবর। সুইস চকোলেট আর সেখানকার ষোড়শীর চাহনি। কলকাতা ছাড়ার আগে বন্ধু শুভজিৎ পই পই করে বলে দিয়েছিল, ‘‘যেখানেই যাস না কেন, পারলে একবার ইন্টারলাকেনটা ঘুরে নিস।’’
তাই ইন্টারলাকেন যাওয়ার লোভে একা একাই বেরিয়ে পড়লাম।
সুইজারল্যান্ডের পর্যটন বিভাগের নিমন্ত্রণে ভারত থেকে এসেছি আমরা জনা সাতেক সাংবাদিক। কেউ দিিল্লর, কেউ কেরালার, কেউ পঞ্জাবের, কেউ বা মুম্বইয়ের। আমি একা কলকাতা থেকে। দিল্লি থেকে জুরিখ, সেখান থেকে জারম্যাট। জারম্যাট থেকে ফেরার পথে লুজার্ন। সেখান থেকে আবার জুরিখ হয়ে ফিরে যাওয়া। সাতদিনের ট্যুর। কিন্তু, সেই ট্যুর শিডিউলের কোথাও ইন্টারলাকেনের নাম ছিল না। সুইস পর্যটনের বিন্দু কৃপালিনী অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, জারম্যাট, লুজার্ন দেখলেই ইন্টারলাকেন দেখা হয়ে যায়। নতুন কিছু দেখার নেই। ইন্টারলাকেন ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথায় যে জুমফ্রাও রয়েছে তার সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে ম্যাটারহর্ণ। বরফ ঢাকা সেই ম্যাটারহর্ণ পাহাড় ততক্ষণে আমাদের ঘোরা হয়ে গিয়েছে।
মন তবু মানতে চায়নি। খুত খুত করছিল। ভাত-ডাল-মাছের ঝোল খাওয়া বঙ্গসন্তানের পক্ষে আবার কবে সুইজারল্যান্ড আসা হবে তার কোনও ঠিক নেই। ফলে বন্ধু যখন বলেছে একবার দেখেই আসি না ইন্টারলাকেন। কিন্তু চাইলেই তো যাওয়া যায় না। সময় ধরে ধরে শিডিউল করা। সকালে ৯ টায় বেরোন থেকে রাত ৯ টায় ফেরা পর্যন্ত সবকিছুই ঘড়ি বাধা। আর সাত দিনের সেই ঘড়ি ধরা শিডিউলের কোথাও ইন্টারলাকেনের নামগন্ধ নেই।
তক্কে তক্কে ছিলাম। লুজার্নের শেষ দিনে টিটলিস পাহাড়ের মাথায় রেেস্তারায় বসে জানলাম সে দিনই দুপুরে একটি খালি সময় পাওয়া যাচ্ছে নিজেদের ইচ্ছে মতো ঘোরার। খবর নিয়ে জানলাম, লুজার্ন থেকে মেরিনজেন হয়ে ইন্টারলাকেন পৌছতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগবে। দু’বার ট্রেন বদল করতে হবে। নিয়মে বাধা কোনও কিছুই বাঙালির যে ধাতে নেই তা বুঝে ওঠার আগেই রেেস্তারায় বসা অন্যদের থেকে বিদায় নিয়ে কেটে পড়লাম একা। এ ভাবে দলছুট হয়ে কেটে পড়ায় চিন্তায় পড়ে যান আমাদের ট্যুর গাইড বিন্দু। বার বার জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কী, একা একা ঘুরে হোটেলে ঠিক সময়ে ফিরতে পারবেন তো? কাল সকালে কিন্তু আমাদের জুরিখের পথে রওনা হতে হবে।’’ আমি ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সন্ধ্যা এখানে দেরিতেই নামে। তাই অন্তত ঘন্টা তিনেক ইন্টারলাকেন ঘোরার পরিকল্পনা করেই ঝুকি নিয়ে নেমে পড়লাম। দলের অন্যরা ঠিক করলেন বাকি সময়টা কেনাকাটা করে কাটাবেন। টিটলিস পাহাড় থেকে নেমে এলাম রোপওয়ে চড়ে। ট্রেন ধরলাম ইন্টারলাকেনের পথে।
পাচ দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি এই দেশে। কখনও ট্রেনে, কখনও বাসে। বরফ ঢাকা পাহাড় দেখেছি, নীল টলটলে জলের লেক দেখেছি। পাহাড়ের গায়ে ঘাসের গালিচা পাতা, তাও দেখেছি। কিন্তু, এই প্রথম, মেরিনজন থেকে ট্রেনে ইন্টারলাকেন যাওয়ার পথে মনে হল প্রকৃতি ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করছে। ট্রেনের জানলায় বসে কীরকম বিমূঢ় হয়ে পড়ছি। ভুলে যাচ্ছি ক্যামেরায় চোখ রাখতে। কখনও সিম্বত ফিরছে। ক্যামেরা তুলে ধরছি। পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এ ছবি ক্যামেরায় তুলে রাখা সম্ভব নয়। এ ছবি একান্তই আমার। এই দিন, এই সময়, এই মুহূর্ত সব কিছুই যেন একবারই তৈরি হয়েছে শুধু কলকাতার এক অখ্যাত সাংবাদিককে মোহগ্রস্থ করে দিতে। পাহাড় তো আগেও দেখেছি। লেকও আগে দেখেছি। কিন্তু দুইয়ের এমন সহাবস্থান-এর নামই বোধহয় সুইজারল্যান্ড।
একদিকে মখমলের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। তার পাশ দিয়ে ছুটছে আমার কু-ঝিকঝিক ট্রেন। বিলাসের দিক থেকে এই দেশ ইউরোপের অন্য শহরের চেয়েও এগিয়ে। ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর পাস ছিল আমাদের কাছে। তার বিলাসিতার কাছে লজ্জা পেয়ে যাবে আমাদের দেশের তারা-আটা হোটেল। উপত্যকার উেল্টাদিকে লেক। তার জল স্বচ্ছ স্ফটিকের মত। লেকের ধার থেকে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে যে পাহাড়, বহুদূরে তার মাথায় চিকচিক করছে বরফ। আকাশের যে রং তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। অনেক ধরণের নীল রং দেখেছি। কিন্তু, সেই দিন আকাশের সেই রং, সবার চেয়েই আলাদা। চোখ তুলে আকাশে চাইলে কোনও এক অপূর্ব প্রসন্নতায় মন ভরে যায়।
ইন্টারলাকেন ছাড়ার পরে আরও তিন দিন ঘুরেছি সুইজারল্যান্ডে। কিন্তু, সে দিনের সেই আকাশ, স্ফটিকের মত লেক, চোখে আরাম দেয় এমন সবুজ গালিচা, একসঙ্গে আর কোথাও দেখিনি। হয়তো একা একা ঘুরে সে দিন আরও বেশি একাত্ম হতে পেরেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে। হয়তো, মনের ভিতরে ইন্টারলাকেন যাওয়ার সেই অদম্য ইচ্ছা থেকেই ভালো লাগাগুলো আরও বেশি ডানা মেলে প্রসারিত হয়েছিল। ইন্টারলাকেনের েস্টশন থেকে লম্বা একটা রাস্তা নাক বরাবর চলে গিয়েছে শহরের বুক চিরে। সেই রাস্তার দু’পাশে পৃথিবীর যাবতীয় নামিদামি ব্র্যান্ডের শো-রুম। পথের পাশে রেেস্তারা, হোটেল। কোথাও দোকান সরিয়ে সেই পথের পাশেই নেমে এসেছে এক চিলতে সবুজ টিলা পাহাড়। সব মিলিয়ে ইন্টারলাকেন শহরটা বেশ ছোটই। সেখান থেকে ছোট ট্রেনে চেপে পাহাড়ের মাথায় জুমফ্রাও যাওয়া যায়। আমার হাতে সময় ছিল না। তার জন্য এক রাত ইন্টারলাকেনে থাকার দরকার ছিল।
তিনটি ঘন্টা ধরে এক টানা সেই লম্বা রাস্তায় সে দিন একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি। নিজের ছবি নিজে তুলেছি। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-এর শু্যটিং রাস্তার পাশের যে রেেস্তারায় হয়েছিল সেখানে খানিকক্ষণ বসে থেকেছি। সেই রেেস্তারার ম্যানেজার এসে জানালেন, ভারত থেকে গোটা ইউনিট নিয়ে এসে শু্যটিং তাদের কাছে এখন জলভাত হয়ে গিয়েছে। পড়ন্ত সেই সুইস্ বিকেলে গায়ে হাত বুলিয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা হাওয়া, মন ছুয়ে যাওয়া প্রকৃতির স্পর্শ, পাশ দিয়ে খিলখিলিয়ে চলে যাওয়া সুইস্ সুন্দরী, চার দিকে চকোলেটের মিিষ্ট গেন্ধ এই ‘হরিপদ’ সাংবাদিক যে পরিমান আপ্লুত হয়েছিল তার কোনও হিসেব ছিল না। রাতে লিভার্নের হোটেলে ফিরে অবাঙালি সেই সাংবাদিককুলকে বোঝানোর চেষ্টাও করিনি, জীবনে প্রথমবার সুইজারল্যান্ডে এসে তারা নিজেদের ঠিক কতটা বিঞ্চত করলেন।
আরও একটা জায়গার বর্ণনা না দিলে অন্যায় করা হবে সুইজারল্যান্ডের প্রতি। সেটা জারম্যাট। কলকাতা বা ভারত থেকে এত দিন যারাই বেড়াতে গিয়েছেন, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই গিয়েছেন ভারম্যাটে। সুইজারল্যান্ডের একেবারে দক্ষিণে এই শহর। জারম্যাট দার্জিলিঙের চেয়ে ছোট, কিন্তু ওরকমই পাহাড়ে ঘেরা। দূষণহীন ভারম্যাটের বিশেষত্ব হল, এখানে শুধুই ব্যাটারি চালিত গাড়ি চলে। রাস্তায় কণামাত্র ধুলো নেই। বড় বড় শপিং সেন্টারে পৃথিবীর সমস্ত তাবড় নামী সংস্থার জিনিষ পাওয়া যায়। রয়েছে একের পর এক ঘড়ির দোকান। সুইস্ ঘড়ি পাওয়া যায় ভারতীয় মুদ্রায় চার হাজার টাকাতেও। কোটি টাকা দামের ঘড়িও রয়েছে। এখান থেকেই যেতে হয় ম্যাটারহর্ণ পাহাড়। যারা িস্ক করেন, ম্যাটারহর্ণ তাদের কাছে স্বর্গ।
এখানে আরও একটা গল্প বলে রাখা ভালো। সুইস্ পর্যটনের আমন্ত্রণ পেয়ে কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার আগের দিন বন্ধু শুভজিতের কাছ থেকে ছোটখাট ‘টিপস’ নিতে গিয়েছিলাম। জুলাই মাসে আর কতই বা ঠাণ্ডা হবে এই ভেবে একটা ফুলহাতা এবং একটি হাফহাতা সোয়েটার নিয়েছিলাম। শুভজিৎ ভয়ানক বকাঝকা করে বলেছিল, ‘‘মোটা জ্যাকেট তো নিবিই। সঙ্গে উলের টুপি, গ্লাভস এমনকী ভিতরে পরার ইনারও নিয়ে নিস। নইলে পস্তাতে হবে।’’ ওর কথা শুনেই গরম জামাকাপড় নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। ম্যাটারহর্ণের মাথায় পৌছে যখন নাকের কোনও সাড় ছিল না, চারদিকে সাদা ঝাপসা হাওয়া, সেই হাওয়ায় বরফের কুচি উড়ে এসে সূচ ফুটিয়ে যাচ্ছে, তখন স্থানীয় এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘তাপমাত্রা আজ একটু বেশিই রয়েছে। মাইনাস ১৮ ডিগ্রি।’’ শুনে কাপুনি বেড়ে গিয়েছিল।
ম্যাটারহর্ণের উচ্চতা ৩৮৮৩ মিটার। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ৩৮২০ মিটার উচুতে জারম্যাট পর্যটন বিভাগ একটি কেব্ল কার েস্টশন বানিয়েছে। ফলে কেব্ল কার-এ চেপেই সেখানে পৌছে যাওয়া যায়। েস্টশনটি ইউরোপের উচ্চতম কেব্ল কার েস্টশন। েস্টশনের পাশে রেেস্তারায় বসে আফশোষ করলেন জারম্যাট পর্যটন বিভাগের ক্লডিয়া স্টেবার। এই মহিলা মার্কেটিং ডিরেক্টরের কথায়, ‘‘গত বছর ২০ লক্ষ পর্যটক এসেছে ভারম্যাটে। কিন্তু, তুলনায় ভারতীয়দের সংখ্যা অনেক কম। তবে এখন ভারতের ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি বাড়ছে। ভারতীয়রা ততটা স্কি নিয়ে উৎসাহী নন। তাই মে মাস থেকে অেক্টাবরের মধ্যে জারম্যাট এলে তাদের অতটা ঠাণ্ডাও লাগবে না আবার বরফও উপভোগ করতে পারবেন।’’
সুইজারল্যান্ডে প্রতিটি শহরের জন্য আলাদা পর্যটন বিভাগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, পর্যটক টানতে তারা একে অপরের বিরুেদ্ধ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। লুজার্নের পর্যটন বিভাগের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মার্সেল পেরেন বলেন, ‘‘যেতেই পারেন ভারম্যাটে। কিন্তু, আমাদেরও লুজার্ন শহর রয়েছে। শহরে ঝা চকচকে ট্রাম রয়েছে। শহরের গায়ে বিশাল লেক রয়েছে। বিলাসবহুল মোটরবোটে বসে লেকের জলে ঘুরতে ঘুরতে আপনি লাঞ্চ, ডিনার করতে পারবেন। আবার টিটলিস-এর মতো বরফ ঢাকা পাহাড়ও রয়েছে।’’
এই কারণেই গত বছর প্রায় ৪০ হাজার ভারতীয় বেড়াতে গিয়েছিলেন লুজার্নে। ভারতীয়দের কাছে অবশ্য ইন্টারলাকেনই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে জনিপ্রয় জায়গা।
দলছুট হয়ে গেলাম।
লুজার্ন-এ রয়ে গেল গোটা দল। আমি ক্যামেরা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে।
সুইজারল্যান্ড । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনে এসেছি দেশটার কথা। শুনে এসেছি এখানে এসে নাকি প্রকৃতির নেশায় ঘোর লেগে যায়। সেই নেশায় আমেজ বাড়ায় বরফ-ঢাকা পাহাড়। নীল জলের সরোবর। সুইস চকোলেট আর সেখানকার ষোড়শীর চাহনি। কলকাতা ছাড়ার আগে বন্ধু শুভজিৎ পই পই করে বলে দিয়েছিল, ‘‘যেখানেই যাস না কেন, পারলে একবার ইন্টারলাকেনটা ঘুরে নিস।’’
তাই ইন্টারলাকেন যাওয়ার লোভে একা একাই বেরিয়ে পড়লাম।
সুইজারল্যান্ডের পর্যটন বিভাগের নিমন্ত্রণে ভারত থেকে এসেছি আমরা জনা সাতেক সাংবাদিক। কেউ দিিল্লর, কেউ কেরালার, কেউ পঞ্জাবের, কেউ বা মুম্বইয়ের। আমি একা কলকাতা থেকে। দিল্লি থেকে জুরিখ, সেখান থেকে জারম্যাট। জারম্যাট থেকে ফেরার পথে লুজার্ন। সেখান থেকে আবার জুরিখ হয়ে ফিরে যাওয়া। সাতদিনের ট্যুর। কিন্তু, সেই ট্যুর শিডিউলের কোথাও ইন্টারলাকেনের নাম ছিল না। সুইস পর্যটনের বিন্দু কৃপালিনী অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, জারম্যাট, লুজার্ন দেখলেই ইন্টারলাকেন দেখা হয়ে যায়। নতুন কিছু দেখার নেই। ইন্টারলাকেন ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথায় যে জুমফ্রাও রয়েছে তার সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে ম্যাটারহর্ণ। বরফ ঢাকা সেই ম্যাটারহর্ণ পাহাড় ততক্ষণে আমাদের ঘোরা হয়ে গিয়েছে।
মন তবু মানতে চায়নি। খুত খুত করছিল। ভাত-ডাল-মাছের ঝোল খাওয়া বঙ্গসন্তানের পক্ষে আবার কবে সুইজারল্যান্ড আসা হবে তার কোনও ঠিক নেই। ফলে বন্ধু যখন বলেছে একবার দেখেই আসি না ইন্টারলাকেন। কিন্তু চাইলেই তো যাওয়া যায় না। সময় ধরে ধরে শিডিউল করা। সকালে ৯ টায় বেরোন থেকে রাত ৯ টায় ফেরা পর্যন্ত সবকিছুই ঘড়ি বাধা। আর সাত দিনের সেই ঘড়ি ধরা শিডিউলের কোথাও ইন্টারলাকেনের নামগন্ধ নেই।
তক্কে তক্কে ছিলাম। লুজার্নের শেষ দিনে টিটলিস পাহাড়ের মাথায় রেেস্তারায় বসে জানলাম সে দিনই দুপুরে একটি খালি সময় পাওয়া যাচ্ছে নিজেদের ইচ্ছে মতো ঘোরার। খবর নিয়ে জানলাম, লুজার্ন থেকে মেরিনজেন হয়ে ইন্টারলাকেন পৌছতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগবে। দু’বার ট্রেন বদল করতে হবে। নিয়মে বাধা কোনও কিছুই বাঙালির যে ধাতে নেই তা বুঝে ওঠার আগেই রেেস্তারায় বসা অন্যদের থেকে বিদায় নিয়ে কেটে পড়লাম একা। এ ভাবে দলছুট হয়ে কেটে পড়ায় চিন্তায় পড়ে যান আমাদের ট্যুর গাইড বিন্দু। বার বার জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কী, একা একা ঘুরে হোটেলে ঠিক সময়ে ফিরতে পারবেন তো? কাল সকালে কিন্তু আমাদের জুরিখের পথে রওনা হতে হবে।’’ আমি ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সন্ধ্যা এখানে দেরিতেই নামে। তাই অন্তত ঘন্টা তিনেক ইন্টারলাকেন ঘোরার পরিকল্পনা করেই ঝুকি নিয়ে নেমে পড়লাম। দলের অন্যরা ঠিক করলেন বাকি সময়টা কেনাকাটা করে কাটাবেন। টিটলিস পাহাড় থেকে নেমে এলাম রোপওয়ে চড়ে। ট্রেন ধরলাম ইন্টারলাকেনের পথে।
পাচ দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি এই দেশে। কখনও ট্রেনে, কখনও বাসে। বরফ ঢাকা পাহাড় দেখেছি, নীল টলটলে জলের লেক দেখেছি। পাহাড়ের গায়ে ঘাসের গালিচা পাতা, তাও দেখেছি। কিন্তু, এই প্রথম, মেরিনজন থেকে ট্রেনে ইন্টারলাকেন যাওয়ার পথে মনে হল প্রকৃতি ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করছে। ট্রেনের জানলায় বসে কীরকম বিমূঢ় হয়ে পড়ছি। ভুলে যাচ্ছি ক্যামেরায় চোখ রাখতে। কখনও সিম্বত ফিরছে। ক্যামেরা তুলে ধরছি। পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এ ছবি ক্যামেরায় তুলে রাখা সম্ভব নয়। এ ছবি একান্তই আমার। এই দিন, এই সময়, এই মুহূর্ত সব কিছুই যেন একবারই তৈরি হয়েছে শুধু কলকাতার এক অখ্যাত সাংবাদিককে মোহগ্রস্থ করে দিতে। পাহাড় তো আগেও দেখেছি। লেকও আগে দেখেছি। কিন্তু দুইয়ের এমন সহাবস্থান-এর নামই বোধহয় সুইজারল্যান্ড।
একদিকে মখমলের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। তার পাশ দিয়ে ছুটছে আমার কু-ঝিকঝিক ট্রেন। বিলাসের দিক থেকে এই দেশ ইউরোপের অন্য শহরের চেয়েও এগিয়ে। ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর পাস ছিল আমাদের কাছে। তার বিলাসিতার কাছে লজ্জা পেয়ে যাবে আমাদের দেশের তারা-আটা হোটেল। উপত্যকার উেল্টাদিকে লেক। তার জল স্বচ্ছ স্ফটিকের মত। লেকের ধার থেকে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে যে পাহাড়, বহুদূরে তার মাথায় চিকচিক করছে বরফ। আকাশের যে রং তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। অনেক ধরণের নীল রং দেখেছি। কিন্তু, সেই দিন আকাশের সেই রং, সবার চেয়েই আলাদা। চোখ তুলে আকাশে চাইলে কোনও এক অপূর্ব প্রসন্নতায় মন ভরে যায়।
ইন্টারলাকেন ছাড়ার পরে আরও তিন দিন ঘুরেছি সুইজারল্যান্ডে। কিন্তু, সে দিনের সেই আকাশ, স্ফটিকের মত লেক, চোখে আরাম দেয় এমন সবুজ গালিচা, একসঙ্গে আর কোথাও দেখিনি। হয়তো একা একা ঘুরে সে দিন আরও বেশি একাত্ম হতে পেরেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে। হয়তো, মনের ভিতরে ইন্টারলাকেন যাওয়ার সেই অদম্য ইচ্ছা থেকেই ভালো লাগাগুলো আরও বেশি ডানা মেলে প্রসারিত হয়েছিল। ইন্টারলাকেনের েস্টশন থেকে লম্বা একটা রাস্তা নাক বরাবর চলে গিয়েছে শহরের বুক চিরে। সেই রাস্তার দু’পাশে পৃথিবীর যাবতীয় নামিদামি ব্র্যান্ডের শো-রুম। পথের পাশে রেেস্তারা, হোটেল। কোথাও দোকান সরিয়ে সেই পথের পাশেই নেমে এসেছে এক চিলতে সবুজ টিলা পাহাড়। সব মিলিয়ে ইন্টারলাকেন শহরটা বেশ ছোটই। সেখান থেকে ছোট ট্রেনে চেপে পাহাড়ের মাথায় জুমফ্রাও যাওয়া যায়। আমার হাতে সময় ছিল না। তার জন্য এক রাত ইন্টারলাকেনে থাকার দরকার ছিল।
তিনটি ঘন্টা ধরে এক টানা সেই লম্বা রাস্তায় সে দিন একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি। নিজের ছবি নিজে তুলেছি। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-এর শু্যটিং রাস্তার পাশের যে রেেস্তারায় হয়েছিল সেখানে খানিকক্ষণ বসে থেকেছি। সেই রেেস্তারার ম্যানেজার এসে জানালেন, ভারত থেকে গোটা ইউনিট নিয়ে এসে শু্যটিং তাদের কাছে এখন জলভাত হয়ে গিয়েছে। পড়ন্ত সেই সুইস্ বিকেলে গায়ে হাত বুলিয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা হাওয়া, মন ছুয়ে যাওয়া প্রকৃতির স্পর্শ, পাশ দিয়ে খিলখিলিয়ে চলে যাওয়া সুইস্ সুন্দরী, চার দিকে চকোলেটের মিিষ্ট গেন্ধ এই ‘হরিপদ’ সাংবাদিক যে পরিমান আপ্লুত হয়েছিল তার কোনও হিসেব ছিল না। রাতে লিভার্নের হোটেলে ফিরে অবাঙালি সেই সাংবাদিককুলকে বোঝানোর চেষ্টাও করিনি, জীবনে প্রথমবার সুইজারল্যান্ডে এসে তারা নিজেদের ঠিক কতটা বিঞ্চত করলেন।
আরও একটা জায়গার বর্ণনা না দিলে অন্যায় করা হবে সুইজারল্যান্ডের প্রতি। সেটা জারম্যাট। কলকাতা বা ভারত থেকে এত দিন যারাই বেড়াতে গিয়েছেন, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই গিয়েছেন ভারম্যাটে। সুইজারল্যান্ডের একেবারে দক্ষিণে এই শহর। জারম্যাট দার্জিলিঙের চেয়ে ছোট, কিন্তু ওরকমই পাহাড়ে ঘেরা। দূষণহীন ভারম্যাটের বিশেষত্ব হল, এখানে শুধুই ব্যাটারি চালিত গাড়ি চলে। রাস্তায় কণামাত্র ধুলো নেই। বড় বড় শপিং সেন্টারে পৃথিবীর সমস্ত তাবড় নামী সংস্থার জিনিষ পাওয়া যায়। রয়েছে একের পর এক ঘড়ির দোকান। সুইস্ ঘড়ি পাওয়া যায় ভারতীয় মুদ্রায় চার হাজার টাকাতেও। কোটি টাকা দামের ঘড়িও রয়েছে। এখান থেকেই যেতে হয় ম্যাটারহর্ণ পাহাড়। যারা িস্ক করেন, ম্যাটারহর্ণ তাদের কাছে স্বর্গ।
এখানে আরও একটা গল্প বলে রাখা ভালো। সুইস্ পর্যটনের আমন্ত্রণ পেয়ে কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার আগের দিন বন্ধু শুভজিতের কাছ থেকে ছোটখাট ‘টিপস’ নিতে গিয়েছিলাম। জুলাই মাসে আর কতই বা ঠাণ্ডা হবে এই ভেবে একটা ফুলহাতা এবং একটি হাফহাতা সোয়েটার নিয়েছিলাম। শুভজিৎ ভয়ানক বকাঝকা করে বলেছিল, ‘‘মোটা জ্যাকেট তো নিবিই। সঙ্গে উলের টুপি, গ্লাভস এমনকী ভিতরে পরার ইনারও নিয়ে নিস। নইলে পস্তাতে হবে।’’ ওর কথা শুনেই গরম জামাকাপড় নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। ম্যাটারহর্ণের মাথায় পৌছে যখন নাকের কোনও সাড় ছিল না, চারদিকে সাদা ঝাপসা হাওয়া, সেই হাওয়ায় বরফের কুচি উড়ে এসে সূচ ফুটিয়ে যাচ্ছে, তখন স্থানীয় এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘তাপমাত্রা আজ একটু বেশিই রয়েছে। মাইনাস ১৮ ডিগ্রি।’’ শুনে কাপুনি বেড়ে গিয়েছিল।
ম্যাটারহর্ণের উচ্চতা ৩৮৮৩ মিটার। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ৩৮২০ মিটার উচুতে জারম্যাট পর্যটন বিভাগ একটি কেব্ল কার েস্টশন বানিয়েছে। ফলে কেব্ল কার-এ চেপেই সেখানে পৌছে যাওয়া যায়। েস্টশনটি ইউরোপের উচ্চতম কেব্ল কার েস্টশন। েস্টশনের পাশে রেেস্তারায় বসে আফশোষ করলেন জারম্যাট পর্যটন বিভাগের ক্লডিয়া স্টেবার। এই মহিলা মার্কেটিং ডিরেক্টরের কথায়, ‘‘গত বছর ২০ লক্ষ পর্যটক এসেছে ভারম্যাটে। কিন্তু, তুলনায় ভারতীয়দের সংখ্যা অনেক কম। তবে এখন ভারতের ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি বাড়ছে। ভারতীয়রা ততটা স্কি নিয়ে উৎসাহী নন। তাই মে মাস থেকে অেক্টাবরের মধ্যে জারম্যাট এলে তাদের অতটা ঠাণ্ডাও লাগবে না আবার বরফও উপভোগ করতে পারবেন।’’
সুইজারল্যান্ডে প্রতিটি শহরের জন্য আলাদা পর্যটন বিভাগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, পর্যটক টানতে তারা একে অপরের বিরুেদ্ধ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। লুজার্নের পর্যটন বিভাগের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মার্সেল পেরেন বলেন, ‘‘যেতেই পারেন ভারম্যাটে। কিন্তু, আমাদেরও লুজার্ন শহর রয়েছে। শহরে ঝা চকচকে ট্রাম রয়েছে। শহরের গায়ে বিশাল লেক রয়েছে। বিলাসবহুল মোটরবোটে বসে লেকের জলে ঘুরতে ঘুরতে আপনি লাঞ্চ, ডিনার করতে পারবেন। আবার টিটলিস-এর মতো বরফ ঢাকা পাহাড়ও রয়েছে।’’
এই কারণেই গত বছর প্রায় ৪০ হাজার ভারতীয় বেড়াতে গিয়েছিলেন লুজার্নে। ভারতীয়দের কাছে অবশ্য ইন্টারলাকেনই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে জনিপ্রয় জায়গা।
No comments:
Post a Comment