রাত দশটা পাচের হাওড়া পুরী এক্সেপ্রস আমাদের যখন কটক স্টেশনে নামিয়ে
দিল, ভোর রাতের ফাল্গুন আকাশে তারারা তখনও তাদের জৌলুস হারায়নি। ঘুমের ঘোর
লাগা রাজপথ বেয়ে রিক্সায় বাদামবাড়ি বাস স্ট্যাণ্ডে এলাম মিনিট পাচেকে।
সেখানে তখন সারি দিয়ে দাড়িয়ে নানা রুটের দূরপাল্লার বাস। কোনওটা যাচ্ছে
ভুবনেশ্বর, কোনওটা পুরী, কোনওটা আবার সম্বলপুর, কোরাপুট বা পারাদ্বীপ। আমরা
উঠলাম অঙ্গুল হয়ে সম্বলপুর যাবার বাসে, যাব জেলা সদর ঢেনকানল শহর।
ঘন্টা খানেকের রাস্তা কেটে গেল যেন কয়েক মূহূর্তে, পথের পাশে সূর্যোদয়ের আলোমাখা ওড়িশার গ্রাম দেখতে দেখতে। অনেকগুলো ছোট টিলায় ঘেরা ঢেনকানল শহর ৪২ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর। শহরের চারপাশে বেশ কয়েকটা বিখ্যাত মন্দির, যেমন শম্ভুগোপাল, বলভদ্র, কুঞ্জকান্ত, রঘুনাথ। আছে একটি চিলেড্রন্স পার্ক আর টিলার মাথায় পুরোনো রাজবাড়ি। এ যাত্রায় মিন্দর দেখা মুলতুবি রেখে চললাম ঢেনকানল ছেড়ে ১৭ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে কপিলাসে। ঢেনকানল বাজারের পাশের স্ট্যাণ্ড থেকে ২০০ টাকায় পাওয়া গেল অ্যাম্বাসাডার প্রাইভেট ট্যাক্সি। কপিলাস পৌছতে সময় লাগল দেড় ঘন্টা।
পূর্বঘাট পর্বতমালার মধ্যে ৪৫৭ মিটার উচু কপিলাস পাহাড় পবিত্র শৈবতীর্থ। ওড়িয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, হিমালয়ে মহাদেবের আবাস বলে চিিহ্নত কৈলাস পর্বতের মতোই পবিত্র এই পাহাড়, তার মাথায় এক প্রাচীন শিবমিন্দর। এখানে অধিিষ্ঠত চন্দ্রশেখর শিব। ‘মহাশিবরাত্রি’ উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে বিশাল মেলা বসে এখানে। হাজার হাজার মানুষ আসেন সেই মেলায়। উৎসব মুখর ক’টা দিন কিন্তু নেহাত ব্যাতিক্রম কপিলাসের রোজনামচায়। পাখির ডাক, মৌমাছির গুনগুন, ঝিঝির এসরাজ, ঝরা পাতার খসখসানি আর জ্যোৎস্না ধোয়া বনপ্রান্তর নিত্যসঙ্গী এই ছোট্ট জনপদের। শুনলাম, ‘স্বাস্থকর’ বলেও এখানকার সুখ্যাতি আছে।
পয়লা নজরেই মন কেড়ে নেওয়া কপিলাস আয়তনে খুবই সামান্য। পাহাড়ের পায়ের কাছে বাগান ঘেরা বিরাট হাতার মাঝে দাড়িয়ে ও টি ডি সির পান্থশালা একমাত্র পর্যটক আবাস। পান্থশালার গেটের বাইরে আছে গোটা দুই ঝুপড়ি এবং একটি মাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান । চারদিকে প্রকৃতি সবুজের বিপুল সম্ভার নিয়ে হাজির। গাছগাছালির ফাক দিয়ে এক মাথা নীল আকাশ নিয়ে দাড়িয়ে কপিলাস পাহাড়।
পান্থশালায় থাকার ব্যাবস্থা চমৎকার। চারটি ডবল বেডরুম আর পাচ বেডের এক ডর্মিটরি আছে এখানে। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে বাথরুম আর এক ফালি বারান্দা। বড় ডাইনিং হল আর কিচেন আছে। চাইলে নিজেরাও রান্না করা যেতে পারে। ডবল বেডরুমের ভাড়া দৈনিক ১৮০্ টাকা ও ডর্মিটরিতে বেডপিছু ভাড়া ৭৫্ টাকা। খাওয়া আলাদা খরচে। স্নান সেরে ক্লািন্ত দূর হল। পান্থশালার পাচকের হাতের অপূব্বর্ সুস্বাদু রান্না খেয়ে পাওয়া গেল নতুন শক্তি। হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়লাম কাছের সায়েন্স পার্ক দেখতে। সুন্দর বাগানে ঘেরা এক এলাহি ব্যাপার! বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রকৃতিকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতার উন্নতি সম্ভব তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে অগুনতি মডেল আর ফলকে। পার্কের ফোয়ারার ধারে বসে আড্ডা মারতে মারতে হঠাৎ ঠিক হল খানিক দূরের গ্রাম দেখতে যাব।
সায়েন্স পার্ক থেকে পায়ে হেঁটেই পৌছে গেলাম দেওগার পথে ছোট্ট গ্রামে। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামের ঠিক মাঝখানে আটচালা পুজোমণ্ডপ। সেন্ধর মুখে সেখানে ছেলেবুড়ো সক্কলে গেল্প মশগুল। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, পঞ্চায়েত অফিস, দোকানপাট ছাড়াও চোখে পড়ল বেশ কিছু পাকা দেওয়ালের ঘরবাড়ি। বিজলী বাতি সব বাড়িতে অবশ্যই নেই তবু মোটের ওপর গ্রামখানা ছিমছাম বলা চলে। গ্রাম ছেড়ে পান্থশালা ফিরলাম ঝুপড়ি দোকান থেকে কেনা হাতে গরম তেলেভাজা চাখতে চাখতে, চাদের আলোয় মাখামাখি ঝোপজঙ্গলের রূপে মগ্ন হয়ে।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল দোয়েলের শিস শুনে। চটপট স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিলাম কপিলাস পাহাড়ের মাথায় চন্দ্রশেখর শিবের মিন্দর দেখতে। পান্থশালা থেকে ঘাট রোড ধরে পাচ কিলোমিটার দূরের এই দেবস্থানে যাওয়া যায় ১৫০ টাকায় জিপ ভাড়া নিয়ে। তবে আমরা বেছে নিলাম পায়ে চলা দু’কিলোমিটার দূরেত্বর পাথুরে ঁসিড়ির রাস্তাটাই। ১৩৬৫টি ধাপওয়ালা এই হাটাপথে প্রকৃতিকে পাওয়া যায় আর একটু আপন করে। বট, অশ্বত্থ, বেল, আমলকী, হরতুকী আর বহেড়ার ছায়া ঘেরা পথে মন মাতানো নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ আর রঙিন প্রজাপতির মেলা ক্লািন্ত ভুলিয়ে দেয়। আর দেখলাম হনুমানের দাপট! কিছু পরেই শুনতে পেলাম ঝর্নার শব্দ। পাহাড়ের ওপর দেখা যাচ্ছে ধবধবে সাদা শিবমিন্দরের চুড়ো। কিংবদন্তী বলে, বনবাসের সময় পাণ্ডবরা কপিলাসে এসে প্রথম শুরু করেন শিলারূপী মহেশ্বরের পুজো।
প্রাচীন মিন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ দেখার মত। ওড়িশার বিখ্যাত মিন্দর স্থাপত্যের এ আর এক নমুনা। তবে মিন্দরের গায়ের মূল্যবান কারুকাজ ঢেকে গেছে চুনকামের মোটা প্রলেপে। মিন্দরের পাথুরে উঠোনে দারুণ সুন্দর কাঠখোদাই করা একটা ছত্রী। গর্ভগৃহে নাগবেিষ্টত চন্দ্রশেখরের পুজো দেখাশোনার দায়িেত্ব আছেন পাণ্ডারা। মূল মিন্দরের পূবদিকে পাচশো ফুট ওপরে বিষ্ণু ও কাশীর বিশ্বনাথের দুটো মিন্দর। দেখে মনে হল প্রায় সমসাময়িক কালেই তৈরী। এই মিন্দর দুটো ছাড়িয়ে উঠতে হল আরও কিছুটা। পাহাড়ের চুড়োর কাছাকাছি কয়েকটা গুহা। এই প্রাকৃতিক গুহাগুলো ঘিরেও অনেক পৌরাণিক কাহিনী। ইতিহাস জানাচ্ছে, এরই এক গুহায় তপস্যা করে সিিদ্ধলাভ করেন মহাসাধক মহিমা গোসাই যিনি তার ‘‘মহিমাবাদ’’ প্রচার করে পরে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভগবৎ প্রচারক শ্রীধর স্বামীও সাধনা করেছিলেন এইখানে।
মিন্দর দেখে ফিরেছি পান্থশালায়। আমাদের উৎসাহ দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ম্যানেজার শ্রীপাণিগ্রাহি, বললেন সপ্তশয্যার কথা। নতুন স্পট দেখার উত্তেজনায় জিপ ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম কপিলাস ছেড়ে ঢেনকানল হয়ে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে এই পিকনিক স্পটের উেদ্দশে। ঘন্টাখানেকের জিপযাত্রা শেষে অল্প পায়ে চলা রাস্তায় এলাম সপ্তশয্যা। অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে। আবার শোনা গেল মহাভারতের গল্প। অষ্টাদশ শতকের রানী রতুপ্রভা দেবীর উৎসাহে তৈরী রঘুনাথের মিন্দর দেখলাম এখানে। খানিকটা দূরে বয়ে চলেছে এক ছোট ঝোরা।
সেন্ধর অন্ধকার নামার আগেই ফিরে এলাম কপিলাসে ডিয়ার পার্ক দেখতে। পান্থশালার খুব কাছেই এই পার্ক এক ছোটখাটো চিড়িয়াখানা। শহুরে নামজাদা সব পশুশালার চেয়ে অনেকটাই আলাদা এই অখ্যাত মৃগদাব তার সুন্দর সবুজ পরিবেশের জন্য। চিতল হরিণ আর সম্বর চরে বেড়ায় বিরাট ঘেরা মাঠে যার মধ্যে ফাকে ফাকে অনেক বড় গাছ আছে দরকারি ছায়ার যোগান দিতে। ভালুকের ডেরা পরিখার ধারে কৃত্রিম গুহা। আছে বনবেড়াল, শেয়াল, সজারু, নেউল আর খরগোশ। টিয়া, ময়না, চন্দনা, মৌটুসির মত খাচায় রাখা পাখি ছাড়াও উচু গাছের ডালে বসে ডাকছে দোয়েল, ঘুঘু, বসন্তবৌরি, বেনেবউ, মাছরাঙা আর দাড়কাক। চিড়িয়াখানার মধ্যে আছে এক বিশাল লেক। লেকের জলে শীতে উড়ে আসে অনেক পরিযায়ী পাখি। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা হল পানকৌড়ি, ডাহুক আর জলপিপি। এই লেকের এক ধারে তৈরী হয়েছে বিপন্ন প্রজাতির ঘড়িয়াল সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র। উৎসাহী পর্যটকদের জন্য কর্তৃপক্ষ নৌকোভ্রমণের ব্যবস্থাও রেখেছেন।
আজ কপিলাসে আমাদের শেষ রাত। পান্থশালার লন ভেসে যাচ্ছে দোলপূর্ণিমার চাদের আলোয়; কুরিন্জি ফুলের গেন্ধ মাতোয়ারা আমরা সৌন্দর্যের নেশায় বুদ। এমন সময় কপিলাস পাহাড়ের মাথা থেকে শন্শন্ শেব্দ নেমে এল মার্চ উইণ্ড। চুলে বিলি কেটে অস্ফূটে জানিয়ে গেল আবার আসার নিমন্ত্রণ।
ঘন্টা খানেকের রাস্তা কেটে গেল যেন কয়েক মূহূর্তে, পথের পাশে সূর্যোদয়ের আলোমাখা ওড়িশার গ্রাম দেখতে দেখতে। অনেকগুলো ছোট টিলায় ঘেরা ঢেনকানল শহর ৪২ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর। শহরের চারপাশে বেশ কয়েকটা বিখ্যাত মন্দির, যেমন শম্ভুগোপাল, বলভদ্র, কুঞ্জকান্ত, রঘুনাথ। আছে একটি চিলেড্রন্স পার্ক আর টিলার মাথায় পুরোনো রাজবাড়ি। এ যাত্রায় মিন্দর দেখা মুলতুবি রেখে চললাম ঢেনকানল ছেড়ে ১৭ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে কপিলাসে। ঢেনকানল বাজারের পাশের স্ট্যাণ্ড থেকে ২০০ টাকায় পাওয়া গেল অ্যাম্বাসাডার প্রাইভেট ট্যাক্সি। কপিলাস পৌছতে সময় লাগল দেড় ঘন্টা।
পূর্বঘাট পর্বতমালার মধ্যে ৪৫৭ মিটার উচু কপিলাস পাহাড় পবিত্র শৈবতীর্থ। ওড়িয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, হিমালয়ে মহাদেবের আবাস বলে চিিহ্নত কৈলাস পর্বতের মতোই পবিত্র এই পাহাড়, তার মাথায় এক প্রাচীন শিবমিন্দর। এখানে অধিিষ্ঠত চন্দ্রশেখর শিব। ‘মহাশিবরাত্রি’ উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে বিশাল মেলা বসে এখানে। হাজার হাজার মানুষ আসেন সেই মেলায়। উৎসব মুখর ক’টা দিন কিন্তু নেহাত ব্যাতিক্রম কপিলাসের রোজনামচায়। পাখির ডাক, মৌমাছির গুনগুন, ঝিঝির এসরাজ, ঝরা পাতার খসখসানি আর জ্যোৎস্না ধোয়া বনপ্রান্তর নিত্যসঙ্গী এই ছোট্ট জনপদের। শুনলাম, ‘স্বাস্থকর’ বলেও এখানকার সুখ্যাতি আছে।
পয়লা নজরেই মন কেড়ে নেওয়া কপিলাস আয়তনে খুবই সামান্য। পাহাড়ের পায়ের কাছে বাগান ঘেরা বিরাট হাতার মাঝে দাড়িয়ে ও টি ডি সির পান্থশালা একমাত্র পর্যটক আবাস। পান্থশালার গেটের বাইরে আছে গোটা দুই ঝুপড়ি এবং একটি মাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান । চারদিকে প্রকৃতি সবুজের বিপুল সম্ভার নিয়ে হাজির। গাছগাছালির ফাক দিয়ে এক মাথা নীল আকাশ নিয়ে দাড়িয়ে কপিলাস পাহাড়।
পান্থশালায় থাকার ব্যাবস্থা চমৎকার। চারটি ডবল বেডরুম আর পাচ বেডের এক ডর্মিটরি আছে এখানে। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে বাথরুম আর এক ফালি বারান্দা। বড় ডাইনিং হল আর কিচেন আছে। চাইলে নিজেরাও রান্না করা যেতে পারে। ডবল বেডরুমের ভাড়া দৈনিক ১৮০্ টাকা ও ডর্মিটরিতে বেডপিছু ভাড়া ৭৫্ টাকা। খাওয়া আলাদা খরচে। স্নান সেরে ক্লািন্ত দূর হল। পান্থশালার পাচকের হাতের অপূব্বর্ সুস্বাদু রান্না খেয়ে পাওয়া গেল নতুন শক্তি। হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়লাম কাছের সায়েন্স পার্ক দেখতে। সুন্দর বাগানে ঘেরা এক এলাহি ব্যাপার! বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রকৃতিকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতার উন্নতি সম্ভব তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে অগুনতি মডেল আর ফলকে। পার্কের ফোয়ারার ধারে বসে আড্ডা মারতে মারতে হঠাৎ ঠিক হল খানিক দূরের গ্রাম দেখতে যাব।
সায়েন্স পার্ক থেকে পায়ে হেঁটেই পৌছে গেলাম দেওগার পথে ছোট্ট গ্রামে। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামের ঠিক মাঝখানে আটচালা পুজোমণ্ডপ। সেন্ধর মুখে সেখানে ছেলেবুড়ো সক্কলে গেল্প মশগুল। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, পঞ্চায়েত অফিস, দোকানপাট ছাড়াও চোখে পড়ল বেশ কিছু পাকা দেওয়ালের ঘরবাড়ি। বিজলী বাতি সব বাড়িতে অবশ্যই নেই তবু মোটের ওপর গ্রামখানা ছিমছাম বলা চলে। গ্রাম ছেড়ে পান্থশালা ফিরলাম ঝুপড়ি দোকান থেকে কেনা হাতে গরম তেলেভাজা চাখতে চাখতে, চাদের আলোয় মাখামাখি ঝোপজঙ্গলের রূপে মগ্ন হয়ে।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল দোয়েলের শিস শুনে। চটপট স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিলাম কপিলাস পাহাড়ের মাথায় চন্দ্রশেখর শিবের মিন্দর দেখতে। পান্থশালা থেকে ঘাট রোড ধরে পাচ কিলোমিটার দূরের এই দেবস্থানে যাওয়া যায় ১৫০ টাকায় জিপ ভাড়া নিয়ে। তবে আমরা বেছে নিলাম পায়ে চলা দু’কিলোমিটার দূরেত্বর পাথুরে ঁসিড়ির রাস্তাটাই। ১৩৬৫টি ধাপওয়ালা এই হাটাপথে প্রকৃতিকে পাওয়া যায় আর একটু আপন করে। বট, অশ্বত্থ, বেল, আমলকী, হরতুকী আর বহেড়ার ছায়া ঘেরা পথে মন মাতানো নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ আর রঙিন প্রজাপতির মেলা ক্লািন্ত ভুলিয়ে দেয়। আর দেখলাম হনুমানের দাপট! কিছু পরেই শুনতে পেলাম ঝর্নার শব্দ। পাহাড়ের ওপর দেখা যাচ্ছে ধবধবে সাদা শিবমিন্দরের চুড়ো। কিংবদন্তী বলে, বনবাসের সময় পাণ্ডবরা কপিলাসে এসে প্রথম শুরু করেন শিলারূপী মহেশ্বরের পুজো।
প্রাচীন মিন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ দেখার মত। ওড়িশার বিখ্যাত মিন্দর স্থাপত্যের এ আর এক নমুনা। তবে মিন্দরের গায়ের মূল্যবান কারুকাজ ঢেকে গেছে চুনকামের মোটা প্রলেপে। মিন্দরের পাথুরে উঠোনে দারুণ সুন্দর কাঠখোদাই করা একটা ছত্রী। গর্ভগৃহে নাগবেিষ্টত চন্দ্রশেখরের পুজো দেখাশোনার দায়িেত্ব আছেন পাণ্ডারা। মূল মিন্দরের পূবদিকে পাচশো ফুট ওপরে বিষ্ণু ও কাশীর বিশ্বনাথের দুটো মিন্দর। দেখে মনে হল প্রায় সমসাময়িক কালেই তৈরী। এই মিন্দর দুটো ছাড়িয়ে উঠতে হল আরও কিছুটা। পাহাড়ের চুড়োর কাছাকাছি কয়েকটা গুহা। এই প্রাকৃতিক গুহাগুলো ঘিরেও অনেক পৌরাণিক কাহিনী। ইতিহাস জানাচ্ছে, এরই এক গুহায় তপস্যা করে সিিদ্ধলাভ করেন মহাসাধক মহিমা গোসাই যিনি তার ‘‘মহিমাবাদ’’ প্রচার করে পরে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভগবৎ প্রচারক শ্রীধর স্বামীও সাধনা করেছিলেন এইখানে।
মিন্দর দেখে ফিরেছি পান্থশালায়। আমাদের উৎসাহ দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ম্যানেজার শ্রীপাণিগ্রাহি, বললেন সপ্তশয্যার কথা। নতুন স্পট দেখার উত্তেজনায় জিপ ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম কপিলাস ছেড়ে ঢেনকানল হয়ে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে এই পিকনিক স্পটের উেদ্দশে। ঘন্টাখানেকের জিপযাত্রা শেষে অল্প পায়ে চলা রাস্তায় এলাম সপ্তশয্যা। অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে। আবার শোনা গেল মহাভারতের গল্প। অষ্টাদশ শতকের রানী রতুপ্রভা দেবীর উৎসাহে তৈরী রঘুনাথের মিন্দর দেখলাম এখানে। খানিকটা দূরে বয়ে চলেছে এক ছোট ঝোরা।
সেন্ধর অন্ধকার নামার আগেই ফিরে এলাম কপিলাসে ডিয়ার পার্ক দেখতে। পান্থশালার খুব কাছেই এই পার্ক এক ছোটখাটো চিড়িয়াখানা। শহুরে নামজাদা সব পশুশালার চেয়ে অনেকটাই আলাদা এই অখ্যাত মৃগদাব তার সুন্দর সবুজ পরিবেশের জন্য। চিতল হরিণ আর সম্বর চরে বেড়ায় বিরাট ঘেরা মাঠে যার মধ্যে ফাকে ফাকে অনেক বড় গাছ আছে দরকারি ছায়ার যোগান দিতে। ভালুকের ডেরা পরিখার ধারে কৃত্রিম গুহা। আছে বনবেড়াল, শেয়াল, সজারু, নেউল আর খরগোশ। টিয়া, ময়না, চন্দনা, মৌটুসির মত খাচায় রাখা পাখি ছাড়াও উচু গাছের ডালে বসে ডাকছে দোয়েল, ঘুঘু, বসন্তবৌরি, বেনেবউ, মাছরাঙা আর দাড়কাক। চিড়িয়াখানার মধ্যে আছে এক বিশাল লেক। লেকের জলে শীতে উড়ে আসে অনেক পরিযায়ী পাখি। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা হল পানকৌড়ি, ডাহুক আর জলপিপি। এই লেকের এক ধারে তৈরী হয়েছে বিপন্ন প্রজাতির ঘড়িয়াল সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র। উৎসাহী পর্যটকদের জন্য কর্তৃপক্ষ নৌকোভ্রমণের ব্যবস্থাও রেখেছেন।
আজ কপিলাসে আমাদের শেষ রাত। পান্থশালার লন ভেসে যাচ্ছে দোলপূর্ণিমার চাদের আলোয়; কুরিন্জি ফুলের গেন্ধ মাতোয়ারা আমরা সৌন্দর্যের নেশায় বুদ। এমন সময় কপিলাস পাহাড়ের মাথা থেকে শন্শন্ শেব্দ নেমে এল মার্চ উইণ্ড। চুলে বিলি কেটে অস্ফূটে জানিয়ে গেল আবার আসার নিমন্ত্রণ।
No comments:
Post a Comment