Tuesday, July 1, 2014

নেপালের পোখরার আকাশচারণ

শাকুর মজিদ
পোখরা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। মূলত পর্যটনকে কেন্দ্র করেই এর বেড়েওঠা। কাঠমান্ডু, যদিওবা এ দেশের রাজধানী, তারপরও তিনটি পুরনো দরবার স্কোয়ার আর কতগুলো মন্দির ছাড়া ওখানে দেখার তেমন কিছু নেই। নেপাল বিখ্যাত হয়ে আছে তার পাহাড়গুলোর জন্য। সেই পাহাড়গুলো দেখতে, চড়তে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের আসা-যাওয়ার কারণে এই পোখরাই নেপালের পর্যটন শহরে পরিণত হয়েছে। নেপালের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটির মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ফেওয়া লেককে পাশে রেখে যে ক্ষুদ্র শহরতলিটি গড়ে উঠেছে, পর্যটকদের গিজ-গিজানি মূলত এ জায়গাটি নিয়ে। এই ছোট্ট শহরতলিটি বেশ জমজমাট। দোকানপাটের বেশির ভাগই নেপালে তৈরি জিনিসপত্রে ঠাসা। শহরতলিতে কিছু দোকানদার আর পর্যটক ছাড়া স্থানীয় তেমন লোকজন নেই। মূল পোখরা শহরে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আছে নানা বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। কিন্তু এই লেক সাইডটি একেবারেই আলাদা। একটি মাত্র বড় সড়কের দুপাশে কিছু দু-তিনতলার দালান।
পোখরায় বেশ কিছু রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের দেখা যায়। তারা আসেন অন্নপূর্ণা জয় করতে অথবা অন্নপূর্ণার গা বেয়ে চড়ে বেড়াতে। এসব ট্রেকার দীর্ঘদিন এসে থাকেন এখানে। এ কারণে বেশ কিছু ট্যুর অপারেটরের অফিস চোখে পড়ে। ট্রেকিং ছাড়াও খেচর হয়ে আকাশে উড়ে উঁচু উঁচু পর্বতের রূপ দেখার জন্য পর্যটকেদের ঝোঁক থাকে। পোখরার ছোট্ট বিমানবন্দরটি যদিও কাঠমান্ডু ও অন্য দুএকটি শহরের সঙ্গে ওড়াওড়ির যোগসূত্র তৈরি করেছে, তারপরই ছোট ছোট দুই আসনের কিছু উড়োজাহাজ নিয়ে কেউ কেউ উড়ে বেড়ান। দেড়শ ডলারে ২০ মিনিটের জন্য এমন আকাশভ্রমণও করা যায়। পোখরা বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে একজন পাইলট পেছনের আসনে একজনকে বসিয়ে উড়ে চলেন অন্নপূর্ণার দিকে। ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় তারা অনেক কাছাকাছি থেকে দেখে আসেন অন্নপূর্ণার মৎস্যপুচ্ছ গিরিশৃঙ্গটি। অতি বৃহদাকার যান্ত্রিক ফড়িংয়ের মতো এই যানটির সঙ্গে লাগানো থাকে ভিডিও ক্যামেরা। তাদের সার্বক্ষণিক ভ্রমণটুকু রেকর্ড করা থাকে এবং ট্যুর শেষে এরকম একটি ভিডিও যাত্রীদের উপহারও দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সাল থেকেই এখানে চালু হয়েছে এটি সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার জন্য ওড়ার সুযোগ আছে এখানে। আমাদের দলের কয়েকজন উড়বে চিন্তা করছে। প্যারাগ্লাইডিং তো করবেই, আলট্রা লাইট ফ্লাইটেও যাবে। কিন্তু বুকিং অফিস থেকে মুখ শুকনো করে বেরিয়ে এসে বলে, গতকালই দু-দুটি প্লেন একেবারেই গেছে। দুজন ইউরোপীয় পর্যটক, সঙ্গের দুই পাইলট_ একসঙ্গে স্পট ডেড। তাদের লাশ কীভাবে নিয়ে আসা হবে এ নিয়ে ব্যস্ত আছে তাদের কর্মকর্তারা, সুতরাং আজ আর আগামীকাল কোনো ফ্লাইট নেই। বাঁচা গেল! কেউ তবে ওই আলট্রা ফ্লাইট নিচ্ছে না। তারা এখন সবাই প্যারাগ্লাডিংয়ের জন্য খোঁজখবর নিচ্ছে। এই প্যারাগ্লাইডিংয়ের যাত্রাস্থল পোখরা সংলগ্ন সবচেয়ে উঁচু পাহাড় সারাংকোট। যে সারাংকোটে আমরা গিয়েছিলাম অন্নপূর্ণার সূর্যোদয় দেখতে, সেই সারাংকোটেরই পাঁচ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে কাপড়ের পাল ঘেরা পাখনায় ভর করে মানুষ উড়ে বেড়ায় ২০ মিনিটের মতো সময়। আমাদের দলের গোটা দশেক অতি উৎসাহী স্থপতি ইচ্ছা পোষণ করেন, তারাও এবার খেচর হবেন। এ জন্য শহরের বুকিং কাউন্টারে ১০০ ডলার দিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করলেন তারা। এক দলের সঙ্গে যুক্ত হলাম আমিও। না, আমি খেচর হব না, ওরা যারা হবে, তাদের ছবি তুলব। অচেনা মানুষদের ছবি তুলতে নানা ঝামেলা। আমার সঙ্গে আরেক দর্শক সেলিম ভাই। খেচর হবে আসিফ, বায়েজিদ, অহনা, রুম্পা। আসিফের বউ কান্তা গলা শুকিয়ে বসে আছে কাউন্টারে। একবার বলল_ আচ্ছা ওখানে দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যাওয়ার চান্স কতটুকু? 'খুব কম। বছরে এক দুটো ঘটে, যদি বাতাসের সমস্যা হয়।' কাউন্টারের মেয়েটি জবাব দেয়। কান্তা আরও মন খারাপ করে।
টেবিলের কোনায় পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফরম পূরণ করছে অহনা আর রুম্পা। অহনা এক সময় লেখা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করি, বিষয় কী? অহনার গলা শুকানো। বলে, এখানে সই করতে হবে।
অহনা একবার আমার দিকে তাকায়। আবার চোখ ফিরিয়ে কাগজের দিকে মুখ নামিয়ে সিগনেচার করা ফরমটি কাউন্টারের মেয়েটির কাছে দিয়ে দেয়। আমাকে বলে, আমার পুরো ড্রাইভটা কিন্তু আপনি রেকর্ড করবেন। যদি পড়ে গিয়ে মরেও যাই, সবাই যেন দেখে কীভাবে মরলাম।
আমাদের দলের চার নভোচারী আর তাদের জন্য চারজন দর্শককে নিয়ে দুটি ট্যাঙ্ িছুটে চলে সেই পাহাড়ের দিকে। ফেওয়া লেকের পুরো আকারটি ওখানে ভেসে উঠেছে, দেখি লাল-নীল-সবুজ-হলুদ রংয়ের কতগুলো পালতোলা ফড়িং ওড়াওড়ি করছে পাহাড়ের গা বরাবর। এর নামই তাহলে প্যারাগ্লাইডিং! এভাবে ফড়িংয়ের মতো পাখা লাগিয়ে কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া শুধু বাতাসের বেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যে আকাশে উড়তে পারে, তা কিন্তু খুব বেশি দিন আগে মানুষ জানত না। ১৯৫২ সালে এই হেকমতটি মানুষ প্রথম বের করে। ১০ বছর পর, ১৯৬২ সাল থেকে উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে মানুষ এই পাখনা দিয়ে ভাসতে ভাসতে নিচে নামা শুরু করে। নেপালে এই কৌশলের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র ১৭ বছর আগে ১৯৯৬ সালে। সারাংকোট চূড়ার এই প্যারাগ্লাইডিংয়ের দুটি কেন্দ্র। প্রতি কেন্দ্র থেকে দুটি করে ছাতা ওড়ে। সকাল-বিকাল দুই শিফটে ওড়াওড়ি চলে। বেলা ১১টায় শুরু হয় একটি, বিকাল ৩টায় অপরটি। আমাদের ওড়াওড়ি নেই, আমরা দর্শক। যারা উড়বে তাদের বুক ধুকধুক করছে। কেউ কেউ ঘন ঘন পানি খাচ্ছে। কতগুলো লোক এক একটা বস্তার ভেতর থেকে নাইলনের রশিওয়ালা এক ধরনের বিশেষ সুতা দিয়ে বানানো কাপড় মেলে ধরছে উপরে। নাইলনের রশি গোছগাছ করে ধরিয়ে দিচ্ছে পাইলটের হাতে।
বেশ কজন পাইলট সাইডলাইনে বসা। একজন আমার সামনে। তার নাম টম। ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। বেশির ভাগ পাইলটই ইউরোপীয়, কিছু আছেন ভারতীয়, দু-একজন নেপালি। টমের বয়স ৫৫। ১৪ বছর তিনি এ পেশায় আছেন। দিনে এক শিফটে কাজ করেন। ৪টার বেশি গ্লাইড নেন না কোনো দিনই। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করেন। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল বেশ মোটা বেতনে চাকরি তাদের। প্রতি ফ্লাইটের ৪০ শতাংশ তার কাছে যায়। প্রতিবার ওড়ার জন্য ৪০ ডলার। অবশ্য এ জন্য তাকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক। আড়াই বছর ট্রেনিং নিয়ে শিখেছেন এই কাজ এবং পরীক্ষায় পাস করার জন্য একে একে ৮০ জন নিকটাত্দীয় ও বন্ধুকে নিয়ে তার চড়তে হয়েছে। দুর্ঘটনা যদি কিছু ঘটেই থাকে, তবে তা যেন নিজের আত্দীয়ের ওপর দিয়েই যায়। এ জন্য এই নিয়ম। পাইলটরা এই প্যারাগ্লাইডগুলোতে দড়ি দিয়ে ধরে টেনে বাতাস নিয়ন্ত্রণ করে চলেন। তাদের সামনে থাকেন আরোহী। একজন মাত্র আরাহীকে নিয়ে তিনি ২০-২৫ মিনিট উড়বেন এই পোখরার ওপর। তার হাতের সঙ্গে লাগানো আছে একটি কাঠি। কাঠির উপরে ক্যামরা ফিট করা। পুরো যাত্রা পথটুকুই ভিডিও ক্যামেরায় বন্দী করেন তিনি। এর মধ্যে কখন ডানে যাবেন, কখন বামে, কখনোবা সামনে বা উপরে, সবটুকু নিয়ন্ত্রণ হবে তার দুহাতের রশিগুলো দিয়ে। এক এক করে আমাদের সামনে দিয়ে আকাশে উড়তে থাকেন একজন খেচর। কেউ কেউ আকাশে উড়ে উড়ে গান গাইতে থাকেন। আমি স্পষ্ট শুনছি এক চৈনিক মহিলার গান। বেশ জোরেই গাইছেন। একটু দূর হয়ে যাওয়ার পর এই প্যারাগ্লাইডারগুলোকে নানা রংয়ের চিলের মতোই মনে হয়। অনেকক্ষণ এসব দেখে হেঁটে হেঁটে একটু ঢালু দিয়ে দ্বিতীয় কেন্দ্রটিতে যাই। দেখি বায়েজিদের কোমরে বেল্ট বাঁধা হচ্ছে। এক ইউরোপীয় পাইলট তাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন, কেমন করে দৌড়ে দৌড়ে উপর থেকে নামতে হবে, দড়ি কীভাবে ধরে রাখতে হবে এসব।
বায়েজিদ তার সঙ্গে গল্প করছে। তার বিশেষ কৌতূহল প্যারাস্যুটটি নিয়ে। সে প্রায় নিশ্চিত, আকাশে ওড়া মাত্র সে দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যাবে। পড়ে যাওয়ার পর প্যারাস্যুট তাকে কিভাবে রক্ষা করবে, সে কী করে ওটা খুলবে_ এমন কিছু জানতে চাইছে। তার পাইলট তাকে খুব পাত্তা দিচ্ছে না। তার কথা হচ্ছে_ এ জন্য তো আমিই আছি। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। প্যারাস্যুট খোলার মতো যথেষ্ট উচ্চতা এখানে আছে। পাইলট বলেন, আমরা যেখানে আছি, তার থেকে নিকটতম ভূমি ১৫০০ ফুট নিচে। ১৫০০ ফুট নেমে যেতে তোমার যে সময় লাগবে, এর মধ্যেই প্যারাস্যুট খুলে যাবে, চিন্তা কর না। নিচের ভূমি যদি ৫০০ ফুট বা তার চেয়ে কম হয়, তবে কিঞ্চিত বিপদ আছে। প্যারাস্যুট খোলার আগেই তুমি পড়ে যাবে। আর এত উপর থেকে পড়লে সাধারণত কেউ বাঁচে না। বায়েজিদ বেশ নার্ভাস। তার পাইলট এটা টের পেয়ে তাকে প্রশ্ন করে_ 'তুমি কী এই প্রথমবার এটা করতে এসেছ?'
বায়েজিদ জবাব দেয়, 'না না, প্রথমবার নয়, এটাই আমার শেষ বার।' এক সময় বায়েজিদকে নিয়ে তার পাইলট পাহাড় থেকে লাফ দেয়। আমরা ট্যাঙ্ িনিয়ে ওদের অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হই। নিচের উপত্যকায় ফেওয়া হ্রদের কাছে তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়।

No comments:

Post a Comment