Thursday, July 3, 2014

ভারতের কালনা মন্দিরের দেশ

ভাগীরথীর পাড়ে ছোট্ট একটি শহর কালনা। মূলত ধান-চালের ব্যবসার সূত্রে এই শহর ক্রমশ জনিপ্রয় হয়ে ওঠে। অতীতে জলপথ ধরে ধান-চাল এখান থেকে পৌছাত দেশের বিভিন্ন স্থানে। ব্যবসায়ীদের এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক মন্দির মসজিদ। টেরাকোটার অপূর্ব কারুকাজে তৈরি বেশির ভাগ মন্দিরই বর্ধমান রাজপরিবারের তৈরি।
শহরের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে ১০৮ শিবমন্দির। শিবমন্দিরগুলি দুটি বৃত্তে সাজানো। প্রথম বৃত্তে রয়েছে ৭৪টি মন্দির। ভিতরের বৃত্তে রয়েছে ৩৪টি মন্দির। ১৮০৯ সালে মহারাজ তেজচেন্দ্রর সময়ে নির্মিত মন্দিরগুলির ভিতরে রয়েছে শ্বেতপাথর ও কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। আটচালা শৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরগুলিকে উচু জায়গা থেকে দেখলে মনে হবে পাপড়ি মেলা পদ্ম।
১০৮ শিবমিন্দেরর উল্টো দিকে রয়েছে রাজবাড়ি কমেপ্লক্স। এই কমেপ্লেক্সর মধ্যে রয়েছে ২২টি পুরনো মন্দির। এর মধ্যে কয়েকটি মন্দিরের টেরাকোটার কারুকাজ চোখ টানে। ওড়িশার রেখদেউলের আদলে তৈরি হয়েছে প্রতাপেশ্বর মন্দির। বর্ধমান মহারাজ প্রতাপচাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। মন্দিরের গায়ে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা, রাবণের দুর্গাপুজো-সহ নানান পৌরাণিক দৃশ্য খোদিত।
এ ছাড়াও রয়েছে ৬০ ফুট উচ্চতার কৃষ্ণচেন্দ্রর মন্দির। মন্দিরটি ২৫ চূড়ার। এই কমেপ্লেক্সর মধ্যে রয়েছে আরও একটি ২৫ চূড়ার মন্দির। সেটির নাম লালজী মন্দির। কথিত আছে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাজমাতা ব্রজকিশোরী দেবীর বৃন্দাবন যাত্রাকে উপলক্ষ করে মন্দিরটি নির্মিত হয়। এ ছাড়াও গিরিগোবর্ধনের মন্দির, লালজী মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দিরের কারুকার্য চোখ ধাধাবে। কমেপ্লেক্সর মধ্যে রয়েছে রংবাহারি ফুলের বাগান। পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা বাগানের পরিষেবা মনোরম।

রাজবাড়ির বাইরে সিদ্ধেশ্বরী পাড়ায় আছে আর একটি ২৫ চূড়ার মন্দির। গোপাল জীউর মন্দির নামে এই মন্দিরটি ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। এই মন্দিরটি প্রথম ধাপে ১২টি, দ্বিতীয় ধাপে ৮টি, তৃতীয় ধাপে ৪টি এবং মূল শিখরে রয়েছে ১টি চূড়া। কালনার ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশের একমাত্র এই শহরেই রয়েছে তিনটি ২৫ চূড়ার মন্দির। এ ছাড়াও জগন্নাথ বাড়ির জোড়া শিবমন্দির, অনন্ত বাসুদেব মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির নজর কাড়বে।
শহরের দঁাতনকাঠিতলায় রয়েছে হাবসি আমলের প্রাচীন মসজিদ। মসজিদ-ই-মজলিস নামে মসজিদটির গঠনশৈলী মন কাড়ে।


শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাজমাতা মন্দির, মাইজী মন্দির, জগানন্দ মঠ সহ আরও বহু মন্দির।
যাতায়াত
– বাস: উেল্টাডাঙা, এসপ্ল্যানেড, বারাসাত স্ট্যাণ্ড থেকে নদিয়া জেলার শান্তিপুরগামী বাসে চেপে শ্যামচঁাদ মোড় অথবা ডাকঘর মোড়ে প্রথমে নামতে হবে। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূর কালনা ঘাট। এ ক্ষেত্রে বাস, ট্রেকার অথবা অটো মিলবে। কালনা ঘাট থেকে নৌকায় কালনা শহরে পৌছতে হবে। ঘাটে সরকারি ফেরি চালু থাকে রাত দশটা পর্যন্ত।
– গাড়ি: গাড়িতে নিবেদিতা ব্রিজ, বালি ব্রিজ অথবা দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে এক্সেপ্রসওয়ে ধরে হুগলি জেলার গুড়াপে আসতে হবে। এখান থেকে কালনাগামী রাস্তা ধরতে হবে। অথবা দিিল্ল রোড ধরে প্রথমে মগরা, পরে সেখান থেকে এস.টি.কে.কে রোড ধরে কালনা শহরে পৌছনো যায়।
– ট্রেন: হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি অিম্বকা-কালনা স্টেশনে আসার সারা দিন ট্রেন মিলবে। অথবা হাওড়া থেকে প্রথমে ব্যাণ্ডেল স্টেশন। পরে এখান থেকে ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া লাইনের ট্রেন ধরে এই স্টেশনে পৌছনো যায়। সকালে শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও ট্রেন মেলে।
আস্তানা
– পান্থনীড়
(কালনা পুরসভা পরিচালিত)
১৩ নম্বর ওয়ার্ড, নেপপাড়া
– হোটেল প্রিয়দর্শিনী
কালনা বাস স্ট্যাণ্ডের সামনে রয়েছে এই হোটেলটি।
ফোন- ০৩৪৫৪-২৫৫৬১৫ মোবাইল- ৯৭৩২০৭৬৬৯০
খরচ- তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
আশেপাশে
বাংলার কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামব্রহ্ম বাড়ি। এখানে রয়েছে বৈষ্ণবগুরু ভগবান দাস বাবাজীর সমাধিস্থল ও সাধন ক্ষেত্র। বাড়ির একপাশে রয়েছে পাতাল গঙ্গা নামে একটি কুয়ো। জনশ্রুতি, বৃদ্ধ বয়সে ভগবান দাস গঙ্গা স্নান করতে যেতে পারতেন না। তখন মা গঙ্গা তাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে তার বাড়ি চলে আসেন।
– মহাপ্রভু পাড়ায় রয়েছে ‘নিতাই গৌর মন্দির’। এই মন্দিরে নিতাই ও গৌরের দারু মূর্তি রয়েছে। শ্রীচৈতন্য যে নৌকায় কালনায় এসেছিলেন তার বৈঠা এবং মহাপ্রভুর নিজে হাতে লেখা কিছু পুথিও এই মন্দিরে সংরক্ষিত। এ ছাড়াও এই শহরে রয়েছে নিত্যানন্দ প্রভুর শ্বশুরবাড়ি এবং বিবাহস্থল।
— জীবনের বেশির ভাগ সময়টা কালনা শহরে কাটিয়ে ছিলেন ভবা পাগলা। সাধক কবি এখানে তৈরি করেন ভবানী মন্দির। সে মন্দিরে খোদাই করা আছে সাধক কবি স্বরচিত প্রচুর কবিতা ও গান। এই শহরেই রয়েছে আর এক সাধক কবি কমলাকান্তের বাস্তু ভিটা।




– শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি খুটিয়ে দেখতে সময় লাগবে দু’দিন। এক ঘেয়েমি কাটাতে তৃতীয় দিন যাওয়া যেতে পারে শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পূর্বস্থলী ব্লকের চুপি গ্রাম। এই গ্রামে ভাগীরথীর ছেড়ে যাওয়া অংশে পঞ্চায়েত সমিতি তৈরি করেছে ‘পাখিরালয়’। দেশ-বিদেশের পরিযায়ী পাখিরা মিষ্টি জলের খোজে এইখানে পাড়ি জমায়। তবে পাখি দেখার জন্য শীতকালকে বাছাই ভাল।
– পাখিরালয়ের কাছাকাছি রয়েছে পিকনিক স্পট। এখান থেকে কাছাকাছি বিদ্যাসাগর গ্রামে রয়েছে মহাপ্রভু বাল্য শিক্ষাস্থল। এবং পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের মন্দির।
– জাহন্নগর গ্রামে গেলে দেখা মিলবে সারঙ্গ মুরারীর আশ্রম এবং চৈতন্য ভাগবৎ রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের জন্মস্থান। এই গ্রামের পাশে রয়েছে প্রাচীন চাদের বিল।

No comments:

Post a Comment