সমুদ্রসৈকতে পর্যটক মাথার ওপর সূর্য। পায়ের নিচে বালু। পেছনে ঝাউবন।
সামনে সাদা মুকুটের ঢেউতোলা প্রিয় বঙ্গোপসাগর। কক্সবাজার সৈকতের এ অংশকে
লোকে বলে পুরোনো বিচ, আদ্যিকালের সৈকত। এই পথ তেমন কেউ মাড়ায় না। বিস্তীর্ণ
সৈকতের বুকটাও তাই পদচিহ্নহীন, নিষ্কলুষ। ঝাউবনের ফাঁকে দুটো ছাতাঢাকা
হেলানো বেঞ্চ। কালেভদ্রে হয়তো এখানে কেউ এসে বসে। বেশ কিছুটা দূরে ধনুকের
মতো বাঁক খেয়ে বাঁকটা ঘুরে গেছে। দূর থেকে সে সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটা
সাদা রেখা শুধু চোখে পড়ে। সাগর থেকে উঠে আসা দুরন্ত বাতাসে অবিরাম এলোমেলো
হয়ে যাচ্ছে সবকিছু, মনটাও। ওটা দূর থেকে ভালো করে লক্ষ না করলে মনে হবে,
সাগরের বুকেই বুঝি চলছে ঢেউয়ের দাপাদাপি। সেটা ভুল। কেননা, খুব দূরে কালো
মতো অনুচ্চ একটা রেখা দেখা যাচ্ছে, কতকটা উঁচু-নিচু, পাহাড়ি ঝোপের মতো।
সৈকতচারী এক শামুক-কুড়ানিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ওটা
মহেশখালী-কক্সবাজারের সেই পৌরাণিক দ্বীপ। কক্সবাজার শহর থেকে ঝিনুক মার্কেট
আর বিমানবন্দরের মাঝখান দিয়ে সোজা নেমে আসা এ সড়ক এসে থেমেছে এই বিচে।
একসময় এটাই ছিল কক্সবাজার সৈকতের প্রবেশদ্বার। এখন এই সৈকতে সে ঐতিহ্য
হারিয়েছে, হারিয়ে গেছে লাবণী পয়েন্ট আর কলাতলীর নবীন বেলাভূমির কাছে।
কিন্তু তাই বলে তার আকর্ষণ আর সৌন্দর্য মোটেও কমেনি।
রাস্তার প্রান্তে গোটা কয়েক নারকেলগাছ বালুর মধ্যে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দুদিকে বিস্তীর্ণ সারি বাঁধা ঝাউবন। জোয়ারের পানি এসে ঝাউগাছগুলোর শেকড়বাখড় ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে ফেনা ফেনা দুরন্ত ঢেউ। ভাটায় পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে উদোম পিঠে রোদপোহানো সৈকত—চকচকে রুপালি। অন্যান্য সৈকত যেখানে মহাব্যস্ত, জনারণ্যে ম্রিয়মাণ ঝাউ অরণ্য আর বালুর বুকে ধেয়ে চলা সাগর কলমীলতা, সেখানে পুরোনো সৈকতের নির্জনতাটুকুই যেন ওর অহংকার। এসব ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম সূর্যাস্ত দেখার অপেক্ষায়। অবশ্য কেউ কেউ বিচ-স্কুটারে চেপে বা ঘোড়ায় চড়ে এদিকে মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যাচ্ছে নবীন বিচ থেকে। এখানে বসেও রীতিমতো উপলব্ধি করছি, নবীন বিচ থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত সৈকতের অংশটুকু হাজার হাজার মানুষের পদচারণে উৎসবে রূপ নিয়েছে। ছাতা খুলে সাজিয়ে রাখা বেঞ্চগুলোর প্রায় কোনোটাই খালি নেই। অন্যবেলায় অনেকেই সাগরের পানিতে ভিজে একাকার হচ্ছে। ঝিনুকমালা বিক্রেতার দল ছুটে বেড়াচ্ছে এর কাছ থেকে ওর কাছে। আর স্থানীয় ক্যামেরাম্যানরা ওত পেতে বসে আছে শিকারের আশায়। সূর্যাস্তের মুহূর্তগুলো ওরা ক্যামেরাবন্দী করতে মহাব্যস্ত। সূর্যাস্তের ছবি তোলার ওদের একটা পছন্দের পোজ আছে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটার সামনে কেউ একজন হাতের তালু পেতে ধরেছে, যেন সে অস্তায়মান সূর্যটাকেই ধরে আছে। হেমন্ত-শীতে সেটা সম্ভব হলেও এই গ্রীষ্মে, অফ সিজনে সেই পছন্দনীয় ছবির ফ্রেম তৈরি করা একরকম অসম্ভবই বটে। সূর্যটা হেলতে শুরু করেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়েব হয়ে যাবে সাগরের পানিতে। হলোও তা-ই। বিকেল ফুরোতে না ফুরোতেই আকাশের কালবৈশাখী মেঘের টুকরোটা ক্রমেই যেন বড় হতে লাগল। সূর্যাস্ত দেখার সব আশা গুড়ে বালি হয়ে গেল। আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে হঠাৎ করে কোথায় যেন সূর্যটা হারিয়ে গেল, মিশে গেল মেঘের পকেটে। কালচে আকাশের মতো আমাদের মনটাও কালো হয়ে গেল। একেই বলে ‘অফ সিজন’। হঠাৎ করে প্রকৃতি ও সাগরের মুড অফ হয়ে যাওয়া। হলোও তা-ই। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো কালবৈশাখী। দাপুটে বৃষ্টি। মাতাল সাগর। দু-চারজন ছাড়া মুহূর্তের মধ্যে বিচ খালি হয়ে গেল। বলা তো যায় না, সাগর কখন আরও বেশি খেপে ওঠে। সূর্য চেয়ে মেঘ পেলাম, মেঘ থেকে নামল বৃষ্টি আর বাতাস, শুকনো বালুতে সারা গা মাখামাখি, দাঁত কিচমিচ, মন খিচমিচ নিয়ে উঠতে হলো ওপরে। কিন্তু ওপরেও তো কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই, নেই বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা। কী আর করা! অফ সিজন বলে কথা। হোটেলগুলো তো আর শুধু শুধু ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অফার করেনি। দর্শনের আনন্দও তাই ফিফটি পার্সেন্ট কমবে না কেন? এই সান্ত্বনা নিয়েই ডেরায় ফিরতে হলো কাকভেজা হয়ে, রিকশাবিহীন হেঁটে। তবু থেমে থাকে না ভ্রমণ। ভেজার পরও এক অন্য রকম ভালো লাগা—সাগরের পাড়ে লোনা জলে নয়, স্বর্গীয় মিঠা এক শীতল জলের ধারায় সিক্ত হওয়া। সব মানুষের সময় করে ওঠা তো আর একসময় হয় না। তাই অন্য কোনো সময়ে অন্য এক বেলাভূমিতে নিরিবিলি সময় কাটানো, এও এক অন্য রকমের আনন্দ, কক্সবাজারে বেড়ানোর এক অন্য পিঠ। কক্সবাজারে সে জন্য অফ সিজনে হোটেলগুলোও যেন তাদের ভাড়া কমিয়ে পর্যটকদের ডাকতে থাকে। তবে যাঁরা খুব ভিড় এড়িয়ে কক্সবাজারকে দুই দিনের জন্য একান্তে পেতে চান আপন করে, উপভোগ করতে চান সৈকতের আসল প্রকৃতি, নিরাবরণ সেই শুদ্ধ সৈকতকে দেখার এটাই ভালো সময়, অন্তত বর্ষাকাল পর্যন্ত তা চলতে পারে। কক্সবাজারে এখন লোভনীয় সব থাকার জায়গা আর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে হোটেল-মোটেলে। ভাড়াও আশ্চর্যজনকভাবে কম। অফ সিজন বলে ভিড় কম, রাস্তাও ফাঁকা। দোকানগুলোতেও চলছে নানা রকমের ডিসকাউন্ট, দরকষাকষি। তাই অফ সিজন মনে করে সামনের শীতের অপেক্ষা না করে এখনই কক্সবাজারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লে খুব খারাপ কিছু হবে না।
কীভাবে যাবেন
কক্সবাজারে যাওয়া এখন তো ডাল-ভাতের মতো সোজা। ঢাকা থেকে সোজা হানিফ, এস আলম, ইউনিক ইত্যাদি বিলাসবহুল যেকোনো বাসে চড়ে কক্সবাজারে। বিমান বা ট্রেনে গেলে চট্টগ্রাম থেকে আবার বাসে কক্সবাজারে যেতে হবে। থাকার জন্য পর্যটন মোটেলসহ অন্তত ১০০ হোটেল আছে।
রাস্তার প্রান্তে গোটা কয়েক নারকেলগাছ বালুর মধ্যে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দুদিকে বিস্তীর্ণ সারি বাঁধা ঝাউবন। জোয়ারের পানি এসে ঝাউগাছগুলোর শেকড়বাখড় ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে ফেনা ফেনা দুরন্ত ঢেউ। ভাটায় পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে উদোম পিঠে রোদপোহানো সৈকত—চকচকে রুপালি। অন্যান্য সৈকত যেখানে মহাব্যস্ত, জনারণ্যে ম্রিয়মাণ ঝাউ অরণ্য আর বালুর বুকে ধেয়ে চলা সাগর কলমীলতা, সেখানে পুরোনো সৈকতের নির্জনতাটুকুই যেন ওর অহংকার। এসব ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম সূর্যাস্ত দেখার অপেক্ষায়। অবশ্য কেউ কেউ বিচ-স্কুটারে চেপে বা ঘোড়ায় চড়ে এদিকে মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যাচ্ছে নবীন বিচ থেকে। এখানে বসেও রীতিমতো উপলব্ধি করছি, নবীন বিচ থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত সৈকতের অংশটুকু হাজার হাজার মানুষের পদচারণে উৎসবে রূপ নিয়েছে। ছাতা খুলে সাজিয়ে রাখা বেঞ্চগুলোর প্রায় কোনোটাই খালি নেই। অন্যবেলায় অনেকেই সাগরের পানিতে ভিজে একাকার হচ্ছে। ঝিনুকমালা বিক্রেতার দল ছুটে বেড়াচ্ছে এর কাছ থেকে ওর কাছে। আর স্থানীয় ক্যামেরাম্যানরা ওত পেতে বসে আছে শিকারের আশায়। সূর্যাস্তের মুহূর্তগুলো ওরা ক্যামেরাবন্দী করতে মহাব্যস্ত। সূর্যাস্তের ছবি তোলার ওদের একটা পছন্দের পোজ আছে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটার সামনে কেউ একজন হাতের তালু পেতে ধরেছে, যেন সে অস্তায়মান সূর্যটাকেই ধরে আছে। হেমন্ত-শীতে সেটা সম্ভব হলেও এই গ্রীষ্মে, অফ সিজনে সেই পছন্দনীয় ছবির ফ্রেম তৈরি করা একরকম অসম্ভবই বটে। সূর্যটা হেলতে শুরু করেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়েব হয়ে যাবে সাগরের পানিতে। হলোও তা-ই। বিকেল ফুরোতে না ফুরোতেই আকাশের কালবৈশাখী মেঘের টুকরোটা ক্রমেই যেন বড় হতে লাগল। সূর্যাস্ত দেখার সব আশা গুড়ে বালি হয়ে গেল। আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে হঠাৎ করে কোথায় যেন সূর্যটা হারিয়ে গেল, মিশে গেল মেঘের পকেটে। কালচে আকাশের মতো আমাদের মনটাও কালো হয়ে গেল। একেই বলে ‘অফ সিজন’। হঠাৎ করে প্রকৃতি ও সাগরের মুড অফ হয়ে যাওয়া। হলোও তা-ই। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো কালবৈশাখী। দাপুটে বৃষ্টি। মাতাল সাগর। দু-চারজন ছাড়া মুহূর্তের মধ্যে বিচ খালি হয়ে গেল। বলা তো যায় না, সাগর কখন আরও বেশি খেপে ওঠে। সূর্য চেয়ে মেঘ পেলাম, মেঘ থেকে নামল বৃষ্টি আর বাতাস, শুকনো বালুতে সারা গা মাখামাখি, দাঁত কিচমিচ, মন খিচমিচ নিয়ে উঠতে হলো ওপরে। কিন্তু ওপরেও তো কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই, নেই বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা। কী আর করা! অফ সিজন বলে কথা। হোটেলগুলো তো আর শুধু শুধু ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অফার করেনি। দর্শনের আনন্দও তাই ফিফটি পার্সেন্ট কমবে না কেন? এই সান্ত্বনা নিয়েই ডেরায় ফিরতে হলো কাকভেজা হয়ে, রিকশাবিহীন হেঁটে। তবু থেমে থাকে না ভ্রমণ। ভেজার পরও এক অন্য রকম ভালো লাগা—সাগরের পাড়ে লোনা জলে নয়, স্বর্গীয় মিঠা এক শীতল জলের ধারায় সিক্ত হওয়া। সব মানুষের সময় করে ওঠা তো আর একসময় হয় না। তাই অন্য কোনো সময়ে অন্য এক বেলাভূমিতে নিরিবিলি সময় কাটানো, এও এক অন্য রকমের আনন্দ, কক্সবাজারে বেড়ানোর এক অন্য পিঠ। কক্সবাজারে সে জন্য অফ সিজনে হোটেলগুলোও যেন তাদের ভাড়া কমিয়ে পর্যটকদের ডাকতে থাকে। তবে যাঁরা খুব ভিড় এড়িয়ে কক্সবাজারকে দুই দিনের জন্য একান্তে পেতে চান আপন করে, উপভোগ করতে চান সৈকতের আসল প্রকৃতি, নিরাবরণ সেই শুদ্ধ সৈকতকে দেখার এটাই ভালো সময়, অন্তত বর্ষাকাল পর্যন্ত তা চলতে পারে। কক্সবাজারে এখন লোভনীয় সব থাকার জায়গা আর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে হোটেল-মোটেলে। ভাড়াও আশ্চর্যজনকভাবে কম। অফ সিজন বলে ভিড় কম, রাস্তাও ফাঁকা। দোকানগুলোতেও চলছে নানা রকমের ডিসকাউন্ট, দরকষাকষি। তাই অফ সিজন মনে করে সামনের শীতের অপেক্ষা না করে এখনই কক্সবাজারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লে খুব খারাপ কিছু হবে না।
কীভাবে যাবেন
কক্সবাজারে যাওয়া এখন তো ডাল-ভাতের মতো সোজা। ঢাকা থেকে সোজা হানিফ, এস আলম, ইউনিক ইত্যাদি বিলাসবহুল যেকোনো বাসে চড়ে কক্সবাজারে। বিমান বা ট্রেনে গেলে চট্টগ্রাম থেকে আবার বাসে কক্সবাজারে যেতে হবে। থাকার জন্য পর্যটন মোটেলসহ অন্তত ১০০ হোটেল আছে।
No comments:
Post a Comment