Thursday, July 3, 2014

বৈসাবিতে আমন্ত্রণ

আপনি কি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়েছেন? আসবেন না আদিবাসীদের বৈসাবিতে? সময় ও সুযোগ হলে চলে চলে আসুন রাঙামাটি, বান্দরবান অথবা খাগড়াছড়িতে। বাংলা বছরের শেষ দিনটি সবার জন্য সব আদিবাসীর বাড়ির দুয়ার থাকে খোলা। সারা দিন চলে আপ্যায়ন ও খানাপিনা। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে, গ্রাম থেকে গ্রামে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ, শোনা যাবে ‘হে হে হু হু হু রেং’ (আনন্দ ধ্বনি)।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি। তবে উৎসবটির নাম সম্প্রদায়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবার উদ্যাপন রীতি ও সময় এক। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতির সান্নিধ্যে এসে চৈত্র সংক্রান্তির আদলে আদিবাসীরা এ উৎসবকে নিজস্ব আঙ্গিকে ধারণ করেছে।
চৈত্র মাস শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ের গাছগাছালিতে বসে একটি পাখি মধুর সুরে ডাকে বি-ঝু, বিঝু, বিঝু। এই পাখির ডাক শুনে আদিবাসীরা উৎসবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। অবশ্য এ উৎসবকে চাকমারা বিঝু নামে ডাকলেও বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকে। তবে সব সম্প্রদায়ের উৎসব উদ্যাপনের রীতি প্রায় একই। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিনে চলে উৎসব।
বৈচিত্র্যময় তিন দিন
আদিবাসীদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎসবের যেমন ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে, তেমনি উৎসবের তিনটি দিনের নামও আলাদা। ত্রিপুরারা উৎসবের প্রথম দিনকে হারি বৈসুক, দ্বিতীয় দিনকে বিসুমা ও তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল, একইভাবে মারমারা সাংগ্রাই আকনিয়াহ্, সাংগ্রাই আক্রাইনিহ্ ও লাছাইংতার এবং চাকমারা ফুলবিঝু, মূলবিঝু ও গোজ্যেপোজ্যে দিন বলে। উৎসব উদ্যাপনের সময় একই হলেও বান্দরবানের মারমা সম্প্রদায় বর্মী পঞ্জিকা অনুসারে দুই দিন পর উৎসব শুরু করে। অবশ্য রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির মারমারা চাকমা এবং ত্রিপুরাদের সঙ্গেই উৎসব উদ্যাপন করে।
উৎসবের প্রথম দিন ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এ দিন পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে ‘মা গঙ্গা’কে পূজা করে গোসল করা হয়। এ ছাড়াও পাড়ার যুবক-যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেন। অনেক এলাকায় দল বেঁধে বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকেও গোসল করানো হয়। এর পর সারা দিন প্রস্তুতি চলে পরবর্তী দিন বা উৎসবের মূল দিনের খানাপিনা আয়োজনের।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনে প্রত্যেক বাড়িতে নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। তবে ২০ থেকে ২৫ বা তারও বেশি আনাজপাতি দিয়ে তৈরি ‘পাজন’ এবং পানীয় পরিবেশন করা হয়। নানা বয়সী লোকজন সারা দিন দল বেঁধে ‘হে হু হু হু’ রেং (আনন্দ ধ্বনি) দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চাকমাদের একটা কথা প্রচলন আছে, যে ব্যক্তি কমপক্ষে ১০টি বাড়িতে বিঝু খাবে না সে পরবর্তী জনমে শূকর হয়ে জন্মাবে।
তৃতীয় দিনে দল বেধেঁ মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়। এ দিন অনেকে পাড়ার বয়স্ক মুরব্বিদের বাড়িতে ডেকে ভালো কিছু খাবার দেন। আর অনেকে উৎসবের তিন দিন মন্দির, বাড়ির আঙিনা, নদীর ঘাট, সবুজ গাছের নিচে এবং গোয়াল ঘরে বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশে মোমবাতি জ্বালান।
তবে উৎসবে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের কিছু বিশেষ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান থাকে। এর মধ্যে চাকমাদের ‘বিঝু নৃত্য’, ত্রিপুরাদের ‘গরাইয়া নৃত্য’ ও মারমাদের ‘পানি খেলা’ রয়েছে। তবে একমাত্র মারমাদের পানি খেলা ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায় আর তেমনভাবে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে না। অনেক সময় কিছু এলাকায় বিশেষভাবে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার এবং পটুয়াখালীর রাখাইন সম্প্রদায়ও বর্ষবিদায় এবং বরণ উৎসব পালন করে থাকে। তারা এ উৎসবকে ‘মাহা সাংগ্রেং’ বলে অভিহিত করে। এ ছাড়াও ভারতের আসাম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওসসহ বেশ কয়েকটি দেশে একই সময় অর্থাৎ ইংরেজি মাস এপ্রিলের ১৩-১৪ তারিখে উৎসবটি পালন করা হয় বলে বিভিন্ন গবেষকের লেখায় জানা যায়। এ উৎসব আসামে ‘বিহু’, মিয়ানমারে ‘ছিংগায়ান’ এবং থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’ নামে পরিচিত। কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে উৎসবটি সব দেশে পালনের রীতি একই বলে জানা যায়।
বৈসাবিকে উপলক্ষ করে এ সময়টা পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে আসতে পারেন। উৎসবমুখর পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কটা দিন ভালোই লাগবে।

No comments:

Post a Comment