কপিলাস ঘুরে কলকাতার ট্রেন ধরতে পৌছলাম কটক শহরে। রাতের ট্রেন, সারাদিন
ঘরে বসে না থেকে ঘুরবার প্ল্যান হল। স্টেশনের কাছেই হোটেল কোনার্কে ডাব্ল
বেডরুম পেয়ে গেলাম ৩০০টাকা ভাড়ায়। সময় অল্প, ঝটপট ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল
ছেড়ে বেরিয়ে পরলাম ১০০ টাকা চুক্তিতে অটোরিক্সা নিয়ে।
কটকে দেখার অনেক জায়গা, অজস্র জিনিস। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে দুটো জায়গা দেখার। সত্যি বলতে কি, এগুলো দেখব বলেই সাত তাড়াতাড়ি কপিলাস থেকে বেরিয়ে পড়েছি। প্রথমটা হল জানকীনাথ ভবন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বাড়িতে, এখানেই কাটে তার গোটা শৈশব। তাই বরবাটি দুর্গ, কটকচণ্ডীর মিন্দর, স্টেডিয়াম ছেড়ে আমরা চললাম নেতাজির জন্মভিটে দেখতে। অটোয় উঠে ড্রাইভারকে আমাদের ইচ্ছে জানালাম। সে তো আকাশ থেকে পড়ল! ‘‘কওন নেতাজি? কিস পার্টি কা নেতা হ্যায় ওহ্?’’
আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম! এবার নাম বলতে বুঝল বটে তবে সে বাড়ির রাস্তা তার সঠিক জানা নেই। এক মাঝবয়সী দোকানি জানালেন বাড়িটা ‘উড়িয়া বাজারে’। অটোওয়ালা ততক্ষণে আমাদের বোকামো দেখে অবাক। এত কিছু ছেড়ে শেষে কিনা উড়িয়া বাজারের এদো গলি? তার চেয়ে ফোর্ট দেখতে চলুন, মিউজিয়াম দেখুন, শপিং সেন্টারে ভাল কটকী শাড়ি কিনুন। কিন্তু আমাদের উদ্ভট খেয়ালের জোরে তাকে যেতেই হল শহরের পুরনো ওই অঞ্চলে। একেবারে সরু গলির মধ্যে দিয়ে পাক খেতে খেতে হাজির হলাম বাড়ির সামনে।
দোতলা মাঝারি মাপের বাড়ি অনেকটা ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আদলে তৈরী। গেটের পাশে ফলকে লেখা বাড়ির পরিচিতি আর ‘‘২৪শে জানুয়ারী, ২০০৫ তারিখে এই বাড়িকে জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক’’। দেড়শো বছরের পুরনো স্থাপত্য বোঝা যায় কেবল তার আকৃতি দেখে। বাড়ির সাজসজ্জা সবই নতুন ঝকঝকে। দোতলায় ফোটো গ্যালারী, ব্যারিস্টার জানকীনাথের চেম্বার আর সেই ঘর যেখানে ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী জেন্মছিলেন জানকীনাথের নবম সন্তান, সুভাষচন্দ্র। ফোটোগ্রাফ যা দেখলাম তা প্রায় সবই আমাদের আগে দেখা। সুভাষচেন্দ্রর লেখা বেশ কিছু চিঠি আছে এখানে যাতে রাজনীতির ছিটেফোটাও নেই বরং তাকে পাওয়া গেল একজন ‘পরিবারের সদস্য’ হিসেবেই। কারাগারে বিভিন্ন সময় বন্দী থাকায় পরিবারের সািন্নধ্য খুব বেশি পাননি। চিঠিগুলোয় কখনও তিনি চিিন্তত বাবার শারীরিক অবস্থার জন্য আবার কখনও আলোচনায় মশগুল সে বছর বাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে। হাসপাতালের পুরনো রেজিস্টারের পাতায় তার জেন্মর উেল্লখ। রাখা কাচের শো কেসের মধ্যে। জানকীনাথের চেম্বার সাজানো সেই সময়কার আসবাব ও জিনিসপত্র দিয়ে। মনে হয় এই ঘরের কর্তা যেন একটু আগেই কোনও দরকারে বেরিয়েছেন। আলো আর নানা ছবি দিয়ে সাজানো ‘ডিসেপ্ল রুম’ দর্শককে মুগ্ধ করে।
এত সাজানো গোছানো মিউজিয়াম দেখে ভালো লাগলেও একটা কথা মনে খচ্ খচ্ করে ওঠে: নেতাজির জন্মস্থানকে জাতীয় স্মারক হিসেবে গড়ে তুলতে স্বাধীন ভারতের এতগুলো বছর কেন লাগল ? এই আটান্ন বছর ধরে কী করছিলেন সরকার? কী ভাবে টিকে ছিল আজকের ঝাঁ চকচকে জানকীনাথ ভবন? মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ের পান দোকানীর কাছে শুনলাম সেই সব গল্প।
উড়িয়া বাজারের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে বহুকাল অবহেলায় পড়ে ছিল রায়বাহাদুর জানকীনাথের বাস্তুভিটে যদিও ১৯৫৮ সালেই ভারত সরকার তা অধিগ্রহণ করেন। প্রায় এক একর জমির ওপর তৈরী এ বাড়ি দেখাশোনার দায় বর্তায় নেতাজি সেবা সদন ট্রাস্ট বোর্ডের ওপর। বাড়ির যেত্নর খুবই অভাব হতে শুরু করে এই সময়। কয়েক বছর পর দু’টো ঘর বাদ দিয়ে বাকি বাড়িতে তৈরী হয় ২৩ বেডের এক প্রসূতি সদন ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। বন্ধ দু’টো ঘরের একটা ছিল সুভাষচেন্দ্রর জন্মকক্ষ। কোনও দর্শনার্থী এলে দরোয়ান তালা খুলে দিত পলেস্তারা খসা দেওয়ালে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ক’টা ফোটোগ্রাফে সাজানো ঘরটার। এ ভাবেই ফাটল ধরা মেঝে, নোনা লাগা দেওয়াল, ঝুলে পড়া জল চোয়ানো ছাদ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে হানাবাড়ি। এই অবস্থােতই বাড়ি দেখে গেছেন দেশ বিদেশের প্রচুর মানুষ। জাতীয় সম্পত্তির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ ও অনুরোধ জানিয়েছেন।
শেষমেশ সরকারের টনক নড়ে। বাড়ির ভোল ফেরাতে ৫ লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়। এর পরও প্রশাসনিক গড়িমসির ফলে নষ্ট হয় ক’টা বছর। কর্তৃপক্ষ নাকি বুঝতেই পারছিলেন না টাকাপয়সা খরচ করবেন কোন কোন খাতে! এমন কি, এক সময় তারা ভাবেন যে ২৩ বেডের হাসপাতাল বাড়িয়ে ১০০ বেডের করা হবে ওই টাকা থেকেই। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালে সরকার জানকীনাথ ভবনকে জাতীয় স্মারক ঘোষণা করেন, শুরু হয় মেরামতির কাজ। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে অনেক বাধা পেরিয়ে অবশেষে স্বীকৃত হল সুভাষচেন্দ্রর জন্মস্থান।
সরকারী দফতর থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ, সকলের ব্যবহারেই চরম অবহেলা। কেবল অনাদর নয়, তাতে মিশে আছে মাত্রাছাড়া অবজ্ঞা। সুভাষচন্দ্র ছিলেন প্রচারবিমুখ এক চরিত্র। তার স্বল্পায়ু জীবনে নিঃস্বার্থ দেশেপ্রমের নানান কীর্তি ভারতবাসীকে আজও গর্বিত করে। তার স্মৃতি রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। তবু কটকের সরু গলিতে তার এই জন্মস্থানকে অনেকগুলো বছর ধরে অনাদর সহ্য করতে হয়েছে, আজও হচ্ছে । নতুন প্রজন্ম উদ্ধত ভঙ্গিতে জানতে চায়, ‘কৌন নেতাজি? কিস পার্টিকা….?’
উড়িয়া বাজার ছেড়ে এবার চললাম মহানদীর কাছে। আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে এই নদীর সঙ্গে। তখন সবে ক্লাস থ্রি। শীতের ছুটিতে বাড়ির সবার সঙ্গে যাচ্ছি পুরী, জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখতে। ভোরবেলা ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল পিসিমার ডাকে, ‘‘ওঠ ওঠ, মহানদী এসে গেছে!’’ ঘুমচোখে জানলার ধারে পিসিমার কোল ঘেসে বসে সেই প্রথম আমার মহানদী দেখা। ধূ ধূ বালির চর আর মাঝে মাঝে সরু জলের ধারা বয়ে চলেছে। পিসিমা তখন শোনাচ্ছেন নদীর ভয়ঙ্কর রূপের কথা যা যুগে যুগে ভাসিয়ে দিয়েছে ওড়িশাকে। গুম গুম শেব্দ েট্রন িব্রজ পেরোচ্ছে। সঙ্গে গায়ে কাটা দেওয়া বন্যার গল্প। সেই সময় থেকেই মহানদী সম্পর্কে এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরী হয়েছিল যার টানেই এত বছর পর সুযোগ পেয়েই তাকে দেখতে আসা।
প্রায় ৯০০ কিলোমিটার লম্বা মহানদীর জন্ম ছত্তিশগড় রাজ্যের রায়পুর জেলার ফরসিয়া গ্রামের এক দিঘি থেকে। এই অঞ্চল বস্তার মালভূমি। এখান থেকে উত্তর পুবে ছোট্ট ঝোরা বয়ে চলে আর তাতে যোগ দেয় বস্তারের অগুনতি ঝরনা আর নালা। সমতলে পৌছে পুবে বাক নিয়ে ওড়িশায় ঢোকে মহানদী। তার জল ও গতি দুইই এবার বেড়ে ওঠে। ওড়িশার সম্বলপুর জেলার কাছে সে বাধা পায় প্রাচীন পাহাড়ের পাচিলে। কঠিন পাথর ফুড়ে এক গিরিখাত তৈরী করে বয়ে যায় মহানদী। এই গিরিখাত সাত ক্রোশ লম্বা বলে এর নাম হয় সাত কোশিয়া গর্জ যার দু’পারে টিকরপাড়ার গভীর জঙ্গল। সম্বলপুরে মহানদীকে বাধা হয়েছে হিরাকুদ বাধ দিয়ে, তৈরী হয়েছে জলবিদ্যুতকেন্দ্র। হিরাকুদ ছেড়ে প্রথমে দক্ষিণমুখো তারপর পুবে ঘুরে মহানদী তিন ধারায় ভাগ হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পড়েছে । একটি মহানদী, একটি কাঠজুরি আর একটি বৈতরণী। নদীর বয়ে আনা পলিতে তৈরী হয়েছে দু’টি বদ্বীপ।
এই দুই বদ্বীপের একটিতে ৯৮৯ খৃষ্টাব্দে রাজা নৃপ কেশরী কটক শহর পত্তন করেন। উত্তরে মহানদী আর দক্ষিণে কাঠজুরি অল্প সময়েই কটককে এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহরের পরিচিতি এনে দেয়। কিন্তু বর্ষার ভয়ঙ্কর প্লাবনে প্রায় প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয় কটক। ১০০৬ খৃষ্টাব্দে মহারাজ মরকৎ কেশরী কাঠজুরির বা তীরে তৈরী করেন এক শক্তিশালী পাথুরে বাধ যা আজও অটুট।
বাঁধ ছেড়ে চললাম মহানদীর পাড়ে। আর পাঁচটা নদী ঘেঁষা শহরের মত কটকেও নদীর পাড় বাঁধিয়ে পার্ক তৈরী করেছে পুরসভা। তবে তার রক্ষণাবেক্ষণে ফাঁক আছে বলে মনে হল। আগাছা ছেয়ে গেছে গোটা অয়ার্কেই। রেলিং ভেঙেছে অনেক জায়গায়। বিবর্ণ কিছু বেঞ্চ আর অকেজো এক ফোয়ারা প্রকট করছে সরকারি গাফিলতি। পার্ক পেরিয়ে এলাম নদীর ধারে। ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে দেখি এক ভাঙাচোরা ঘাট। সে ঘাটের না আছে কোন নাম না ঐতিহাসিক কৌলীন্য। কে বা কারা কোন যুগে গড়েছিল এ ঘাট সে কথা লেখা নেই কোথাও। হাটাহাটি করে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম ঘাটের ঁসিড়িতে। একটা বুড়ো অশ্বত্থ গাছ ছায়া ফেলেছে। হাল্কা হাওয়ায় ঝিরঝির করে কাপছে পাতা। এখানে বসে দেখতে পেলাম ছোটোবেলার সেই রেলিব্রজ। চোখ ভরে দেখলাম মহানদীকে। এত চওড়া নদীর বুক জানিনা এ দেশে আর কোথায় আছে। এখন তার জলের ধারা সরু হলেও বর্ষায় এর ভয়াল রূপ কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। আক্ষরিক অর্থেই এ মহা নদী।
বুড়ো অশ্বত্থের ডালে এক দল বুলবুলি জোর ঝগড়া করছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে ঝমঝম শেব্দ একটা ট্রেন চলে গেল। চার ধারে কোনও মানুষ নেই। একটা অগোছাল সৌন্দর্য আছে জায়গাটার। বসে বসে মনে পড়ল ছেলেবেলার সেই বেড়ানোর কথা। সেই প্রথম সমুদ্র দেখে চমকে ওঠা, নুলিয়ার হাত ধরে ঢেউ পেরোনো, ভেজা বালি দিয়ে দিদির তৈরী কেল্লা, ভোরবেলা মায়ের সেঙ্গ ঝিনুক কুড়োনো, সন্ধ্যেবেলা রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজিদের প্রার্থনা গীতি আর চাঁদের আলোয় পিসিমার মায়াবী রবীন্দ্রসঙ্গীত।
ভাবতে বসে খেয়াল ছিল না কখন আকাশ গোলাপি করে ডুবে গেছে সূর্য। ঝগড়া মিটিয়ে বাসায় ফিরেছে বুলবুলির দল। মহানদীর বালি ভরা বুকে নেমে এসেছে আবছা অন্ধকার। একে একে টিমটিমিয়ে জ্বলে উঠেছে রেলিব্রজের আলো। এবার উঠতে হবে ঘাটের ধাপ ছেড়ে। সময় মত স্টেশনে পৌছতে হবে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে।
কটকে দেখার অনেক জায়গা, অজস্র জিনিস। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে দুটো জায়গা দেখার। সত্যি বলতে কি, এগুলো দেখব বলেই সাত তাড়াতাড়ি কপিলাস থেকে বেরিয়ে পড়েছি। প্রথমটা হল জানকীনাথ ভবন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বাড়িতে, এখানেই কাটে তার গোটা শৈশব। তাই বরবাটি দুর্গ, কটকচণ্ডীর মিন্দর, স্টেডিয়াম ছেড়ে আমরা চললাম নেতাজির জন্মভিটে দেখতে। অটোয় উঠে ড্রাইভারকে আমাদের ইচ্ছে জানালাম। সে তো আকাশ থেকে পড়ল! ‘‘কওন নেতাজি? কিস পার্টি কা নেতা হ্যায় ওহ্?’’
আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম! এবার নাম বলতে বুঝল বটে তবে সে বাড়ির রাস্তা তার সঠিক জানা নেই। এক মাঝবয়সী দোকানি জানালেন বাড়িটা ‘উড়িয়া বাজারে’। অটোওয়ালা ততক্ষণে আমাদের বোকামো দেখে অবাক। এত কিছু ছেড়ে শেষে কিনা উড়িয়া বাজারের এদো গলি? তার চেয়ে ফোর্ট দেখতে চলুন, মিউজিয়াম দেখুন, শপিং সেন্টারে ভাল কটকী শাড়ি কিনুন। কিন্তু আমাদের উদ্ভট খেয়ালের জোরে তাকে যেতেই হল শহরের পুরনো ওই অঞ্চলে। একেবারে সরু গলির মধ্যে দিয়ে পাক খেতে খেতে হাজির হলাম বাড়ির সামনে।
দোতলা মাঝারি মাপের বাড়ি অনেকটা ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আদলে তৈরী। গেটের পাশে ফলকে লেখা বাড়ির পরিচিতি আর ‘‘২৪শে জানুয়ারী, ২০০৫ তারিখে এই বাড়িকে জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক’’। দেড়শো বছরের পুরনো স্থাপত্য বোঝা যায় কেবল তার আকৃতি দেখে। বাড়ির সাজসজ্জা সবই নতুন ঝকঝকে। দোতলায় ফোটো গ্যালারী, ব্যারিস্টার জানকীনাথের চেম্বার আর সেই ঘর যেখানে ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী জেন্মছিলেন জানকীনাথের নবম সন্তান, সুভাষচন্দ্র। ফোটোগ্রাফ যা দেখলাম তা প্রায় সবই আমাদের আগে দেখা। সুভাষচেন্দ্রর লেখা বেশ কিছু চিঠি আছে এখানে যাতে রাজনীতির ছিটেফোটাও নেই বরং তাকে পাওয়া গেল একজন ‘পরিবারের সদস্য’ হিসেবেই। কারাগারে বিভিন্ন সময় বন্দী থাকায় পরিবারের সািন্নধ্য খুব বেশি পাননি। চিঠিগুলোয় কখনও তিনি চিিন্তত বাবার শারীরিক অবস্থার জন্য আবার কখনও আলোচনায় মশগুল সে বছর বাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে। হাসপাতালের পুরনো রেজিস্টারের পাতায় তার জেন্মর উেল্লখ। রাখা কাচের শো কেসের মধ্যে। জানকীনাথের চেম্বার সাজানো সেই সময়কার আসবাব ও জিনিসপত্র দিয়ে। মনে হয় এই ঘরের কর্তা যেন একটু আগেই কোনও দরকারে বেরিয়েছেন। আলো আর নানা ছবি দিয়ে সাজানো ‘ডিসেপ্ল রুম’ দর্শককে মুগ্ধ করে।
এত সাজানো গোছানো মিউজিয়াম দেখে ভালো লাগলেও একটা কথা মনে খচ্ খচ্ করে ওঠে: নেতাজির জন্মস্থানকে জাতীয় স্মারক হিসেবে গড়ে তুলতে স্বাধীন ভারতের এতগুলো বছর কেন লাগল ? এই আটান্ন বছর ধরে কী করছিলেন সরকার? কী ভাবে টিকে ছিল আজকের ঝাঁ চকচকে জানকীনাথ ভবন? মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ের পান দোকানীর কাছে শুনলাম সেই সব গল্প।
উড়িয়া বাজারের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে বহুকাল অবহেলায় পড়ে ছিল রায়বাহাদুর জানকীনাথের বাস্তুভিটে যদিও ১৯৫৮ সালেই ভারত সরকার তা অধিগ্রহণ করেন। প্রায় এক একর জমির ওপর তৈরী এ বাড়ি দেখাশোনার দায় বর্তায় নেতাজি সেবা সদন ট্রাস্ট বোর্ডের ওপর। বাড়ির যেত্নর খুবই অভাব হতে শুরু করে এই সময়। কয়েক বছর পর দু’টো ঘর বাদ দিয়ে বাকি বাড়িতে তৈরী হয় ২৩ বেডের এক প্রসূতি সদন ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। বন্ধ দু’টো ঘরের একটা ছিল সুভাষচেন্দ্রর জন্মকক্ষ। কোনও দর্শনার্থী এলে দরোয়ান তালা খুলে দিত পলেস্তারা খসা দেওয়ালে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ক’টা ফোটোগ্রাফে সাজানো ঘরটার। এ ভাবেই ফাটল ধরা মেঝে, নোনা লাগা দেওয়াল, ঝুলে পড়া জল চোয়ানো ছাদ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে হানাবাড়ি। এই অবস্থােতই বাড়ি দেখে গেছেন দেশ বিদেশের প্রচুর মানুষ। জাতীয় সম্পত্তির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ ও অনুরোধ জানিয়েছেন।
শেষমেশ সরকারের টনক নড়ে। বাড়ির ভোল ফেরাতে ৫ লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়। এর পরও প্রশাসনিক গড়িমসির ফলে নষ্ট হয় ক’টা বছর। কর্তৃপক্ষ নাকি বুঝতেই পারছিলেন না টাকাপয়সা খরচ করবেন কোন কোন খাতে! এমন কি, এক সময় তারা ভাবেন যে ২৩ বেডের হাসপাতাল বাড়িয়ে ১০০ বেডের করা হবে ওই টাকা থেকেই। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালে সরকার জানকীনাথ ভবনকে জাতীয় স্মারক ঘোষণা করেন, শুরু হয় মেরামতির কাজ। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে অনেক বাধা পেরিয়ে অবশেষে স্বীকৃত হল সুভাষচেন্দ্রর জন্মস্থান।
সরকারী দফতর থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ, সকলের ব্যবহারেই চরম অবহেলা। কেবল অনাদর নয়, তাতে মিশে আছে মাত্রাছাড়া অবজ্ঞা। সুভাষচন্দ্র ছিলেন প্রচারবিমুখ এক চরিত্র। তার স্বল্পায়ু জীবনে নিঃস্বার্থ দেশেপ্রমের নানান কীর্তি ভারতবাসীকে আজও গর্বিত করে। তার স্মৃতি রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। তবু কটকের সরু গলিতে তার এই জন্মস্থানকে অনেকগুলো বছর ধরে অনাদর সহ্য করতে হয়েছে, আজও হচ্ছে । নতুন প্রজন্ম উদ্ধত ভঙ্গিতে জানতে চায়, ‘কৌন নেতাজি? কিস পার্টিকা….?’
উড়িয়া বাজার ছেড়ে এবার চললাম মহানদীর কাছে। আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে এই নদীর সঙ্গে। তখন সবে ক্লাস থ্রি। শীতের ছুটিতে বাড়ির সবার সঙ্গে যাচ্ছি পুরী, জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখতে। ভোরবেলা ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল পিসিমার ডাকে, ‘‘ওঠ ওঠ, মহানদী এসে গেছে!’’ ঘুমচোখে জানলার ধারে পিসিমার কোল ঘেসে বসে সেই প্রথম আমার মহানদী দেখা। ধূ ধূ বালির চর আর মাঝে মাঝে সরু জলের ধারা বয়ে চলেছে। পিসিমা তখন শোনাচ্ছেন নদীর ভয়ঙ্কর রূপের কথা যা যুগে যুগে ভাসিয়ে দিয়েছে ওড়িশাকে। গুম গুম শেব্দ েট্রন িব্রজ পেরোচ্ছে। সঙ্গে গায়ে কাটা দেওয়া বন্যার গল্প। সেই সময় থেকেই মহানদী সম্পর্কে এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরী হয়েছিল যার টানেই এত বছর পর সুযোগ পেয়েই তাকে দেখতে আসা।
প্রায় ৯০০ কিলোমিটার লম্বা মহানদীর জন্ম ছত্তিশগড় রাজ্যের রায়পুর জেলার ফরসিয়া গ্রামের এক দিঘি থেকে। এই অঞ্চল বস্তার মালভূমি। এখান থেকে উত্তর পুবে ছোট্ট ঝোরা বয়ে চলে আর তাতে যোগ দেয় বস্তারের অগুনতি ঝরনা আর নালা। সমতলে পৌছে পুবে বাক নিয়ে ওড়িশায় ঢোকে মহানদী। তার জল ও গতি দুইই এবার বেড়ে ওঠে। ওড়িশার সম্বলপুর জেলার কাছে সে বাধা পায় প্রাচীন পাহাড়ের পাচিলে। কঠিন পাথর ফুড়ে এক গিরিখাত তৈরী করে বয়ে যায় মহানদী। এই গিরিখাত সাত ক্রোশ লম্বা বলে এর নাম হয় সাত কোশিয়া গর্জ যার দু’পারে টিকরপাড়ার গভীর জঙ্গল। সম্বলপুরে মহানদীকে বাধা হয়েছে হিরাকুদ বাধ দিয়ে, তৈরী হয়েছে জলবিদ্যুতকেন্দ্র। হিরাকুদ ছেড়ে প্রথমে দক্ষিণমুখো তারপর পুবে ঘুরে মহানদী তিন ধারায় ভাগ হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পড়েছে । একটি মহানদী, একটি কাঠজুরি আর একটি বৈতরণী। নদীর বয়ে আনা পলিতে তৈরী হয়েছে দু’টি বদ্বীপ।
এই দুই বদ্বীপের একটিতে ৯৮৯ খৃষ্টাব্দে রাজা নৃপ কেশরী কটক শহর পত্তন করেন। উত্তরে মহানদী আর দক্ষিণে কাঠজুরি অল্প সময়েই কটককে এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহরের পরিচিতি এনে দেয়। কিন্তু বর্ষার ভয়ঙ্কর প্লাবনে প্রায় প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয় কটক। ১০০৬ খৃষ্টাব্দে মহারাজ মরকৎ কেশরী কাঠজুরির বা তীরে তৈরী করেন এক শক্তিশালী পাথুরে বাধ যা আজও অটুট।
বাঁধ ছেড়ে চললাম মহানদীর পাড়ে। আর পাঁচটা নদী ঘেঁষা শহরের মত কটকেও নদীর পাড় বাঁধিয়ে পার্ক তৈরী করেছে পুরসভা। তবে তার রক্ষণাবেক্ষণে ফাঁক আছে বলে মনে হল। আগাছা ছেয়ে গেছে গোটা অয়ার্কেই। রেলিং ভেঙেছে অনেক জায়গায়। বিবর্ণ কিছু বেঞ্চ আর অকেজো এক ফোয়ারা প্রকট করছে সরকারি গাফিলতি। পার্ক পেরিয়ে এলাম নদীর ধারে। ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে দেখি এক ভাঙাচোরা ঘাট। সে ঘাটের না আছে কোন নাম না ঐতিহাসিক কৌলীন্য। কে বা কারা কোন যুগে গড়েছিল এ ঘাট সে কথা লেখা নেই কোথাও। হাটাহাটি করে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম ঘাটের ঁসিড়িতে। একটা বুড়ো অশ্বত্থ গাছ ছায়া ফেলেছে। হাল্কা হাওয়ায় ঝিরঝির করে কাপছে পাতা। এখানে বসে দেখতে পেলাম ছোটোবেলার সেই রেলিব্রজ। চোখ ভরে দেখলাম মহানদীকে। এত চওড়া নদীর বুক জানিনা এ দেশে আর কোথায় আছে। এখন তার জলের ধারা সরু হলেও বর্ষায় এর ভয়াল রূপ কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। আক্ষরিক অর্থেই এ মহা নদী।
বুড়ো অশ্বত্থের ডালে এক দল বুলবুলি জোর ঝগড়া করছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে ঝমঝম শেব্দ একটা ট্রেন চলে গেল। চার ধারে কোনও মানুষ নেই। একটা অগোছাল সৌন্দর্য আছে জায়গাটার। বসে বসে মনে পড়ল ছেলেবেলার সেই বেড়ানোর কথা। সেই প্রথম সমুদ্র দেখে চমকে ওঠা, নুলিয়ার হাত ধরে ঢেউ পেরোনো, ভেজা বালি দিয়ে দিদির তৈরী কেল্লা, ভোরবেলা মায়ের সেঙ্গ ঝিনুক কুড়োনো, সন্ধ্যেবেলা রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজিদের প্রার্থনা গীতি আর চাঁদের আলোয় পিসিমার মায়াবী রবীন্দ্রসঙ্গীত।
ভাবতে বসে খেয়াল ছিল না কখন আকাশ গোলাপি করে ডুবে গেছে সূর্য। ঝগড়া মিটিয়ে বাসায় ফিরেছে বুলবুলির দল। মহানদীর বালি ভরা বুকে নেমে এসেছে আবছা অন্ধকার। একে একে টিমটিমিয়ে জ্বলে উঠেছে রেলিব্রজের আলো। এবার উঠতে হবে ঘাটের ধাপ ছেড়ে। সময় মত স্টেশনে পৌছতে হবে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে।
No comments:
Post a Comment