ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁদের সঙ্গে এই নামটির
পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যাঁরা দেখেননি, তাঁদের জন্য জানাই,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ফরাসি কথাসাহিত্যিক পিয়েরে বোলের
(১৯১২—১৯৯৪) উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি তৈরি করেছিলেন পরিচালক ডেভিড লিন। এলেক
গিনেস, উইলিয়াম হোল্ডেন আর জ্যাক হকিন্স অভিনীত ছবিটি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা
(এলেক গিনেস), শ্রেষ্ঠ পরিচালনা আর সেরা ছবিসহ ১৯৫৭ সালের মোট সাতটি অস্কার
পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। ছবিটি দেখতে দেখতে অনেক দর্শক একসময় নিজের অজান্তে
ভাবতে শুরু করেন যে ছবিটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। এ রকম ভাবার কারণ
বোধকরি পিয়ের বোলের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত উপন্যাসটি। উল্লেখ্য, তিনি
নিজেও ছিলেন একদা যুদ্ধবন্দী। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তিনি প্যারিসে ফিরে গিয়ে
লেখালেখি শুরু করেন। সে সময় যুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেন ব্রিজ
অন দ্য রিভার কাওয়াই (১৯৫২)। বইটি বিশ্বব্যাপী বেস্টসেলার হিসেবে লাখ লাখ
কপি বিক্রি হয়। চিত্রায়িত হওয়ার পর এটি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্যও একাডেমি
পুরস্কার পায়, যদিও চিত্রনাট্য তিনি লেখেননি; লেখার প্রশ্নও ওঠে না, কারণ
তিনি ইংরেজি জানেন না। অস্কারের ইতিহাসে নাকি সংক্ষিপ্ততম ধন্যবাদজ্ঞাপক
ভাষণটি ছিল তাঁর, ‘মার্সি’ অর্থাত্ ধন্যবাদ। তবে ছবিটির ইংরেজি
চিত্রনাট্যকার দুজন—কার্ল ফোরম্যান ও মাইকেল উইলসনকে কমিউনিস্ট সমর্থক
হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও আমেরিকার মোশন পিকচার একাডেমি ১৯৮৪ সালে এ
দুজনের নাম মূল ছবির পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহর থেকে ঘণ্টা দুয়েকের দূরত্বে কাঞ্চনাবুরি শহরে কাওয়াই নদীর ওপরের যে সেতু দিয়ে থাইল্যান্ড-বার্মা রেল সড়কটি চলে গেছে, সেটিই ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই। মজার ব্যাপার, ভিয়েতনামের ওপর বহু ছবির শুটিং থাইল্যান্ডে হলেও থাইল্যান্ডের নদীর ওপর রেলসেতুর নামে অস্কারজয়ী ছবিটি কিন্তু থাইল্যান্ডে চিত্রায়িত হয়নি, এটির শুটিং হয়েছিল শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ডে।
আমাদের গাইড মেয়েটি গজদাঁত বের করে হাসা ছাড়া আর কিছু জানে বলে মনে হলো না। তবে সার্কাসের বাঘ গলে যেতে পারে এমন বিশাল কানের রিং নেড়ে নিজের নামটি সে বলতে পেরেছিল—লেক। রমণীয় উপস্থিতিসহ ভ্রমণসঙ্গিনী হওয়াই ছিল ওর একমাত্র ভূমিকা। ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে চলতে চলতে বিনা নোটিশে একপাশে গাড়ি রেখে ড্রাইভার এবং মেয়েটি যখন নামার তোড়জোড় করে, তখনো আমরা বুঝতে পারি না যে কাঞ্চনাবুরি সমর সমাধি দেখানোর জন্য আমাদের ওখানে থামানো হয়েছে। অবশ্য এ রকম ওয়ার সেমেট্রি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লায়ও রয়েছে।
জাপানি সেনা, যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ সরবরাহের জন্য থাইল্যান্ড-বার্মা রেলপথ নির্মাণের সময় মারা যাওয়া প্রায় ১৬ হাজার কমনওয়েলথ, ওলন্দাজ এবং আমেরিকান যুদ্ধবন্দীকে রেলপথের আশপাশেই কবর দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে এদের কবরগুলো চিহ্নিত করে মোট তিনটি সমাধিতে স্থানান্তর করা হয়, থাইল্যান্ডের চুংকাই এবং কাঞ্চনাবুরি, আর বার্মার থানবুজায়াত সমর সমাধিতে। এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে বড় কাঞ্চনাবুরির সমাধি।
১৯৪৩ সালের মে-জুন মাসে কলেরায় মারা যাওয়া শ তিনেক সৈন্যের দাহকৃত দেহভস্মও এই সমাধির দুটি কবরে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কাঞ্চনাবুরি সমর সমাধিতে আছে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মোট পাঁচ হাজার ৮৪ জন এবং পর্তুগালের এক হাজার ৮৯৬ জন সৈনিকের কবর।
সমাধিতে ঢোকার মুখে ছোট গেটহাউসে তিনটি আর্চওয়ে, তার ভেতরের দেয়ালে উত্কীর্ণ রয়েছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মারা যাওয়া ১১ জন ভারতীয় মুসলিম সৈনিকের নাম—যাঁদের থাইল্যান্ডের বিভিন্ন গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল; তবে সেসব আর আলাদা করে সংরক্ষণ করা যায়নি। এই ১১ জনের নাম হচ্ছে: ল্যান্স নায়েক করম খান, সেপার (সমর প্রকৌশলী) কাদির খান, ল্যান্স নায়েক নিয়ানামুথি, সিপাহি আবদুল খালিক, মনজুর ইলাহি, ফতেহ খান, আমির, সুরুজদিন, ল্যান্স দফাদার শাহ মুহাম্মাদ,আমির আহমাদ ও শাব্বির।
সমাধিক্ষেত্রটি আমাদের দেশের দুটোর মতোই, তবে আয়তনে অনেক বড়। মাঝখানে উঁচু ক্রসচিহ্নের ভাস্কর্য, তার চারপাশে নাম লেখা সারি সারি সমাধিপাথরের সারি তৈরি করেছে জ্যামিতিক প্যাটার্ন। সবুজ ঘাসে পানি ছিটাচ্ছে কয়েকটা স্প্রিঙ্কলার। কাওয়াই রেল সেতুর নির্মাণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে এই সমাধিক্ষেত্রের একটা সরাসরি যোগসূত্র আছে বলেই এখানে নামা। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলে লেক গজদাঁত দেখিয়ে হাসলে আকিক পাথরের মতো ওর সফেদ গজদাঁতে দুপুরের রোদ ঝিকিয়ে ওঠে। ওর বিনম্র বুকের ওপর নেমে আসা কালো রং করা সরল রেশমের মতো চুল মৃদু বাতাসে দোল খায়, সংক্ষিপ্ত স্কার্টের ঝুল বরাবর উঠে আসা ঊরু কামড়ে ধরা কালো স্টকিংয়ের ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত হয় প্রচ্ছন্ন উজ্জ্বলতা।
১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরে মিত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জাপানি বাহিনী ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে নেয়। সেখানে সৈন্য ও রসদ পাঠানোর জন্য জাপানিদের সমুদ্রপথে মালাক্কা প্রণালী ও আন্দামান সাগর হয়ে আসতে হতো। দূরত্ব ছাড়াও মিত্র বাহিনীর সাবমেরিন ছিল জাপানিদের জন্য সমুদ্রপথের এক বড় বিপদ। ফলে বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড থেকে রেলপথের কথা ভাবা হয়। অবশ্য এই রেলপথটির জন্য বহু আগেই বার্মায় ব্রিটিশ সরকার একবার জরিপ করিয়েছিল, কিন্তু দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল আর বহু নদীর কারণে প্রকল্পটি আর এগোয়নি। জাপানি বাহিনী শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বার্মার থানবুজায়াত থেকে থাইল্যান্ডের নং প্লাদুক পর্যন্ত ৪১৫ কিলোমিটার বিপজ্জনক দীর্ঘ পথটিতে রেললাইন বসানোর দুঃসাহসিক প্রকল্পটি গ্রহণ করে। পরিবহন-সুবিধা ছাড়াও বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে হানা দেওয়াও ছিল জাপানিদের আরেক উদ্দেশ্য। এই কাজে যুদ্ধবন্দীদের অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তাতে প্রায় ১৬ হাজার যুদ্ধবন্দী মারা যায়। সে কারণে রেল লাইনটির নাম হয়ে যায় ‘মরণ রেলপথ’ (ডেথ রেলওয়ে)। হিসেব করলে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটার রাস্তার জন্য প্রাণ দিয়েছে ৩৮ জন যুদ্ধবন্দী অথবা প্রতিটি রেলওয়ে স্লিপারের বদলে একটা করে লাশ। এদের মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টি, অসুস্থতা ও অত্যধিক পরিশ্রমের কারণে। বন্দীদের খাবার ছিল দিনে দুই বেলা—ভাত আর লবণসেদ্ধ সবজি। সামান্য অপরাধ বা গাফিলতির জন্য ছিল মারাত্মক শাস্তি। ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই ছবিতে কেবল রেলসেতু নির্মাণের সময়কে ধরা হলেও নিপীড়নের কিছু কিছু বিষয় সিনেমাটিতে উঠে আসে।
জেনেভা কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে যুদ্ধবন্দীদের ওপর অনৈতিক দুর্ব্যবহার ও নিপীড়নের একটা বিশ্বাসযোগ্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে বের করা হয় যে মিত্র বাহিনীর সহজ আত্মসমর্পণ জাপানিদের কাছে কাপুরোষোচিত মনে হয়েছিল। এ রকম অসহায় আত্মসমর্পণের চেয়ে আত্মহত্যা (হারিকিরি বা সেপুকু) বরং শ্রেয়তর ছিল—এটাই ছিল জাপানিদের মনোভাব।
প্রথম জরিপের সময় ধারণা করা হয়েছিল, রেললাইন বসানোর কাজে সময় নেবে বছর পাঁচেক। কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের অতিরিক্ত খাটিয়ে মাত্র দেড় বছরেরও কম সময়ে লাইনটি চালু করা হয়। ন্যূনতম সময়ে কাজটি শেষ করার জন্য জাপানিরা এতই মরিয়া ছিল যে যুদ্ধবন্দীদের ভালোমন্দ দেখার বিন্দুমাত্র প্রয়াস তাদের ছিল না। কাজ শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যে অতিরিক্ত শ্রম এবং রোগ ও মহামারির কারণে যুদ্ধবন্দীদের কর্মক্ষমতা এতই কমে যায় যে সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য জাপানিদের প্রায় দুই লাখ এশীয় শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। এদের মধ্যে ছিল চীনা, মালয়েশীয়, তামিল ও বর্মী। এদের দুরবস্থা ছিল যুদ্ধবন্দীদের চেয়েও খারাপ। এ কারণে প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক মারা যায়। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা দেড় লাখের কম হবে না। কারণ এসব শ্রমিকের কোনো রেকর্ড রাখা হতো না।
মরণ রেলপথটির কাজ শুরু হয় ১৯৪২ সালের জুন মাসে বার্মা ও থাইল্যান্ডের উভয় প্রান্ত থেকে। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে থাইল্যান্ডের কায়েং খোইথাতে এসে উভয় প্রান্তের লাইন মিলিত হয়। তবে রেললাইনটির পুরো নির্মাণকাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাওয়াই নদীর ওপর রেল সেতুটি। আমরা নদীটির নাম কাওয়াই জানলেও স্থানীয় উচ্চারণে এটির নাম কোয়ে।
সমর সমাধি থেকে কাওয়াই ব্রিজের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ব্রিজের কাছে এসে একটা পার্কিং লটে গাড়ি রেখে লেক আর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরে। এটির অন্য নাম জিথ মিউজিয়াম। মরণ রেলপথ তৈরির সময় মূলত যেসব দেশের যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছিল, সে দেশগুলোর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে (জাপানের জে, ইংল্যান্ডের ই, অস্ট্রেলিয়ার এ, থাইল্যান্ডের টি ও হল্যান্ডের এইচ) জাদুঘরটির নামকরণ। জাদুঘরে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে আজদাহার মতো আস্ত এক রেল ইঞ্জিন। আমরা যেগুলোকে কয়লা-ইঞ্জিন বলে চিনি, সেরকম ইঞ্জিনটির পুরোটাই জং ধরা, পাশ থেকে ক্ষয়ে গেছে শরীরের কিছু অংশ। ইঞ্জিনের গায়ে বড় একটা জাপানি পতাকা টানানো, সামনে-পেছনে ইতালি, জর্ডান, বেলজিয়াম, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, কানাডা, কলাম্বিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মিশরসহ আরও অনেক দেশের ছোট ছোট পতাকা দড়িতে ঝোলান থাকায় বেশ উত্সব-উত্সব ভাব। তবে রেলের ইঞ্জিনটির দুরবস্থার জন্য সবকিছু যেন মার খেয়ে গেছে। ইঞ্জিনের গায়ে সাদা রং দিয়ে থাই ও ইংরেজিতে লেখা—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা যুদ্ধকে বার্মা এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে গোলাবারুদ আনা-নেওয়ার জন্য এই ট্রেনটি ব্যবহার করত। ট্রেনের ওপর দাঁড়িয়ে যে বিনা পয়সায় ছবি তোলা যায়, সেই ঘোষণাও সাঁটানো আছে ওটার গায়ে। বিশ্বযুদ্ধের এ রকম একটা স্মারকের হতশ্রী অবস্থা বিস্ময়কর বৈকি। কোনো সংস্কার কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ না করার ফলে মরচে ধরে ট্রেনটির পুরোটাই হয়তো একসময় ক্ষয়ে যাবে।
আমরা যখন ট্রেনটি ঘুরেফিরে দেখি, তখন লেক আর ড্রাইভারটি সামনের একটি বেঞ্চ দখল করে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। টিকিট কেটে জাদুঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বেলা চড়ে যায়। বিশ্বযুদ্ধের স্মারকগুলো সযত্ন সংরক্ষণের প্রয়াস ভেতরেও অনুপস্থিত দেখা গেল। দোতলার খোলা ছাদের ওপর থেকে সাদামাটা কাওয়াই ব্রিজটির সম্পূর্ণ দৃশ্য চোখে পড়ে। দেখতে সাদামাটা হলেও অসাধারণ ফিল্মটির কল্যাণে এটি আর সাধারণ কোনো রেলসেতু নেই; এটার নাম ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই হলেও ঠিক এ ব্রিজটা কিন্তু যুদ্ধবন্দীরা তৈরি করেনি। ব্রিজের ইস্পাতের কাঠামো ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে তুলে এনে কাওয়াই নদীর ওপর বসানো হয়। তবে সিনেমায় কাঠের যে ব্রিজ তৈরি এবং শেষে গেরিলা অ্যামবুশে ধ্বংস করা দেখানো হয়, সেটিও ছিল বর্তমান ব্রিজটির পাশে, অর্থাত্ পাশাপাশি দুটি ব্রিজই প্রায় একই সময় ছিল। কাঠেরটি ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে মিত্র বাহিনীর বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর মাত্র দুই মাস পর আরেক হামলায় এখন চালু সেতুটিরও তিনটি স্প্যান ভেঙে পড়ে। মজার ব্যাপার, দুটি ব্রিজের নির্মাণকাজও শেষ হয়েছিল ঠিক দুই মাসের ব্যবধানে। সেদিন মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান গর্জন তুলে কাঞ্চনাবুরির আকাশে যখন শিকারি বাজের মতো চক্কর দিচ্ছিল, তখন জাপানিরা যুদ্ধবন্দীদের গাদা করে নিয়ে গিয়ে ব্রিজের ওপর লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বিমানের উদ্দেশে হাত নাড়ানোর নির্দেশ দেয়, যাতে মিত্র বাহিনীর বিমান ব্রিজের ওপর বোমা ফেলার আগে দুবার চিন্তা করে। প্লেনগুলো নিচু হয়ে ব্রিজের ওপর উড়ে আসার পরই নিরস্ত্র বন্দীরা বুঝতে পারেন, মৃত্যুর কতখানি মুখোমুখি তাঁরা। স্বপক্ষের এতজন বন্দীকে দেখেও ব্রিজ ধ্বংসের দায়িত্ব বিস্মৃত হয় না মিত্র বাহিনীর পাইলট। প্লেনের পেট উজাড় করে নির্ভুল নিশানায় বোমাগুলো ছেড়ে দিলে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে সেতুর তিনটি স্প্যান, এর সঙ্গে নদীর পানিতে হারিয়ে যায় শত শত বন্দীর মৃতদেহ। তাঁদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল কাওয়াই, আর গলিত মৃতদেহের কারণে পরের কয়েক দিনের জন্য সম্পূর্ণ অপেয় হয়ে গিয়েছিল তার জল। যুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যান তিনটি মেরামত করা হয়েছিল।
জাদুঘরের ভেতর রয়েছে যুদ্ধের সময় জাপানিদের ব্যবহূত জিপ গাড়ি, এর ভেতর জাপানি সেনা অফিসারের মূর্তি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি, মোটরসাইকেল, বোমার খোল, পত্রিকার খবরের কাটিং—এসব। অস্ত্রধারী জাপানি সেনাদের প্রহরায় রেললাইনে কর্মরত হাড়জিরজিরে শরীরের প্রায়-উলঙ্গ যুদ্ধবন্দীদের ভাস্কর্যমূর্তি দেখে তাদের দুরবস্থার কথা কিছুটা আঁচ করা যায়। জাদুঘর ভবনের মাঝখানে খোলা জায়গায় আমাদের মালগাড়ির মতো একটা রেলের বগি, সেটার দরজায় গরাদ লাগানো, ভেতরে কৌপীন পরা এক যুদ্ধবন্দীর মূর্তি। জাদুঘরে জাপানি দখলদারি, অবস্থান ও তাদের অত্যাচার-নিপীড়নের নানা স্মারকচিহ্ন ও নিদর্শন সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। লম্বা বাঁশের ব্যারাকে যুদ্ধবন্দীদের যে মানবেতরভাবে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল; সাজানো আছে তার অনেক মর্মস্পর্শী আলোকচিত্র। একটি দেয়ালের গায়ে সারি সারি সাজানো রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমর-নেতাদের মূর্তি। এক জায়গায় কাচের ঘেরার ভেতর রয়েছে গণকবর থেকে উদ্ধার করা এশীয় শ্রমিকদের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। দোতলার প্রায় পুরো একটা উইং জুড়ে রয়েছে জাপানি সৈন্যদের ব্যবহার করা হাজারো জিনিসপত্র। এগুলোর মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ থেকে শুরু করে মাউথ অর্গান, টাইপরাইটার ও মশারি পর্যন্ত। জাদুঘরটি রকমারি স্মারকে প্রায় ঠাসা, তবে সংরক্ষণব্যবস্থা খুব সুবিধার নয়। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না করলে কালের আবর্তে বহু জিনিস নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সাধারণত জাদুঘরে স্মারক ও নিদর্শনগুলো যেভাবে যত্ন ও সংরক্ষণের মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়, এখানে সে রকম যত্নের বালাই নেই বলে মনে হলো।
আমরা যখন জাদুঘর থেকে বের হয়ে আসি, তখনো সেই বেঞ্চের ওপর ঠাঁয় বসে আছে লেক আর ড্রাইভারটি। এদের পায়ে কী খিলও ধরে না! আমরা ভাবি। লেক আমাদের দেখে উঠে এসে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে, লাঞ্চ? আমাদের সায় পেয়ে দুজন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আমাদের পথ দেখিয়ে যেতে যেতে রেললাইন পেরিয়ে নিয়ে যায় একদম নদীর ওপর ভাসমান রেস্তোরাঁয়। সেখান থেকে সামান্য উজানে কাওয়াই ব্রিজের বিশাল কাঠামো জ্যামিতিক নকশায় নীল আকাশের পটভূমিতে আঁকা। পাশাপাশি তিনটি রেস্তোরাঁ ভাসছে কাওয়াই নদীর শান্ত বহমান স্রোতের ওপর—এর মধ্যে ঠাসা ট্যুরিস্ট। আমাদের রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দিয়ে ওরা দুজন মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে ওদের লাঞ্চ করতে বলব, কিন্তু ওদের আর টিকিটিও দেখা যায় না। থাই খাবার অচেনা নয় বলে খেতে আমাদের তেমন বেগ পেতে হয় না। স্যুপ, থাই ওমলেট, শাক, রাইস—প্রায় সবকিছু মিশিয়ে বাঙালি খাবারের মতো খেতে শুরু করলে পরিবেশনকারী মেয়েগুলো অন্য টেবিলের তদারকি ভুলে গিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাদের খাওয়া দেখে। দেশ থেকে ক্রমাগত কয়েক দিন বাইরে থাকলে দেশি খাবারের মতো কিছু খেতে ইচ্ছে করে বলে আমরা ওদের কৌতূহলী দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে আমাদের মতো করে খেতে থাকি।
খাওয়া শেষ হলে আমরা যখন রেস্তোরাঁর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের স্রোত থেকে চোখ তুলে দূরের সবুজ বনানীর দৃশ্য দেখে পর্যটকসুলভ উচ্ছ্বাসে মগ্ন হই, তখন লেক আর ড্রাইভারটি কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়। আমাদের বাচ্চা ছেলের মতো ট্রেনে চড়ার লোভ দেখিয়ে ওখান থেকে বের করে আনে ওরা। খোলা স্টেশনের প্লাটফরমের পাশে টিকিট কাটার গুমটি দেখিয়ে জানায়, ওখান থেকে ট্রেনে চড়ে কাওয়াই ব্রিজ পেরিয়ে আমরা ওপার থেকে ঘুরে আসতে পারি। টিকিট কাটতে কাটতে চারপাশ খোলা ট্যুরিস্ট ট্রেন প্লাটফরমে এসে যায়। বিকেলের তীর্যক রোদ টয় ট্রেনের ভেতর তেরচা বর্শার মতো ঢুকে পড়লে গুড়গুড় করে চলতে শুরু করে ট্রেন। শিশুপার্কের টয় ট্রেনের মতো রেলগাড়িটা যখন কাওয়াই ব্রিজের ওপর উঠে পড়ে, ট্রেনভর্তি যাত্রীদের সহর্ষ হুল্লোড় কাওয়াই নদীর শান্তজলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন। ট্রেন চলার সময় পদচারীদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য ব্রিজের ওপর কিছুদূর পরপর ঝুল-বারান্দার মতো রেলিং ঘেরা জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে এক বেহালাবাদক ছড় বোলাতে বোলাতে প্রায় ঝুঁকে পড়ে। ট্রেনের শব্দে তার বেহালার সুরের মূর্ছনা ঢেকে যায়। ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেনটি ঢালু রেল সড়কের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে যেতে একটা পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে থামে, তারপর আবার ফিরতি পথে চলতে শুরু করে।
যুদ্ধবন্দী মিত্র বাহিনীর রক্ত আর ঘামে নির্মিত রেল সড়কের ওপর দিয়ে ফিরে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে যায়। নিস্তরঙ্গ কাওয়াই নদীর পানির আয়নায় পড়ন্ত বিকেলের রোদ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ব্রিজের কাছাকাছি স্টেশনে নেমে পড়ার পর সেতুটার দিকে ফিরে তাকাই, ট্যুরিস্টদের এলোমেলো পদচারণে আর মৃদু কোলাহল ছাপিয়ে কানে বাজতে থাকে ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই ছবিতে যুদ্ধবন্দী সৈনিকদের কুচকাওয়াজের তালে তালে শিস দিয়ে বাজানো সুর।
থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহর থেকে ঘণ্টা দুয়েকের দূরত্বে কাঞ্চনাবুরি শহরে কাওয়াই নদীর ওপরের যে সেতু দিয়ে থাইল্যান্ড-বার্মা রেল সড়কটি চলে গেছে, সেটিই ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই। মজার ব্যাপার, ভিয়েতনামের ওপর বহু ছবির শুটিং থাইল্যান্ডে হলেও থাইল্যান্ডের নদীর ওপর রেলসেতুর নামে অস্কারজয়ী ছবিটি কিন্তু থাইল্যান্ডে চিত্রায়িত হয়নি, এটির শুটিং হয়েছিল শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ডে।
আমাদের গাইড মেয়েটি গজদাঁত বের করে হাসা ছাড়া আর কিছু জানে বলে মনে হলো না। তবে সার্কাসের বাঘ গলে যেতে পারে এমন বিশাল কানের রিং নেড়ে নিজের নামটি সে বলতে পেরেছিল—লেক। রমণীয় উপস্থিতিসহ ভ্রমণসঙ্গিনী হওয়াই ছিল ওর একমাত্র ভূমিকা। ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে চলতে চলতে বিনা নোটিশে একপাশে গাড়ি রেখে ড্রাইভার এবং মেয়েটি যখন নামার তোড়জোড় করে, তখনো আমরা বুঝতে পারি না যে কাঞ্চনাবুরি সমর সমাধি দেখানোর জন্য আমাদের ওখানে থামানো হয়েছে। অবশ্য এ রকম ওয়ার সেমেট্রি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লায়ও রয়েছে।
জাপানি সেনা, যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ সরবরাহের জন্য থাইল্যান্ড-বার্মা রেলপথ নির্মাণের সময় মারা যাওয়া প্রায় ১৬ হাজার কমনওয়েলথ, ওলন্দাজ এবং আমেরিকান যুদ্ধবন্দীকে রেলপথের আশপাশেই কবর দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে এদের কবরগুলো চিহ্নিত করে মোট তিনটি সমাধিতে স্থানান্তর করা হয়, থাইল্যান্ডের চুংকাই এবং কাঞ্চনাবুরি, আর বার্মার থানবুজায়াত সমর সমাধিতে। এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে বড় কাঞ্চনাবুরির সমাধি।
১৯৪৩ সালের মে-জুন মাসে কলেরায় মারা যাওয়া শ তিনেক সৈন্যের দাহকৃত দেহভস্মও এই সমাধির দুটি কবরে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কাঞ্চনাবুরি সমর সমাধিতে আছে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মোট পাঁচ হাজার ৮৪ জন এবং পর্তুগালের এক হাজার ৮৯৬ জন সৈনিকের কবর।
সমাধিতে ঢোকার মুখে ছোট গেটহাউসে তিনটি আর্চওয়ে, তার ভেতরের দেয়ালে উত্কীর্ণ রয়েছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মারা যাওয়া ১১ জন ভারতীয় মুসলিম সৈনিকের নাম—যাঁদের থাইল্যান্ডের বিভিন্ন গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল; তবে সেসব আর আলাদা করে সংরক্ষণ করা যায়নি। এই ১১ জনের নাম হচ্ছে: ল্যান্স নায়েক করম খান, সেপার (সমর প্রকৌশলী) কাদির খান, ল্যান্স নায়েক নিয়ানামুথি, সিপাহি আবদুল খালিক, মনজুর ইলাহি, ফতেহ খান, আমির, সুরুজদিন, ল্যান্স দফাদার শাহ মুহাম্মাদ,আমির আহমাদ ও শাব্বির।
সমাধিক্ষেত্রটি আমাদের দেশের দুটোর মতোই, তবে আয়তনে অনেক বড়। মাঝখানে উঁচু ক্রসচিহ্নের ভাস্কর্য, তার চারপাশে নাম লেখা সারি সারি সমাধিপাথরের সারি তৈরি করেছে জ্যামিতিক প্যাটার্ন। সবুজ ঘাসে পানি ছিটাচ্ছে কয়েকটা স্প্রিঙ্কলার। কাওয়াই রেল সেতুর নির্মাণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে এই সমাধিক্ষেত্রের একটা সরাসরি যোগসূত্র আছে বলেই এখানে নামা। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলে লেক গজদাঁত দেখিয়ে হাসলে আকিক পাথরের মতো ওর সফেদ গজদাঁতে দুপুরের রোদ ঝিকিয়ে ওঠে। ওর বিনম্র বুকের ওপর নেমে আসা কালো রং করা সরল রেশমের মতো চুল মৃদু বাতাসে দোল খায়, সংক্ষিপ্ত স্কার্টের ঝুল বরাবর উঠে আসা ঊরু কামড়ে ধরা কালো স্টকিংয়ের ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত হয় প্রচ্ছন্ন উজ্জ্বলতা।
১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরে মিত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জাপানি বাহিনী ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে নেয়। সেখানে সৈন্য ও রসদ পাঠানোর জন্য জাপানিদের সমুদ্রপথে মালাক্কা প্রণালী ও আন্দামান সাগর হয়ে আসতে হতো। দূরত্ব ছাড়াও মিত্র বাহিনীর সাবমেরিন ছিল জাপানিদের জন্য সমুদ্রপথের এক বড় বিপদ। ফলে বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড থেকে রেলপথের কথা ভাবা হয়। অবশ্য এই রেলপথটির জন্য বহু আগেই বার্মায় ব্রিটিশ সরকার একবার জরিপ করিয়েছিল, কিন্তু দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল আর বহু নদীর কারণে প্রকল্পটি আর এগোয়নি। জাপানি বাহিনী শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বার্মার থানবুজায়াত থেকে থাইল্যান্ডের নং প্লাদুক পর্যন্ত ৪১৫ কিলোমিটার বিপজ্জনক দীর্ঘ পথটিতে রেললাইন বসানোর দুঃসাহসিক প্রকল্পটি গ্রহণ করে। পরিবহন-সুবিধা ছাড়াও বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে হানা দেওয়াও ছিল জাপানিদের আরেক উদ্দেশ্য। এই কাজে যুদ্ধবন্দীদের অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তাতে প্রায় ১৬ হাজার যুদ্ধবন্দী মারা যায়। সে কারণে রেল লাইনটির নাম হয়ে যায় ‘মরণ রেলপথ’ (ডেথ রেলওয়ে)। হিসেব করলে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটার রাস্তার জন্য প্রাণ দিয়েছে ৩৮ জন যুদ্ধবন্দী অথবা প্রতিটি রেলওয়ে স্লিপারের বদলে একটা করে লাশ। এদের মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টি, অসুস্থতা ও অত্যধিক পরিশ্রমের কারণে। বন্দীদের খাবার ছিল দিনে দুই বেলা—ভাত আর লবণসেদ্ধ সবজি। সামান্য অপরাধ বা গাফিলতির জন্য ছিল মারাত্মক শাস্তি। ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই ছবিতে কেবল রেলসেতু নির্মাণের সময়কে ধরা হলেও নিপীড়নের কিছু কিছু বিষয় সিনেমাটিতে উঠে আসে।
জেনেভা কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে যুদ্ধবন্দীদের ওপর অনৈতিক দুর্ব্যবহার ও নিপীড়নের একটা বিশ্বাসযোগ্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে বের করা হয় যে মিত্র বাহিনীর সহজ আত্মসমর্পণ জাপানিদের কাছে কাপুরোষোচিত মনে হয়েছিল। এ রকম অসহায় আত্মসমর্পণের চেয়ে আত্মহত্যা (হারিকিরি বা সেপুকু) বরং শ্রেয়তর ছিল—এটাই ছিল জাপানিদের মনোভাব।
প্রথম জরিপের সময় ধারণা করা হয়েছিল, রেললাইন বসানোর কাজে সময় নেবে বছর পাঁচেক। কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের অতিরিক্ত খাটিয়ে মাত্র দেড় বছরেরও কম সময়ে লাইনটি চালু করা হয়। ন্যূনতম সময়ে কাজটি শেষ করার জন্য জাপানিরা এতই মরিয়া ছিল যে যুদ্ধবন্দীদের ভালোমন্দ দেখার বিন্দুমাত্র প্রয়াস তাদের ছিল না। কাজ শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যে অতিরিক্ত শ্রম এবং রোগ ও মহামারির কারণে যুদ্ধবন্দীদের কর্মক্ষমতা এতই কমে যায় যে সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য জাপানিদের প্রায় দুই লাখ এশীয় শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। এদের মধ্যে ছিল চীনা, মালয়েশীয়, তামিল ও বর্মী। এদের দুরবস্থা ছিল যুদ্ধবন্দীদের চেয়েও খারাপ। এ কারণে প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক মারা যায়। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা দেড় লাখের কম হবে না। কারণ এসব শ্রমিকের কোনো রেকর্ড রাখা হতো না।
মরণ রেলপথটির কাজ শুরু হয় ১৯৪২ সালের জুন মাসে বার্মা ও থাইল্যান্ডের উভয় প্রান্ত থেকে। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে থাইল্যান্ডের কায়েং খোইথাতে এসে উভয় প্রান্তের লাইন মিলিত হয়। তবে রেললাইনটির পুরো নির্মাণকাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাওয়াই নদীর ওপর রেল সেতুটি। আমরা নদীটির নাম কাওয়াই জানলেও স্থানীয় উচ্চারণে এটির নাম কোয়ে।
সমর সমাধি থেকে কাওয়াই ব্রিজের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ব্রিজের কাছে এসে একটা পার্কিং লটে গাড়ি রেখে লেক আর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরে। এটির অন্য নাম জিথ মিউজিয়াম। মরণ রেলপথ তৈরির সময় মূলত যেসব দেশের যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছিল, সে দেশগুলোর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে (জাপানের জে, ইংল্যান্ডের ই, অস্ট্রেলিয়ার এ, থাইল্যান্ডের টি ও হল্যান্ডের এইচ) জাদুঘরটির নামকরণ। জাদুঘরে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে আজদাহার মতো আস্ত এক রেল ইঞ্জিন। আমরা যেগুলোকে কয়লা-ইঞ্জিন বলে চিনি, সেরকম ইঞ্জিনটির পুরোটাই জং ধরা, পাশ থেকে ক্ষয়ে গেছে শরীরের কিছু অংশ। ইঞ্জিনের গায়ে বড় একটা জাপানি পতাকা টানানো, সামনে-পেছনে ইতালি, জর্ডান, বেলজিয়াম, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, কানাডা, কলাম্বিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মিশরসহ আরও অনেক দেশের ছোট ছোট পতাকা দড়িতে ঝোলান থাকায় বেশ উত্সব-উত্সব ভাব। তবে রেলের ইঞ্জিনটির দুরবস্থার জন্য সবকিছু যেন মার খেয়ে গেছে। ইঞ্জিনের গায়ে সাদা রং দিয়ে থাই ও ইংরেজিতে লেখা—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা যুদ্ধকে বার্মা এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে গোলাবারুদ আনা-নেওয়ার জন্য এই ট্রেনটি ব্যবহার করত। ট্রেনের ওপর দাঁড়িয়ে যে বিনা পয়সায় ছবি তোলা যায়, সেই ঘোষণাও সাঁটানো আছে ওটার গায়ে। বিশ্বযুদ্ধের এ রকম একটা স্মারকের হতশ্রী অবস্থা বিস্ময়কর বৈকি। কোনো সংস্কার কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ না করার ফলে মরচে ধরে ট্রেনটির পুরোটাই হয়তো একসময় ক্ষয়ে যাবে।
আমরা যখন ট্রেনটি ঘুরেফিরে দেখি, তখন লেক আর ড্রাইভারটি সামনের একটি বেঞ্চ দখল করে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। টিকিট কেটে জাদুঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বেলা চড়ে যায়। বিশ্বযুদ্ধের স্মারকগুলো সযত্ন সংরক্ষণের প্রয়াস ভেতরেও অনুপস্থিত দেখা গেল। দোতলার খোলা ছাদের ওপর থেকে সাদামাটা কাওয়াই ব্রিজটির সম্পূর্ণ দৃশ্য চোখে পড়ে। দেখতে সাদামাটা হলেও অসাধারণ ফিল্মটির কল্যাণে এটি আর সাধারণ কোনো রেলসেতু নেই; এটার নাম ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই হলেও ঠিক এ ব্রিজটা কিন্তু যুদ্ধবন্দীরা তৈরি করেনি। ব্রিজের ইস্পাতের কাঠামো ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে তুলে এনে কাওয়াই নদীর ওপর বসানো হয়। তবে সিনেমায় কাঠের যে ব্রিজ তৈরি এবং শেষে গেরিলা অ্যামবুশে ধ্বংস করা দেখানো হয়, সেটিও ছিল বর্তমান ব্রিজটির পাশে, অর্থাত্ পাশাপাশি দুটি ব্রিজই প্রায় একই সময় ছিল। কাঠেরটি ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে মিত্র বাহিনীর বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর মাত্র দুই মাস পর আরেক হামলায় এখন চালু সেতুটিরও তিনটি স্প্যান ভেঙে পড়ে। মজার ব্যাপার, দুটি ব্রিজের নির্মাণকাজও শেষ হয়েছিল ঠিক দুই মাসের ব্যবধানে। সেদিন মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান গর্জন তুলে কাঞ্চনাবুরির আকাশে যখন শিকারি বাজের মতো চক্কর দিচ্ছিল, তখন জাপানিরা যুদ্ধবন্দীদের গাদা করে নিয়ে গিয়ে ব্রিজের ওপর লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বিমানের উদ্দেশে হাত নাড়ানোর নির্দেশ দেয়, যাতে মিত্র বাহিনীর বিমান ব্রিজের ওপর বোমা ফেলার আগে দুবার চিন্তা করে। প্লেনগুলো নিচু হয়ে ব্রিজের ওপর উড়ে আসার পরই নিরস্ত্র বন্দীরা বুঝতে পারেন, মৃত্যুর কতখানি মুখোমুখি তাঁরা। স্বপক্ষের এতজন বন্দীকে দেখেও ব্রিজ ধ্বংসের দায়িত্ব বিস্মৃত হয় না মিত্র বাহিনীর পাইলট। প্লেনের পেট উজাড় করে নির্ভুল নিশানায় বোমাগুলো ছেড়ে দিলে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে সেতুর তিনটি স্প্যান, এর সঙ্গে নদীর পানিতে হারিয়ে যায় শত শত বন্দীর মৃতদেহ। তাঁদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল কাওয়াই, আর গলিত মৃতদেহের কারণে পরের কয়েক দিনের জন্য সম্পূর্ণ অপেয় হয়ে গিয়েছিল তার জল। যুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যান তিনটি মেরামত করা হয়েছিল।
জাদুঘরের ভেতর রয়েছে যুদ্ধের সময় জাপানিদের ব্যবহূত জিপ গাড়ি, এর ভেতর জাপানি সেনা অফিসারের মূর্তি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি, মোটরসাইকেল, বোমার খোল, পত্রিকার খবরের কাটিং—এসব। অস্ত্রধারী জাপানি সেনাদের প্রহরায় রেললাইনে কর্মরত হাড়জিরজিরে শরীরের প্রায়-উলঙ্গ যুদ্ধবন্দীদের ভাস্কর্যমূর্তি দেখে তাদের দুরবস্থার কথা কিছুটা আঁচ করা যায়। জাদুঘর ভবনের মাঝখানে খোলা জায়গায় আমাদের মালগাড়ির মতো একটা রেলের বগি, সেটার দরজায় গরাদ লাগানো, ভেতরে কৌপীন পরা এক যুদ্ধবন্দীর মূর্তি। জাদুঘরে জাপানি দখলদারি, অবস্থান ও তাদের অত্যাচার-নিপীড়নের নানা স্মারকচিহ্ন ও নিদর্শন সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। লম্বা বাঁশের ব্যারাকে যুদ্ধবন্দীদের যে মানবেতরভাবে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল; সাজানো আছে তার অনেক মর্মস্পর্শী আলোকচিত্র। একটি দেয়ালের গায়ে সারি সারি সাজানো রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমর-নেতাদের মূর্তি। এক জায়গায় কাচের ঘেরার ভেতর রয়েছে গণকবর থেকে উদ্ধার করা এশীয় শ্রমিকদের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। দোতলার প্রায় পুরো একটা উইং জুড়ে রয়েছে জাপানি সৈন্যদের ব্যবহার করা হাজারো জিনিসপত্র। এগুলোর মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ থেকে শুরু করে মাউথ অর্গান, টাইপরাইটার ও মশারি পর্যন্ত। জাদুঘরটি রকমারি স্মারকে প্রায় ঠাসা, তবে সংরক্ষণব্যবস্থা খুব সুবিধার নয়। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না করলে কালের আবর্তে বহু জিনিস নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সাধারণত জাদুঘরে স্মারক ও নিদর্শনগুলো যেভাবে যত্ন ও সংরক্ষণের মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়, এখানে সে রকম যত্নের বালাই নেই বলে মনে হলো।
আমরা যখন জাদুঘর থেকে বের হয়ে আসি, তখনো সেই বেঞ্চের ওপর ঠাঁয় বসে আছে লেক আর ড্রাইভারটি। এদের পায়ে কী খিলও ধরে না! আমরা ভাবি। লেক আমাদের দেখে উঠে এসে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে, লাঞ্চ? আমাদের সায় পেয়ে দুজন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আমাদের পথ দেখিয়ে যেতে যেতে রেললাইন পেরিয়ে নিয়ে যায় একদম নদীর ওপর ভাসমান রেস্তোরাঁয়। সেখান থেকে সামান্য উজানে কাওয়াই ব্রিজের বিশাল কাঠামো জ্যামিতিক নকশায় নীল আকাশের পটভূমিতে আঁকা। পাশাপাশি তিনটি রেস্তোরাঁ ভাসছে কাওয়াই নদীর শান্ত বহমান স্রোতের ওপর—এর মধ্যে ঠাসা ট্যুরিস্ট। আমাদের রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দিয়ে ওরা দুজন মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে ওদের লাঞ্চ করতে বলব, কিন্তু ওদের আর টিকিটিও দেখা যায় না। থাই খাবার অচেনা নয় বলে খেতে আমাদের তেমন বেগ পেতে হয় না। স্যুপ, থাই ওমলেট, শাক, রাইস—প্রায় সবকিছু মিশিয়ে বাঙালি খাবারের মতো খেতে শুরু করলে পরিবেশনকারী মেয়েগুলো অন্য টেবিলের তদারকি ভুলে গিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাদের খাওয়া দেখে। দেশ থেকে ক্রমাগত কয়েক দিন বাইরে থাকলে দেশি খাবারের মতো কিছু খেতে ইচ্ছে করে বলে আমরা ওদের কৌতূহলী দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে আমাদের মতো করে খেতে থাকি।
খাওয়া শেষ হলে আমরা যখন রেস্তোরাঁর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের স্রোত থেকে চোখ তুলে দূরের সবুজ বনানীর দৃশ্য দেখে পর্যটকসুলভ উচ্ছ্বাসে মগ্ন হই, তখন লেক আর ড্রাইভারটি কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়। আমাদের বাচ্চা ছেলের মতো ট্রেনে চড়ার লোভ দেখিয়ে ওখান থেকে বের করে আনে ওরা। খোলা স্টেশনের প্লাটফরমের পাশে টিকিট কাটার গুমটি দেখিয়ে জানায়, ওখান থেকে ট্রেনে চড়ে কাওয়াই ব্রিজ পেরিয়ে আমরা ওপার থেকে ঘুরে আসতে পারি। টিকিট কাটতে কাটতে চারপাশ খোলা ট্যুরিস্ট ট্রেন প্লাটফরমে এসে যায়। বিকেলের তীর্যক রোদ টয় ট্রেনের ভেতর তেরচা বর্শার মতো ঢুকে পড়লে গুড়গুড় করে চলতে শুরু করে ট্রেন। শিশুপার্কের টয় ট্রেনের মতো রেলগাড়িটা যখন কাওয়াই ব্রিজের ওপর উঠে পড়ে, ট্রেনভর্তি যাত্রীদের সহর্ষ হুল্লোড় কাওয়াই নদীর শান্তজলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন। ট্রেন চলার সময় পদচারীদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য ব্রিজের ওপর কিছুদূর পরপর ঝুল-বারান্দার মতো রেলিং ঘেরা জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে এক বেহালাবাদক ছড় বোলাতে বোলাতে প্রায় ঝুঁকে পড়ে। ট্রেনের শব্দে তার বেহালার সুরের মূর্ছনা ঢেকে যায়। ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেনটি ঢালু রেল সড়কের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে যেতে একটা পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে থামে, তারপর আবার ফিরতি পথে চলতে শুরু করে।
যুদ্ধবন্দী মিত্র বাহিনীর রক্ত আর ঘামে নির্মিত রেল সড়কের ওপর দিয়ে ফিরে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে যায়। নিস্তরঙ্গ কাওয়াই নদীর পানির আয়নায় পড়ন্ত বিকেলের রোদ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ব্রিজের কাছাকাছি স্টেশনে নেমে পড়ার পর সেতুটার দিকে ফিরে তাকাই, ট্যুরিস্টদের এলোমেলো পদচারণে আর মৃদু কোলাহল ছাপিয়ে কানে বাজতে থাকে ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই ছবিতে যুদ্ধবন্দী সৈনিকদের কুচকাওয়াজের তালে তালে শিস দিয়ে বাজানো সুর।
No comments:
Post a Comment