Tuesday, July 15, 2014

নিঃসঙ্গ পাহাড়ি পথ

যতদূর চোখ যায় নজরে আসছে সামনের রাস্তাটা। সরু হতে হতে সামনের পাহাড় শ্রেণির মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে।
রাস্তার দু’পাশে ধূ ধূ প্রান্তর। দিগন্ত জুড়ে থাকা পাহাড়ের গায়ে তাও ধাক্কা খেয়ে থেমে গিয়েছে। বিকেলের রোদ এসে পড়েছে প্রান্তরে, পাহাড়ের ঘন সবুজ বনানীর গায়ে। কেমন যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে ইটকাঠের জঙ্গল বাদ দিয়ে অন্য এক দুনিয়ার কথা।
রাস্তাটা জাতীয় সড়ক। আর পাচটা এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ক্ষেত্রে যা হয় এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। রাস্তায় সার দিয়ে চলেছে গাড়ি, লরি আর বাস। হর্নের আওয়াজে অনেক সময়ই ঢেকে যাচ্ছে আশপাশের শব্দ। রাস্তার পাশে দোকান আর বাড়ি। মাঝে মধ্যেই দেখা মিলছে পেেট্রাল পাম্পের। কিন্তু এই দ্রুত সরে যাওয়া সভ্যতার চিহ্নের মধ্যে ফাক পেলেই প্রকৃতি হাতছানি দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দিগেন্তর প্রহরী হয়ে থাকা পর্বত শ্রেনীর। ধূ ধূ প্রান্তরের।
বিকেলের রোদ গায়ে মেখে গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আমাদের নিয়ে বোলেরো ছুটছে।
পুজোর সময়ে পাঁচ বঙ্গসন্তান এসেছে উত্তর-পূর্ব ভারতে। গন্তব্যস্থল ১৭০ কিলোমিটার দূরের চেরাপুঞ্জি।
শিলং হয়ে পূর্ব খাসি পাহাড়ের অন্যতম প্রধান শহর। বিশ্বে যাকে এক ডাকে চেনে পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের অঞ্চল বলে। ছোটোবেলায় ভূগোল বইয়ের পাতায় ছবির মাধ্যমেই চেরাপুঞ্জির সঙ্গে পরিচয় গড়পড়তা বাঙালির। পরে বড় হয়ে অবশ্য সে জানতে পারছে সাহারার জন্য একখানি মেঘও চেরাপুঞ্জির কাছ থেকে ধার চেয়ে রেখেছেন কবি।
তবে যাত্রা পথ যে সহজ নয় তা মালুম পেয়েছিলাম বিমানবন্দরের বাইরে এসেই। ‘ওয়েলকাম টু নর্থ ইস্ট’ বলে সহাস্য মুখে গুয়াহাটির যে বছর পয়ত্রিশের যুবক আমাদের গাড়ির সারথির পরিচয় দিয়ে সহাস্যে এগিয়ে এসেছিলেন, পার্কিং লটে আমাদের নিয়ে এলেন, গাড়ির পেছনে সাগ্রহে
মালপত্র রাখতেও সাহায্য করলেন, সেই তিনিই গন্তব্যস্থল চেরাপুঞ্জি শুনে থমকে গেলেন।
ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে যা বললেন তার মর্মার্থ হল, গুয়াহাটি থেকে প্রায় ঘন্টা সাতেক লাগবে চেরাপুঞ্জি পৌছতে। কারণ শিলং হয়ে যেতে হবে। আর গুয়াহাটি-শিলং ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব যেতেই ঘন্টা চারেক লেগে যাবে। কারণ রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। এত রাতে যাওয়া বোধহয় সমীচীন হবে না। তার চেয়ে বরং রাতটা শিলংয়ে কাটিয়ে পরদিন সকালে চেরাপুঞ্জি গেলেই ভাল হয়।
কিন্তু সেই রাতেই পৌছতে হবে চেরাপুঞ্জি। ছোট্ট ৬ কামরার রিসর্টে বুকিং রয়েছে যে! চেরাপুঞ্জি- বরাপানি- শিলং ঘিরে আগামী দিন আষ্টেকের যে যাত্রাপথ, তার সূচনা তো চেরাপুঞ্জি দিয়েই। সেই সূচি অনুসারে পরবর্তী জায়গাগুলোর বুকিং ও রয়েছে। (পরে অবশ্য বুঝেছিলাম, সব কিছুই ঠিক ছিল না)।
তাই সারথির সঙ্গেই আমাদের যাত্রা শুরু হল। চেরাপুঞ্জির দিকে।স্ত যেতে বসেছিল!
মহাসপ্তমীর সকালে কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার কথা। গুয়াহাটিগামী বিমান ছাড়ার কথা বেলা ১ টা ১০-এ। কিন্তু সকাল থেকেই আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। এই রে, যাওয়া হবে তো?
বৃষ্টি তখন ঝিরঝিরে থেকে প্রবল আকার নিয়েছে। আকাশের গায়ে ক্রমশই কৃষ্ণবর্ণের প্রলেপ পড়ছে। সাতসকালেই কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। সল্টলেকের রাস্তাতে জলও জমতে শুরু করেছে।
কয়েক দিন আগেই বৃষ্টিতে কলকাতা ভেসে গিয়েছিল। সারা শহর গিয়েছিল অচল হয়ে। ভেনিস- প্রায় শহরের রাস্তায় গাড়িগুলোর হয়েছিল প্রায় গণ্ডোলার দশা। ফলে সেই স্মৃতি চট করে মনে না এসে উপায় আছে! বেশি বৃষ্টিতে যদি দমদম থেকে গুয়াহাটি গামী বিমানই না ছাড়ে?
এই প্রথম উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়া। ফলে অন্য একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি তো রয়েছেই। সঙ্গে একরাশ আশঙ্কাও ঘনিয়ে এসেছে প্রথম থেকেই। বন্ধু বান্ধবের এই দলকে চালনা করে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল অনির্বাণ আর দেবযানীর। মূলত অনির্বানের বাড়িতে অগেস্টর এক বৃষ্টির রোববার দুপুরে কিব্জ ডুবিয়ে খেতে খেতে যাওয়ার ছক কষা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেবযানীর হাতের আঙুলের হাড়ে চিড় ধরা পড়ল। অনির্বাণ বেচারি প্রাণপাত করে দৌড়োদৌড়ি করে ডাক্তার বদ্যি করতে লাগল। যদি যাওয়া যায়? কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ডাক্তার ভাঙা আঙুল নিয়ে দেবযানীকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। যাত্রা শুরুর আগেই যাত্রী সংখ্যা গেল কমে। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম!
ফলে দুপুর আড়াইটে নাগাদ যখন বোর্ডিং কল দিল বিমান সংস্থা, তখন কী যে আনন্দ পেলাম তা বলে বোঝাতো পারব না। কারণ তার আগে পর্যন্ত ক্রমাগত ভয় হচ্ছে কখন উড়ান বাতিল হওয়ার ঘোষণা শুনব বলে।
আনেন্দর পর্ব অবশ্য অত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়নি। বিমানের জানালা থেকে যখন দেখেছি চেনাশুনো জগৎটা সরে গিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়, সেই সব কয়েক হাজার ফুট নীচে থাকা মেঘে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে রোদ পড়েছে, রোদে পাহাড়ি খরেস্রাতার জল চিক্‌চিক্‌ করছে তখনও মন ভরে গিয়েছিল আনেন্দ। সবুজ যে কত ধরণের হতে পারে তাও তার প্যালেট খুলে দেখিয়েছিল প্রকৃতি।

কলকাতায় যখন মহাসপ্তমীর ভেজা বিকেল, গুয়াহাটিতে তখন মিঠে রোদ্দুর। গুয়াহাটি বিমানবন্দরে বিমান থেকে নেমে অসম ফ্লাইং ক্লাবের হ্যাঙ্গার দেখতে দেখতে চেক আউটে চলে আসা। আর তারপর যাত্রা শুরু।
সারথি বললেন, গুয়াহাটি শহরে ঢোকা হবে না। তাকে বাইপাস করে আমরা শিলং যাত্রা করব। হলও তাই। গুয়াহাটি শহরকে পাশ দিয়ে ক্ষণিক দেখেই বোলেরো চলল। ক্রমে সন্ধ্যার আধার নামতে শুরু করল। রাস্তার পাশের দোকানেও আলো জ্বলতে শুরু করল। দেখলাম যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি তার বা দিকে অসম, ডানদিকে মেঘালয়।
গাড়িতে জলের ভাড়ার তলানিতে এসে ঠেকেছিল। তাই রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে জল কিনতে নেমে পড়লাম। সে এক অদ্ভুত জায়গা। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। রাস্তার এক পাশে অন্ধকারের দেওয়াল। সেই দেওয়ালের ওপরে যে আরেকটা রাস্তা
রয়েছে তা নীচ থেকে বোঝা যাচ্ছে। দোকানের পাশ দিয়ে ছোট্ট নালা বয়ে যাচ্ছে। তাই দোকানে যেতে গেলে একটা ছোট্ট বাশের সাকো রয়েছে। রাস্তায় আলো বলতে আশপাশের দোকানের বাল্ব আর গাড়ির হেডলাইট। বেশ বোঝা যাচ্ছে এ এক অন্য জগৎ।
জল কিনে ফের গাড়ি চলল শিলংয়ের পথে। অন্ধকার নেমে এসেছে। তাই রাস্তার ধারের দৃশ্য দেখার কোনও উপায় নেই। শুধু অদ্ভুত এক পাহাড়ি সুরে সারিথ গান গেয়ে চলেছেন। আর মাঝে মধ্যে কলকাতার যাত্রীদের মনোরঞ্জন করছে ছোট্ট মিঠি। নাচার উপায় নেই। তাই গলাকে সম্বল করেই সে প্রাণপণে বিনোদন জোগাচ্ছিল আমাদের। শেষমেষ বাধ্য হয়ে তার মাকে বলতেই হলো,‘‘অনেক হয়েছে। মিঠি এ বার ঘুমাও।’’
শুনেছিলাম সাড়ে সাতটার কাটা পেরোলেই উত্তর-পূর্ব ভারত ঘুমিয়ে পড়ে। হয়ত তাই। একের পর এক রাস্তা পেরোচ্ছিলাম। মাঝে মধ্যেই আসছিল অসম অয়েল-এর পেেট্রাল পাম্প। অাসছিল শহরও। রাস্তার দু’পাশের আলোর উজ্জ্বলতা সাময়িক হলেও অন্ধকারকে ঢেকে দিচ্ছিল। গুয়াহাটি-শিলং যাত্রাপথে মালবাহী লরিরও কোনও অভাব নেই। বস্তুত সারা রাস্তা লরি বাহিনীর ধোয়া মেখে যেতে হল আমাদের বাহনকে।
শিলং যে এসে পৌছেছি তা মালুম হল ডন বস্‌কো স্কুলটা দেখে। তারপরই চোখের সামনে চলে এল আলোকিত পাহাড়। শারদীয়ার আলোকসজ্জায় সজ্জিত পুরো শহরটা দৃশ্যমান হলো। একটু এগোতেই পরিচিত দৃশ্য। রাস্তা ভিড়ে ভিড়াক্কার। মহাসপ্তমীর সন্ধ্যায় বাবার হাত ধরে কচি কাচারা বেরিয়েছে ঠাকুর দেখতে। মণ্ডপের বহু আগে থেকেই রয়েছে আলোকসজ্জা। দর্শনার্থীদের সুশৃঙ্খল ভাবে প্রতিমা দেখার জন্য মাইকে বারংবার ঘোষণা করা হচ্ছে।
যাক পুজোর আমেজ একেবারে ফেলে আসিনি তা হলে!সেই আমেেজর রেশ থাকতে থাকতেই িদ্বতীয় ধাক্কাটা খেলাম।
শিলংয়ের পোলো মোড়ে রাত সাড়ে ৮টার সময়ে যখন কর্তব্যরত ট্রাফিক কনেস্টবলকে চেরাপুঞ্জির যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞাসা করলাম, তখন তার তো প্রায় ভির্মি খাওয়ার দাখিল। এতো রাতে চেরাপুঞ্জি? কিন্তু ওই রাস্তায় এত রাতে তো কেউ…………
বেশি কথা পুলিশকর্মী বলেননি। কিন্তু তার বিস্ফারিত চোখ অনেক না বলা কথাই বলে দিয়েছিল।
একটু পরেই অবশ্য বুঝলাম তার অর্থ। রাস্তার এক ধারে পাহাড়ের খাড়াই দেওয়াল। অন্যধারে নিকষ অন্ধকার। আর রাস্তায় অামাদের গাড়ি ছাড়া িদ্বতীয় কোনও যান নেই। মানুষ তো দূর অস্ত।
শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। পাহাড়ি রাস্তায় সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগলো ঘন্টা তিনেক। আর সেই দীর্ঘ পথে ত্রস্তপদে চলা দুই পাহাড়ি মহিলা ছাড়া আর কারুর দেখা মেলেনি।
জনমানবহীন রাস্তার সঙ্গে পরিচয় কিছুদিন আগেই হয়েছিল। শািন্তনিকেতন ঢোকার পথে গভীর রাতে জঙ্গলের পথে। কিন্তু সেই রাস্তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক কম।

মাঝে মধ্যে অন্ধকারে মোড়ানো রাস্তায় গাড়িতে বসে যে নিজেকে খুব সাহসী বলে মনে হচ্ছিল এমন কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। তাই সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে ছিলাম দূরের পাহাড়ের আলোগুলের দিকে। বলাই বাহুল্য প্রতিটা আলো দেখে সবাই হিসাব কষছিল চেরাপুঞ্জি আর কতটা দূরে। পরে দিনের বেলায় বুঝেছিলাম ওই আলোগুলোর অধিকাংশই ছিল সীমান্তপারের বাংলাদেশের কোনও শহরের আলো। চেরাপুঞ্জির আলো আমাদের নজরেই পড়েনি।
অবশ্য তাতে উৎসাহের কমতি ছিল না। চেরাপুঞ্জির যে ছোট্ট ৬ কামরার রিসর্টে অামাদের ঘর বুক করা রয়েছে তার মালিক ডেনিস রায়েনকে শিলং থেকে বেরিয়েই ফোন করা হল।
‘মিস্টার রায়েন। উই আর অন দ্য ওয়ে টু ইওর রিসর্ট।’’
‘‘রিয়েলি। গ্রেট!’’
‘‘উই অল আর বিট হাংরি টু।’’
‘‘ন্যাচারালি। শুড আই অ্যারেঞ্জ ফর দ্য ডিনার?’’
‘‘উই উড বি টু গ্রেটফুল। কুড উই টেক ওয়ান মোর অফ ইওর ফেভার?’’
‘‘ইয়েস?’’
‘‘উই হোপ, উই উড বি রিচিং ইওর রিসর্ট শর্টলি। সো কুড টি বি অ্যারেঞ্জড্‌?’’
‘‘সার্টেনলি। হোয়াই নট?’’
ডেনিসের কথা সেই নির্জন জনমানবহীন রাস্তায় যে এক রাশ স্বিস্ত নিয়ে এসেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাক, তাহলে চেরাপুঞ্জি চলে এল বলে!
কিন্তু আধঘন্টা, এক ঘন্টা, দেড় ঘন্টা, দু’ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও সেই রাস্তার শেষ হচ্ছে না। দূরের আলো দূরেই রয়ে গিয়েছে। আর আমরা সেই আলোর দিকে ছুটে চলেছি।
বন্ধুরা বলল ডেনিসকেই আর একবার ফোন করে দেখা যাক। শেষ আর কতদূরে তা ঠাওর করার জন্য।
কিন্তু এ বার আর ডেনিসের মোবাইল সংযোগ মিলল না। কিছুক্ষণ পরে গাড়ির কারুরই আর মোবাইল নেটওয়ার্ক রইল না। অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় পাচজনকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। ঘড়ির কাটাও মনে হচ্ছে থেমে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর শেষ েস্টশনের দিকে চলেছি।
রাত ১১টা নাগাদ একটা জনপদে ঢুকলাম আমরা। দেখি ঘন অন্ধকারের মধ্যে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তাতে লেখা শোহরা। ব্র্যাকেটে চেরাপুঞ্জি।কারণ মেঘালয়ে সরকারি ভাবে চেরাপুঞ্জির পরিচয় শোহরা নামে।
যাক, ঘন্টা সাতেকের দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে চেরাপুঞ্জি এসে পৌছলাম তবে। কিন্তু রিসর্ট কোথায়?
রাতের অন্ধকারেই মালুম হল ছোট্ট পাহাড়ি শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। পাথরের রাস্তায় প্রায় কেউই নেই।
আমরা তো কোন ছার, আমাদের সারথিও কোনওদিন চেরাপুঞ্জি আসেননি। ফলে অামাদের অবস্থাটা অনেকটাই ভূ-আবিষ্কারকদের মতো। সবটা রাস্তাই একা চিনে যেতে হবে।
রিসর্ট খুজে বার করার আশা ছেড়ে দিয়ে যখন রাতটা গাড়িতেই কাটাতে হবে ধরে নিয়েছি, তখন হঠাৎ দেখা গেল দুই তরুণীকে। দু’জনে দিব্যি গল্প করতে করতে হাটছিলেন। আর আমরা তাদেরই খড়কুটোর মতো আকড়ে ধরলাম।
এত রাতে রিসর্টে যাব শুনে তারা তো আমাদের পাগল ঠাওরে বসলেন। কোনও মতে বললেন, সে তো অনেক দূর।
কতদূর?
চোখ কুচকে যা জানােলন তার মমার্থ হল এখনও রাস্তা অনেক বাকি। সিমেন্ট কারখানা পড়বে, রাস্তায় মিলবে গির্জা। তারপরই পাহাড়ি পথে ১০ কিলোমিটার।
রাতের অাধারে কারখানা দেখলাম, গির্জাও নজের এল। সেখানেই দেখা এক সিস্টারের সঙ্গে। পথ নির্দেশ দিয়ে তিনিও না বলে পারলেন না, ‘‘েব্লস ইউ মাই চিলেড্রন।’’
শহরটা যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। ফের শুরু হয়ে গেল পাহাড়ি রাস্তা। অন্ধকারের মধ্যে হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলছে গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে ভেজা পাহাড়ি দেওয়াল।
আমরা যে ঠিক পথেই যাচ্ছি তা বুঝলাম একটু পরেই। বৃষ্টির সঙ্গে রোমান্স, মেঘের সঙ্গে হাটার থেকে শুরু করে প্রকৃততে আসার ডাক। সঙ্গে রিসর্টে যাওয়ার পথ নির্দেশ। বস্তুত সেই নির্জন রাতে সেই পথ নির্দেশই মনে হয়েছিল সভ্যতার সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্র।
নির্জন ঠিকই কিন্তু সেই রাস্তা শব্দহীন নয়। অদ্ভুত এক শব্দজাল অামাদের ঘিরে ফেলল। একটু পরে বুঝলাম সেটা ঁঝিঁঝির ডাক। কিন্তু কলকাতার ইট কাঠের জঙ্গলে তো এত জোরে ঁঝিঝির ডাক শুনি না! কিন্তু সেই নির্জন রাতে সেই ডাক যেন আরও ভাল করে আমাদের জানিয়ে দিল, সভ্যতার অন্য দিকও এ বার ধীরে ধীরে উেন্মাচিত হচ্ছে।
পথটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। দেখলাম একটা ছোট্ট টিলার মাথায় এসে পৌছেছি। সহাস্যে অামাদের স্বাগত জানাতে হাজির ডেনিস। পথক্লান্ত যাত্রীদের ঘরে পৌছে দেওয়া থেকে শুরু করে নিজে দাড়িয়ে থেকে খাবার পরিবেশন করানো, সব কিছুতেই তার আন্তরিকতার ছাপ ছিল স্পষ্ট।
রিসর্টের সামনের ছোট্ট এক ফালি সবুজ। রাতে সেখানে দাড়িয়েই ডেনিস বললেন, ‘‘রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। সকালে উঠে খাসি পাহাড় আর দূর বাংলাদেশের সমতলভূমি দেখে মন ভাল হবেই হবে।’’
রাতে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে চলে গেলাম। মন কিন্তু প্রতীক্ষায় রইল প্রকৃতির রঙ রূপ দেখার জন্য।




No comments:

Post a Comment