মদমহেশ্বরের মন্দিরও বন্ধ থাকে শীতকালে। বিগ্রহ তখন বিরাজ করেন
উখিমঠের ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরেই। অক্ষয় তৃতীয়ায় কেদার মন্দিরের দরজা খোলার
কয়েক দিন পরে ভক্তজনের দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয় বাকি চার কেদার মন্দিরও।
মে মাসের শেষে মদমহেশ্বরের বিগ্রহ উখিমঠ থেকে ডুলি চেপে যাত্রা শুরু করেন
মূল মন্দিরের উদ্দেশ্যে। বর্ণাঢ্য সেই শোভাযাত্রার সঙ্গী হয়ে দুর্গম ষাট
কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন লেখক। রাস্তা গিয়েছে ঘন জঙ্গলে হিমালয়ান কালো
ভালুকের আস্তানা পেরিয়ে, বানতোলি আর নানুর কুখ্যাত চড়াই ডিঙিয়ে,
পাইন-রডোডেনড্রন-ভুজগাছের বেষ্টনি ঘেরা বুগিয়াল টপকে প্রায় দশ হাজার ফিট
উচ্চতার ওপর দিয়ে।
মদমহেশ্বর যাওয়ার পরিকল্পনা পর্বেই অনেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন আমাদের। জঙ্গল, জলের অভাব, বুনো ভালুক, দমফাটা চড়াই— এমন অনেক ফিরিস্তি সাজিয়ে বলেছিলেন, “বউ-ছেলেকে নিয়ে ষাট কিলোমিটার হাটতে জান কয়লা হয়ে যাবে। কী দরকার এমন পাগলামির?’” এই শুভানুধ্যায়ীদের বলতে পারিনি, শৈশবে ৬ মাস বয়সে ঝাঝার বাংলোয় মহুয়া গাছের নিচে দড়ির দোলনায় শুয়ে থাকার সময় এক মা-ভালুক আমার গা শুকে চলে যায়। সেই থেকেই বোধহয় বন্যতা আমার রক্তে। ভদ্রলোক আর এ জীবনে হয়ে উঠতে পারলাম না।
উৎসাহ জুগিয়েছিলেন পাহাড়িয়া বিশ্বদেব বিশ্বাস এবং খ্যাপা আলোকচিত্রী শিবনাথ বসু। শিবনাথদা বলেছিলেন, ‘‘মে মাসে যখন গাড়োয়ালে যাচ্ছ, অবশ্যই যাবে মদমহেশ্বর। আর চেষ্টা করবে মন্দির খোলার আগে ডোলির সঙ্গে যেতে। দেখবে সে অভিজ্ঞতা জীবনে ভুলতে পারবে না।’’
শীতের দিনগুলিতে কেদারের মতো মদমহেশ্বরের পুজো হয় উখিমঠে ওঙ্কারেশ্বর শিবমন্দিরে। সাধারণত অক্ষয় তৃতীয়ায় কেদারমন্দিরের দরজা খোলে। বাকি চার কেদারের পাট খোলে আরও দিন কয়েক পরে। কেদার ঘুরে গৌরীকুণ্ডে এসেই খবর পাই, ২৫ মে উখিমঠ থেকে চতুর্দোলায় মদমহেশ্বরের বিগ্রহ নিয়ে যাত্রা শুরু হবে। স্থানীয় ভাষায় বলে ‘ডোলি’। তখনই ঠিক করে ফেলি, আমরাও যাব ডোলির পিছু পিছু। রাসি হয়ে ২৭ মে ডোলি পৌছবে মদমহেশ্বর মন্দিরে। খুলবে মন্দিরের দ্বার। আমরাও ওই শুভদিনে পা দেব হিমতীর্থ মদমহেশ্বরে।
২৪ মে উখিমঠে ইন্দর সিংহের আস্তানা থেকে আমরা রওয়া দিলাম সকাল ৯টা নাগাদ। প্রথমদিন আজ আমরা যাব রাসি গ্রাম পর্যন্ত। উখিমঠ থেকে জিপে ১৩ কিলোমিটার। (এই সূত্রে বলে রাখি, ১৯৯৮ সালে এক ভয়াবহ ধসে এই ছোট্ট জনপদটি মাটিতে মিশে গিয়েছে। বিরৌলিতে যে ঝোলপুল পেরিয়ে আমরা যাত্রা করেছিলাম লেখের দিকে, এ পৃথিবীতে তার আর অস্তিত্বই নেই। গোটা এলাকাটি জলমগ্ন হয়ে রূপ নেয় মদমহেশ্বর তালের। ২০০৭-এর খবর, সে তাল নাকি এখন শুকিয়ে গিয়েছে।)
বিরৌলিতে একটা ছোট্ট দোকানে চা খেয়ে হাটতে শুরু করলাম সওয়া দশটা নাগাদ। প্রথমে উৎরাই। কিছুটা এগিয়েই পেরোতে হল সবুজ রঙের একটা ঝোলা পুল। নিচে রুদ্র গর্জনে বয়ে চলেছে মদমহেশ্বর গঙ্গা (কেউ বলে কালীগঙ্গা)। সেতু পেরিয়েই পথ ঊধ্বর্মুখী। লালচে বাদামি বা কালো পাথর ছড়ানো সুড়িপথ চীর-পাইন-অ্যাকাশিয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। পাইনের পাতাগুলি যেন মনে হচ্ছে তেল দিয়ে মাজা। পায়ের তলায় ঝরা পাইনের স্তূপ, আর নাকে তার গন্ধ। অনেকটা চন্দনের গেন্ধর মতো।
বনের মধ্যে যে যার নিজের ছেন্দ হাটছি, হঠাৎই কানে এল ‘ডিম-ডিম-ডিম’।
পোর্টার যোগিন্দর বলল, ‘‘ওই দেখুন মদমহেশ্বরের ডোলি।’’ গাছের পাতার ফাক দিয়ে দেখি শোভাযাত্রা সহকারে চতুর্দোলায় চেপে চলেছে মদমহেশ্বরের বিগ্রহ। লাল-হলুদ রেশমি ঝালরে আবৃত। শীর্ষে রাজছত্র। রুপোর দুটো পেল্লায় শিঙা, আটোসাটো, গৈরিক ঝাণ্ডা নিয়ে চলেছে ভক্তের দল। সামনে পিছনে ঢাক বাজাতে বাজাতে বাদ্যকরেরা। শিঙার ফুৎকারে চমকে উড়ে পালিয়ে গেল দুটি গোেল্ডন হিমালয়ান ঈগল। ডোলি কাধে নিয়ে আমাদের অতিক্রম করে গেল শোভাযাত্রাকারীরা। যাওয়ার আগে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে গেল, ‘‘ডোলির সঙ্গে যাচ্ছেন। অশেষ পুণ্য আপনাদের। এমন সৌভাগ্য খুব কম যাত্রীরই হয়। জয় মদমহেশ্বর।’’ জয় মদমহেশ্বর এই যাত্রাপথে ‘পাসওয়ার্ড’।
বেলা ১২টা নাগাদ পৌছলাম লেখ গ্রামে। প্রথমেই নজরে পড়ল স্কুলবাড়ি। ছোট্ট, কিন্তু সমৃদ্ধ গ্রাম। বেশ কয়েকটি ছিমছাম পাকা বাড়ি। ছাদ বেশির ভাগই স্লেট পাথরের, এদিকে যেমন হয়। অনেক বাড়ির সামনেই ছোট্ট সবজিবাগান, চোখে পড়ল ফুলের গাছও। দুপুরের খাওয়া সারলাম একটি বাড়িতে। একতলায় পুচকে একটি দোকানঘর। বাশের মই বেয়ে দোতলায় এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পরই খানা হাজির। আতপ চালের ভাত, অড়হর ডাল, আলুর তরকারি। একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশ। সহজ আন্তরিকতায় ভরা এখানকার মানুষের মন। গৃহস্বামী বললেন, ‘‘ফেরার সময় আবার আসবেন কিন্তু।’’
ভোজনপর্বের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা। লেখের উচ্চতা চার হাজার ফিট। আজ আমাদের উঠতে হবে ৬৪৬০ ফিট উচ্চতায় রাসিতে। কিছুদূর হাটার পর পথে পড়ল ওনিয়া গ্রাম। খেলাঘরের মতো পুচকে এক পোস্ট অফিস। দাওয়ায় একটা কুকুর। কুকুর এবং পোস্টমাস্টার দু’জনেই পরিপাটি দিবানিদ্রায় রত। পাশে ছোট্ট একটা দোকানঘর। বাশের মাচায় বসে দোকানি ঢুলছে। শহরের কলকোলাহল হতে সহস্র যোজন দূরে এই নিশ্চিন্দপুরের পথে হাটতে হাটতে লোভ হয়, এখানেই ডেরাডেণ্ডা ফেলে বসে যাই। চলতে চলতে দেখি পাশে পাহাড়ের থাকে থাকে চাষ হচ্ছে। ছোট ছোট গরু। তাদের তাড়িয়ে চলেছে ফাদানথ ঝোলানো গাড়োয়ালি বধূ। লাল রামদানার খেতে লুকোচুরি খেলছে দুটি গাড়োয়ালি শিশু। এমনি করে হাঁটতে হাঁটতেই বিকেল গড়িয়ে আসে। শ্রান্ত পায়ে পৌছই রাসিতে। রাকেশ্বরী দেবীর নামেই গ্রামের নাম। মদমহেশ্বরের ডোলিও আজ রাতে এ গ্রামেই থাকবে।
মন্দিরের কাছে একটি ঘরেই রাতের আশ্রয় মিলল। একটু জিরিয়ে মন্দির এলাকায় গেলাম। সেখানে তখন মদমহেশ্বরের ডোলিকে ঘিরে সারা গ্রামের ভিড়। সব বাড়ি থেকেই এসেছে পুজোর ডালি। প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি হচ্ছে। বাজছে ঢাক জাতীয় বাদ্যি। হিমালয়ের এই প্রত্যন্ত জনপদের প্রায় নিস্তব্ধ জীবনে মধ্য-কেদার বিগ্রহের এই ডোলি নামানোও একটি বড় ঘটনা। মৃদু চাদের আলোয় যখন ঘরে ফিরলাম মনে কেমন প্রশান্তির স্পর্শ। রাতে ঠাণ্ডা প্রবল। রাত ৯টার মধ্যেই অড়হর ডাল, আতপ চালের ভাত, সর্ষে শাক সিদ্ধ— এই থ্রিকোর্স ডিনার সেরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেধোলাম।
পরদিন ২৬ মে সকাল ৭টায় চা এবং রুটি খেয়ে হাটা শুরু হল। প্রথমেই অনেকটা উৎরাই। গড়ানে পথ বেয়ে পাচ কিলোমিটার হেঁটে বেলা এগারোটা নাগাদ পৌছোলাম ৫৫৪০ ফিট উচ্চতার গৌণ্ডার গ্রামে। গোটা পথটাই পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে, মাঝে মাঝেই চীর ও পাইনের বন। পায়ের তলায় শুকনো ঝরা পাইনের কাটা পাতার স্তূপ। একটু অসতর্ক হলেই পদস্খলন অনিবার্য। কোথাও কোথাও ক্ষীণ জলধারা
বয়ে গেছে পথের উপর দিয়ে। সন্ধ্যার পরে এ অঞ্চলে ভালুক বেরোয়। তাই দিনের বেলায়ও একটু সতর্ক হয়ে পথ চলাই ভাল। গৌণ্ডারে ছোট একটি চায়ের দোকান—সরু, একদম রাস্তার গা ঘেষে। চা খাই সেখানে বসে। মূল গ্রামটি নিচে, নদীর ধারে, উপর থেকে দেখি গ্রামবাসীদের শান্ত জীবন ছন্দ। আপেলের মতো টুকটুকে গালের শিশু ঝুলছে কর্মরতা মায়ের পিঠে। কোথাও কাঠ কুড়োচ্ছেন বৃদ্ধা রমণী। আমাদের দেখে দূর থেকে হাত নাড়েন। মুখে লাখ টাকার হাসি।
আবার পথ চলা। মিলিয়ে যায় গৌণ্ডার গ্রাম। আবার বন। মায়াময় ছায়াপথ। সূর্যালোকে ঝলমল করছে গাছের পাতা। মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হচ্ছে নদী। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বনঁঝিঝির একটানা মাতন, পাইনের সুবাস, আর তারই সঙ্গে অদ্ভুত এক সুরেলা ধ্বনি ঠি-ন্-ন্। পরে জেনেছি এ হল কপার ষ্টিং পাখির ডাক। মনে হয় বনদেবীর উদ্দেশে অলক্ষ্যে কোনও মহাশিল্পীর নিপুণ বাজনা। পথের বাকে বাকে পেল্লায় আকারের গিরগিটি। তারা অবাক চোখে ঘাড় তুলে চায় আমার দিকে। রাস্তা ছাড়ার কোনও লক্ষণই নেই। ভাবে বোধ হয়—আমাদের রাজেত্ব এ আপদ এল কোথা থেকে। বন অনেক দেখেছি। কিন্তু এতো অরণ্যানী!
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ এসে হাজির হই বানতলিতে। সামনেই প্রাক্তন ফৌজি গজেন্দ্র সিংহের পর্ণ কুটির। আশ্রম মৃগ নয়, ঘুরছে বিশাল এক পাহাড়ি কুকুর। জঙ্গলে এরাই গবাদি পশুর পাহারাদার। গলায় মোটা করে লোহার পাত বসানো। হিংস্র শ্বাপদ জন্তুর অতর্কিত কামড় আটকাতে। দুপুরে আহারের বেন্দাবস্ত হয় এখানেই। খানা পাকানোর অবসরে ঘুরে দেখি জায়গাটা। অপূর্ব রম্যস্থান। চারদিকে সবুজের সমারোহ। শান্ত নিস্তবদ্ধ বনস্থলী। ভাবি, বনস্থলী থেকেই কি বানতলি নাম? নির্জনতািপ্রয় হিমালয় প্রেমিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একটি কুটির বানিয়েছিলেন এখানে। তার ভগ্নদশা দেখে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। অল্প কিছু দূরেই মদমহেশ্বর গঙ্গা ও সরস্বতীর সঙ্গম। একটি নেমে আসছে নন্দীকুণ্ড, অন্যটি চৌখাম্বা থেকে। যেন আশ্রমের পরিবেশ। দু’চোখ ভরে দেখি।
বানতলির প্রায় গায়েই ছোট একটি পুল। সেতুর অবস্থা খুব ভাল নয়। বানতলির পরই শুরু হয়েছে দমফাটা চড়াই। এ অঞ্চলের রসিকতা, ‘বানতলিকা চড়াই, জার্মান কা লড়াই’। িদ্বপ্রাহরিক ভোজন সেরে পথে নামি। এখানে থেকে মদমহেশ্বর ৯ কিলোমিটার। আজ আমরা খাডারা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার এগিয়ে থাকায় কাল ভাঙতে হবে ৭ কিলোমিটার পথ।
বিকাল চারটে নাগাদ এসে পৌছই খাডারায় ফতে সিংহের সিংহসেবা েপ্রম কুটিরে। দুটি মাত্র খড়ের ঘর। কিন্তু তকতকে নিকোনো। ঁসিদুর পড়লেও কুড়িয়ে নেওয়া যায়। এ মরসুমে আমরাই প্রথম যাত্রী। আগেকার দিনে হিমালয়ের তীর্থপথে এমন চটিতেই দিনের শেষে আশ্রয় নিত শ্রান্ত যাত্রীর দল। এখন ট্যুরিজমের গুতোয় চটি শব্দটাই ঠাই নিয়েছে অভিধানের পাতায়। কুটিরের সামনে খোলা চত্বরে বসে উপভোগ করছিলাম এই পাহাড়তলির সন্ধ্যা। চারদিক ঘিরে অতিদীর্ঘ বনস্পতির দল। শৈশবে পূর্ণ চক্রবতর্রী আকা রামায়ণে রামসীতার কুটিরের একটি ছবি দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল সেই ছবিটিই যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে এখানে। রাত বাড়তেই ঠাণ্ডা যেন ছোবল মারতে লাগল। তবু ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছিল না। গাছগাছালির ফাক দিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের হাতছানি, ঝিঁঝির চড়া ঐকতান, ঘুমোতে যাওয়ার আগে মৃদু কন্ঠে ফতে সিংহের শিবেস্তাত্র পাঠ—স্তব্ধ অরণ্যে এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। (পরে জেনেছি, এই ফতে সিংহ উত্তরাখণ্ডে মাধ্যমিকে শীর্ষস্থান অধিকারী ছাত্র)।
পরদিন ২৭ মে যখন ঘুম ভাঙল, আকাশে শুকতারা তখনও জ্বলজ্বল করছে। সাড়ে ৬টায় যাত্রা শুরু করি। পথের কঠিনতম চড়াই আজকেই অতিক্রম করতে হবে। পাকে পাকে রাস্তা পাহাড়কে বেষ্টন করে সটান ঊধ্বর্মুখী। সোনালি সূর্যালোক দীর্ঘ বনস্পতির ফাক দিয়ে এক অপূর্ব জ্যামিতিক আলোকসম্পাতের ব্যবস্থা করেছে। ঢালু অতি সরু পথ। একেবারে ক্ষমাহীন চড়াই। মনকে প্রবোধ দিতে তাকাই অকৃপণ প্রকৃতির পানে। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপি রডোডেনড্রন আর পাইনের অজস্র সমারোহ। পাথর ছড়ানো পথে ঝরা লালফুল আর পাইন চীরের পাতায় মিলে অদ্ভুত কোলাজ! এই বিচিত্র অরণ্যানীর মধ্যে দিয়ে হাফাতে হাফাতে দু’কিলোমিটার চড়াই ভেঙে হাজির হলাম নানুতে।
নানুর উচ্চতা ৭১১৪ ফিট। এখান থেকে মদমহেশ্বর আর মাত্র পাচ কিলোমিটার। নানুতে ঝোপড়ির মধ্যে ছোট্ট একটি দোকানে চা খেয়ে অলস পায়ে আবার চলতে শুরু করি। বন ক্রমশই নিবিড় হয়ে আসে। সূর্যের আলোও ঘন পাতা ভেদ করে প্রবেশ করতে পারছে না। এ বার দেখা যায় ভুজ গাছ। এই গাছ দেখেই বুঝি হাজার দশেক ফিটের কাছাকাছি এসে পড়েছি। এক জায়গায় বিশাল এক ভুজ গাছ উলটে পড়ে, পাশে ছোট গাছগুলো তার মাটিতে পতন রুখে দিয়েছি। যেন ভীেষ্মর শরশয্যা। গায়ে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ। পাশ কাটিয়ে পথ চলি। শুনি বনের এ অংশে প্রায়ই ভালুক বেরোয়। এক সময় সামনে দিয়ে চলে যায় বিশাল ময়াল জাতীয় একটি সাপ। রাজকীয় মেজাজে। উলটোদিক থেকে নামতে দেখি গৈরিকধারিণী এক বিদেশিনিকে। স্মিতহাস্যে বলেন, ‘‘জয় মদমহেশ্বর। প্রায় এসে গেছেন। আর একটু।’’ ভরসা পাই মনে। আবার হাটি। আবার দাড়াই। হঠাৎ দেখি ঘন বন যেন কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছে। বড় গাছের সংখ্যা কমে আসে। পাহাড়ের ঢালে বুগিয়াল। দূরে দেখা যায় মদমহেশ্বর মন্দিরের চূড়া।
এ এক আশ্চর্য সবুজের দেশ। কিছুটা গড়ানো ঢাল, যেন সবুজ কার্পেট বিছানো। ঢালের শেষে কেদার ও তুঙ্গনাথের মন্দিরের আদলেই ছিমছাম নিরাভরণ অথচ আশ্চর্য সুন্দর মদমহেশ্বরের মন্দির। মন্দিরের পিছনে ও পাশে রাজছত্রের মতো দীর্ঘ কয়েকটি গাছ, অ্যাকাশিয়া ধরনের পাতা। সামনে ছড়ানো প্রান্তরে রুমেেক্সর ঝাড়। দেখতে অনেকটা পালংশাকের মতো। কিছু দূরে তুষারে আবৃত রুপোলি পর্বতশ্রেণি। তারই মধ্যে জ্বলজ্বল করছে চৌখাম্বার শিখর। পথের ক্লান্তি নিমেষে দুর হয়ে যায়।
বেলা প্রায় দুটো। আশ্রয় মেলে মন্দিরের গায়েই মন্দির কমিটির কাঠের দোতলা ধর্মশালায়। ইতিমধ্যে ডোলি এসে পৌছেছে। হোম চলেছে মন্দিরের চত্বরে। টাঙানো হচ্ছে বিশাল এক ঘণ্টা। এখন ছয় মাস বিগ্রহের নিয়মিত পুজো হবে এ মন্দিরে। দক্ষিণমুখী মন্দির। ঈষৎ হেলানো দ্বিখণ্ডিত কালো প্রস্তরখণ্ড। পঞ্চকেদারের মধ্যম কেদার এই মদমহেশ্বর। মহিষরূপী মহাদেবের নাভিদেশ। আবার কেউ বলেন, মত্ত মহেশ্বর। উচ্চতা ১১,৪৭৪ ফিট। ঘুরে ঘুরে দেখি চারদিক। একান্তই অনাড়ম্বর পরিবেশ। কেদার ও বদরিনাথের ধনী ভক্তদের ভিড় উৎপাত নেই। মূল বড় মন্দিরের বা দিকে ঘেষে ছোট্ট দুটি মন্দির। একটিতে পার্বতী, অন্যটিতে হরপার্বতীর যুগলমূর্তি। উৎকুটিকাসনে বীণাধর চতুর্ভুজ শিব।
সামনেই চালার নিচে একেবারেই আটপৌরে ভোজনশালা। সেই আতপ চালের ভাত-ডাল ও সর্ষে শাকের তরকারি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। বেলা তখন তিনটে। আয়োজন সামান্য, কিন্তু আতিথ্যে ত্রুটি নেই। ইতিমধ্যে আকাশজুড়ে কালো মেঘ চারদিক ছেয়ে ফেলল। সঙ্গে ঘন কুয়াশা। কুড়ি হাত দূরে মন্দিরকেও দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি নামে হুড়মুড়িয়ে। বাতাসে যেন ছুরির ধার। সব শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়েও স্বিস্ত পাই না। তবু বারান্দায় দাড়িয়ে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফিট উচ্চতায় শিব ঠাকুরের আপন দেশে দেখি প্রকৃতির রুদ্রলীলা। বিদ্যুতের ঝলকে, মেঘের গর্জনে যেন বাজে রুদ্র শিবের ডমরু।
সন্ধ্যার মুখে মেঘ কেটে যায়। আবার দৃশ্যমান হয় পাহাড়ের কোলে সবুজের দৃপ্ত সমারোহ। পশ্চিমে দিনের শেষ রৌদ্রালোকে গোলাপি হয়ে ওঠে পর্বতমালা। যেন মুঠোমুঠো সিঁদুর ছড়ানো দিগদিগেন্ত। কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি চলে মন্দিরে। যেন মহাকালের ঘণ্টা। অনেক রাত্রি পর্যন্ত নির্নিমেষে চেয়ে থাকি স্তব্ধ বনস্থলের সিল্যুট চিত্রের দিকে। যেন স্বেপ্নর দৃশ্য।
পরদিন ভোরে আরও দু’কিলোমিটার চড়াই ভেঙে উঠলাম বুড়া মদমহেশ্বরে। বিশাল ওলটানো ঝুড়ির মতো গড়ানে উপত্যকা। পথ বুঝতে না পেরে উঠি ঘাস লতা ধরে। উঠেই বিস্ময়! এ যেন অফুরন্ত সবুজের মেলা। সবুজ গড়ানে উপত্যকা ভেসে যাচ্ছে প্রথম সূর্যের মায়াবি আলোর বন্যায়। সোনালি রোদ্দুরে ঝলমল করছে চৌখাম্বা পর্বতের রজত সিংহাসন। ঢালের তিন দিকেই রুপোলি পাহাড় যেন কোন মহাপুজোর বন্দনারত। প্রায় ১২ হাজার ফিট উচ্চতায় সবুজের এই সমারোহ প্রায় অবিশ্বাস্য। সবুজের মাঝে কিছুটা অংশ ন্যাড়া। প্রবাদ, পাণ্ডবরা শিবের খোজে লাঙল চালিয়েছিলেন এখানে। সেই থেকে ঘাস গজায় না ওইটুকু অংশে।
ওই ঢালের এক স্থানে কিছু পাথর অযেত্ন সাজিয়ে বুড়া মদমহেশ্বরের মন্দির। একেবারেই হাতখানেক। ছোট্ট শিবলিঙ্গ। দু’একটি বুনো ফুল কেউ দিয়ে গেছে। শান্ত নিরাসক্ত নিরাকাঙ্ক্ষা ধ্যানাতীত মহাযোগীশ্বরের উপযুক্ত ক্ষেত্র। পার্থিব উপাচারের ডালি এখানে মূল্যহীন।
সূর্য ধীরে ধীরে উঠছে মাথার উপর। তার আলোকে চিকচিক করছে শিশিরকণা। এ বার নামার পালা। প্রত্যাবর্তন ইটকাঠ পাথরের তথাকথিত সেই সভ্যজগতে। পা যেন টেনে ধরে। শেষ বারের মতো প্রাণভরে দেখে নিই শান্ত স্তব্ধ হিমারণ্যে সবুজের এই সমারোহ। প্রশান্ত চৌখাম্বার শিখর। মনে মনে বলি, আবার, আবার আসব। তোমার চরণচিহ্ন ছুতে।
মদমহেশ্বর যাওয়ার পরিকল্পনা পর্বেই অনেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন আমাদের। জঙ্গল, জলের অভাব, বুনো ভালুক, দমফাটা চড়াই— এমন অনেক ফিরিস্তি সাজিয়ে বলেছিলেন, “বউ-ছেলেকে নিয়ে ষাট কিলোমিটার হাটতে জান কয়লা হয়ে যাবে। কী দরকার এমন পাগলামির?’” এই শুভানুধ্যায়ীদের বলতে পারিনি, শৈশবে ৬ মাস বয়সে ঝাঝার বাংলোয় মহুয়া গাছের নিচে দড়ির দোলনায় শুয়ে থাকার সময় এক মা-ভালুক আমার গা শুকে চলে যায়। সেই থেকেই বোধহয় বন্যতা আমার রক্তে। ভদ্রলোক আর এ জীবনে হয়ে উঠতে পারলাম না।
উৎসাহ জুগিয়েছিলেন পাহাড়িয়া বিশ্বদেব বিশ্বাস এবং খ্যাপা আলোকচিত্রী শিবনাথ বসু। শিবনাথদা বলেছিলেন, ‘‘মে মাসে যখন গাড়োয়ালে যাচ্ছ, অবশ্যই যাবে মদমহেশ্বর। আর চেষ্টা করবে মন্দির খোলার আগে ডোলির সঙ্গে যেতে। দেখবে সে অভিজ্ঞতা জীবনে ভুলতে পারবে না।’’
শীতের দিনগুলিতে কেদারের মতো মদমহেশ্বরের পুজো হয় উখিমঠে ওঙ্কারেশ্বর শিবমন্দিরে। সাধারণত অক্ষয় তৃতীয়ায় কেদারমন্দিরের দরজা খোলে। বাকি চার কেদারের পাট খোলে আরও দিন কয়েক পরে। কেদার ঘুরে গৌরীকুণ্ডে এসেই খবর পাই, ২৫ মে উখিমঠ থেকে চতুর্দোলায় মদমহেশ্বরের বিগ্রহ নিয়ে যাত্রা শুরু হবে। স্থানীয় ভাষায় বলে ‘ডোলি’। তখনই ঠিক করে ফেলি, আমরাও যাব ডোলির পিছু পিছু। রাসি হয়ে ২৭ মে ডোলি পৌছবে মদমহেশ্বর মন্দিরে। খুলবে মন্দিরের দ্বার। আমরাও ওই শুভদিনে পা দেব হিমতীর্থ মদমহেশ্বরে।
২৪ মে উখিমঠে ইন্দর সিংহের আস্তানা থেকে আমরা রওয়া দিলাম সকাল ৯টা নাগাদ। প্রথমদিন আজ আমরা যাব রাসি গ্রাম পর্যন্ত। উখিমঠ থেকে জিপে ১৩ কিলোমিটার। (এই সূত্রে বলে রাখি, ১৯৯৮ সালে এক ভয়াবহ ধসে এই ছোট্ট জনপদটি মাটিতে মিশে গিয়েছে। বিরৌলিতে যে ঝোলপুল পেরিয়ে আমরা যাত্রা করেছিলাম লেখের দিকে, এ পৃথিবীতে তার আর অস্তিত্বই নেই। গোটা এলাকাটি জলমগ্ন হয়ে রূপ নেয় মদমহেশ্বর তালের। ২০০৭-এর খবর, সে তাল নাকি এখন শুকিয়ে গিয়েছে।)
বিরৌলিতে একটা ছোট্ট দোকানে চা খেয়ে হাটতে শুরু করলাম সওয়া দশটা নাগাদ। প্রথমে উৎরাই। কিছুটা এগিয়েই পেরোতে হল সবুজ রঙের একটা ঝোলা পুল। নিচে রুদ্র গর্জনে বয়ে চলেছে মদমহেশ্বর গঙ্গা (কেউ বলে কালীগঙ্গা)। সেতু পেরিয়েই পথ ঊধ্বর্মুখী। লালচে বাদামি বা কালো পাথর ছড়ানো সুড়িপথ চীর-পাইন-অ্যাকাশিয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। পাইনের পাতাগুলি যেন মনে হচ্ছে তেল দিয়ে মাজা। পায়ের তলায় ঝরা পাইনের স্তূপ, আর নাকে তার গন্ধ। অনেকটা চন্দনের গেন্ধর মতো।
বনের মধ্যে যে যার নিজের ছেন্দ হাটছি, হঠাৎই কানে এল ‘ডিম-ডিম-ডিম’।
পোর্টার যোগিন্দর বলল, ‘‘ওই দেখুন মদমহেশ্বরের ডোলি।’’ গাছের পাতার ফাক দিয়ে দেখি শোভাযাত্রা সহকারে চতুর্দোলায় চেপে চলেছে মদমহেশ্বরের বিগ্রহ। লাল-হলুদ রেশমি ঝালরে আবৃত। শীর্ষে রাজছত্র। রুপোর দুটো পেল্লায় শিঙা, আটোসাটো, গৈরিক ঝাণ্ডা নিয়ে চলেছে ভক্তের দল। সামনে পিছনে ঢাক বাজাতে বাজাতে বাদ্যকরেরা। শিঙার ফুৎকারে চমকে উড়ে পালিয়ে গেল দুটি গোেল্ডন হিমালয়ান ঈগল। ডোলি কাধে নিয়ে আমাদের অতিক্রম করে গেল শোভাযাত্রাকারীরা। যাওয়ার আগে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে গেল, ‘‘ডোলির সঙ্গে যাচ্ছেন। অশেষ পুণ্য আপনাদের। এমন সৌভাগ্য খুব কম যাত্রীরই হয়। জয় মদমহেশ্বর।’’ জয় মদমহেশ্বর এই যাত্রাপথে ‘পাসওয়ার্ড’।
বেলা ১২টা নাগাদ পৌছলাম লেখ গ্রামে। প্রথমেই নজরে পড়ল স্কুলবাড়ি। ছোট্ট, কিন্তু সমৃদ্ধ গ্রাম। বেশ কয়েকটি ছিমছাম পাকা বাড়ি। ছাদ বেশির ভাগই স্লেট পাথরের, এদিকে যেমন হয়। অনেক বাড়ির সামনেই ছোট্ট সবজিবাগান, চোখে পড়ল ফুলের গাছও। দুপুরের খাওয়া সারলাম একটি বাড়িতে। একতলায় পুচকে একটি দোকানঘর। বাশের মই বেয়ে দোতলায় এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পরই খানা হাজির। আতপ চালের ভাত, অড়হর ডাল, আলুর তরকারি। একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশ। সহজ আন্তরিকতায় ভরা এখানকার মানুষের মন। গৃহস্বামী বললেন, ‘‘ফেরার সময় আবার আসবেন কিন্তু।’’
ভোজনপর্বের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা। লেখের উচ্চতা চার হাজার ফিট। আজ আমাদের উঠতে হবে ৬৪৬০ ফিট উচ্চতায় রাসিতে। কিছুদূর হাটার পর পথে পড়ল ওনিয়া গ্রাম। খেলাঘরের মতো পুচকে এক পোস্ট অফিস। দাওয়ায় একটা কুকুর। কুকুর এবং পোস্টমাস্টার দু’জনেই পরিপাটি দিবানিদ্রায় রত। পাশে ছোট্ট একটা দোকানঘর। বাশের মাচায় বসে দোকানি ঢুলছে। শহরের কলকোলাহল হতে সহস্র যোজন দূরে এই নিশ্চিন্দপুরের পথে হাটতে হাটতে লোভ হয়, এখানেই ডেরাডেণ্ডা ফেলে বসে যাই। চলতে চলতে দেখি পাশে পাহাড়ের থাকে থাকে চাষ হচ্ছে। ছোট ছোট গরু। তাদের তাড়িয়ে চলেছে ফাদানথ ঝোলানো গাড়োয়ালি বধূ। লাল রামদানার খেতে লুকোচুরি খেলছে দুটি গাড়োয়ালি শিশু। এমনি করে হাঁটতে হাঁটতেই বিকেল গড়িয়ে আসে। শ্রান্ত পায়ে পৌছই রাসিতে। রাকেশ্বরী দেবীর নামেই গ্রামের নাম। মদমহেশ্বরের ডোলিও আজ রাতে এ গ্রামেই থাকবে।
মন্দিরের কাছে একটি ঘরেই রাতের আশ্রয় মিলল। একটু জিরিয়ে মন্দির এলাকায় গেলাম। সেখানে তখন মদমহেশ্বরের ডোলিকে ঘিরে সারা গ্রামের ভিড়। সব বাড়ি থেকেই এসেছে পুজোর ডালি। প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি হচ্ছে। বাজছে ঢাক জাতীয় বাদ্যি। হিমালয়ের এই প্রত্যন্ত জনপদের প্রায় নিস্তব্ধ জীবনে মধ্য-কেদার বিগ্রহের এই ডোলি নামানোও একটি বড় ঘটনা। মৃদু চাদের আলোয় যখন ঘরে ফিরলাম মনে কেমন প্রশান্তির স্পর্শ। রাতে ঠাণ্ডা প্রবল। রাত ৯টার মধ্যেই অড়হর ডাল, আতপ চালের ভাত, সর্ষে শাক সিদ্ধ— এই থ্রিকোর্স ডিনার সেরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেধোলাম।
পরদিন ২৬ মে সকাল ৭টায় চা এবং রুটি খেয়ে হাটা শুরু হল। প্রথমেই অনেকটা উৎরাই। গড়ানে পথ বেয়ে পাচ কিলোমিটার হেঁটে বেলা এগারোটা নাগাদ পৌছোলাম ৫৫৪০ ফিট উচ্চতার গৌণ্ডার গ্রামে। গোটা পথটাই পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে, মাঝে মাঝেই চীর ও পাইনের বন। পায়ের তলায় শুকনো ঝরা পাইনের কাটা পাতার স্তূপ। একটু অসতর্ক হলেই পদস্খলন অনিবার্য। কোথাও কোথাও ক্ষীণ জলধারা
বয়ে গেছে পথের উপর দিয়ে। সন্ধ্যার পরে এ অঞ্চলে ভালুক বেরোয়। তাই দিনের বেলায়ও একটু সতর্ক হয়ে পথ চলাই ভাল। গৌণ্ডারে ছোট একটি চায়ের দোকান—সরু, একদম রাস্তার গা ঘেষে। চা খাই সেখানে বসে। মূল গ্রামটি নিচে, নদীর ধারে, উপর থেকে দেখি গ্রামবাসীদের শান্ত জীবন ছন্দ। আপেলের মতো টুকটুকে গালের শিশু ঝুলছে কর্মরতা মায়ের পিঠে। কোথাও কাঠ কুড়োচ্ছেন বৃদ্ধা রমণী। আমাদের দেখে দূর থেকে হাত নাড়েন। মুখে লাখ টাকার হাসি।
আবার পথ চলা। মিলিয়ে যায় গৌণ্ডার গ্রাম। আবার বন। মায়াময় ছায়াপথ। সূর্যালোকে ঝলমল করছে গাছের পাতা। মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হচ্ছে নদী। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বনঁঝিঝির একটানা মাতন, পাইনের সুবাস, আর তারই সঙ্গে অদ্ভুত এক সুরেলা ধ্বনি ঠি-ন্-ন্। পরে জেনেছি এ হল কপার ষ্টিং পাখির ডাক। মনে হয় বনদেবীর উদ্দেশে অলক্ষ্যে কোনও মহাশিল্পীর নিপুণ বাজনা। পথের বাকে বাকে পেল্লায় আকারের গিরগিটি। তারা অবাক চোখে ঘাড় তুলে চায় আমার দিকে। রাস্তা ছাড়ার কোনও লক্ষণই নেই। ভাবে বোধ হয়—আমাদের রাজেত্ব এ আপদ এল কোথা থেকে। বন অনেক দেখেছি। কিন্তু এতো অরণ্যানী!
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ এসে হাজির হই বানতলিতে। সামনেই প্রাক্তন ফৌজি গজেন্দ্র সিংহের পর্ণ কুটির। আশ্রম মৃগ নয়, ঘুরছে বিশাল এক পাহাড়ি কুকুর। জঙ্গলে এরাই গবাদি পশুর পাহারাদার। গলায় মোটা করে লোহার পাত বসানো। হিংস্র শ্বাপদ জন্তুর অতর্কিত কামড় আটকাতে। দুপুরে আহারের বেন্দাবস্ত হয় এখানেই। খানা পাকানোর অবসরে ঘুরে দেখি জায়গাটা। অপূর্ব রম্যস্থান। চারদিকে সবুজের সমারোহ। শান্ত নিস্তবদ্ধ বনস্থলী। ভাবি, বনস্থলী থেকেই কি বানতলি নাম? নির্জনতািপ্রয় হিমালয় প্রেমিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একটি কুটির বানিয়েছিলেন এখানে। তার ভগ্নদশা দেখে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। অল্প কিছু দূরেই মদমহেশ্বর গঙ্গা ও সরস্বতীর সঙ্গম। একটি নেমে আসছে নন্দীকুণ্ড, অন্যটি চৌখাম্বা থেকে। যেন আশ্রমের পরিবেশ। দু’চোখ ভরে দেখি।
বানতলির প্রায় গায়েই ছোট একটি পুল। সেতুর অবস্থা খুব ভাল নয়। বানতলির পরই শুরু হয়েছে দমফাটা চড়াই। এ অঞ্চলের রসিকতা, ‘বানতলিকা চড়াই, জার্মান কা লড়াই’। িদ্বপ্রাহরিক ভোজন সেরে পথে নামি। এখানে থেকে মদমহেশ্বর ৯ কিলোমিটার। আজ আমরা খাডারা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার এগিয়ে থাকায় কাল ভাঙতে হবে ৭ কিলোমিটার পথ।
বিকাল চারটে নাগাদ এসে পৌছই খাডারায় ফতে সিংহের সিংহসেবা েপ্রম কুটিরে। দুটি মাত্র খড়ের ঘর। কিন্তু তকতকে নিকোনো। ঁসিদুর পড়লেও কুড়িয়ে নেওয়া যায়। এ মরসুমে আমরাই প্রথম যাত্রী। আগেকার দিনে হিমালয়ের তীর্থপথে এমন চটিতেই দিনের শেষে আশ্রয় নিত শ্রান্ত যাত্রীর দল। এখন ট্যুরিজমের গুতোয় চটি শব্দটাই ঠাই নিয়েছে অভিধানের পাতায়। কুটিরের সামনে খোলা চত্বরে বসে উপভোগ করছিলাম এই পাহাড়তলির সন্ধ্যা। চারদিক ঘিরে অতিদীর্ঘ বনস্পতির দল। শৈশবে পূর্ণ চক্রবতর্রী আকা রামায়ণে রামসীতার কুটিরের একটি ছবি দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল সেই ছবিটিই যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে এখানে। রাত বাড়তেই ঠাণ্ডা যেন ছোবল মারতে লাগল। তবু ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছিল না। গাছগাছালির ফাক দিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের হাতছানি, ঝিঁঝির চড়া ঐকতান, ঘুমোতে যাওয়ার আগে মৃদু কন্ঠে ফতে সিংহের শিবেস্তাত্র পাঠ—স্তব্ধ অরণ্যে এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। (পরে জেনেছি, এই ফতে সিংহ উত্তরাখণ্ডে মাধ্যমিকে শীর্ষস্থান অধিকারী ছাত্র)।
পরদিন ২৭ মে যখন ঘুম ভাঙল, আকাশে শুকতারা তখনও জ্বলজ্বল করছে। সাড়ে ৬টায় যাত্রা শুরু করি। পথের কঠিনতম চড়াই আজকেই অতিক্রম করতে হবে। পাকে পাকে রাস্তা পাহাড়কে বেষ্টন করে সটান ঊধ্বর্মুখী। সোনালি সূর্যালোক দীর্ঘ বনস্পতির ফাক দিয়ে এক অপূর্ব জ্যামিতিক আলোকসম্পাতের ব্যবস্থা করেছে। ঢালু অতি সরু পথ। একেবারে ক্ষমাহীন চড়াই। মনকে প্রবোধ দিতে তাকাই অকৃপণ প্রকৃতির পানে। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপি রডোডেনড্রন আর পাইনের অজস্র সমারোহ। পাথর ছড়ানো পথে ঝরা লালফুল আর পাইন চীরের পাতায় মিলে অদ্ভুত কোলাজ! এই বিচিত্র অরণ্যানীর মধ্যে দিয়ে হাফাতে হাফাতে দু’কিলোমিটার চড়াই ভেঙে হাজির হলাম নানুতে।
নানুর উচ্চতা ৭১১৪ ফিট। এখান থেকে মদমহেশ্বর আর মাত্র পাচ কিলোমিটার। নানুতে ঝোপড়ির মধ্যে ছোট্ট একটি দোকানে চা খেয়ে অলস পায়ে আবার চলতে শুরু করি। বন ক্রমশই নিবিড় হয়ে আসে। সূর্যের আলোও ঘন পাতা ভেদ করে প্রবেশ করতে পারছে না। এ বার দেখা যায় ভুজ গাছ। এই গাছ দেখেই বুঝি হাজার দশেক ফিটের কাছাকাছি এসে পড়েছি। এক জায়গায় বিশাল এক ভুজ গাছ উলটে পড়ে, পাশে ছোট গাছগুলো তার মাটিতে পতন রুখে দিয়েছি। যেন ভীেষ্মর শরশয্যা। গায়ে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ। পাশ কাটিয়ে পথ চলি। শুনি বনের এ অংশে প্রায়ই ভালুক বেরোয়। এক সময় সামনে দিয়ে চলে যায় বিশাল ময়াল জাতীয় একটি সাপ। রাজকীয় মেজাজে। উলটোদিক থেকে নামতে দেখি গৈরিকধারিণী এক বিদেশিনিকে। স্মিতহাস্যে বলেন, ‘‘জয় মদমহেশ্বর। প্রায় এসে গেছেন। আর একটু।’’ ভরসা পাই মনে। আবার হাটি। আবার দাড়াই। হঠাৎ দেখি ঘন বন যেন কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছে। বড় গাছের সংখ্যা কমে আসে। পাহাড়ের ঢালে বুগিয়াল। দূরে দেখা যায় মদমহেশ্বর মন্দিরের চূড়া।
এ এক আশ্চর্য সবুজের দেশ। কিছুটা গড়ানো ঢাল, যেন সবুজ কার্পেট বিছানো। ঢালের শেষে কেদার ও তুঙ্গনাথের মন্দিরের আদলেই ছিমছাম নিরাভরণ অথচ আশ্চর্য সুন্দর মদমহেশ্বরের মন্দির। মন্দিরের পিছনে ও পাশে রাজছত্রের মতো দীর্ঘ কয়েকটি গাছ, অ্যাকাশিয়া ধরনের পাতা। সামনে ছড়ানো প্রান্তরে রুমেেক্সর ঝাড়। দেখতে অনেকটা পালংশাকের মতো। কিছু দূরে তুষারে আবৃত রুপোলি পর্বতশ্রেণি। তারই মধ্যে জ্বলজ্বল করছে চৌখাম্বার শিখর। পথের ক্লান্তি নিমেষে দুর হয়ে যায়।
বেলা প্রায় দুটো। আশ্রয় মেলে মন্দিরের গায়েই মন্দির কমিটির কাঠের দোতলা ধর্মশালায়। ইতিমধ্যে ডোলি এসে পৌছেছে। হোম চলেছে মন্দিরের চত্বরে। টাঙানো হচ্ছে বিশাল এক ঘণ্টা। এখন ছয় মাস বিগ্রহের নিয়মিত পুজো হবে এ মন্দিরে। দক্ষিণমুখী মন্দির। ঈষৎ হেলানো দ্বিখণ্ডিত কালো প্রস্তরখণ্ড। পঞ্চকেদারের মধ্যম কেদার এই মদমহেশ্বর। মহিষরূপী মহাদেবের নাভিদেশ। আবার কেউ বলেন, মত্ত মহেশ্বর। উচ্চতা ১১,৪৭৪ ফিট। ঘুরে ঘুরে দেখি চারদিক। একান্তই অনাড়ম্বর পরিবেশ। কেদার ও বদরিনাথের ধনী ভক্তদের ভিড় উৎপাত নেই। মূল বড় মন্দিরের বা দিকে ঘেষে ছোট্ট দুটি মন্দির। একটিতে পার্বতী, অন্যটিতে হরপার্বতীর যুগলমূর্তি। উৎকুটিকাসনে বীণাধর চতুর্ভুজ শিব।
সামনেই চালার নিচে একেবারেই আটপৌরে ভোজনশালা। সেই আতপ চালের ভাত-ডাল ও সর্ষে শাকের তরকারি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। বেলা তখন তিনটে। আয়োজন সামান্য, কিন্তু আতিথ্যে ত্রুটি নেই। ইতিমধ্যে আকাশজুড়ে কালো মেঘ চারদিক ছেয়ে ফেলল। সঙ্গে ঘন কুয়াশা। কুড়ি হাত দূরে মন্দিরকেও দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি নামে হুড়মুড়িয়ে। বাতাসে যেন ছুরির ধার। সব শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়েও স্বিস্ত পাই না। তবু বারান্দায় দাড়িয়ে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফিট উচ্চতায় শিব ঠাকুরের আপন দেশে দেখি প্রকৃতির রুদ্রলীলা। বিদ্যুতের ঝলকে, মেঘের গর্জনে যেন বাজে রুদ্র শিবের ডমরু।
সন্ধ্যার মুখে মেঘ কেটে যায়। আবার দৃশ্যমান হয় পাহাড়ের কোলে সবুজের দৃপ্ত সমারোহ। পশ্চিমে দিনের শেষ রৌদ্রালোকে গোলাপি হয়ে ওঠে পর্বতমালা। যেন মুঠোমুঠো সিঁদুর ছড়ানো দিগদিগেন্ত। কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি চলে মন্দিরে। যেন মহাকালের ঘণ্টা। অনেক রাত্রি পর্যন্ত নির্নিমেষে চেয়ে থাকি স্তব্ধ বনস্থলের সিল্যুট চিত্রের দিকে। যেন স্বেপ্নর দৃশ্য।
পরদিন ভোরে আরও দু’কিলোমিটার চড়াই ভেঙে উঠলাম বুড়া মদমহেশ্বরে। বিশাল ওলটানো ঝুড়ির মতো গড়ানে উপত্যকা। পথ বুঝতে না পেরে উঠি ঘাস লতা ধরে। উঠেই বিস্ময়! এ যেন অফুরন্ত সবুজের মেলা। সবুজ গড়ানে উপত্যকা ভেসে যাচ্ছে প্রথম সূর্যের মায়াবি আলোর বন্যায়। সোনালি রোদ্দুরে ঝলমল করছে চৌখাম্বা পর্বতের রজত সিংহাসন। ঢালের তিন দিকেই রুপোলি পাহাড় যেন কোন মহাপুজোর বন্দনারত। প্রায় ১২ হাজার ফিট উচ্চতায় সবুজের এই সমারোহ প্রায় অবিশ্বাস্য। সবুজের মাঝে কিছুটা অংশ ন্যাড়া। প্রবাদ, পাণ্ডবরা শিবের খোজে লাঙল চালিয়েছিলেন এখানে। সেই থেকে ঘাস গজায় না ওইটুকু অংশে।
ওই ঢালের এক স্থানে কিছু পাথর অযেত্ন সাজিয়ে বুড়া মদমহেশ্বরের মন্দির। একেবারেই হাতখানেক। ছোট্ট শিবলিঙ্গ। দু’একটি বুনো ফুল কেউ দিয়ে গেছে। শান্ত নিরাসক্ত নিরাকাঙ্ক্ষা ধ্যানাতীত মহাযোগীশ্বরের উপযুক্ত ক্ষেত্র। পার্থিব উপাচারের ডালি এখানে মূল্যহীন।
সূর্য ধীরে ধীরে উঠছে মাথার উপর। তার আলোকে চিকচিক করছে শিশিরকণা। এ বার নামার পালা। প্রত্যাবর্তন ইটকাঠ পাথরের তথাকথিত সেই সভ্যজগতে। পা যেন টেনে ধরে। শেষ বারের মতো প্রাণভরে দেখে নিই শান্ত স্তব্ধ হিমারণ্যে সবুজের এই সমারোহ। প্রশান্ত চৌখাম্বার শিখর। মনে মনে বলি, আবার, আবার আসব। তোমার চরণচিহ্ন ছুতে।
অসাধারণ লেখনী। জীবন্ত, প্রাণবন্ত। কিন্তু লেখকের নামটি জানতে পারলে মনের অপূর্ণতা পূরণ হতো।।
ReplyDelete