Sunday, July 13, 2014

অ্যাডভেঞ্চার পেতে হলে ডাউকি

দু’পাশে গভীর খাদ। মাঝখানে রাস্তা। প্রবাল বলেছিল, একমাত্র ডাউকি যেতে গেলেই এই রকম পাহাড়ি রাস্তা পেরোতে হবে। ভূভারতে নাকি এ রকম রাস্তা মিলবে না। তাই অ্যাডভেঞ্চার পেতে হলে যেতেই হবে ডাউকি
এসেছি শিলংয়ে। মহাসপ্তমীর দিন গুয়াহাটি নেমে পাচ বঙ্গসন্তানের উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণ শুরু। চেরাপুিঞ্জ আর বরাপানিতে দু’দিন করে কাটিয়ে এখন শিলংয়ে। মেঘালয়ের রাজধানীতে থাকার মেয়াদ দু’দিন।
প্রথম দিন শিলং পীক, এলিফ্যান্ট ফল্‌স আর গির্জা দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। ভাবলাম িদ্বতীয় দিন প্রজাপতি যাদুঘর থেকে আরও দু’একটা জায়গা দেখব। কিন্তু দিনের শেষে হোটেল পোলো টাওয়ার্সে ফিরতেই প্রবালের গলায় অন্য সুর।
ডাউকি যেতেই হবে। কারণটা কি তা তো আগেই বলেছি। কিছুটা টানা পোড়েনের পর অবশেষে প্রবালেরই জয় হল। অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ কে না পেতে চায়?
পরিদন তাই অল্প সময়ের মধ্যে শিলং গল্‌ফ কোর্স দেখে নিয়ে মারুতি ভার্সা চলল ডাউকির দিকে। ইেন্দা-বাংলাদেশ সীমােন্ত ডাউকি। ওপারে বাংলাদেশের শ্রীহট্ট। রয়েছে সুরমা নদীর বদ্বীপ।
গাড়ি শিলং ছাড়িয়ে পাহাড়ি রাস্তায় পড়তেই মনে হল বিভিন্ন বইয়ে অনেক সময়েই পড়েছি যাত্রার আসল আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে পথ চলাতেই। গড়পড়তা আর পাচজন বাঙালির মতোই সেই কথার মর্মার্থ এতদিন বুঝিনি। ভেবেছি কোনও জায়গা পৌছলেই বুঝি বেড়ানোর আনন্দ মিলবে। কিন্তু প্রবালের দৌলতে বেড়ানোর অন্য দিকটাও খুলে গেল চোখের সামনে।
তবে লোকজন যে প্রবল উৎসাহ দিয়েছিল এমন কথা হলফ করে বলাও যাচ্ছে না। সীমােন্তর দিকে যাচ্ছি শুনে বরং বলেছিল, ‘‘কিস্যু তো দেখার নেই ডাউকিতে। তাহলে যাওয়া কী জন্য?’’
কি করে বলি, আমাদের এই যাওয়াটা যে শুধু যাওয়ার জন্যই। ফলে শিলং ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথ ধরার সময় কেন জানি না এক অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল।
যাত্রাপথের বেশ কিছুটা শিলং-চেরাপুিঞ্জর রাস্তা। একদিকে গহন গভীর খাদ, অন্য দিকে খাড়াই পাহাড়ি দেওয়াল। মাঝখানে এক টুকরো জঙ্গল।
গাড়ি যখন বাঁক নিচ্ছে তখন নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি কয়েক হাজার ফুট নীচে পাহাড়ি ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। এতো ছোট দেখাচ্ছে যে মনে হচ্ছে কেউ যেন পিচকিরি দিয়ে জল ঢালছে।
শুধু খাদ নয়। গ্রামেরও দেখা মিলছে। পথের ধারে কাঠের বাড়ি। অনেকগুলোই দোতলা। দেখলেই বোঝা যায় বাড়ির মালিকরা বেশ রুচিশীল। দরজা, জানলায় মানানসই পর্দা। একের পর এক রঙবেরঙের বাড়ি। কিছু দুরে একটি গির্জা।
পথে যতগুলি গ্রাম নজরে এল সবগুলিতেই দেখলাম রয়েছে গির্জা। গ্রামের মিলনস্থল হিসাবেও গির্জা কাজ করে তার পরিচয়ও মিলল খানিক পরে। গির্জা থেকে হাসি মুখে গল্প করতে করতে বেরিয়ে আসছিলেন গ্রামের একদল মানুষ। তাদের সামনে দৌড়োচ্ছিল একদল কচিকাচা। এক কথায় পুরোটাই উৎসবের মেজাজ।
গ্রামে আর একটা জিনিশ নজরে পড়ল। খবরের কাগজ। খাসি ভাষার হরফ রোমান। তাই দোকানে ঝোলানো কাগজগুলো দূর থেকে ইংরেজি বলে ভুল হচ্ছিল। সেই সব দোকানে চা জলখাবার যেমন বিক্রি হচ্ছে তেমনি মুদির দোকান হিসাবেও কাজ করে তারা। ফলে ঠিক কলকাতার মতোই দোকানের সামনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে দেখা গেল অনেককেই।
রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছেন নানা বয়সের গ্রামবাসী। কেউ বা পাশের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে মাথায় করে নিয়ে ফিরছেন। কেউ বা ছিপ নিয়ে চলেছেন কোনও জলাশয় থেকে মাছ ধরার আশায়।
একসময় চেরাপুিঞ্জকে বা দিকে রেখে ভার্সা ঘুরল ডাউকির দিকে। কিন্তু ডাউকি কোথায়? মাইলেস্টানে তো দেখা যাচ্ছে তামাবিলের নাম। পরে জেনেছিলাম তামাবিলই হল সীমান্ত। আর তার পাশের গ্রামের নাম ডাউকি। অনেক কাল আগে বোধহয় সীমােন্তর কোনও চৌকি ছিল এখানে। তাই নামটা ডাউকি রয়ে গিয়েছে।

চেরাপুিঞ্জর দিক থেকে মুখ ফেরানোর পরই যাত্রাপথের চেহারা পাল্টাতে শুরু করল। বুঝলাম এ বার আমরা উপরে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড় কেটে ডলোমাইট বার করা হচ্ছে রাস্তায়। ফলে জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের বুক চেরা। সঙ্গে সাবধানবাণী লেখা সাইনবোর্ড- ‘‘ব্লাস্ট সাইট হিয়ার। বিওয়্যার।’’ অবশ্য পাহাড়ের গায়ে বিপজ্জনক জায়গায় দাড়িয়ে যারা গাইতি চালাচ্ছেন, বা যারা রাস্তায় কাজ করছেন তারা এসবের খুব একটা পরোয়া করেন বলে তো মনে হল না। রয়েছে রাস্তা থেকে পাথর সরানোর জন্য ছোটখাট ক্রেনও। দু’দু’বার সেই ক্রেন আমাদের কাজেও এল। রাস্তায় পড়ে থাকা পাথর অনায়াসে ঠেলে সরিয়ে দিল যন্ত্রদানব।
গাড়ি বেশ জোরেই চলছিল। যত উপরের দিকে উঠছিলাম তত আবহাওয়া ঠান্ডা হচ্ছিল।
জানিনা হঠাৎ আবহাওয়া পাল্টানোর জন্যই কি না বা গাড়ির দ্রুত গতির জন্য কি না, ছোট্ট মিঠির শরীর খারাপ লাগতে শুরু হল। আমরা দাড়িয়ে পড়লাম এক নির্জন পাহাড়ি রাস্তায়। বাক খেতে খেতে রাস্তাটা হারিয়ে গিয়েছে সামনের পাহাড়ের মধ্যে। দুপুরের রোদ মেখে কয়েক হাজার ফুট নেমে যাওয়া ভয়ঙ্কর সুন্দর পাহাড়ি জঙ্গল চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।
মিঠি কিংবা তার মা বাবার অবশ্য তখন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার অবকাশ নেই। মেয়েকে সুস্থ করার আপ্রাণ প্রয়াস চলছে তখন।
রাস্তার ধারে গাড়ির পাশে জনা পাচেক মানুষের জটলা। পাশ দিয়ে মাঝে মধ্যে চলে যাওয়া গাড়ি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। এমন কোনও নিস্তব্ধতা সচরাচর নজরে পড়েনি।
মিনিট পাঁচেক পরই মিঠি ফের চাঙ্গা। আর তার প্রমাণ মিলল গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর পরই। প্রবালের হাত ধরে মিঠির চিৎকার,‘‘আমার গল্প শুনছ না কেন? খালি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছো?’’ তারপরই আপনমনে কবিতা বলতে শুরু করল।
প্রবাল থামস আপ সাইন দেখাল। অর্থাৎ যাত্রা ফের পুরোদমে। মিঠি বেচারি পুরোদমে অবশ্য পুরো যাত্রাটা যেতে পারেনি। আরও একবার গাড়ি দাড়াতে হয়েছিল সে অসুস্থ হয়ে পড়ায়। পাইনুরস্লা নামের ছোট্ট এক শহরে গিয়ে কিছুক্ষণ দাড়াতেও হল। বিশ্রামের জন্য। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি তার হার না মানা িস্পরিট আমাদের তাজা করে রেখেছিল।
রাস্তার রূপ দ্রুত বদলাচ্ছিল। গাড়ি পাকদণ্ডি বেয়ে ক্রমেই পামসুতিয়া গিরিখাতের উপরে উঠছিল। নীচে ভয়াল সবুজ জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় শ্রেণি। দূরের পাহাড়ি রাস্তায় খেলনার মতো ছোট্ট গাড়িও নজরে আসছিল।
এতক্ষণ গাড়ির মধ্যে যাত্রীদের কথা ভেসে আসছিল। ক্রমে সেটাও থেমে গেল। থাকল শুধু হাওয়ার শব্দ। সেই শেব্দর তীব্রতা এতটাই যে গাড়ির ভেতরে একে অপরের কথাও শুনতে পাচ্ছিল না। কথা তাই স্বাভাবিক নিয়মেই থেমে গেল। রয়ে গেল কেবল শো শো হাওয়ার শব্দ। অবশ্য কথা বলার দমও মোটামুটি তখন কমতির দিকে। চরকি পাক খেতে খেতে গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় উঠছে। আর তাতেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে যাত্রীদের। অবস্থা এমন হল যে সারথিকে বলতে হল গাড়ির গতি কমাতে। না হলে পুরোদস্তুর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাকে ঠেকানো যাচ্ছে না। গাড়ির গতি কমে এল। আর তখনই সেই উচ্চতায় প্রকৃতিকে দু চোখ ভরে দেখার সুযোগও হল।
যতদূরে চোখ যায় একের পর এক পাহাড়। ঘন জঙ্গল নেমেছে সেই সব পাহাড়ের গা বেয়ে। সেই গাঢ় সবুজ রয়েছে নীল আকাশের তলায়।
গিরিখাত কতদূরে নেমেছে তা দেখা গেল না। কানে এল জলপ্রপাতের শব্দ। চোখে না দেখা গেলেও বুঝলাম ধারে কাছেই রয়েছে বরুণদেবের ধারা।
মিনিট কুড়ি ধরে চলল সেই সর্বোচ্চ উচ্চতার পথ দিয়ে চলা। তারপর হঠাৎ পথের বাঁক নিতেই দেখি যাদুমন্ত্রে সামনে হাজির এক বিশাল উপত্যকা। আর সেখানে রয়েছে ছোট্ট গ্রাম।
এতো উপরে মানুষের বসবাস দেখে একটা কথা মনে হল। মানুষ যুগে যুগে প্রকৃতিকে এমন ভাবেই বশ মানিয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা নীচের সমতলে যাতায়াত করেন কী ভাবে? একটু পরেই সেই প্রেশ্নর উত্তর আপনা আপনিই মিলে গেল।
আমাদের উল্টাদিক থেকে আসছিল একটা ট্যাক্সি। রাস্তার ধারে দাড়িয়েছিলেন কয়েকজন গ্রামবাসী। তাদের দেখে ট্যাক্সি দাড়িয়ে গেল। গ্রামবাসীরাও ঝটপট তাতে উঠে পড়লেন। ট্যাক্সি সমতলে নামার রাস্তা ধরল।
এই অবস্থা দেখেছি গুয়াহাটি থেকে চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত এলাকায়। ট্যািক্সকে বাসের জায়গা নিতে। শুধু জানা হল না ভাড়াটা কত। নিশ্চয়ই দূরত্ব অনুসারে তা নির্ধারিত করা হয়। মিঠি আমাদের মনের কথাটা বলেই ফেলল, ‘‘ মা, আমিও ওই ইিণ্ডকা ট্যািক্স চড়ে পরের বার পাহাড়ে চড়ব।’’
শিলং থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন জানতাম যাত্রাপথ বড়জোর আড়াই ঘন্টার। কিন্তু একটু একটু করে আড়াই ঘন্টা কখন পেরিয়ে গেল। তবু পথের পাশে মাইল স্টোনে তামাবিল এত কিলোমিটার, তামাবিল তত কিলোমিটার আর শেষ হল না।
এক এক সময় মনে হচ্ছিল ঠিকঠাক পথে যাচ্ছি তো? কোনও পাহাড়ি বাকে ভুল রাস্তায় চলে যাইনি তো? পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল, কী সব যা তা ভাবছি। একটাই তো রাস্তা। ভুল হওয়ার তো কোনও জো নেই!
ঠিক সেই সময় হঠাৎ বুঝলাম গাড়ি ফের নামতে শুরু করেছে। যে পাহাড় শ্রেণির সর্বোচ্চ অংশকে অনায়াসে দেখতে পাচ্ছিলাম সেগুলিই এখন মাথা উচু করে দেখতে হচ্ছে।
জঙ্গলের পথও শুরু হচ্ছে। রাস্তার দু’পাশের গাছগুলোকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। বাশ কি? সারথি হাসলেন। এই সব গাছ দিয়ে ঘরের ঝাড়ু তৈরি হয়।
জঙ্গলের ছোট রাস্তা। দু’পাশ দিয়ে গাছ যেন পথকে গ্রাস করতে এগোচ্ছে। জঙ্গলটা অবশ্যই ভ্রম। কারণ জানি গাড়ির বা দিকে যেটাকে ঘন জঙ্গল বলে মনে হচ্ছে সেটা আসলে জঙ্গলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ছোট্ট এই জঙ্গলের পরই গভীর গিরিখাত। বলা যায় ভয়াল রূপকে ঢাকতেই প্রকৃতির এই সবুজ প্রলেপ।
নীচে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা ভাবটাও চলে গেল। সবাই নিজের নিজের সোয়েটার জ্যাকেট খুলে ফেলতে পারলে তখন বাচে। ডানদিকের জঙ্গলের অবগুণ্ঠনটাও সরে গেল। সামনে ভেসে উঠল সুরমা নদীর বিশাল বদ্বীপ। বিশাল সেই অঞ্চল। যতদূর চোখ যায় শুধু নদীর তটভূমি। মাঝে মধ্যে নদী বয়ে চলেছে। রোদ্দুর পড়ে সেই জল চিক্‌চিক্‌ করছে। প্রচুর জেলে নৌকো রয়েছে।

মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে চেরাপুঞ্জিতে ডেনিসের রিসর্ট থেকে সুরমা বদ্বীপ দেখার কথা। সে ছিল অনেক দূর থেকে দেখা। আর এত হাত বাড়ালেই যেন ছোয়া যায়।
কানে এক ট্রেনের শব্দ। নিশ্চয়ই ধারে কাছে কোনও রেললাইন রয়েছে। অদৃশ্য থেকেই সে নিজের উপিস্থতি জানান দিচ্ছে। খাসি পাহাড় এখানেই শেষ। সঙ্গে ভারতীয় ভূখণ্ডও। তারপরই বাংলাদেশের সমতলভূমি।
আমরা সেই সমতলভূমির দিকে এগোতে থাকলাম। তবে বেশী দূর যাওয়া হল না। কারণ এক অসাধারণ দৃশ্য।
পাহাড়ি রাস্তার ডান দিকে সুরমা বদ্বীপ অঞ্চল তার রূপের ডালি সাজিয়ে উপিস্থত। আর তাকে অলঙ্কারিত করেছে উমগোট খাড়ি।
খাড়ির মুখে শতশত জেলে নৌকো। এমন ভাবে পাশাপাশি নৌকাগুলি রাখা যে একজন অনায়াসে খাড়ির মুখ পার হয়ে যেতে পারে সেটাকে সেতু হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। আর খাড়ির সবুজ জলে নৌকো ভাসছে অনেক। তাতে চেপে অনেক মৎস্যশিকারী বসে রয়েছেন। মাথায় নানা রংয়ের টুপি। পরনে রংবেরংয়ের পোশাক।
শরীরটা ভাল না লাগায় কাকলি গাড়িতেই বসেছিল। তার মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বেরোল, “যাক, এক কষ্ট করে আসাটা তাহলে একদম ফেলা যায়নি! রাস্তার দু’পাশে খাদ না দেখি, এমন অসাধারণ খাড়ি আর বদ্বীপ অঞ্চল তো দেখলাম। তাই বা কম কীসে?’’
বেশ খানিকক্ষণ ওখানেই কেটে গেল। কিন্তু ডাউকি যেতে হবে তো? সারথি বললেন, আসলে আমরা যাচ্ছি তামাবিল। সীমান্ত পয়েন্ট। সেতু পেরিয়ে ভার্সা চলল সেই দিকে। কিছুদূর গিয়ে বোঝা গেল সীমান্ত সামনেই। নেমে
দেখি সীমােন্তর ফলক। একটা ছোট্ট বাড়িতে একদল অফিসার বসে কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন। দূরে দাড়িয়ে রয়েছে লরির সারি। এক অফিসার জানালেন, অদূরেই নো ম্যানস ল্যাণ্ড পেরিয়েই বাংলাদেশ। সীমােন্ত অবশ্য মনোমুগ্ধকর এমন কিছু দেখা গেল বলে মনে হল না। সারি সারি লরি। তার মধ্য দিয়ে কোনওরকমে গাড়ির চলা।
চলে আসছি। হঠাৎ নজরে পড়ল দূরে মাঠের ঝোপঝাড়ের মধ্যে অবহেলায় পড়ে থাকা এক শহিদ বেদি। ভাল করে দেখলাম সেটা বাংলাদেশ যুেদ্ধর সময় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিরক্ষার্থে তৈরি। ফিরলাম তো একই পথ দিয়ে। তাই স্মৃতির ঝুলিতে রাখার মতো নতুন কিছু যে আর পাব না তা ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যে কতদূর ভুল একটি পরেই বুঝলাম।
বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। বা পাশে গিরিখাতকে রেখে ভার্সা তখন শিলং ফিরছে। দূরে দেখা যাচ্ছে একের পর এক কুয়াশার আবরণে ঢাকা খাসি পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের গায়েই সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এমন দিগন্ত জুড়োনো দৃশ্যকে কি ফেলে যাওয়া যায়?
দাড়িয়ে গেলাম। চেষ্টা শুরু হল ক্যামেরায় মুহুর্তটাকে বিন্দ করে নেওয়ার। নির্জন খাসি পাহাড়শ্রেণিকে সাক্ষী রেখে সূর্য অস্ত গেল। ধীরে ধীরে অন্ধকার পুরো দিগন্তকে গ্রাস করতে শুরু করল।
গাড়ির হেডলাইটই একমাত্র দৃশ্যমান আলো। ভূল। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখি চাদ উঠেছে। সামনেই কোজাগরী পূর্ণিমা। ফলে চন্দ্রদেবও তার স্বমহিমায়। নির্জন পাহাড়, জঙ্গল, নদী। আর তাতে পড়েছে চাদের আলো। ছুটন্ত গাড়ি থেকেও স্পষ্ট বুঝলাম ফের চেনাশুনা জগৎ থেকে অন্য এক বিেশ্বর রূপ দেখছি আমি। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে নির্জন উপত্যকা। ভেসে যাচ্ছে পাহাড়, জঙ্গল, নদীখাত। অজানা ঝরণার জল চিকচিক করছে। অজানা পাখির দল ডাকছে। এক অদ্ভুত নৈঃশেব্দ ভরে রয়েছে জগৎ।
পাহাড়ের অনেক উপরে গাড়ি রয়েছে। নীচের রাস্তায় গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে বহুদূর থেকে।
রাস্তার দু’পাশে গিরিখাতের সঙ্গে দেখা হয়নি। বেশির ভাগ রাস্তাটাই সীমান্তরক্ষীদের জন্যই হয়তো বেশ ভাল। কিন্তু তা সেত্ত্বও ডাউকিকে ভোলা যাবে না।
হাজার হাজার ফুট গভীর গিরিখাতকে পাশে রেখে অদ্ভুত শো শো শব্দের হাওয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া বা নির্জন পাহাড়শ্রেণিকে সাক্ষী রেখে সূর্যাস্ত বা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া উপত্যকা বা সবুজ জলের খাড়িতে নিশিন্তে মাছ ধরা- এসব দৃশ্য ইট কাঠের জঙ্গলে কোথায় মিলবে?

No comments:

Post a Comment