মহাদেও হিলসে জমিয়ে বর্র্ষা এসেছে। পচ্মঢ়ীর আকাশ অন্যান্য আকাশের
তুলনায় মাটির কাছে। তার ওপর বর্ষার মেঘের ভারে আরও নুয়ে পড়েছে। মেঘগুলোও
ভারী জো পেয়ে গিয়েছে। দরজা জানলার বাধাকে লবডঙ্কা দেখিয়ে যখন তখন ঘরে ঢুকে
পড়ছে; যেন দার্জিলিঙ। তাই না দেখে হাওয়ার হয়েছে বেজায় ফুর্তি। গাছের মাথা
নিয়ে শুরু করেছে টেনিস খেলা। গাছগুলো তাই একবার এ দিকে একবার ও দিকে হেলে
পড়ছে আর পাশ দিয়ে কুয়াশা ফিসফিস করতে করতে চলে যাচ্ছে।
পৌঁছে শুনি টানা কুড়ি দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই আরও কুড়ি দিনের বৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। তা হলে কি আমাদের বেড়ানো ভেেস্ত যাবে? তাই কখনও হয়! পচ্মঢ়ীর চোখ ধাধানো রূপ র্যাফায়েলের ভেলের মতো মেঘের আড়াল থেকে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়েই গেল আর আমরা রেনকোট আর হাওয়াই চটি সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম শিবঠাকুরের সন্ধানে।
ছোট শহর পচ্মঢ়ী। দক্ষিণের দিকে মহাদেও হিলস পৌঁছতে বিশেষ সময় লাগেনা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। এক পাহাড় থেকে নেমে আর এক পাহাড়ে ওঠা। গাড়ির কাচ ঝাপসা। পরিষ্কার করলেই কুয়াশা আর বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে দেখা যায় সবুজের সমারোহের অস্পষ্ট আভাস, ইম্প্রেশানিস্ট শিল্পীর ছবির মতো। চোখ নয় হয়তো, কিন্তু মন যে জুড়িয়ে যায় সে বিষয় সেন্দহ নেই। বাস্তব না স্বপ্ন বিচার করতে করতেই গাড়ি এসে থামল রাস্তা থেকে খানিকটা নীচে খোলা এক চত্বরে।
জিপসির চালক শব্বির আমাদের পরিচিত মানুষ।গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলতে খুলতে বলল, বড় লঙ্গুরের উৎপাত। আমি যাচ্ছি না। তোমাদের সঙ্গে ও যাবে।
ও মানে আমাদের প্রিয় বন্ধু কৈলাশ। সঙ্গে একজন থাকলেই হল। কৈলাশ হলে তো কথাই নেই।
চারদিকে তাকালাম। এটা নাকি পার্কিং লট। কোথাও কোনও গাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। ঝুপঝুপে বৃষ্টির মধ্যে মাত্র একটা ছাউনির তলায় দু’জন স্যাতস্যাতে মানুষ অত্যুৎসাহী ভক্তের কাছে নারকেল ধুপকাঠি নকুড়দানার প্যাকেট বিক্রির আশায় বসে আছে।
আমরা এগোলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা ধরে। বাদিকে পাহাড় উঠে গিয়েছে। ঘন সবুজ গাছে মোড়া। ডালপালা থেকে লতাপাতা ঝুলছে। ডানদিকে থাকে থাকে পাহাড় নেমে গিয়ে তৈরি করেছে অগভীর খাদ। মাঝখানে রাস্তা নামেই। মাঝারি নুড়িপাথর বিছানো টলমল পথ। মাঝে মাঝেই পাহাড়ের গা বেয়ে জলের স্রোত নেমে আসছে, রাস্তা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বাদিকে থেকে ডানদিক। সময় সময় জলের তোড় এত বেশি যে হাওয়াই চটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মাথার ওপর ছাতা থেকে জল পড়ছে, ফলে জল থেকে রক্ষা করার বদলে ছাতা যেন ভিজিয়েই দিচ্ছে।
সঙ্গীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলে প্রকৃতি দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে। ফিসফিস করে জানাতে চায় তার দু’একটা গোপন কথা। সেই কথায় ভাষা নেই, শুধু ভাব আছে। আছে শাশ্বত বরাভয় যা কোনও মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। নিরালা অচঞ্চল, সবুজে ঘেরা এক অবিশ্বাস্য জগতের মাঝখানে একা দাড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় স্থূল বাস্তব আর সূক্ষ্ম পরাবাস্তবের মধ্যে এই মুহূর্তে কোনও তফাত নেই। আমাদের ইিন্দ্রয়ের বাইরে যে অস্ত্বিত্ব, যার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ চাওয়া হলে মুখ কাচুমাচু হয়ে যাবে, সেই অিস্তেত্বর প্রকাশ এখানে একটু কম অস্পষ্ট। ফলে দুটো জগৎ এখানে মিলে মিশে গিয়েছে। অনায়াসে অবাধে এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যাতায়াত করা যায়। মনে হয় রূপকথা সত্যি হওয়ার দেশে এসেছি। যে কোনও মুহূর্তে মেঘ ফুড়ে রাজপুত্র কিংবা দৈত্য এসে হাজির হতে পারে।
মোড় পেরোতেই চোখের সামনে বড় মাপের পাথর। এই হল গুপ্ত মহাদেওয়ের গুহার প্রবেশ পথ। পাহাড়ের মধ্যে ওই গুহায় ঢুকতে হয় লম্বা সরু পথ দিয়ে। কুড়ি থেকে পচিশ গজ লম্বা ওই পথ জায়গায় জায়গায় এত সরু যে কাত না হলে ঢোকা যায় না। পথের শেষে এক ছোট্ট জায়গায় গুপ্তমহাদেও গুহা। লাল কাপড়ধারী এক সন্ন্যাসী সেখানে মহাদেবের হয়ে পুজো নিচ্ছেন। অপরিসর জায়গায় এক সঙ্গে চার জনের বেশি লোক ধরে না। পিছনে ফেলে এসেছি দিনের আলো, পরিচিত জগৎ। এখানে সবই শুধু নতুন নয়, অন্য রকম। এমন পরিবেশের মধ্যে শহুরে মানুষ সচরাচর পড়ে না।
মিনিট পাঁচেক পরে আমরা ফিরলাম। গুহার মুখে ততক্ষণে ‘‘হর হর মহাদেও’’ হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। ওরা এক দল ভক্ত, গুহার মধ্যে ঢুকতে চায়। বাইরে এসে নিিশ্চন্ত নিঃশ্বাস পড়ে। ঠিক ভয় নয়, একটা ক্ষীণ অস্বিস্ত যেন পেয়ে বসতে চাইছিল।
এই সেই গুপ্ত মহাদেও, বলে কৈলাশ। কেন ওমন নাম জানো তো? এখানে ভস্মাসুরের ভয়ে মহাদেব এসে লুকিয়ে ছিলেন।
ভস্মাসুরের গল্প তুমি জানো? আমি বলি।
কেন যে বলেছিলাম স্পষ্ট নয়। গল্পটা আমি জানি। কৈলাশও যে জানে, তা জানি। তবু প্রশ্ন করি।
পায়ের নীচে নুড়ি পাথর ছড়ানো অসমান পথের জায়গায় জায়গায় জল জমে গোষ্পদ তৈরি হয়েছে। টুপটাপ জল পড়ছে গাছের ডাল আর লতাপাতা থেকে। আশেপাশে কোনও সাড়াশব্দ নেই। গুহার গভীরে ‘হর হর মহাদেও’ হুঙ্কার মিলিয়ে গিয়েছে।
ওই তো, বলতে শুরু করল কৈলাশ। ভস্মাসুরকে মহাদেব বর দিলেন, যা স্পর্শ করবে, তাই ছাই হয়ে যাবে। ভস্মাসুর তখন ভাবল, তবে আর কী! এখন মহাদেবকে স্পর্শ করে, ভস্ম করে ফেলতে পারলেই বিশ্বসংসারের অধিপতি হয়ে যাব। ভেবেই ছুটল মহাদেবকে ভস্ম করতে। সেই না দেখে মহাদেব দে দৌড়। শেষকালে পালাতে পালাতে এসে লুকিয়ে পড়লেন গুপ্ত মহাদেওয়ের গুহায়…
ডানদিকে গাছপালা ঢাকা পাহাড়ের দিকে তাকাই। মনে হয় গাছপালার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ যদি মহাদেব দৌড়তে দৌড়তে গুহায় এসে ঢোকেন, মোটেই অবাক হব না। এই সেই পাহাড়ি রাস্তা যেখানে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষের কল্পনায় আর বাস্তবে মহাদেব প্রাণ বাচাতে গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই সেই জায়গা যেখানে সেই কাহিনী তিল তিল করে গড়ে উঠেছে। আর সেই দেশেরই এক মানুষ, ঠিক সেই জায়গায় দাড়িয়ে আমাকে কত যত্ন করে সেই গল্পখানা শোনাচ্ছে।
সবুজ ঘেরা আদিম কালের পৃথিবীতে তখন পড়ছে। অনুভব করলাম ওই কয়েকটা মুহূর্ত চিরকালের জন্য মনের মধ্যে গেথে গেল। হয়তো আরও অনেক বার এখানে ফিরে আসব, অনেক বার এইভাবে এইখানে দাড়াবও। কিন্তু আমাদের সঙ্কীর্ণ এই অস্ত্বিত্ব যে বিশাল জগতের মধ্যে ভেসে রয়েছে, যার অনেকটা এখনও আমাদের কাছে অজানা, রহস্যময়, সেই জগতের পর্দা সরিয়ে অন্য ওই জগৎকে এক পলক দেখার সুযোগ ঠিক আজকের মতো করে আর কোনও দিনই হয়তো আসবে না।
তোমার কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কৈলাশ।
আমার অনেক কিছু হয়েছে বলে থেমে যেতে হল।
আমার অত্যন্ত খারাপ হিন্দিতে ওকে কী করে বোঝাব, সাইকোলজিস্টরা যাকে ‘পিক এক্সপিরিয়েন্স’ বলে থাকে, সেই অনাস্বাদিত অসাধারণ বিরল এক অভিজ্ঞতা, যা মানুষের জীবনে একবার এলেই জীবন ধন্য বলে মনে হয়; তেমন এক মুহূর্ত, নিজের অজান্তে অথচ কত অনায়াসে ও আমাকে উপহার দিল।
পৌঁছে শুনি টানা কুড়ি দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই আরও কুড়ি দিনের বৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। তা হলে কি আমাদের বেড়ানো ভেেস্ত যাবে? তাই কখনও হয়! পচ্মঢ়ীর চোখ ধাধানো রূপ র্যাফায়েলের ভেলের মতো মেঘের আড়াল থেকে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়েই গেল আর আমরা রেনকোট আর হাওয়াই চটি সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম শিবঠাকুরের সন্ধানে।
ছোট শহর পচ্মঢ়ী। দক্ষিণের দিকে মহাদেও হিলস পৌঁছতে বিশেষ সময় লাগেনা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। এক পাহাড় থেকে নেমে আর এক পাহাড়ে ওঠা। গাড়ির কাচ ঝাপসা। পরিষ্কার করলেই কুয়াশা আর বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে দেখা যায় সবুজের সমারোহের অস্পষ্ট আভাস, ইম্প্রেশানিস্ট শিল্পীর ছবির মতো। চোখ নয় হয়তো, কিন্তু মন যে জুড়িয়ে যায় সে বিষয় সেন্দহ নেই। বাস্তব না স্বপ্ন বিচার করতে করতেই গাড়ি এসে থামল রাস্তা থেকে খানিকটা নীচে খোলা এক চত্বরে।
জিপসির চালক শব্বির আমাদের পরিচিত মানুষ।গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলতে খুলতে বলল, বড় লঙ্গুরের উৎপাত। আমি যাচ্ছি না। তোমাদের সঙ্গে ও যাবে।
ও মানে আমাদের প্রিয় বন্ধু কৈলাশ। সঙ্গে একজন থাকলেই হল। কৈলাশ হলে তো কথাই নেই।
চারদিকে তাকালাম। এটা নাকি পার্কিং লট। কোথাও কোনও গাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। ঝুপঝুপে বৃষ্টির মধ্যে মাত্র একটা ছাউনির তলায় দু’জন স্যাতস্যাতে মানুষ অত্যুৎসাহী ভক্তের কাছে নারকেল ধুপকাঠি নকুড়দানার প্যাকেট বিক্রির আশায় বসে আছে।
আমরা এগোলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা ধরে। বাদিকে পাহাড় উঠে গিয়েছে। ঘন সবুজ গাছে মোড়া। ডালপালা থেকে লতাপাতা ঝুলছে। ডানদিকে থাকে থাকে পাহাড় নেমে গিয়ে তৈরি করেছে অগভীর খাদ। মাঝখানে রাস্তা নামেই। মাঝারি নুড়িপাথর বিছানো টলমল পথ। মাঝে মাঝেই পাহাড়ের গা বেয়ে জলের স্রোত নেমে আসছে, রাস্তা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বাদিকে থেকে ডানদিক। সময় সময় জলের তোড় এত বেশি যে হাওয়াই চটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মাথার ওপর ছাতা থেকে জল পড়ছে, ফলে জল থেকে রক্ষা করার বদলে ছাতা যেন ভিজিয়েই দিচ্ছে।
সঙ্গীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলে প্রকৃতি দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে। ফিসফিস করে জানাতে চায় তার দু’একটা গোপন কথা। সেই কথায় ভাষা নেই, শুধু ভাব আছে। আছে শাশ্বত বরাভয় যা কোনও মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। নিরালা অচঞ্চল, সবুজে ঘেরা এক অবিশ্বাস্য জগতের মাঝখানে একা দাড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় স্থূল বাস্তব আর সূক্ষ্ম পরাবাস্তবের মধ্যে এই মুহূর্তে কোনও তফাত নেই। আমাদের ইিন্দ্রয়ের বাইরে যে অস্ত্বিত্ব, যার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ চাওয়া হলে মুখ কাচুমাচু হয়ে যাবে, সেই অিস্তেত্বর প্রকাশ এখানে একটু কম অস্পষ্ট। ফলে দুটো জগৎ এখানে মিলে মিশে গিয়েছে। অনায়াসে অবাধে এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যাতায়াত করা যায়। মনে হয় রূপকথা সত্যি হওয়ার দেশে এসেছি। যে কোনও মুহূর্তে মেঘ ফুড়ে রাজপুত্র কিংবা দৈত্য এসে হাজির হতে পারে।
মোড় পেরোতেই চোখের সামনে বড় মাপের পাথর। এই হল গুপ্ত মহাদেওয়ের গুহার প্রবেশ পথ। পাহাড়ের মধ্যে ওই গুহায় ঢুকতে হয় লম্বা সরু পথ দিয়ে। কুড়ি থেকে পচিশ গজ লম্বা ওই পথ জায়গায় জায়গায় এত সরু যে কাত না হলে ঢোকা যায় না। পথের শেষে এক ছোট্ট জায়গায় গুপ্তমহাদেও গুহা। লাল কাপড়ধারী এক সন্ন্যাসী সেখানে মহাদেবের হয়ে পুজো নিচ্ছেন। অপরিসর জায়গায় এক সঙ্গে চার জনের বেশি লোক ধরে না। পিছনে ফেলে এসেছি দিনের আলো, পরিচিত জগৎ। এখানে সবই শুধু নতুন নয়, অন্য রকম। এমন পরিবেশের মধ্যে শহুরে মানুষ সচরাচর পড়ে না।
মিনিট পাঁচেক পরে আমরা ফিরলাম। গুহার মুখে ততক্ষণে ‘‘হর হর মহাদেও’’ হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। ওরা এক দল ভক্ত, গুহার মধ্যে ঢুকতে চায়। বাইরে এসে নিিশ্চন্ত নিঃশ্বাস পড়ে। ঠিক ভয় নয়, একটা ক্ষীণ অস্বিস্ত যেন পেয়ে বসতে চাইছিল।
এই সেই গুপ্ত মহাদেও, বলে কৈলাশ। কেন ওমন নাম জানো তো? এখানে ভস্মাসুরের ভয়ে মহাদেব এসে লুকিয়ে ছিলেন।
ভস্মাসুরের গল্প তুমি জানো? আমি বলি।
কেন যে বলেছিলাম স্পষ্ট নয়। গল্পটা আমি জানি। কৈলাশও যে জানে, তা জানি। তবু প্রশ্ন করি।
পায়ের নীচে নুড়ি পাথর ছড়ানো অসমান পথের জায়গায় জায়গায় জল জমে গোষ্পদ তৈরি হয়েছে। টুপটাপ জল পড়ছে গাছের ডাল আর লতাপাতা থেকে। আশেপাশে কোনও সাড়াশব্দ নেই। গুহার গভীরে ‘হর হর মহাদেও’ হুঙ্কার মিলিয়ে গিয়েছে।
ওই তো, বলতে শুরু করল কৈলাশ। ভস্মাসুরকে মহাদেব বর দিলেন, যা স্পর্শ করবে, তাই ছাই হয়ে যাবে। ভস্মাসুর তখন ভাবল, তবে আর কী! এখন মহাদেবকে স্পর্শ করে, ভস্ম করে ফেলতে পারলেই বিশ্বসংসারের অধিপতি হয়ে যাব। ভেবেই ছুটল মহাদেবকে ভস্ম করতে। সেই না দেখে মহাদেব দে দৌড়। শেষকালে পালাতে পালাতে এসে লুকিয়ে পড়লেন গুপ্ত মহাদেওয়ের গুহায়…
ডানদিকে গাছপালা ঢাকা পাহাড়ের দিকে তাকাই। মনে হয় গাছপালার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ যদি মহাদেব দৌড়তে দৌড়তে গুহায় এসে ঢোকেন, মোটেই অবাক হব না। এই সেই পাহাড়ি রাস্তা যেখানে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষের কল্পনায় আর বাস্তবে মহাদেব প্রাণ বাচাতে গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই সেই জায়গা যেখানে সেই কাহিনী তিল তিল করে গড়ে উঠেছে। আর সেই দেশেরই এক মানুষ, ঠিক সেই জায়গায় দাড়িয়ে আমাকে কত যত্ন করে সেই গল্পখানা শোনাচ্ছে।
সবুজ ঘেরা আদিম কালের পৃথিবীতে তখন পড়ছে। অনুভব করলাম ওই কয়েকটা মুহূর্ত চিরকালের জন্য মনের মধ্যে গেথে গেল। হয়তো আরও অনেক বার এখানে ফিরে আসব, অনেক বার এইভাবে এইখানে দাড়াবও। কিন্তু আমাদের সঙ্কীর্ণ এই অস্ত্বিত্ব যে বিশাল জগতের মধ্যে ভেসে রয়েছে, যার অনেকটা এখনও আমাদের কাছে অজানা, রহস্যময়, সেই জগতের পর্দা সরিয়ে অন্য ওই জগৎকে এক পলক দেখার সুযোগ ঠিক আজকের মতো করে আর কোনও দিনই হয়তো আসবে না।
তোমার কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কৈলাশ।
আমার অনেক কিছু হয়েছে বলে থেমে যেতে হল।
আমার অত্যন্ত খারাপ হিন্দিতে ওকে কী করে বোঝাব, সাইকোলজিস্টরা যাকে ‘পিক এক্সপিরিয়েন্স’ বলে থাকে, সেই অনাস্বাদিত অসাধারণ বিরল এক অভিজ্ঞতা, যা মানুষের জীবনে একবার এলেই জীবন ধন্য বলে মনে হয়; তেমন এক মুহূর্ত, নিজের অজান্তে অথচ কত অনায়াসে ও আমাকে উপহার দিল।
No comments:
Post a Comment